ধর্ম এবং বিজ্ঞান
একটি অনুপযুক্ত মিশ্রণ
হাজার হাজার বছর ধরে বৈজ্ঞানিক সত্যের অনুসন্ধান, আরও গবেষণা করার জন্য দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেছে বলে মনে হয়। আরও উন্নতি করার পথে কিছুই বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু তবুও, দ্যা বুক অফ্ পপুলার সায়েন্স বলে, “সা.শ. তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম শতকে বিজ্ঞান খুব বেশি অগ্রগতি করতে পারেনি।”
এই পরিস্থিতির প্রতি দুটি ঘটনার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। প্রথম শতাব্দীতে, যীশু খ্রীষ্টের মাধ্যমে একটি নতুন ধর্মীয় যুগ শুরু হয়েছিল। আর বেশ কিছু দশক আগে, সা.শ.পূ. ৩১ সালে, রোমান্ সাম্রাজ্য স্থাপিত হওয়ার পর থেকে একটি নতুন রাজনৈতিক যুগ আরম্ভ হয়েছিল।
তাদের পূর্বেকার গ্রীকদের বিপরীতে, রোমান্রা “অনির্দিষ্ট সত্যের অন্বেষণ করার চেয়ে দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলির সমাধান করতে বেশি আগ্রহী ছিল,” পূর্বে উল্লিখিত গবেষণামূলক বইটি জানায়। সুতরাং, যুক্তিপূর্ণভাবে বলতে গেলে, “অবিমিশ্রিত বিজ্ঞানের প্রতি তাদের অবদান খুবই অল্প।”
কিন্তু, তখন পর্যন্ত যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান একত্রিত করা হয়েছিল তা পরবর্তীকালের মানুষের কাছে হস্তান্তর করার জন্য রোমান্রা একটি বড় ভূমিকা নিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম শতাব্দীতে প্লিনী দ্যা এল্ডার ন্যাচেরাল হিস্টরী নামে বৈজ্ঞানিক তথ্যের একটি সংকলন করেছিলেন। যদিও তা নির্ভুল ছিল না, কিন্তু তবুও তাতে নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক তথ্য ছিল যা অন্যথা পরের বংশগুলি পেত না।
ধর্মের ক্ষেত্রে, দ্রুত বৃদ্ধিরত খ্রীষ্ট ধর্ম তখনকার বৈজ্ঞানিক অন্বেষণে জড়িত ছিল না। তারা যে বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়, কিন্তু খ্রীষ্ট নিজে তাঁর অনুগামীদের জীবনে ধর্মীয় সত্য ভালভাবে বুঝতে এবং তা প্রচার করাকে প্রাধান্য দিতে বলেছিলেন।—মথি ৬:৩৩; ২৮:১৯, ২০.
প্রথম শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই, ধর্মভ্রষ্ট খ্রীষ্টানেরা যে ধর্মীয় সত্য তাদের প্রচার করতে বলা হয়েছিল, তা কলুষিত করতে শুরু করেছিল। পরে এর থেকে তারা একটি ধর্মভ্রষ্ট খ্রীষ্টান শাখা সৃষ্টি করেছিল, ঠিক যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। (প্রেরিত ২০:৩০; ২ থিষলনীকীয় ২:৩; ১ তীমথিয় ৪:১) পরবর্তীকালের ঘটনা দেখায় যে ধর্মীয় সত্য পরিত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রতিও উদাসীন মনোভাব দেখাতে শুরু করে—কখনও কখনও এমনকি বিরুদ্ধাচরণও করে।
“খ্রীষ্টীয়” ইউরোপ নেতৃত্ব হারায়
দ্যা ওয়ার্ল্ড বুক এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্যাখ্যা করে যে মধ্য যুগে (পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত), “ইউরোপে, পণ্ডিত ব্যক্তিরা ঈশ্বরতত্ত্বে, অর্থাৎ ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশুনায় বেশি আগ্রহী ছিলেন, প্রকৃতিকে পরীক্ষা করায় নয়।” আর “প্রকৃতির অনুসন্ধানের বদলে, পরিত্রাণের উপর এই মনোযোগ,” কোলিয়ারস্ এন্সাইক্লোপিডিয়া উল্লেখ করে, “বিজ্ঞানের জন্য উদ্দীপক না হয়ে বরং বাধাস্বরূপ হয়েছিল।”
এই রকম বাধা হিসাবে কাজ করার জন্য খ্রীষ্টের শিক্ষা দেওয়া হয়নি। কিন্তু, খ্রীষ্টজগতের মিথ্যা ধর্মীয় চিন্তাধারার গোলকধাঁধা, যার অন্তর্ভুক্ত কল্পিত অমর আত্মার পরিত্রাণের প্রতি অতিরিক্ত জোর দেওয়া, তার মাধ্যমে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অধিকাংশ শিক্ষা ব্যবস্থা গির্জার তত্ত্বাবধানে ছিল এবং প্রধানত মঠগুলিতে তার চর্চা করা হত। এই ধর্মীয় মনোভাব বৈজ্ঞানিক সত্যের অন্বেষণের গতি কমিয়ে দিয়েছিল।
সাধারণ শতাব্দীর শুরু থেকেই ঈশ্বরতত্ত্বের পরে বিজ্ঞান দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল। বলা যেতে পারে, একমাত্র উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হয়েছিল চিকিৎসা-শাস্ত্রের ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ, সা.শ. প্রথম শতকের রোমান্ চিকিৎসক-লেখক, আউলাস্ কেল্সাস্, যাকে “হিপ্পোক্রেটিস্ অফ্ দ্যা রোমান্স্“ বলা হত, তিনি একটি বই লিখেছিলেন এখন যাকে ডাক্তারিবিদ্যায় শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির মধ্যে একটি বলে ধরা হয়। গ্রীক্ চিকিৎসক পেডেনিয়ুস্ ডায়স্করিডিস্, যিনি নিরোর রোমান্ সেনাবাহিনীর একজন শল্যচিকিৎসক ছিলেন, তিনি একটি উল্লেখযোগ্য ডাক্তারি পাঠ্যপুস্তক লিখেছিলেন যেটি বহু শতাব্দী ধরে ব্যবহার করা হয়েছিল। গ্যালেন, দ্বিতীয় শতাব্দীর একজন গ্রীক, পরীক্ষামূলক জীববিজ্ঞানের সৃষ্টি করে তার সময় থেকে মধ্য যুগের শেষ পর্যন্ত চিকিৎসাতত্ত্ব এবং পদ্ধতিকে প্রভাবিত করেছিলেন।
বৈজ্ঞানিক নিষ্ক্রিয়তার যুগ পঞ্চদশ শতাব্দীর পরেও দেখা গিয়েছিল। সত্য, ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিকেরা এই সময়ে কিছু আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলির আগেও অস্তিত্ব ছিল। টাইম্ পত্রিকা উল্লেখ করে: “বিজ্ঞান সম্বন্ধে [চীনদেশের লোকেরা] পৃথিবীতে প্রথম পারদর্শী ছিল। ইউরোপীয়দের বহু আগে, তারা জানত কিভাবে কম্পাস্ ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে কাগজ ও বারুদ তৈরি করতে হয় [এবং] কিভাবে চলমান টাইপের সাহায্যে ছাপানো যায়।”
সুতরাং, “খ্রীষ্টীয়” ইউরোপে সাধারণ বৈজ্ঞানিক চিন্তার অভাবের জন্য, অ-খ্রীষ্টীয় সমাজগুলি নেতৃত্ব নিতে শুরু করে।
বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি
নবম শতাব্দীর শেষে, আরব বৈজ্ঞানিকেরা, বিজ্ঞানের বিষয়ে দ্রুত এগিয়ে চলেছিল। বিশেষত দশম এবং একাদশ শতাব্দীতে—খ্রীষ্টজগৎ যখন নিশ্চেষ্ট ছিল—আরবেরা বৈজ্ঞানিক কীর্তির ক্ষেত্রে স্বর্ণ যুগে পৌঁছেছিল। চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, অঙ্কশাস্ত্রের প্রতি তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান করেছিল। (পৃষ্ঠা ২০তে দেওয়া বাক্স দেখুন।) কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির আরবী ভাষায় সহায়ক প্রফেসর, মায়েন্ জেড. মাডিনা বলেছেন যে “আধুনিক ত্রিকোণমিতি, এমনকি বীজগণিত এবং জ্যামিতিও, বহুলাংশে আরবদের সৃষ্টি।”
এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অধিকাংশই তারা নিজেরা আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু তার কিছুটা গ্রীক্ দর্শনবাদের উপর ভিত্তি করে ছিল এবং আশ্চর্যজনকভাবে, ধর্মের অবদানে যা সম্ভব হয়েছিল।
সাধারণ শতাব্দীর প্রথম দিকে, থ্রীষ্টধর্ম পারস্যদেশে এবং পরে আরব ও ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চম শতাব্দীতে, কন্সটান্টিনোপলের অধিকর্তা, নেস্টোরিয়াস্ একটি মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন যার জন্য প্রাচ্যের গির্জাগুলির মধ্যে বিভেদ দেখা দিয়েছিল। এর ফলে একটি আলাদা দলের সৃষ্টি হয়, নেস্টোরিয়ানস্।
সপ্তম শতাব্দীতে, নতুন ইস্লাম ধর্ম যখন হঠাৎ জগতে উদয় হয়েছিল এবং তাদের বিজয় অভিযান শুরু করেছিল, তখন নেস্টোরিয়ান্রা তাদের জ্ঞান আরব বিজেতাদের দান করেছিল। দ্যা এন্সাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়ান্ অনুযায়ী “গ্রীক্ পাঠ্যসমূহ প্রথমে সিরিয় এবং তারপরে আরবী ভাষায় অনুবাদ করে নেস্টোরিয়ান্রা প্রথম গ্রীক্ দর্শনবাদ ও বিজ্ঞানের প্রসার ঘটায়।” “বাগ্দাদে গ্রীক্ ওষুধের প্রচলন শুরু করাতেও” তারা প্রথম ছিল। নেস্টোরিয়ানদের কাছে শেখা বিষয়গুলি আরব বৈজ্ঞানিকেরা আরও উন্নত করে তোলে। আরব জগতে সিরিয় ভাষার বদলে আরবী ভাষা বৈজ্ঞানিক লেখার জন্য প্রচলিত হয় এবং দেখা যায় যে এই ভাষা বিজ্ঞানসংক্রান্ত লেখার জন্য উপযুক্ত।
কিন্তু জ্ঞান নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরবরা জ্ঞান বিতরণও করেছিল। স্পেনের মধ্যে দিয়ে মূরজাতির লোকেরা যখন ইউরোপে প্রবেশ করেছিল—যেখানে তারা ৭০০ বছর বসবাস করেছিল—তারা একটি সুসভ্য মুস্লিম সংস্কৃতি তাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। আর ১০৯৬ থেকে ১২৭২ সালের মধ্যে তথাকথিত আটটি খ্রীষ্টান ক্রুসেডের সময়ে, পাশ্চাত্ত্য ক্রুসেডযোদ্ধারা যে উন্নত ইস্লাম সভ্যতার সান্নিধ্যে এসেছিল, তারা তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। একজন লেখক যেমনভাবে বলেছেন, তারা “বহু নতুন চিন্তাধারা নিয়ে” ফিরে এসেছিল।
আরবদের অঙ্কশাস্ত্রের সরলীকরণ
ইউরোপের প্রতি আরবদের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল রোমান্দের অক্ষর ব্যবহারের বদলে আরবী সংখ্যার প্রচলন। আসলে, “আরবী সংখ্যা” নামটি ঠিক হবে না। আরও উপযুক্ত উক্তি হয়ত “হিন্দু-আরবী সংখ্যা।” সত্য, নবম শতাব্দীর আরব গণিতবিশারদ আল্-খোয়ারিজ্মি এই পদ্ধতি সম্বন্ধে লিখেছিলেন, কিন্তু তিনি তা ভারতের হিন্দু গণিতজ্ঞদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন, যারা সা.শ.পূ. তৃতীয় শতকে, হাজার বছরেরও আগে সেই পদ্ধতির সৃষ্টি করেছিল।
বিখ্যাত গণিতবিশারদ লিওনার্দো ফিবোনাত্চি (যিনি লিওনার্দো অফ্ পিসা নামেও পরিচিত ছিলেন), ১২০২ সালে লিবার্ আবাকি (বুক্ অফ্ দি আ্যব্যাকাস্) প্রবন্ধে এই পদ্ধতি শুরু করানোর আগে, ইউরোপে তা খুব অল্পই পরিচিত ছিল। এই পদ্ধতির সুবিধা প্রদর্শন করতে গিয়ে, তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন: “নটি ভারতীয় সংখ্যা হল: ৯ ৮ ৭ ৬ ৫ ৪ ৩ ২ ১. এই নটি সংখ্যা এবং ০ চিহ্নের সাহায্যে . . . যে কোন সংখ্যা লেখা যেতে পারে।” প্রথমে ইউরোপীয়রা সাড়া দিতে দেরী করেছিল। কিন্তু মধ্য যুগের শেষের দিকে তারা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল এবং এর সরলতা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে সাহায্য করেছিল।
পূর্বেকার রোমান্ সংখ্যার তুলনায় হিন্দু-আরবী সংখ্যার সরলতা সম্বন্ধে আপনার মনে যদি কোন সন্দেহ থাকে, তাহলে MCMXCIII থেকে LXXIX বিয়োগ করতে চেষ্টা করুন। বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন নাকি? হয়ত ১,৯৯৩ থেকে ৭৯ বাদ দেওয়া আরও সহজ হবে।
ইউরোপে শিক্ষার উৎসাহ আবার জাগিয়ে তোলা
শিক্ষার যে দীপশিখা মুস্লিম জগতে উজ্জ্বলভাবে জ্বলছিল, দ্বাদশ শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে তা নিভে আসতে শুরু করে। কিন্তু ইউরোপে সেই শিখা আবার জাগিয়ে তোলা হয়, যখন পণ্ডিতদের বিভিন্ন দল আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবর্তন করেন। দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, প্যারিস্ এবং অক্সফোর্ডের ইউনিভার্সিটির সৃষ্টি হয়। এরপর কেমব্রিজ্ ইউনিভার্সিটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এবং প্রাগ্ ও হেইডেল্বার্গের ইউনিভার্সিটি শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বৈজ্ঞানিক গবেষণার উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
প্রথমে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ধর্মের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, অধিকাংশ গবেষণা হয় ধর্মকে কেন্দ্র করে অথবা ধর্মীয় ইঙ্গিত নিয়ে শুরু হয়েছিল। কিন্তু একই সঙ্গে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গ্রীক দর্শনবাদ, বিশেষত আ্যরিস্টোটলের শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। দ্যা এন্সাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়ান্ অনুযায়ী, “সমস্ত মধ্যযুগ ধরে . . . কোন তথ্যের অর্থপ্রকাশ এবং কোন সমস্যার সমাধান করার সময়ে ব্যাখ্যা করা, শ্রেণীবিভাগ করা এবং যুক্তি দেখানো সম্বন্ধে আ্যরিস্টোটলের মতবাদের উপরে শিক্ষা-পদ্ধতি নির্ভরশীল ছিল।”
ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন পণ্ডিত, যিনি আ্যরিস্টোটলের শিক্ষার সঙ্গে খ্রীষ্টীয় ঈশ্বরতন্ত্র যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহী ছিলেন, তিনি হলেন থমাস্ আ্যকুইনাস্, পরে যাকে বলা হত “খ্রীষ্টান আ্যরিস্টোটল।” কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে আ্যরিস্টোটলের সঙ্গে তার মতের মিল ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীর যে অনন্তকাল থেকে অস্তিত্ব ছিল এই মতবাদ আ্যকুইনাস্ গ্রহণ করেননি, এই ক্ষেত্রে তিনি শাস্ত্রের সঙ্গে একমত ছিলেন যে পৃথিবীকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। দ্যা বুক অফ্ পপুলার সায়েন্স বলে “আমাদের ব্রহ্মাণ্ড যে সুনিয়ন্ত্রিত এবং যুক্তির মাধ্যমে যে তা বোঝা যায়, এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে” বজায় রেখে, তিনি “আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।”
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে, আ্যরিস্টোটল, টলেমি এবং গ্যালেনের শিক্ষাকে, এমনকি গির্জাতেও শাস্ত্রীয় সত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হত। পূর্বে উল্লিখিত গবেষণামূলক বইটি ব্যাখ্যা করে: “মধ্য যুগে, যখন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির প্রতি আগ্রহ সবচেয়ে বেশি কমে এসেছিল, তখন আ্যরিস্টোটলের বাক্যকে আইন হিসাবে মেনে নেওয়া হত। বহু ‘বৈজ্ঞানিক’ ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে মধ্য যুগের শিক্ষকেরা ইপ্সে দিক্শিত্ (‘তিনি নিজেই বলেছেন’) এই যুক্তি ব্যবহার করতেন। এই পরিস্থিতিতে, বিশেষত পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিদ্যায় আ্যরিস্টোটলের কিছু ভ্রান্তি, বহু শতাব্দী ধরে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে আটকে রেখেছিল।”
অন্ধের মত পূর্বেকার মতবাদ মেনে চলাকে যিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তিনি হলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন অক্সফোর্ড যাজক, রজার বেকন্। বেকন্, যাকে “মধ্য যুগের বিজ্ঞানে সর্বমহান পুরুষ” বলা হয়, তিনি একাই বলেছিলেন যে বৈজ্ঞানিক সত্য জানবার একমাত্র উপায় হল পরীক্ষা করা। বলা হয় যে ১২৬৯ সালের মধ্যে, স্পষ্টতই অন্যেরা এইসব বিষয় কল্পনা করার বহু শতাব্দী আগে, তিনি মোটরগাড়ি, উড়োজাহাজ এবং যন্ত্রচালিত জাহাজ সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
তবুও, ভবিষ্যতের ঘটনা সম্বন্ধে অনুমান করা এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও, বাস্তব সম্বন্ধে বেকনের জ্ঞান সীমিত ছিল। তিনি জ্যোতিষশাস্ত্র, যাদুবিদ্যা এবং অপরসায়নবিদ্যায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। এখান থেকে বোঝা যায় যে বিজ্ঞান বাস্তবিকই সত্যের জন্য ক্রমাগত এক অন্বেষণ, প্রায়ই তা শুধরানোর প্রয়োজন হয়।
যদিও চতুর্দশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ততটা দেখা যায়নি, কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দী শেষ হয়ে আসার সময়ে বোঝা যায় যে বৈজ্ঞানিক সত্যের জন্য মানুষের অন্বেষণ শেষ হতে তখনও বহু বাকি। বাস্তবপক্ষে, পরবর্তী ৫০০ বছরে যা হতে চলেছে তার তুলনায় আগেকার আবিষ্কারগুলিকে সম্পূর্ণরূপে গুরুত্বহীন বলে মনে হবে। পৃথিবী একটি বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আর যে কোন বিপ্লবের মতই, এখানেও বহু নায়ক, দুর্বৃত্ত এবং তারচেয়েও উল্লেখযোগ্য বিষয়, এই বিপ্লবের শিকার রয়েছে। আমাদের পরবর্তী সংখ্যায় “বিজ্ঞান—সত্যের জন্য মানুষের ক্রমাগত অন্বেষণ”-এর চতুর্থ ভাগে আরও জানতে পারবেন। (g93 5/8)
বহু শতাব্দী ধরে, আ্যরিস্টোটল (উপরে) এবং প্লেটো (নিচে) প্রবলভাবে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিলেন
আরবী বিজ্ঞানের
স্বর্ণযুগ
আল্-খোয়ারিজ্মি (অষ্টম-নবম শতাব্দী), ইরাকী গণিতবিশারদ এবং জ্যোতির্বিদ; আল্·জব্রা থেকে “আ্যল্জেব্রা,” শব্দের প্রবর্তক হিসাবে বিখ্যাত, যার আরবী অর্থ “ভাঙা টুক্রোর একত্রীকরণ।”
আবু মুসা জাবির ইবেন্ হায়ান্, (অষ্টম-নবম শতাব্দী), অপরসায়নবিদ; একে আরবী রসায়নবিদ্যার পিতা বলা হয়।
আল্-বাতেনাই (নবম-দশম শতাব্দী), জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিশারদ; টলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গণনা আরও নির্ভুল করেছিলেন যার ফলে বছর অথবা ঋতুগুলির দৈর্ঘ্য আরও সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছিল।
আর্-রাজি (রাজিজ্) (নবম-দশম শতাব্দী), পারস্য দেশের চিকিৎসকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন; বসন্ত এবং হামের মধ্যে পার্থক্য ইনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন এবং সমস্ত পদার্থকে হয় প্রাণী, নয়ত উদ্ভিদ অথবা অজৈব পদার্থ হিসাবে শ্রেণীবিভাগ করেছিলেন।
আবু আলি আল্-হাসান্ ইবেন আল্-হাইথাম্, বস্রা শহরের (আল্হাজেন্) (দশম-একাদশ শতাব্দী), গণিতবিশারদ এবং পদার্থবিজ্ঞানী; আলোকবিজ্ঞানের প্রতি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, বিশেষত প্রতিসরণ, প্রতিফলন, দূরবীক্ষণ দৃষ্টি এবং বায়ুমণ্ডল-জনিত প্রতিসরণের ক্ষেত্রে; কোন বস্তু থেকে চোখে আলো পড়ার জন্য যে দৃষ্টি সম্ভব হয়, প্রথম তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
ওমার খায়াম্ (একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী), পারস্যদেশের বিখ্যাত গণিতবিশারদ, পদার্থবৈজ্ঞানিক, জ্যোতির্বিদ, চিকিৎসক এবং দার্শনিক; পাশ্চাত্যজগতে প্রধানত তার কাব্যরচনার জন্য পরিচিত।