আত্মহত্যা কি উত্তর?
“প্রতিদিন সকালে ওঠাতে আমি ক্লান্ত। আমি হারিয়ে গেছি। আমি রাগান্বিত। আমি অন্তরে ব্যথা পাই। . . . তাই আমি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করি। . . . আমি যেতে চাই না কিন্তু আমি মনে করি আমাকে যেতে হবে। . . . আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকাই আর দেখি শুধুমাত্র অন্ধকার ও দুঃখ।”—আত্মহত্যার আগে লেখা ২১ বছরের পিটারের চিঠি।a
বিশেষজ্ঞেরা দাবি করেন যে যুক্তরাষ্ট্রে ২০ লক্ষের মত যুবক-যুবতীরা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। দুঃখের বিষয়, বছরে প্রায় ৫,০০০ সফলকামী হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যুবক-যুবতীদের আত্মহত্যা অস্বাভাবিক কোন কিছু নয়। ভারতে ১৯৯০ সালে প্রায় ৩০,০০০ যুবক-যুবতী আত্মহত্যা করে। ইস্রায়েল, কানাডা, থাইল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফিন্ল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইটজারল্যান্ড ও স্পেনে যুবসমাজে আত্মহত্যার সংখ্যা আশ্চর্যজনকরূপে বৃদ্ধি পেয়েছে।
যদি কেউ প্রচণ্ড দুঃখে ভারাক্রান্ত বোধ করে—অথবা মনে করে দুঃখের জালে জড়িয়ে পড়েছে ও মুক্তি পাওয়ার কোন পথ নেই, তাহলে কী? আত্মহত্যা করা হয়ত প্রলোভনকর বলে মনে হতে পারে কিন্তু বাস্তবে এটি দুঃখজনক অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। পরবর্তীকালে এটি পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের জন্য রেখে যায় শুধুমাত্র দুঃখ ও বেদনা। ভবিষ্যৎ যতই অন্ধকারময় এবং সমস্যা যত বড় বলেই মনে হোক না কেন, নিজেকে হত্যা করা তার উত্তর নয়।
কেন অনেকে এইরূপ মনে করে
ধার্মিক ব্যক্তি ইয়োব হতাশার অর্থ জানতেন। তার পরিবার, সম্পত্তি ও উত্তম স্বাস্থ্য হারিয়ে তিনি বলেছিলেন: “আমার প্রাণ শ্বাসরোধ চাহে, আমার এই অস্থিকঙ্কাল অপেক্ষা মরণ চাহে।” (ইয়োব ৭:১৫) বর্তমানে কিছু যুবক-যুবতীরা হয়ত অনুরূপ বোধ করে। একজন লেখক এইরূপে বলেন: “মানসিক চাপ . . . দুঃখে পরিচালিত করে (ব্যথা ও ভয় পাওয়ার অনুভূতি) [যা] পরিচালিত করে প্রতিরোধে (দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা)।” সুতরাং, আত্মহত্যা হল আপাতদৃষ্টিতে অসহ্য দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার ভ্রান্ত প্রচেষ্টা।
কী কারণে এই প্রকৃতির দুঃখের সৃষ্টি হয়? কোন ঘটনার দ্বারা উদ্দীপিত হতে পারে, যেমন বাবা-মা, বন্ধু বা বান্ধবীর সাথে প্রচণ্ড তর্কবিতর্ক। বান্ধবীর সাথে সম্পর্কচ্যুত হওয়ার পর ১৬ বছরের ব্র্যাড হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু সে তার অনুভূতির কথা কখনও বলেনি। নিজেকে ফাঁসি দিয়ে সে তার দুঃখের ইতি করে দেয়।
উনিশ বছরের সুনীতা হতাশায় জর্জরিত হয় যখন তার বাবা-মা জানতে পারেন যে তার পুরুষ-বন্ধুর সাথে তার অনৈতিক সম্পর্ক আছে। “আমি যেভাবে জীবন যাপন করছিলাম আমি জানি যে সেইভাবে বাস করে যেতে আমি চাই না,” সে স্মরণ করে। “আর তাই আমি একদিন রাত্রে ঘরে এসে একের পর এক আ্যসপিরিন্ খেতে আরম্ভ করি। পরের দিন সকাল বেলা আমার রক্ত বমি হয়। আমার জীবন নয় কিন্তু আমার জীবন ধারাকে আমি ইতি করতে চেয়েছিলাম।”
স্কুলও প্রচণ্ড চাপের উৎস হতে পারে। বাবা-মা (নিজেরা ডাক্তার) ডাক্তার হওয়ার চাপ দেওয়াতে, যুবক আশীষের অনিদ্রার রোগ হয় ও সে নিজেকে সকলের কাছ থেকে গুটিয়ে নিতে আরম্ভ করে। বাবা-মা তার কাছ থেকে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে যা আশা করেছিলেন তা অর্জন করতে না পারায় আশীষ বেশি করে ঘুমের বড়ি খায়। এটি বাইবেলের হিতোপদেশ ১৫:১৩ পদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়: “মনের ব্যথায় আত্মা ভগ্ন হয়।”
পরিবারে দুঃখ-দুর্দশা
পরিবারে অশান্তি—যেমন পিতা-মাতার বিচ্ছেদ অথবা পৃথকভাবে থাকা, পরিবারের সদস্যের মৃত্যু বা কোন নতুন জায়গায় স্থানান্তকরণ—হল আর একটি কারণ কিছু যুবক-যুবতীর আত্মহত্যার জন্য। উদাহরণস্বরূপ উপরে উল্লিখিত ব্র্যাড, তার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও একজন আত্মীয়কে গাড়ির দুঘর্টনায় হারায়। এরপর তার পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়। ব্র্যাড খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সে হয়ত গীতরচকের মত অনুভব করে যিনি আর্তনাদ করে ওঠেন: “আমার প্রাণ দুঃখে পরিপূর্ণ . . . তাহা একসঙ্গে আমাকে বেষ্টন করিয়াছে।”—গীতসংহিতা ৮৮:৩, ১৭.
বহু সংখ্যক যুবক-যুবতীরা আর এক প্রকারের চাপের বলি হচ্ছে: দৈহিক, মানসিক ও যৌন সংক্রান্ত বিষয়ে দুর্ব্যবহার। ভারতের কেরালা রাজ্যে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা সেই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। সেখানে বহু কিশোরী নিজেদের হত্যা করতে চেষ্টা করে কারণ তাদের পিতারা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে। শিশুর প্রতি ভিন্ন প্রকারের দুর্ব্যবহার জগদ্ব্যাপী মহামারী আকারে দেখা যাচ্ছে এবং এর নিরীহ শিকারের জন্য দুঃখ-দুর্দশা হতে পারে চরম।
দুঃখ-দুর্দশার অন্যান্য কারণ
কিন্তু আত্মহত্যা করার প্রত্যেক মনোভাব বাইরের কারণের জন্য হয় না। অবিবাহিত কিশোর-কিশোরীদের উপর এক গবেষণা রিপোর্ট বলে: “যে সকল পুরুষ ও নারী যৌনসম্ভোগ এবং মদ্যজাতীয় পানীয় গ্রহণে লিপ্ত থাকে তাদের [আত্মহত্যা] করার ঝুঁকি তাদের চাইতে বেশি আছে যারা এইগুলি থেকে বিরত থাকে।” সুনীতার বাছবিচারহীন জীবন-যাপন তাকে গর্ভবতী করে—যা সে গর্ভপাতের দ্বারা শেষ করে দেয়। (তুলনা করুন ১ করিন্থীয় ৬:১৮) নিজেকে অপরাধী মনে করাতে সে মরতে চায়। অনুরূপে, ব্র্যাড ১৪ বছর বয়স থেকে মদ খেত, প্রায় নিয়মিতরূপে মদ্যপানোৎসবে অংশ নিত। হ্যাঁ, যখন সদ্ব্যাবহার না করা হয়, মদ ‘সর্পের ন্যায় কামড়াতে’ পারে।—হিতোপদেশ ২৩:৩২.
আত্মহত্যা করার মনোভাব এমনকি নিজের “আন্তরিক ভাবনার” জন্য হতে পারে। (গীতসংহিতা ৯৪:১৯) ডাক্তারেরা বলেন নানা রকম দৈহিক কারণে অনেকসময় অবসাদমূলক চিন্তাধারার উদয় হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভূমিকায় উল্লিখিত পিটারকে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে আত্মহত্যার আগে তার মস্তিষ্কে রাসায়নিক দ্রব্যের অসমতা দেখা দেয়। অবসাদমূলক মনোভাবের উপর নজর না দিলে তা প্রচণ্ড বৃদ্ধি পেতে পারে; আত্মহত্যাকে এক উপায় হিসাবে মনে হতে পারে।
সাহায্য পাওয়া
কিন্তু আত্মহত্যাকে একটি উপায় হিসাবে দেখা উচিত নয়। মানসিক-স্বাস্থ্য বৃত্তিধারী আ্যলন এল. বারমান্ এবং ডেভিড এ. যোবস্ যাকে বলেন ‘মানসিক চাপ ও বিবাদের সাথে সফলতার সাথে মোকাবিলা করতে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উৎস,’ আমাদের সকলেরই তা আছে, আমরা উপলব্ধি করি বা না করি। একটি উৎস হতে পারে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব। হিতোপদেশ ১২:২৫ বলে: “মনুষ্যের মনোব্যথা মনকে নত করে; কিন্তু উত্তম বাক্য তাহা হর্ষযুক্ত করে।” হ্যাঁ, বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে একটি ভাল কথা পরিস্থিতিকে অনেকটা পরিবর্তন করতে পারে!
সুতরাং কেউ যদি অবসাদ বোধ করে বা উদ্বিগ্ন হয় তাহলে তার একা কষ্ট পাওয়া ভাল নয়। (হিতোপদেশ ১৮:১) যে কষ্ট পাচ্ছে সে যাকে বিশ্বাস করে তার কাছে হৃদয়ের কথা খুলে বলতে পারে। কারুর সাথে কথা বললে তা একজনের মানসিক চাপের তীব্রতাকে কমাতে সাহায্য করে এবং সেটি সমস্যাকে নতুন করে দেখতে সাহায্য করতে পারে। যদি কেউ মৃত্যুতে তার বন্ধু বা প্রিয়জনকে হারিয়ে খুবই দুঃখার্ত থাকে, তার উচিত বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছে তা ব্যক্ত করা। যখন কাউকে হারানোর দুঃখের বিষয়টি শোনা হয় এবং বেদনাকে অনুভব করা হয়, সেই ব্যক্তি সান্ত্বনা পায়। (উপদেশক ৭:১-৩) যদি আত্মহত্যা করার ইচ্ছা আবার জাগে তাহলে তাকে বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করতে বলা সাহায্যকারী হতে পারে।
সত্যই, কাউকে বিশ্বাস করা কষ্টকর হতে পারে। কিন্তু যখন জীবনই বিপদাপন্ন তখন এই ঝুঁকিটি নেওয়া যথাযোগ্য নয় কি? যদি কথা ব্যক্ত করা যায় তাহলে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছা হয়ত চলে যেতে পারে। কেউ হয়ত জিজ্ঞাসা করতে পারে ‘কার সাথে কথা বলব?‘ যদি পিতামাতা ঈশ্বর-ভীরু হন তাহলে ‘হৃদয়ের কথা’ তাদের কাছে বলতে চেষ্টা কর না কেন? (হিতোপদেশ ২৩:২৬) অনেকে যা মনে করে তার থেকেও তারা আরও ভাল উপলব্ধি করতে ও সাহায্য করতে পারবেন। যদি মনে হয় আরও সাহায্যের প্রয়োজন আছে—যেমন ডাক্তারের পরীক্ষা—তারা তার জন্য ব্যবস্থা করতে পারেন।
খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর সদস্যেরা সাহায্যের আর একটি উৎস হতে পারে। মণ্ডলীর আধ্যাত্মিকভাবে প্রাচীন ব্যক্তিরা দুর্দশাপূর্ণ ব্যক্তিদের সমর্থন ও সাহায্য করতে পারেন। (যিশাইয় ৩২:১, ২; যাকোব ৫:১৪, ১৫) আত্মহত্যা করার চেষ্টা করার পর সুনীতা একজন পূর্ণ-সময়ের প্রচারকের (অগ্রগামী) কাছ থেকে সাহায্য পায়। সুনীতা বলে: “প্রত্যেকটি বিষয়েতে তিনি আমার সাথে সাথে ছিলেন। যদি তিনি না থাকতেন আমি তাহলে সত্যই পাগল হয়ে যেতাম।”
মোকাবিলা করা
অভ্যন্তরীণ উৎসও আছে যার থেকে শক্তি পাওয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভুল কাজের জন্য অপরাধ বোধে কি কষ্ট পাওয়া হচ্ছে? (তুলনা করুন গীতসংহিতা ৩১:১০.) সেই মনোভাবকে বাড়তে না দিয়ে বিষয়টি ঠিক করতে চেষ্টা করা দরকার। (যিশাইয় ১:১৮; তুলনা করুন ২ করিন্থীয় ৭:১১.) নিজের পিতামাতার কাছে স্বীকার করাটি হবে এক গঠনমূলক পদক্ষেপ। এটি সত্য যে, তারা প্রথমে রাগান্বিত হবেন। কিন্তু তারা সম্ভবত সাহায্য করতে উদ্যত হবেন। আমরা নিশ্চিত যে যারা আন্তরিকভাবে অনুতাপ করে তাদের যিহোবা ‘প্রচুররূপে ক্ষমা করেন।’ (যিশাইয় ৫৫:৭) মুক্তির মূল্যরূপ যীশুর বলিদান অনুতপ্ত ব্যক্তির পাপ মুছে দেয়।—রোমীয় ৩:২৩, ২৪.
খ্রীষ্টানদের বিশ্বাস, শাস্ত্রের জ্ঞান ও যিহোবা ঈশ্বরের সাথে তাদের সম্পর্ক থেকে তারা শক্তি পেতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গীতরচক দায়ূদ এতই দুঃখার্ত ছিলেন যে তিনি বলেন: “শত্রু . . . আমার জীবন ভূমিতে চূর্ণ করিয়াছে।” তিনি হতাশায় ভেঙ্গে পড়েননি। তিনি লেখেন: “আমি নিজ রবে সদাপ্রভুর কাছে ক্রন্দন করি, নিজ রবে সদাপ্রভুর কাছে বিনতি করি।” “আমি পূর্ব্বকালের দিন সকল স্মরণ করিতেছি, তোমার সমস্ত কর্ম্ম ধ্যান করিতেছি, তোমার হস্তের কার্য্য আলোচনা করিতেছি।”—গীতসংহিতা ১৪২:১; ১৪৩:৩-৫.
যদি নিজের ক্ষতি করার ইচ্ছা প্রবল হয় তাহলে তার যিহোবাকে প্রার্থনায় ডাকা দরকার। তিনি দুঃখ বুঝতে পারেন এবং তিনি চান যে কষ্ট পাচ্ছে সে যেন বেঁচে থাকে! (গীতসংহিতা ৫৬:৮) দুঃখের সাথে মোকাবিলা করতে তিনি “স্বাভাবিক শক্তির থেকেও অধিক” শক্তি প্রদান করতে পারেন। (২ করিন্থীয় ৪:৭, NW) আত্মহত্যার কারণে পরিবারের, বন্ধু-বান্ধবদের ও যিহোবার যে দুঃখ হয় সেই সম্বন্ধেও একজনের চিন্তা করা উচিত। সেই সকল বিষয় চিন্তা করলে একজনকে জীবিত থাকতে সাহায্য করবে।
কিছুজনের কাছে মনে হতে পারে যে সেই বেদনা কখনই মন থেকে মুছে যাবে না কিন্তু তারা আস্থা রাখতে পারে যে এমন লোকও জীবিত আছেন যারা একই রকমের দুঃখ পেয়েছিলেন। তারা অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারেন পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে ও পরিবর্তন হয়। সেই দুঃখজনক পরিস্থিতি থেকে বার হয়ে আসতে অপরেও সাহায্য করতে পারে। অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিরা তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে—জীবিত থাকতে পারে!(g94 4/8)
[পাদটীকা]
a কিছু নামের পরিবর্তন করা হয়েছে
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
মনে ব্যথা পাওয়ার বিষয়গুলি কারও কাছে ব্যক্ত করা ভাল