প্রজাপতির জীবনের একটি দিন
আপনার দৈনন্দিন রোজনামচা যদি কঠিন ও কষ্টকর হয়ে থাকে, তাহলে কঠোর পরিশ্রমী প্রজাপতির কথা একটু চিন্তা করুন। প্রথমে আপনি হয়ত মনে করবেন যে প্রজাপতির কাজের তালিকাটিকে দেখে মনে হয় সে আরামে ছুটি কাটাচ্ছে। ফুলে ফুলে নেচে বেরিয়ে, এখানে সেখানে একটু মধু খেয়ে, যখন ইচ্ছা রোদ পোহিয়ে, প্রজাপতিকে মনে হয় এক নিশ্চিন্ত জীবনধারার উপযুক্ত উদাহরণ।
কিন্তু দেখে যা মনে হয় পোকা-মাকড়ের জগতে তা সব সময় হয় না। প্রজাপতিরা হল ব্যস্ত কীট, যারা সময় অযথা নষ্ট না করে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। একটি সাধারণ কাজের দিনে আসুন আমরা একটি প্রজাপতির সাথে যোগ দিই।
সূর্যালোকে প্রাতরাশ
আপনি কি ঘুম থেকে ওঠার সময় আলস্য বোধ করেন? প্রজাপতিদের মধ্যে ভোরের অবসাদ যেন মহামারীর মত। কোন কোন সকালবেলা তারা একেবারেই নড়তে চড়তে পারে না—আক্ষরিকরূপে। তাদের সমস্যা হল দেহের তাপমাত্রা, তা পরিবেশ অনুসারে ওঠা-নামা করে। রাতের বেলায় ঠাণ্ডায় সারারাত পাতার উপর বসে কাটাবার পর তাদের রক্ত এতই শীতল হয়ে পড়ে যে ওড়া তো দূরের কথা তারা আর নড়তেই পারে না। তাই তাদের সূর্যের জন্য অপেক্ষা করতেই হয়।
সূর্য উঠলে প্রজাপতি তার ডানা মেলে, উষ্ণ রশ্মির দিকে সেগুলিকে তুলে ধরে। মেলা ডানাগুলি ক্ষুদ্র সৌর ব্যাটারির মত কাজ করে, প্রয়োজনীয় তাপ তা শীঘ্রই গ্রহণ করে, আর প্রজাপতি উড়ে চলে যায়। কিন্তু আকাশ যদি মেঘলা হয় তাহলে? যে সব অঞ্চলে তাপমাত্রা শীতল হয় সেখানে প্রজাপতিকে—কোন এক সুবিধাজনক পাতায় বা ফুলে নিশ্চল হয়ে থাকতে হয়—সূর্য না ওঠা পর্যন্ত। এটি আলস্যতা নয়, কিন্তু তা অত্যন্ত প্রয়োজন।
যদি দিনটি খুব গরম না হয় তাহলে প্রজাপতি মাঝে মাঝে থামে আরও সূর্যালোকের সেই চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। যেমন একটি গাড়িকে পেট্রল পাম্পে গিয়ে তেল ভরতে হয় ঠিক সেই রকম তার সৌর শক্তি ভরার প্রয়োজন। ক্রান্তিয় অঞ্চলে প্রজাপতিকে শুধুমাত্র সকালে বা এক পশলা বৃষ্টির পর রোদ পোহাতে হয়। সাধারণভাবে বলতে গেলে, আবহাওয়া যত ঠাণ্ডা হয় ততই সে বেশি রোদ পোহায়। একবার শক্তি পেয়ে গেলে সে তার সমস্ত প্রয়োজনীয় কাজগুলি করতে নিমগ্ন হয়।
‘প্রথম সুগন্ধে প্রেম’
সবচেয়ে জরুরী কাজ হল একটি সাথীকে খোঁজা। মাত্র কয়েক সপ্তাহের আয়ু থাকার জন্য তাদের সময় নষ্ট করলে চলবে না। আর প্রজাপতির জগতে সাথী খুঁজে পাওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়—এর জন্য প্রয়োজন বীরসুলভ ধৈর্য ও অবিরাম প্রচেষ্টা।
প্রজাপতিদের মধ্যে “প্রথম পলকে প্রেম” অপরিচিত। তারা শুধুমাত্র কাছের বস্তুগুলি দেখতে পায়, আর প্রায়ই তারা নিজেদের জাতি বলে অন্য প্রজাতিকে ভুল করে। এর জন্য প্রায়ই অযথা ধাওয়া করা চলে এবং পরে যখন আবেদক প্রজাপতি বুঝতে পারে যে তার চোখ তাকে ঠকিয়েছে তখন তার ধাওয়া করা সেখানেই শেষ হয়ে যায়।
জীবন আরও দুর্বিসহ করতে, স্ত্রী প্রজাপতি সাধারণত সাড়া দেয় না। অত্যুৎসাহী পুরুষ প্রচণ্ড গতিতে হাওয়ায় নেচে নেচে তার চারপাশে ক্রমাগত ঘুরে বেড়ায়, এই আশায় যে সে হয়ত অবশেষে নরম হবে। কিন্তু প্রজাপতির এই আকর্ষণীয় নাচ সাধারণত হঠাৎ থেমে যায় যখন দুর্ভাগা পুরুষকে আবার সাথী খোঁজার জন্য ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী প্রজাপতি উড়ে চলে যায়।
আশ্চর্যের বিষয়, স্ত্রী প্রজাপতি পুরুষ সঙ্গীর রঙের বাহারের প্রতি অতটা আকর্ষিত নয়। যদিও ডারউইন আনন্দসহকারে অনুমান করেন যে প্রজাপতির আকর্ষণীয় রঙ ‘বিবর্তনবাদের কিছুটা সহায়তা’ করে তবে তার কোন প্রমাণ নেই। একটি পরীক্ষায় অ্যানারটিয়া অ্যামাথিয়া নামক উত্তর আমেরিকার প্রজাতির স্ত্রী প্রজাপতিরা, পুরুষ প্রজাপতিদের সাথে আনন্দে মিলিত হয় যার উজ্জ্বল লাল ও কাল পাখাকে সম্পূর্ণ কালো রঙ করা হয়। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি হল পুরুষ প্রজাপতির ওড়ার ভঙ্গি, তার অবিরাম প্রচেষ্টা আর এছাড়া অপূর্ব এক “প্রেম-চূর্ণ।”
প্রেম-চূর্ণতে থাকে ফারমোন যা হল পুরুষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু। এটি হল নেশাকর এক সুগন্ধ, যা তার প্রজাতির স্ত্রীদের প্রভাবিত করার জন্যই প্রস্তুত। মেলামেশার সময় পুরুষ প্রজাপতি এই “তীব্র-সুগন্ধ” স্ত্রীর গায়ে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। এই প্রেম-চূর্ণ সফলতার কোন নিশ্চয়তা না দিলেও, ইচ্ছুক স্ত্রী প্রজাপতি পাওয়া গেলে তা খুব আশ্চর্যভাবে কাজে লাগে।
মধুর স্বাদ
সাথীর খোঁজে যে শক্তি ব্যয় হয়েছে তা আবার সঞ্চয় করার প্রয়োজন হয়। তাই প্রজাপতিরা মধু ভালবাসে। ফুলেরা আকর্ষণীয় বর্ণ ও আকারের মাধ্যমে অতি-শক্তিসম্পন্ন এই খাদ্যের বিজ্ঞাপন দেয়। একবার ফুলে বসলে প্রজাপতি তার নলের মত শুঁড়টি ফুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দক্ষতার সাথে মধু খায়।
মধু খাওয়ার সময় প্রজাপতির রোঁয়াওয়ালা দেহতে পরাগ লেগে যায় ফলে সে আর একটি ফুলে বসার সময় পরাগ সঙ্গে করে নিয়ে যায়। সাধারণ এক কাজের দিনে শত শত ফুলের পরাগ মিলন ঘটে। কিন্তু ক্রান্তীয় অঞ্চলে ফুল খুব বেশি দেখা যায় না। তাহলে ক্রান্তীয় প্রজাপতিরা সাধারণত কী খায়?
ক্রান্তীয় প্রজাপতিদের পচা ফল দিয়ে গুরুভোজ করা ছাড়া আর কিছুই ভাল লাগে না। অতি পেকে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া ফলগুলি তাদের প্রচুর শর্করাজাতীয় শক্তি যোগায়।
প্রজাপতিরা লবণও ভালবাসে। ভিজে মাটি থেকে নোনতা আর্দ্রতাকে বা তাকে দেখে মুগ্ধ মানবের হাত থেকে মাঝে মাঝে ঘামকে শুষে নিতে প্রায়ই তাদের দেখা যায়। সাহসী ফ্লেমবৌ প্রজাপতিকে কেম্যান জাতীয় কুমীরের চোখের জলকে শুষে নিতে দেখা গেছে।
সাথী খোঁজার ব্যস্ততার সময়ে, পরাগমিলনের এবং ভালভাবে খাদ্য গ্রহণের সময়ে আমাদের পাখাওয়ালা বন্ধুকে শত্রুর প্রতিও চোখ রাখতে হয়। যদিও তাকে দেখলে অসহায় বলে মনে হয়, কিন্তু ধরা না পড়ার জন্য তার বেশ কয়েকটি কৌশল জানা আছে।
বিপদ থেকে পালানো
ঘাসের উপর এলোমেলোভাবে উড়ে বেড়ানো উজ্জ্বল প্রজাপতি, হয়ত পোকা-মাকড় খাওয়া যে কোন পাখির লোভনীয় এক গ্রাস খাদ্য হতে পারে। কিন্তু প্রজাপতির এলোমেলোভাবে, ওঠানামা করে ওড়া, পাখির পক্ষে শিকার ধরার কাজকে খুব কষ্টকর করে তোলে। কিছু চেষ্টা করে বেশির ভাগ পাখি হাল ছেড়ে দেয়। এমনকি পাখি প্রজাপতিকে ধরলেও প্রজাপতি তার ঠোঁটে পাখার কিছুটা অংশ ছেড়ে এসে পালিয়ে বাঁচে।
দৃষ্টি ক্ষমতাও আর একটি সুরক্ষা। যদিও প্রজাপতিরা কাছের জিনিস দেখতে পায় তবুও তাদের যৌগিক চোখ নড়া-চড়া বুঝতে অত্যন্ত পটু। তারা বিপদের একটু ইঙ্গিত পেলেই পালিয়ে যায়, যেমন যারা প্রজাপতির ছবি নিতে চেষ্টা করেছেন তারা বিষয়টি ভাল করে জানেন।
কিছু প্রজাপতি যারা ধীরে ধীরে ওড়ে তাদের নিরাপত্তার আরেকটি অস্ত্র আছে—তাদের বিশ্রী স্বাদ। তারা যখন শুঁয়োপোকা থাকে তখন বিষাক্ত গাছপালা খাওয়ার জন্য তা হয়ে থাকে। যদি পাখি সেই প্রকৃতির প্রজাপতিকে একবার কামড়ায় তাহলে দ্বিতীয়বার সে ধরার ইচ্ছা করবে না। প্রায়ই এই বিশ্রী স্বাদের প্রজাপতিরা—যেমন মোনার্ক—খুব উজ্জ্বল বর্ণের হয়, দৃশ্য সাবধানবাণী পাখিকে আপাতরূপে দূরে থাকতে স্মরণ করিয়ে দেয়।
যাত্রার শেষ
দ্যা ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোপিডিয়া বলে যে বেশির ভাগ প্রজাপতি কিছু সপ্তাহের বেশি বেঁচে থাকে না, কিন্তু কিছু প্রজাতি ১৮ মাস অবধি বেঁচে থাকে। কিছু প্রজাপতি শীতকালের সময় বা ক্রান্তীয় অঞ্চলের দীর্ঘ শুষ্ক মরশুমে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে।
তাদের স্বল্পায়ু হলেও, প্রজাপতি আশ্চর্যজনক কাজগুলি করে থাকে। গত শতাব্দীতে বহু সংখ্যক মোনার্ক প্রজাপতি আফ্রিকার উপকুলের পাশে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে বসবাসের জন্য অতলান্তিক মহাসাগর পার হয়। আর একটি মহান পর্যটক হল পেইনটেড লেডি, যারা উত্তর আফ্রিকা থেকে উত্তর ইউরোপে গ্রীষ্মকালে নিয়মিত যাত্রা করে।
তাদের জীবনের স্বল্পায়ুকালে, অক্লান্ত প্রজাপতি ফুল, গুল্ম ও ফল গাছের পরাগমিলন করে এক মুখ্য কাজ করে থাকে। এছাড়াও, তাদের অস্তিত্ব গ্রামাঞ্চলে শোভা ও খুশির ছোঁয়া দেয়। প্রজাপতি ছাড়া বসন্তকাল, বসন্তকাল বলে মনেই হবে না। (g93 10/8)
ভোরে রোদ পোহাচ্ছে
ফুল থেকে মধু খাচ্ছে
মাটি থেকে আর্দ্রতা শুষে নিচ্ছে