বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি
আমাদের কি প্রকৃতই যাজকদের প্রয়োজন আছে?
জন পল্ দ্বিতীয় ১৯৯২ সালে পাদ্রিদের প্রতি তার বাৎসরিক চিঠিতে “পবিত্র বৃহস্পতিবার” দিনে বলেন, “যাজকত্বের বরদানের জন্য ধন্যবাদ দিন।” কেবলমাত্র ক্যাথ্লিকেরাই নয়, কিন্তু অন্যেরাও তাদের নিজেদের পাপের জন্য অত্যন্তই সচেতন হয়েছে। তারা ঈশ্বরের নিকট গ্রহণযোগ্য এমন এক ব্যক্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে করে, যে তাদের ঈশ্বরের ইচ্ছা সম্বন্ধে বলতে, তাঁর নিকট বলি উৎসর্গ করতে এবং ঈশ্বর ও তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারে। এই ধরণের একজনকে বলা হয় যাজক। ঈশ্বরের ক্ষমা পাওয়ার জন্য সত্যিই কি আমাদের একজন যাজকের প্রয়োজন?
যাজক ও বলিদান সম্পর্কীয় ধারণাটি মানুষের কাছ থেকে আরম্ভ হয়নি কিন্তু এটি ঈশ্বরের কাছ থেকেই হয়েছিল। যদি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোন পাপ না থাকত, তাহলে যাজকদের কোন প্রয়োজনই থাকত না। এদনে, সিদ্ধ মানুষ আদমের কোন যাজকের প্রয়োজন ছিল না। তাকে নিষ্পাপরূপে সৃষ্টি করা হয়েছিল।—আদিপুস্তক ২:৭, ৮; উপদেশক ৭:২৯.
প্রথম যাজক কারা ছিল?
আদমের স্বেচ্ছাকৃত পাপের জন্য উত্তরাধিকারসূত্রে আজ আমরা সকলেই পাপী এবং আমরা তার বংশধর। (রোমীয় ৩:২৩) প্রথম মানুষ, আদমের পুত্র হেবল এটি উপলব্ধি করেছিল। বাইবেল তার সম্বন্ধে বলে: “বিশ্বাসে হেবল ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে . . . যজ্ঞ উৎসর্গ করিলেন।” (ইব্রীয় ১১:৪) যদিও হেবল এবং অন্যান্য প্রাচীন বিশ্বাসী ব্যক্তিদের—যেমন নোহ, অব্রাহাম ও ইয়োবকে—যাজক বলা হত না, তারা নিজেদের অথবা পরিবারের জন্য যজ্ঞ উৎসর্গ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, বাইবেল ইয়োব ও তার পুত্রদের সম্বন্ধে বলে: “[ইয়োব] তাহাদের সকলের সংখ্যানুসারে হোম করিতেন; কারণ ইয়োব বলিতেন, কি জানি, আমার পুত্ত্রগণ পাপ করিয়াছে।” (ইয়োব ১:৫) কিন্তু, কিভাবে, প্রায় সকল সংস্কৃতিতেই যাজক ও বলিদান একটি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠে?
প্রাচীন কূলপতি নোহের চতুষ্পার্শ্বের ঘটনাবলীর বিষয় বিবেচনা করুন। মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র নোহ ও তার পরিবারই জগদ্ব্যাপী প্লাবন থেকে রক্ষা পায়। তারা জলে ধোয়া পরিষ্কার পৃথিবীতে পদার্পণ করার পরই, নোহ একটি বেদী তৈরি করে এবং যিহোবার দয়া ও সুরক্ষার হস্তের প্রতি উপলব্ধি দেখিয়ে বলিদান উৎসর্গ করেন। যেহেতু সমস্ত জাতি নোহের বংশধর, তাই কোন সন্দেহ নেই যে তারা তারই আদর্শ অনুসরণ করে এবং কালক্রমে মধ্যস্থ ও পাপের বলি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রথার সৃষ্টি করে।—আদিপুস্তক ১০:৩২.
একটি শতাব্দী বিগত হওয়ার কিছু পরে, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বাবিল শহরে এক বিদ্রোহ চাড়া দিয়ে ওঠে। ঈশ্বর লোকেদের মধ্যে ভাষার ভেদ জন্মান ও তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। (আদিপুস্তক ১১:১-৯) এই সময়ে, কিছু যাজকেরা বিকৃত ও নিচু মানের বিশ্বাসকে উৎসাহ দিতে লাগল যার ফলে যে সকল দেশে তারা যেতে আরম্ভ করল সেখানে অপ্রীতিকর ধর্মীয় আচারগুলির সৃষ্টি হল। তৎসত্ত্বেও ঈশ্বর, মহা যাজক, অধীনস্থ যাজকবর্গ ও তাঁর গ্রাহ্য বলিদান সহ প্রকৃত যাজকত্ব সম্বন্ধে তাঁর উপাসকদের শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন।
ঈশ্বর কেন যাজকদের নিযুক্ত করেন
সময়ক্রমে যিহোবা ইস্রায়েল জাতিকে যাজকদের দেন যারা দুই প্রকৃতির মৌলিক কাজ সম্পাদন করত। প্রথমত, বিচারক ও ঈশ্বরের আইনের নির্দেশক হিসাবে তারা মানুষের সামনে ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করত। (দ্বিতীয় বিবরণ ১৭:৮, ৯; মালাখি ২:৭) দ্বিতীয়ত, তারা লোকেদের পক্ষে ঈশ্বরের নিকট বলিদান অর্পণ করে ঈশ্বরের সামনে লোকেদের প্রতিনিধিত্ব করত। ইব্রীয় খ্রীষ্টানদের প্রতি পৌলের পত্র ব্যাখ্যা করে: “বস্তুতঃ প্রত্যেক মহাযাজক মনুষ্যদের মধ্য হইতে গৃহীত হইয়া মনুষ্যদের পক্ষে ঈশ্বরের উদ্দেশ কার্য্যে নিযুক্ত হন, যেন তিনি পাপার্থক উপহার ও বলি উৎসর্গ করেন। . . . কেহ আপনার জন্য সেই সমাদর লয় না, কিন্তু ঈশ্বরকর্ত্তৃক আহূত হইয়াই তাহা পায়।”—ইব্রীয় ৫:১, ৪.
পৌল আরও ব্যাখ্যা করে বলেন যে ইস্রায়েলের যাজকত্ব লোকেদের সাথে পুনরায় বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্য ঈশ্বরের এক চুড়ান্ত উপায় ছিল না। যাজকদের কাজ ছিল এক প্রতীক স্বরূপ যা উত্তম বিষয়গুলি, “স্বর্গীয় বিষয়ের” প্রতি নির্দেশ করে। (ইব্রীয় ৮:৫) একবার ওই স্বর্গীয় বিষয়গুলি উপস্থিত হলে আর প্রতীকের প্রয়োজন হয় না। উদাহরণস্বরূপ: আপনার হয়ত একটি বস্তুর অত্যন্ত প্রয়োজন যার বিজ্ঞাপনটি আপনি নিজের কাছে রাখেন, কিন্তু সেটি নেওয়ার পর আপনি কি সেই বিজ্ঞাপনটি বাতিল করে দেবেন না?
ইস্রায়েল জাতি সৃষ্টি হওয়ার বহু পূর্বেই, ঈশ্বর এক যাজকত্ব স্থাপনের উদ্দেশ্য করেন যার দ্বারা কেবলমাত্র ইস্রায়েল জাতি নয়, কিন্তু সমগ্র মানবজাতির আশীর্বাদ আসবে। প্রথমে, ইস্রায়েল জাতির সুযোগ ছিল সেই যাজকত্বের সদস্যদের প্রদান করার। যখন জাতিটি গঠিত হয়, যিহোবা ইস্রায়েলকে বলেন: “যদি তোমরা আমার রবে অবধান কর . . . আমার নিমিত্তে তোমরাই যাজকদের এক রাজ্য ও পবিত্র এক জাতি হইবে।” (যাত্রাপুস্তক ১৯:৫, ৬; তুলনা করুন আদিপুস্তক ২২:১৮) দুঃখের বিষয়, জাতিটি কদাচিৎ ঈশ্বরের বাক্যে অবধান করত। তাই যীশু যাজক ও ফরিশীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন: “তোমাদের নিকট হইতে ঈশ্বরের রাজ্য কাড়িয়া লওয়া যাইবে, এবং এমন এক জাতিকে দেওয়া হইবে, যে জাতি তাহার ফল দিবে।” মানব জাতির আশীর্বাদার্থে এখন কারা যাজকরূপে সেবা করে?—মথি ২১:৪৩.
খ্রীষ্টানদের কী ধরণের যাজকত্বের প্রয়োজন?
যেহেতু আমরা আদম থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাপ পেয়েছি, তাই একমাত্র যীশুর সিদ্ধ বলিদানের মাধ্যমেই অনন্ত জীবনের পরিত্রাণ লাভ করা সম্ভব। (১ যোহন ২:২) ঠিক ইস্রায়েলের যাজকত্বের মতই যীশু মহা যাজক হয়ে আমাদের পক্ষে নিজেই মধ্যস্থতা করেন। ইব্রীয় ৯:২৪ পদ বলে: “খ্রীষ্ট হস্তকৃত পবিত্র স্থানে প্রবেশ করেন নাই—এ ত প্রকৃত বিষয়গুলির প্রতিরূপমাত্র—কিন্তু স্বর্গেই প্রবেশ করিয়াছেন, যেন তিনি এখন আমাদের জন্য ঈশ্বরের সাক্ষাতে প্রকাশমান হন।” ফলে, খ্রীষ্টের অতি উৎকৃষ্ট মহা যাজকত্ব, মধ্যস্থ হিসাবে মানব যাজকদের প্রয়োজনকে বাতিল করে দেয়। তবুও, অধীনস্থ যাজকদের পরিচর্যার এখনও প্রয়োজন আছে। কোন অর্থে?
যাজকদের “যীশু খ্রীষ্ট দ্বারা ঈশ্বরের গ্রাহ্য আত্মিক বলি উৎসর্গ” করা উচিত। (১ পিতর ২:৫) কী ধরণের উৎসর্গ, সেই সম্পর্কে বলতে গিয়ে পৌল লেখেন: “অতএব আইস, আমরা . . . ঈশ্বরের উদ্দেশে নিয়ত স্তব-বলি, অর্থাৎ . . . ওষ্ঠাধরের ফল, উৎসর্গ করি।” (ইব্রীয় ১৩:১৫) সেইজন্য, যারা রাজকীয় যাজক হবে, তারা পৃথিবীতে থাকাকালীন মানুষের সামনে ঈশ্বরকে প্রতিনিধিত্ব করে তাঁর সাক্ষী হিসাবে, মধ্যস্থ হিসাবে নয়। পরবর্তী সময়ে, স্বর্গে যীশু খ্রীষ্টের সাথে, তারা ঈশ্বরের সামনে মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে খ্রীষ্টের বলিদানের উপকারগুলি প্রদান করে এবং সকল দূর্বলতার আরোগ্য সাধন করে।—তুলনা করুন মার্ক ২:৯-১২.
যদিও সকল বিশ্বাসীদের সাক্ষ্য বহন করতে হবে, তুলনামূলকভাবে কেবলমাত্র অল্প সংখ্যকই স্বর্গীয় ‘যাজকদের এক রাজ্যে’ সেবা করবে। যীশু বলেছিলেন: “হে ক্ষুদ্র মেষপাল, ভয় করিও না, কেননা তোমাদিগকে সেই রাজ্য দিতে তোমাদের পিতার হিতসঙ্কল্প হইয়াছে।” (লূক ১২:৩২; প্রকাশিত বাক্য ১৪:১) এরা স্বর্গে পুনরুত্থিত হবে এবং “ঈশ্বরের ও খ্রীষ্টের যাজক হইবে, এবং সেই সহস্র বৎসর তাঁহার সঙ্গে রাজত্ব করিবে।”—প্রকাশিত বাক্য ২০:৬.
এই স্বর্গীয় যাজকদের জন্য ঈশ্বর আত্মিক ও দৈহিকরূপে কিছু কাজ করার ব্যবস্থা করেছেন যা কোন যাজকত্বই এখনও পর্যন্ত করেনি। শীঘ্রই, যখন তারা যীশুর মুক্তির মূল্যের বলিদানের উপকার প্রয়োগ করবে, তখন তারা সমস্ত বিশ্বাসী মানবকে পুনরায় সিদ্ধতায় ফিরিয়ে আনার কাজে অংশ নিতে সমর্থ হবে। তখন, যিশাইয় ৩৩:২৪ পদ অপূর্বভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করবে। তা বলে: “নগরবাসী কেহ বলিবে না, আমি পীড়িত; তন্নিবাসী প্রজাদের অপরাধের ক্ষমা হইবে।” (g93 10/8)