বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি
আপিনি কী বিশ্বাস করেন তাতে কি কিছু এসে যায়?
“মানুষ সেটাকেই বিশ্বাস করতে পছন্দ করে যাকে সে সত্য বলে মনে করে।”—ফ্রান্সিস বেকন, ১৫৬১-১৬২৬, ইংরেজ প্রবন্ধকার ও কূটনীতিজ্ঞ ব্যক্তি।
যখন ধর্মীয় মতবাদের বিষয় উত্থাপিত হয়, তখন অনেক লোকেরা মনে করেন যে যতক্ষণ একজন বিশ্বাস করে যে ‘উপরে কেউ আছেন’ এবং তার সহমানুষের প্রতি সে প্রেম দেখায়, ততক্ষণ ছাড়া সে আর কী বিশ্বাস করে তাতে কিছু এসে যায় না। কেউ কেউ আবার পরস্পরবিরোধী ধর্মীয় দলগুলির দ্বারা প্রচারিত ঈশ্বর, তাঁর উদ্দেশ্য এবং কিভাবে তাঁর উপাসনা করতে হয় এইগুলি লক্ষ্য করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে এই পার্থক্যগুলি হল নিছক বাহ্যিক, ঠিক যেমন একই ব্যক্তির দ্বারা পরিহিত বিভিন্ন ধরনের পোশাক। তারা এমনকি হয়ত এও ভাবতে পারে যে যারা এই পার্থক্যগুলিকে নিয়ে একটা বিরাট বিতর্কের সৃষ্টি করে তারা সত্য খ্রীষ্টতত্ত্বের আসল উদ্দেশ্যকেই সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়।
শাস্ত্রগুলি স্বীকার করে যে ধর্মীয় শিক্ষা সম্বন্ধে সকল আলোচনাই যথার্থ নয়। উদাহরণস্বরূপ, তীমথিয়ের উদ্দেশ্যে লেখা তার অনুপ্রাণিত চিঠিতে প্রেরিত পৌল সেই ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করেন যারা “হীনসত্য লোকদের চিরবিসংবাদ” ঘটায়। পৌল তাদের “বিতণ্ডা ও বাগ্যুদ্ধের বিষয়ে রোগগ্রস্ত” বলে বর্ণনা করেছেন। (১ তীমথিয় ৬:৪, ৫) তিনি তীমথিয়কে নির্দেশ দেন “মূঢ় ও অজ্ঞান বিতণ্ডা সকল অস্বীকার কর; তুমি জান, এ সকল যুদ্ধ উৎপন্ন করে” আর এও নির্দেশ দেন মণ্ডলীকে উপদেশ দিতে যে তারা “যেন . . . বাগ্যুদ্ধ না করে, . . . তাহাতে কোন ফল দর্শে না।” (২ তীমথিয় ২:১৪, ২৩) আমাদের দিনে অধিকাংশ ধর্মীয় বিতর্কগুলি এই বর্ণনার সাথে মিলে যায় আর এইগুলি সময়ের অপচয় বলে প্রমাণিত হয়েছে।
তাহলে, এর অর্থ কি এই যে সমস্ত ধর্মীয় আলোচনাই বৃথা? কয়েকটি কাপড় পরার অযোগ্য বলে আমরা কাপড় পরাকেই ছেড়ে দিতে পারি না, তাই নয় কি? সুতরাং কয়েকটি মতবাদমূলক প্রশ্ন বিবেচনার জন্য অযোগ্য বলে আমরা কেন সমগ্র ধর্মীয় বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে ধরে নেব? উপরে উদ্ধৃত পৌলের বাক্যগুলির প্রেক্ষাপট দেখায় যে মতবাদমূলক বিষয়গুলিকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বারংবার তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে মিথ্যা শিক্ষা মানুষকে বিশ্বাসের থেকে সরিয়ে নিতে পারে এবং তিনি তীমথিয়কে নির্দেশ দেন “কতকগুলি লোককে এই আদেশ দেও, যেন তাহারা অন্যবিধ শিক্ষা না দেয়।” (১ তীমথিয় ১:৩-৭; ৪:১; ৬:৩-৫; ২ তীমথিয় ২:১৪-১৮, ২৩-২৬; ৪:৩, ৪) প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানেরা যা বিশ্বাস করত তা যদি গুরুত্বপূর্ণ না হত তাহলে তিনি কখনই এইধরনের জোরদার মন্তব্য করতেন না।
তাহলে, মতবাদের উপর ভিত্তিক প্রশ্নগুলিকে এড়িয়ে চলার উপদেশ কেন দেওয়া হয়েছিল? এইজন্য যে পৌলের দিনে কিছু লোক ছিল—যাদের তিনি “নষ্টবিবেক ও হীনসত্য” বলে বর্ণনা করেছিলেন—যারা মতবাদমূলক প্রশ্নগুলি তুলেছিল কেবলমাত্র মানুষের বিশ্বাসকে পরাভূত করার জন্য। (১ তীমথিয় ৬:৫) অতএব শুধুমাত্র ঐসব নষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা উত্থাপিত প্রশ্নগুলির পরিপ্রেক্ষিতেই পৌল তীমথিয়কে উপদেশ দিয়েছিলেন ধর্মীয় বিষয়ের সম্বন্ধে আলোচনাকে এড়িয়ে চলতে।
বিশ্বাস কি আচরণের উপর প্রভাব ফেলে?
কিন্তু, কেউ কেউ হয়ত প্রশ্ন করতে পারে যে, আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস কি আমরা কিধরনের ব্যক্তি হব তা নির্ধারণ করতে পারে—যেমন আমাদের ব্যক্তিগত গুণগুলি এবং আমাদের আচরণ। তারা হয়ত বিশ্বাস এবং আচরণকে দুটি পৃথক বস্তু হিসাবে দেখে, ঠিক যেমন একটি জ্যাকেট ও প্যান্ট যা একসাথেও অথবা আলাদাভাবে পরা যায় নির্ভর করে যে পড়ছে তার ইচ্ছার উপর। কিন্তু, বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে বিশ্বাস ও আচরণকে একটা সুটের সাথে তুলনা করা যেতে পারে যা কেবলমাত্র একসাথেই পড়তে হয়।
আমরা কী বিশ্বাস করি এবং আমরা কিধরনের ব্যক্তি হয়ে উঠি সরাসরিভাবে সম্পর্কযুক্ত এই দুটি বিষয়কে বাইবেল প্রকাশ করে। যীশুর দিনের আত্ম-ধার্মিক ফরীশীরা ভ্রান্ত বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত আচরণের এক উদাহরণ ছিল। (মথি ২৩:১-৩৩; লূক ১৮:৯-১৪) অন্যদিকে, কলসীয় ৩:১০ পদ উপদেশ দেয়: “সেই নূতন মনুষ্যকে পরিধান করিয়াছ, যে আপন সৃষ্টিকর্ত্তার প্রতিমূর্ত্তি অনুসারে তত্ত্বজ্ঞানের [যথার্থ জ্ঞানের, NW] নিমিত্ত নূতনীকৃত হইতেছে।” লক্ষ্য করুন যে দুটি পদেই ঈশ্বরীয় জীবন ধারন করার শক্তির সাথে ঈশ্বরের যথার্থ জ্ঞানের যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে।
যে গ্রীক শব্দটি ‘যথার্থ জ্ঞান’ হিসাবে অনুবাদ করা হয়েছে, যেটি খ্রীষ্টীয় গ্রীক শাস্ত্রে ২০ বার পাওয়া যায়, এটির অর্থ হল আসল, সঠিক অথবা সম্পূর্ণ জ্ঞান। গ্রীক পন্ডিত ন্যাথানিয়েল কালভারওয়েল এটিকে এইভাবে বর্ণনা করেন যে “আমার আগে দেখা কোন জিনিসকে আরও ভালভাবে দেখতে পাওয়া; পূর্বে বহুদূর থেকে দেখা কোন বস্তুকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা।” সুতরাং একজন জহূরী যেভাবে মূল্যবান পাথরগুলিকে পরীক্ষা করে তার গুণ ও মূল্যায়ন করার জন্য, ঠিক সেইভাবে একজন খ্রীষ্টানের উচিত ঈশ্বরের বাক্যকে পরীক্ষা করা যাতে করে যে ঈশ্বরের পরিচর্যা সে করছে তাঁর সম্বন্ধে আসল, সঠিক এবং সম্পূর্ণ জ্ঞান যেন সে পেতে পারে। এর অন্তর্ভুক্ত হল ঈশ্বরের ব্যক্তিত্বকে, তাঁর উদ্দেশ্যগুলি এবং তাঁর মানগুলি আর সেই সমস্ত শিক্ষাগুলি যা “নিরাময় বাক্য সমূহের” গঠন করে সেগুলিকে জানা—এটি সেই সব ব্যক্তির থেকে অনেক আলাদা যে কেবল বিশ্বাস করে যে ‘উপরে কেউ আছে।’—২ তীমথিয় ১:১৩.
উদাহরণস্বরূপ, যে সব ব্যক্তি ঈশ্বরকে দূর থেকে জানে, এর ফলে যে পরিণাম আসে তা রোমীয়দের উদ্দেশ্যে লেখা অনুপ্রাণিত চিঠির প্রথম অধ্যায়ে পাওয়া যায়। সেখানে কিছু ব্যক্তির বিষয় বলা হয়েছে যারা, “ঈশ্বরকে জ্ঞাত হইয়াও, . . . ঈশ্বরকে আপনাদের জ্ঞানে ধারণ করিতে সম্মত হয় নাই।” তাদের ভ্রান্তি বিশ্বাসের পরিণতি সম্বন্ধে প্রেরিত পৌল বিবরণ দেন: “তেমনি ঈশ্বর তাহাদিগকে অনুচিত ক্রিয়া করিতে ভ্রষ্ট মতিতে সমর্পণ করিলেন। তাহারা সর্ব্বপ্রকার অধার্ম্মিকতা, দুষ্টতা, লোভ ও হিংসাতে পরিপূরিত, মাৎসর্য্য, বধ, বিবাদ, ছল ও দুর্বৃত্তিতে পূর্ণ; কর্ণেজপ, পরীবাদক, ঈশ্বর-ঘৃণিত, দুর্বিনীত, উদ্ধত, আত্মশ্লাঘী, মন্দ বিষয়ের উৎপাদক, পিতামাতার অনাজ্ঞাবহ, নির্ব্বোধ, নিয়ম-ভঙ্গকারী, স্নেহ-রহিত, নির্দ্দয়।”—রোমীয় ১:২১, ২৮-৩১.
এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ওই ধরনের লোকেরা যা বিশ্বাস করত তা তাদের খ্রীষ্টীয় জীবন ধারনের ক্ষেত্রকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিল। ঠিক তেমনি আজকের দিনে, বিশ্বাস ও আচরণ এইধরনের পোশাকের তুল্য, যাদের কখনও আলাদা করা যায় না। সুতরাং, এটা গুরুত্বপূর্ণ যে যারা ঈশ্বরের অনুমোদন পেতে চায় তাদের অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে ধর্মের দিক থেকে তারা যা বিশ্বাস করে তা প্রকৃতই সত্য এবং ঈশ্বরের বাক্য ভিত্তিক। কারণ “[ঈশ্বরের] ইচ্ছা এই যেন সমুদয় মনুষ্য পরিত্রাণ পায়, ও সত্যের তত্ত্বজ্ঞান পর্য্যন্ত পঁহুছিতে পারে।” (g95 7/8)
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
ফরীশীর আত্ম-ধার্মিকতা তার বিশ্বাসগুলিকে প্রতিফলিত করত