বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি
“দুর্ব্বল পাত্র”
স্ত্রীদের প্রতি অসম্মান?
“স্ত্রীদের লিঙ্গের দ্বারা বিচার করা হয়, অভিজ্ঞতা, সামর্থ্য এবং বুদ্ধি দ্বারা হয় না কেন?”—বেটি এ।
“স্ত্রীদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে তারা নিম্ন ধরনের প্রাণী।”—লিন এইচ।
বাইবেলের উক্তি “দুর্ব্বল পাত্র” কি স্ত্রীদের নিচু করে? বাইবেলের শাস্ত্রপদ যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছে তা হল ১ পিতর ৩:৭ পদ যা বলে: “তদ্রূপ, হে স্বামিগণ, স্ত্রীলোক অপেক্ষাকৃত দুর্ব্বল পাত্র বলিয়া তাহাদের সহিত জ্ঞানপূর্ব্বক বাস কর, তাহাদিগকে আপনাদের সহিত জীবনের অনুগ্রহের সহাধিকারিণী জানিয়া সমাদর কর; যেন তোমাদের প্রার্থনা রুদ্ধ না হয়।”
যখন পিতর সহখ্রীষ্টানদের প্রতি এই কথাগুলিকে লেখেন তখন স্ত্রীদের খুব কমই অধিকার ছিল শুধু আদি পৌত্তলিক জগতেই নয় এমনকি ধর্মভ্রষ্ট যিহুদি সমাজেও ছিল। পিতর এবং প্রাথমিক খ্রীষ্টানেরা কি সেই তখনকার দিনের মনোভাবকে সমর্থন করছিলেন?
হীনতর পাত্র?
প্রথম শতাব্দীর পাঠকেরা পিতরের বাক্যগুলি “দুর্ব্বল পাত্র” কিভাবে বুঝেছিলেন? গ্রীক শব্দ পাত্র (স্কুয়োস) অনেকবার গ্রীক শাস্ত্রে ব্যবহার করা হয়েছে এবং বিভিন্ন রকমের পাত্র, অস্ত্র, বাসন এবং যন্ত্রকে ইঙ্গিত করে। স্ত্রীদের “দুর্ব্বল পাত্র” বলে পিতর স্ত্রীদের নিচু করছিলেন না, কারণ তার অর্থ ইঙ্গিত করে যে স্বামীরাও পলকা, দুর্ব্বল পাত্র। স্বামী এবং স্ত্রীদের বিষয় ইঙ্গিত করার সময় অন্য বাইবেল শব্দপদগুলিও একই ধরনের ভাষা ব্যবহার করে যেমন “মৃন্ময় পাত্রে” (২ করিন্থীয় ৪: ৭) এবং “দয়াপাত্রদের” (রোমীয় ৯:২৩)। সত্যই, দুই লিঙ্গের মধ্যে স্ত্রীদের পিতর “দুর্ব্বল” বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু রোমীয় ৫:৬ পদ “দুর্ব্বল” সব মানুষদের প্রতি প্রযোজ্য—স্ত্রী এবং পুরুষ। তাই প্রাথমিক খ্রীষ্টীয়ানেরা “দুর্ব্বল পাত্র” কথাটি স্ত্রীদের নিচু করার বিষয়ে মনে করেননি।
বরং, পিতরের কথাগুলি হয়ত স্ত্রীদের পরিস্থিতিকে আরও উচ্চ করা হচ্ছে বলে মনে করা হত। পিতরের দিনে স্ত্রীদের প্রতি শ্রদ্ধা খুব কমই দেখা যেত। ঈশ্বর আগে থেকে জানতেন যে, স্বামীরা বেশির ভাগ স্ত্রীদের উপর কর্তৃত্ব এবং অপব্যবহার করবে দৈহিক, যৌন এবং মানসিক দিক দিয়ে। (আদিপুস্তক ৩:১৬) তাই, খ্রীষ্টীয় স্বামীদের প্রতি আসলে পিতরের উপদেশ ছিল: জগৎ সমাজ পুরুষদের যে ক্ষমতা দিয়েছে তা অপব্যবহার কর না।
“দুর্ব্বল” কথাটি আরও ভাল করে লক্ষ্য করুন। পিতর এই পদে মানসিক গুণাবলি নয় বরং দৈহিক গুণাবলির প্রতি নির্দেশ করছিলেন। পুরুষেরা দুর্ব্বল পাত্র; কিন্তু তুলনামূলকভাবে পুরুষদের থেকে স্ত্রীয়েরা আরও দুর্বল পাত্র। কিভাবে? পুরুষদের হাড় এবং পেশিগুলি এমনভাবে তৈরি যে সাধারণত তাদের শক্তি বেশি। কিন্তু, এখানে কোন ইঙ্গিত নেই যা বোঝায় যে পিতর নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং মানসিক শক্তির তিনি তুলনা করছিলেন। আসলে, কোন বিষয়ের প্রতি মানসিক প্রতিক্রিয়া বলতে গেলে স্ত্রীদের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে পুরুষদের থেকে ভিন্ন বলা যেতে পারে, এর অর্থ এই নয় যে তারা দুর্বল কিংবা সবল। কঠোর নৈতিক চরিত্র, দীর্ঘসহিষ্ণুতা এবং স্ত্রীদের উপলব্ধিবোধ সম্বন্ধে বাইবেল বর্ণনা করে যে সকল স্ত্রীয়েরা ঈশ্বরের পথে চলেছিলেন—যেমন সারা, দবোরা, রূৎ এবং ইষ্টের এদের মধ্যে কয়েকজন। নম্র লোকেদের বুঝতে দেরি হয় না যে স্ত্রীরা তাদের থেকে বেশি বুদ্ধিমতি হতে পারে।
তবুও, কয়েকজন মনে করে যে স্ত্রীদের “দুর্ব্বল” বলা অর্থ হল যে তারা হীনতর ব্যক্তি। কিন্তু এই উদাহরণ সম্বন্ধে চিন্তা করুন। একজন ব্যক্তির কাছে দুইটি কার্যকারী পাত্র আছে। একটি মজবুত অন্যটি একটু কমজোর। দ্বিতীয় পাত্রটি কমজোর বলে কি সেটি কম মূল্যবান? আসলে, কমজোর পাত্রটি সাধারণত বেশি কোমলতা এবং সম্মানের সাথে ব্যবহার করা হয়। তাহলে তার অর্থ কি এই যে, যেহেতু স্ত্রীদের দৈহিক শক্তি কম বলে তারা তাই কম মূল্যবান? নিশ্চয়ই না! পিতর “দুর্ব্বল পাত্র” কথাটির মর্যাদাহানি করতে নয়, কিন্তু সম্মান দিতে ব্যবহার করেছিলেন।
“তদ্রূপ . . . জ্ঞানপূর্ব্বক”
পিতর স্বামীদের উৎসাহ দেন “তদ্রূপ . . . তাহাদের [তাদের স্ত্রীদের] সহিত জ্ঞানপূর্ব্বক বাস কর।” “তদ্রূপ” কাদের সাথে? পূর্বের পদগুলিতে পিতর তাঁর শিষ্যদের প্রতি খ্রীষ্টের প্রেমময় যত্ন করার বিষয়ে কথা বলছিলেন এবং তিনি স্বামীদের নির্দেশ দেন তাদের স্ত্রীদের “তদ্রূপ” যেন যত্ন নেন। (১ পিতর ২:২১-২৫; ৩:৭) যীশু সর্বদাই তাঁর ইচ্ছা এবং পছন্দের আগে শিষ্যদের মঙ্গল এবং আগ্রহকে প্রথমে রাখতেন। তিনি তাদের আধ্যাত্মিক এবং দৈহিক মঙ্গলের প্রতি চিন্তিত ছিলেন, এবং তিনি তাদের কর্মক্ষমতা বুঝতেন। স্বামীদের খ্রীষ্টের প্রেমময় উদাহরণ অনুকরণ করে, স্ত্রীদের প্রতি “তদ্রূপ” আচরণ করতে হবে।
সমস্যা-মুক্ত বিবাহ হঠাৎ করে হয় না। স্বামী এবং স্ত্রী উভয়কে জানতে হবে যে কী করে তাদের বিবাহ সফল করা যায়। তাই, স্বামীদের প্রতি পিতরের উপদেশ স্ত্রীদের সাথে “জ্ঞানপূর্ব্বক” বাস করুক। স্বামীদের অধ্যয়ন করা উচিত কিভাবে যিহোবা এবং তাঁর পুত্র, যীশু খ্রীষ্ট স্ত্রীদের সাথে ব্যবহার করতেন। তাদের স্ত্রীদের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হবে তা তাদের জানতে হবে।
তার সাথে সাথে, স্বামীদের উচিত তাদের স্ত্রীদের ভাল করে জানা—তাদের অনুভূতি, শক্তি, সামর্থ্য, পছন্দ এবং অপছন্দগুলি। তাদের স্ত্রীদের বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা এবং মর্যাদার প্রতি কিভাবে শ্রদ্ধা দেখাতে হয় তা তাদের জানতে হবে। বাইবেল বলে: “স্বামীরা, তোমরা আপন আপন স্ত্রীকে সেইরূপ প্রেম কর, যেমন খ্রীষ্টও মণ্ডলীকে প্রেম করিলেন, আর তাহার নিমিত্ত আপনাকে প্রদান করিলেন; এইরূপে স্বামীরাও আপন আপন স্ত্রীকে আপন আপন দেহ বলিয়া প্রেম করিতে বাধ্য। আপন স্ত্রীকে যে প্রেম করে, সে আপনাকেই প্রেম করে। কেহ ত কখনও নিজ মাংসের প্রতি দ্বেষ করে নাই, বরং সকলে তাহার ভরণ পোষণ ও লালন পালন করে; যেমন খ্রীষ্টও মণ্ডলীর প্রতি করিতেছেন।”—ইফিষীয় ৫:২৫, ২৮, ২৯.
তাদের সমাদর কর
পিতর যখন স্ত্রীদের “দুর্ব্বল পাত্র” বলেন, তখন তিনি এও বলেছিলেন যে স্বামীরা যেন “তাদের সমাদর” করে। গ্রীক ভাষায়, টাইম বিশেষ্যপদটির অর্থ হল সম্মান, শ্রদ্ধা, মূল্যবান, অতিমূল্যবান। অন্য কথায় বলতে গেলে, সমাদর করার অর্থ অপরের প্রতি শুধু পক্ষপাত নয় কিন্তু যা উপযুক্ত তা স্বীকার করা। পুরুষ এবং স্ত্রী সকল খ্রীষ্টানদের পৌল এইরকম নির্দেশ দেন, যা হল: “ভ্রাতৃপ্রেমে পরস্পর স্নেহশীল হও; সমাদরে এক জন অন্যকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কর।”—রোমীয় ১২:১০.
যিহোবা ঈশ্বর স্ত্রীদের শুধুমাত্র ঘর সাজাবার জিনিস হিসাবে মনে করেন না। ইস্রায়েলে, ঈশ্বরের নিয়ম পুরুষ এবং স্ত্রীদের প্রতি একইভাবে প্রযোজ্য ছিল যারা পারদার্য, অজাচার, পশ্বাচার এবং অন্যান্য অপরাধ করত। (লেবীয় পুস্তক ১৮:৬-১৭, ২৩, ২৯; ২০:১০-১২) বিশ্রামবারের উপকারগুলি, নাসরীয়দের যে নিয়ম পরিচালনা করত, উৎসবগুলি এবং অন্যান্য নিয়মের আয়োজনগুলি স্ত্রীরা উপভোগ করতে পারত। (যাত্রাপুস্তক ২০:১০; গণনাপুস্তক ৬:২; দ্বিতীয় বিবরণ ১২:১৮; ১৬:১১, ১৪) পিতা এবং মাতার প্রতিও সম্মান ও বাধ্যতা দেখাতে হত।—লেবীয় পুস্তক ১৯:৩; ২০:৯; দ্বিতীয় বিবরণ ৫:১৬; ২৭:১৬; হিতোপদেশ ১:৮.
প্রজ্ঞা, পরিশ্রমী এবং বিশ্বস্ততার সাথে তার দায়িত্বগুলি সম্পন্ন করার জন্য হিতোপদেশ ৩১ অধ্যায় ১০ থেকে ৩১ পদ ‘গুণবতী স্ত্রীকে’ সম্মান প্রদর্শন করে। সে পরিবারের ব্যবসা এবং অন্যান্য আর্থিক বিষয়ের সাহায্যের অংশকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করে। কয়েকজন ব্যক্তি যেমন মনে করে থাকে স্ত্রীরা শুধু অলঙ্কার সেই মনোভাব থেকে কতই না ভিন্ন ধারণা! পরে প্রাথমিক খ্রীষ্টীয় স্ত্রীদের পবিত্র আত্মার দ্বারা খ্রীষ্টের সাক্ষী হিসাবে শক্তিশালী করা হয়। (প্রেরিত ১:১৪, ১৫; ২:৩, ৪; তুলনা করুন যোয়েল ২:২৮, ২৯.) ফলত, পুরুষ, স্ত্রী এবং এমনকি দূতদের বিচার করতে কিছু স্ত্রীদের বেছে নেওয়া হয়েছে। (১ করিন্থীয় ৬:২, ৩) সত্যই, মণ্ডলীগত সভায় স্ত্রীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয়নি; কিন্তু, এমন পরিস্থিতি এসেছিল যখন খ্রীষ্টীয় স্ত্রীরা প্রার্থনা এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলেন। যুবতী, শিশুদের এবং যারা মণ্ডলীর বাইরে তাদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়েছিল।—মথি ২৪:১৪; ১ করিন্থীয় ১১:৩-৬; তীত ২:৩-৫; তুলনা করুন গীতসংহিতা ৬৮:১১.
আরেকটি বিষয় যা পিতর বলতে চাইছিলেন যখন তিনি বলেন তাদের সমাদর কর, তা পাওয়া যায় ২ পিতর ১:১৭ পদ। সেখানে আমরা পড়ি যে সবার সামনে তাঁকে অনুমোদন করে যিহোবা যীশুকে এই বলে সমাদর করেন: “ইনিই আমার পুত্ত্র, আমার প্রিয়তম।” ঠিক তেমনি স্বামী তার কার্যের দ্বারা ঘরে এবং বাইরে দেখাবে যে সে তার স্ত্রীকে সমাদর করে।
জীবনের উত্তরাধিকারী
সমগ্র ইতিহাসে, দেখা যায় যে পুরুষেরা স্ত্রীদের খুব কমই সম্মান এবং শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য মনে করে—দাসী, কিংবা পুরুষদের খুশি করার বস্তু হিসাবে গণ্য করে। স্ত্রীদের সমাদর করার খ্রীষ্টীয় ধারণা নিশ্চয়ই তাদের শ্রদ্ধার উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়। বারনস্ নোটস ওন দ্যা নিউ টেস্টামেন্ট পিতরের উপদেশের বিষয় লক্ষ্য করে যে “নারীজাতির বিষয় একটি গুরত্বপূর্ণ সত্য রয়েছে। সব ধরনের ধর্ম ব্যবস্থার মধ্যে শুধু খ্রীষ্টীয় ব্যবস্থা ছাড়া, স্ত্রীকে সববিষয়ে নিচু মনে করা হয়েছে। খ্রীষ্টতত্ত্ব শিক্ষা দেয় . . . সব ধরনের আশা এবং প্রতিজ্ঞা যা ধর্ম দেয় তাদের জন্য রয়েছে। . . . এই একটি সত্য স্ত্রীলিঙ্গকে সর্বক্ষেত্রে হীনতা থেকে উচ্চ করবে এবং মানবজাতির অর্ধেক সামাজিক কুকর্মগুলিকে শেষ করে দেবে।”
যেহেতু পুরুষ ও স্ত্রী, উভয়েরই উপরে খ্রীষ্টের মালিকানা রয়েছে, তাই জন্য স্বামীদের আরও বেশি করে উচিত তাদের স্ত্রীদের খ্রীষ্টের সম্পত্তি হিসাবে স্নেহ করা। স্ত্রীদের “দুর্ব্বল পাত্র” বলার ঠিক পরেই পিতর আরও বলেন: “তাহাদিগকে আপনাদের সহিত জীবনের অনুগ্রহের সহাধিকারিণী জানিয়া সমাদর কর; যেন তোমাদের প্রার্থনা রুদ্ধ না হয়।” (১ পিতর ৩:৭খ) পিতর ইঙ্গিত করেন যে স্বামীরা স্ত্রীদের সাথে অপব্যবহার করলে ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক ব্যাহত হবে, তার প্রার্থনা রুদ্ধ হবে।
কোন অর্থে “দুর্ব্বল পাত্র” স্ত্রীদের অসম্মান করে না। যদিও যিহোবা স্বামীদের ঘরের মস্তক করেছেন, কিন্তু তিনি স্ত্রীদের অপব্যবহার অনুমোদন করেন না। পরিবর্তে, তিনি পুরুষকে নিদের্শ দেন যে, স্ত্রীদের জ্ঞানের সাথে তাদের স্নেহ এবং সম্মান করুক।
বাইবেল বিবাহিত এবং অবিবাহিত পুরুষদের নির্দেশ দেয় নারীদের সম্মান করতে, হীনতর ব্যক্তি হিসাবে তাদের সাথে আচরণ করতে নয়। পুরুষ এবং স্ত্রী যারা উৎসাহের সাথে ঈশ্বরকে উপাসনা করে এবং যারা একে অপরকে মর্যাদা দান করে তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে আশীর্বাদ লাভ করবে।—তুলনা করুন ১ করিন্থীয় ৭:১৬. (g94 10/8)