অত্যাচারী পিতামাতা
আসলে মানসিক চাপ দাতা
“পরিবার গণ্ডির বাইরের ধারণা [ছেলেমেয়েদের] এতই কম যে, তারা গৃহেতে নিজেদের ও অপরের সম্বন্ধে যা শেখে তা তাদের মনে সার্বিক সত্য বলে গেঁথে যায়।”
—ডা. সুজেন্ ফরওয়ার্ড।
এক কুমোর কিছুটা মাটির দলাতে উপযুক্ত পরিমাণে জল মিশিয়ে একটি সুন্দর পাত্র তৈরি করতে পারে। অনুরূপে, পিতামাতা সন্তানের মনে নিজেদের এবং জগৎ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করেন। ভালবাসা, নির্দেশ ও শিক্ষা দ্বারা সন্তান এক দৃঢ় প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হয়।
কিন্তু, প্রায়ই শিশুর মনে ও হৃদয়ে অত্যাচারী পিতামাতা এক ছাপ ফেলে। মানসিক, শারীরিক এবং যৌন অত্যাচার এক বিকৃত চিন্তাধারা সৃষ্টি করে যা মনে গভীরভাবে গেঁথে যায় এবং যার পুনর্গঠন করা কষ্টকর।
মানসিক অত্যাচার
কিলের চেয়ে কথার ঘা বেশি। “আমি না জন্মালেই ভাল হত, আমাকে তা বলতে [আমার মা] একদিনও বাদ দিয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না,” বলে জেসন্। কারেন্ স্মরণ করে: “আমাকে সব সময় বলা হত আমি ভাল নই বা আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না।”
তাদের বিরুদ্ধে যা বলা হয় তা সাধারণত ছেলেমেয়েরা বিশ্বাস করে। যদি একটি ছেলেকে সমানে বোকা বলা হয় তাহলে সে নিজেকে অবশেষে বোকাই মনে করবে। একটি মেয়েকে কোন কাজের নয় বললে, সে হয়ত তাই মনে করবে। ছেলেমেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমিত হয় এবং বেশির ভাগ সময়েই তারা কোন্টি সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত বা মিথ্যা, কোন্টি সঠিক তা নির্ণয় করতে পারে না।
শারীরিক অত্যাচার
জো তার শারীরিকরূপে অত্যাচারী পিতার কথা স্মরণ করে: “তিনি আমাকে ঘুসি মেরেই যেতেন যতক্ষণ না তিনি আমাকে দেওয়ালের গায়ে সাঁটিয়ে দিতেন। তিনি আমাকে এত জোরে জোরে মারতেন যে আমি নিস্তেজ হয়ে পড়তাম . . . সব চেয়ে ভয়ের বিষয় এই যে কী তাকে এত রাগান্বিত করত তার কারণ আমি কখনও জানতে পারিনি!”
জেক্-কে তার পিতা নিয়মিত মারধোর করতেন। একবার সেইরকম মারার সময়, জেক্ যখন মাত্র ছয় বছর বয়সের ছিল তখন তার হাত ভেঙ্গে যায়। “আমি কাঁদছি বলে আমার বাবা মা ও তিনজন ছোট বোনকে জানতে দিতাম না,” জেক্ স্মরণ করে। “সেটি ছিল আমার কাছে একমাত্র গর্বের বিষয়।”
আঘাত পেয়েও ভেঙ্গে পড়ে না (Strong at the broken Places) বইটি বলে ছেলেবেলার শারীরিক অত্যাচারকে তুলনা করা যেতে পারে “প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ বা প্রতি মাসে গাড়ি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার” সাথে। সেই প্রকৃতির অত্যাচার শিশুকে শেখায় জগৎ হল বিপজ্জনক স্থান এবং কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। তাছাড়া, মারামারি বেশির ভাগ সময়েই মারামারির সৃষ্টি করে। “যদি ছেলেমেয়েদের অত্যাচারীর কাছ থেকে রক্ষা করা না হয়,” টাইম পত্রিকা সাবধান করে দেয়, “তাহলে একদিন জনগণকে সেই ছেলেমেয়ের কাছ থেকে রক্ষা করতে হবে।”
যৌন অত্যাচার
এক গণনানুসারে, ৩টি মেয়ের মধ্যে ১টি মেয়েকে এবং ৭টি ছেলের মধ্যে ১টি ছেলেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে যৌন অভিজ্ঞতা লাভ করতে জোর করা হয়। এই ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেশির ভাগ চুপ করে সহ্য করে যায়। “যুদ্ধ করতে গিয়ে যেমন কোন সৈনিক হারিয়ে যায়, তেমন এই অত্যাচারিত ছেলেমেয়েরা ভয় ও অপরাধবোধের জঙ্গলে বছরের পর বছর হারিয়ে থাকে,” বলে সমস্যার মধ্যে শিশু বইটি।
“আমাকে অত্যাচার করার জন্য আমি বাবাকে কত ঘৃণা করি আর তাকে ঘৃণা করার জন্য আমি নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী বোধ করি, আমি খুব লজ্জাবোধ করি কারণ ছেলেমেয়ের বাবামাকে ভালবাসার কথা কিন্তু আমি কখনও তাদের ভালবাসিনি,” বলে লুইজ্। শিশুর প্রধান রক্ষক যখন অপরাধী হয় তখন এইরূপ বিভ্রান্তিজনক অনুভূতি বোধসাপেক্ষ। বেভারলী এঙ্গেল্, নিরপরাধীর অধিকার-এ (The Right to Innocence) জিজ্ঞাসা করেন: “আমাদের নিজেদের পিতামাতা, যাদের আমাদের প্রতি ভালাবাসা দেখানোর ও যত্ন নেওয়ার কথা, তারা আমাদের প্রতি এইরূপ ব্যবহার করতে পারে তা আমরা কী করে স্বীকার করে নিতে পারি?”
যৌন অত্যাচার জীবনের প্রতি শিশুর সম্পূর্ণ দৃষ্টিকেই বিকৃত করে দিতে পারে। “পরিণত বয়সের প্রত্যেক জন যাদের ছোটবেলায় যৌন উৎপীড়ন করা হয়, সেই পুরুষ বা স্ত্রী তাদের ছেলেবেলার সেই মনে ছেয়ে থাকা অসম্ভব অযোগ্যতা, অপদার্থতা এবং তারা যে একেবারে অকর্মণ্য এই অনুভূতিগুলি মনে রাখে,” লেখেন ডা. সুজেন্ ফরওয়ার্ড।
ভুলতে পারা যায় না
“শুধুমাত্র শিশুর দেহকেই যে অত্যাচার বা অবহেলা করা হয়েছে তা নয়,” লেখেন গবেষিকা লিণ্ডা টি. স্যানফার্ড। “সমস্যা জর্জরিত পরিবার শিশুর মনকে অত্যাচার করে।” মানসিক, শারীরিক অথবা যৌন সংক্রান্ত বিষয়ে যখন শিশু অত্যাচারিত হয়, সেই ছেলে বা মেয়ে মনে মনে হয়ত এরূপ মনোভাব পোষণ করতে পারে, তাকে কেউ ভালবাসে না এবং সে অযোগ্য।
জেসন, যার সম্বন্ধে পূর্বে উল্লেখ করা হয়, সে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবেও নিজেকে এত নিচু মনে করত যে তাকে আত্মহত্যা-প্রবণ বলে বলা হয়। নিজেকে অহেতুক জীবন-হানিকর পরিস্থিতিতে নিয়ে গিয়ে, সে নিজের জীবনকে তার মা তাকে যেমন শিখিয়েছিলেন সেইরূপ মনে করত: ‘তোমার জন্মানোই উচিত ছিল না।’
ছোটবেলায় শারীরিকরূপে অত্যাচারিত হওয়ার বিষয় মনে করে, জো বলে: “আপনি অন্য গৃহে বাস করলে বা বিবাহিত হলেও সেই সব কথা মন থেকে সরে যায় না। আমি সব সময় কোন কিছুর জন্য ভীত থাকি আর সেই রকম মনে করার জন্য আমি নিজেকে ঘৃণা করি।” শারীরিকরূপে অত্যাচারিত গৃহের উত্তেজনার ফলে বহু ছেলেমেয়ে দুর্ব্যবহারের আশা নিয়ে বড় হয় যা হল কঠোর প্রতিরোধমূলক ব্যবহার যেটি তাদের রক্ষা করার বদলে বন্দি করে।
কনির ক্ষেত্রে, অজাচার তার নিজের সম্বন্ধে এক অনিশ্চিত ধারণার সৃষ্টি করে যা তার মনে পরিণত বয়সেও গভীর ছাপ রাখে: “আমি বেশির ভাগ সময় চিন্তা করি যে লোকে আমার ভিতরটা দেখে বুঝতে পারবে যে আমি কত ঘৃণাস্পদ।”
যে কোন প্রকৃতির অত্যাচারই এক বিষময় শিক্ষা প্রদান করে যা পরিণত বয়স্ক হওয়া পর্যন্তও মনের মধ্যে গভীরভাবে গেঁথে যায়। সত্য, যা আমরা অভিজ্ঞতা করি তা ভুলে যাওয়াও যায়। ছেলেবেলায় অত্যাচারের প্রভাব থেকে মুক্ত অসংখ্য ব্যক্তিরা এই বাস্তবটির সত্যতা প্রতিপাদন করে। কিন্তু যদি পিতামাতারা উপলব্ধি করতেন যে সন্তানের জন্মের পর থেকেই, নিজেদের এবং জগতের সম্পর্কে তাদের ধারণাটি তারাই তাদের মনে গেঁথে দিচ্ছেন তাহলে কতই না ভাল হত। সন্তানের শারীরিক ও মানসিক মঙ্গল অনেকটা পিতামাতার উপরেই নির্ভর করে।
কিলের চেয়ে
কথার ঘা বেশি