মানচিত্র—আপনার প্রয়োজন মেটাতে
ব্রিটেনের সচেতন থাক! প্রতিনিধি কর্তৃক
অপরিচিত পল্লীগ্রাম বা শহরে পথ খুঁজে পাওয়া আপনার পক্ষে এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রথমে, আপনাকে নিজের স্থিতি সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে। এরপর আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কোন্টা হচ্ছে সবচাইতে উত্তম পথ। কিভাবে আপনি তা খুঁজে পাবেন? আপনার যা প্রয়োজন তা হল একটা মানচিত্র!
মানচিত্র—কবে থেকে এবং কেন?
মানচিত্র তৈরি, অথবা যাকে কার্টোগ্রাফি বলা হয়, এর এক দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাস আছে। কিছু বিশেষজ্ঞেরা এই মানচিত্র তৈরি করার ব্যাপারটিকে ৪,৩০০ বছর পুরনো বলে মনে করে যা বাবিলনের মাটির ফলকে খোদাই করা আছে। কিন্তু প্রাচীন গ্রীকদেশীয় লোকেরাই চার্ট তৈরি করে যা আধুনিক মানচিত্রের এক অগ্রদূত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সা.শ. দ্বিতীয় শতাব্দীতে ক্লডিয়াস টলেমি কর্তৃক প্রাচীন পৃথিবীর মানচিত্রাঙ্কনের পর, কার্টোগ্রাফি এক অন্ধকার যুগের মধ্যে তলিয়ে যায়। অনাবিষ্কৃত স্থানগুলিকে দৈত্য ও দানবের এলাকা বলে দেখানো হয়। মানচিত্র তৈরির উপর ধর্ম এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে অনেকে মনে করত এই পৃথিবী এদনোদ্যানের দ্বারা পরিচালিত। সেই সময়কার পরিচিত পৃথিবীর মানচিত্রের মধ্যে যিরূশালেম ও মধ্যপ্রাচ্য সবচাইতে উপরে দৃশ্যমান হয়।
ব্রিটেনের প্রাচীন মানচিত্রগুলির মধ্যেও গির্জার প্রভাব দেখা যায়। এগুলির মধ্যে একটি মানচিত্র সেই রাস্তাটিকে পর্যন্ত দেখায় যা তীর্থযাত্রীরা ইংল্যান্ডের ধর্মীয় উপাসনালয়ে যাওয়া জন্য ব্যবহার করে থাকে। “তীর্থযাত্রীদের এই মহান উত্তরের পথ” সম্বন্ধে নিখুঁত তথ্য দিতে গিয়ে, এই মানচিত্রটিতে উত্তরের ডুরহাম শহরটির থেকে শুরু করে দক্ষিণে অবস্থিত ডোভারের উপকূলবর্তী বন্দরের রাস্তাটি দেখানো হয়।
আধুনিক কার্টোগ্রাফির জনক হলেন গেরারডুস মারকেটার (১৫১২-৯৪)। তিনি এমন এক ধরনের মানচিত্রের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যার সঠিকতার জন্য এটি দিক নির্দেশক কৌশলকারীদের কাছে খুবই সুবিখ্যাত হয়ে ওঠে আর মারকেটারের এই উদ্ভাবন প্রণালী অনুসারে অনেক মানচিত্র আঁকা হয়েছে যা আধুনিক অ্যাটলাসগুলির মধ্যেও পাওয়া যায়।
জমির মালিকদের কাছে, মানচিত্র এক আশীর্বাদস্বরূপ। স্পষ্টভাবে আঁকা সীমানা রেখাগুলি তাদের সাহায্য করেছে আইনগত বিতর্কগুলির সমাধান করতে। মানচিত্রের প্রতি সরকারের আগ্রহও বাড়তে থাকে, যেহেতু জমি দখলের সঠিক হিসাবের উপর নির্ভর করে কর নির্ধারণ করার বিষয়টি।
আজকাল, মানচিত্রগুলি দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনকে মিটিয়ে চলেছে। অ্যাটলাসগুলি স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাহায্য করছে ভূগোলের প্রাথমিক বিষয়টিকে আয়ত্বে আনতে। কিধরনের আবহাওয়া আমরা আশা করতে পারি এই বিষয়ে চার্টগুলি আবহাওয়ার পূর্বাভাস যারা দিয়ে থাকে তাদের সাহায্য করেছে স্পষ্টভাবে তা ব্যক্ত করতে। সাধারণ পরিবহণকে সবচাইতে উত্তমরূপে ব্যবহার করতেও মানচিত্র আমাদের সাহায্য করতে পারে। আর পারিবারিক ভ্রমণের ক্ষেত্রেও, মানচিত্র আমাদের দেখাতে পারে যে সবচাইতে দৃশ্যবহুল পথটি কোথায় অবস্থিত।
বিশেষজ্ঞেরাও উপেক্ষিত হয়নি। শহর পরিকল্পনাকারীদের জন্য আছে জনসংখ্যার ঘনত্ব নির্ধারণ করার মানচিত্রগুলি। ভেঙে যাওয়া জাহাজ অথবা খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানকারীদের সাহায্য করার জন্য আছে সমুদ্রের মানচিত্রগুলি। অতীতকে খুঁজে বার করার জন্য যারা খনন কাজের সাথে লিপ্ত, তাদের সাহায্য করার জন্য রয়েছে ভূ-তত্ত্ব সম্বন্ধীয় মানচিত্রগুলি। এমনকি মহাকাশে যারা গবেষণা করে তাদের জন্যও আছে চাঁদ ও অন্যান্য নক্ষত্রের মানচিত্রগুলি! এই মানচিত্রগুলির মধ্যে অঢেল তথ্য থাকার দরুন, এটা আপনারই পক্ষে ভাল হবে যদি আপনি এটিকে পড়ার কৌশলতা গড়ে তুলতে ও উন্নতি করতে পারেন।
কিভাবে মানচিত্র পড়তে হয়
মানচিত্রের থেকে সবচাইতে উপকার পাওয়ার মানে হল একটি বিদেশী ভাষা শেখা। আরেকটি ভাষা শেখার সময়, আপনি নতুন শব্দ ও অন্য ধরনের ব্যাকরণের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। মানচিত্রমূলক ভাষার ক্ষেত্রে, চিহ্নগুলিকে শব্দের মত আর স্কেল ও গ্রিডকে ব্যাকরণের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানচিত্র আঁকার সময় একটি বাক্সের ব্যবহার করা হয় যার মধ্যে থাকে মানচিত্রে উল্লেখিত চিহ্নগুলির প্রধান নীতি নিয়ম। এটি একটি অভিধানের কাজ করে যা চিহ্নগুলির মানে দেখিয়ে দেয়।
চিহ্নগুলির অর্থকে সঠিকভাবে প্রকাশ করার জন্য এগুলিকে সাবধানতার সাথে বেছে নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি বাতিঘরকে শনাক্ত করার জন্য, এর সাথে সামঞ্জস্য রাখে এমন একটি যথার্থ চিহ্ন বেছে নিন। গির্জা এবং মসজিদগুলি হয়ত ক্রশ অথবা অর্ধচন্দ্র বিশিষ্ট কালো চৌক অথবা গোলাকার কোন চিহ্নের দ্বারা চিত্রিত হতে পারে।
এই চিহ্নগুলির অর্থের সাথে আপনি কিভাবে পরিচিত হতে পারেন? ফলো দ্যা ম্যাপ, নামক বইটির লেখক জন উইলসন “অবসর সময় উত্তমভাবে কাটানোর জন্য ‘মানচিত্রের উপর চোখ বোলানো’”, এই প্রস্তাবটি দেন। তিনি আরও বলেন: “হালকাভাবে মানচিত্রের উপর আপনার চোখ বুলিয়ে যান আর চিহ্নগুলি যখন আপনার সামনে আসবে তখন তার মানে চিন্তা করার চেষ্টা করুন।”
আপনার মানচিত্র যা দেখায় তার তুলনায় আপনি কি মনে করেন যে আপনার এলাকার দৃশ্য বেশ অন্যরকম? এটা কেন হয়? সাধারণত, আমরা আমাদের পরিবেশকে আমাদের নিজস্ব উচ্চতা অনুসারে দেখে থাকি, যা ভূমি থেকে ১.৫ থেকে ১.৮ মিটার উঁচু। কিন্তু মানচিত্রতে প্রত্যেকটি জায়গা দেখা হয় ঠিক তার উপরে, অনেক উঁচু থেকে। এই ধারণাটি আয়ত্ব করার জন্য, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে আপনি মানচিত্রের ব্যাকরণটি বোঝেন।
স্কেল, উচ্চতা ও অবস্থান
মানচিত্র নির্মাতাদের চ্যালেঞ্জ হল সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরস্থ ও স্থলের উপর যে কোন মনুষ্যনির্মিত বস্তুর পরিমাপরেখার রকমভেদের হিসাব রাখা। আর এই সমস্ত ছাপতে হবে এমন একটি কাগজে যা সহজে ব্যবহার করা যায়। এটা সম্পাদন করার জন্য, মানচিত্রগুলিকে স্কেলের ভিত্তিতে আঁকা হয়। একটি প্রচলিত ব্রিটিশ মানচিত্র শ্রেণী দেখায় যে মফস্বল শহরকে ১:৫০,০০০ পরিমাপরেখায় দেখানো হয়েছে—যার অর্থ হল মানচিত্রের মধ্যে উল্লেখিত প্রতিটি সেন্টিমিটার হল পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশের ৫০,০০০ সেন্টিমিটারের তুল্য।
তাহলে, কিভাবে একটি সমতল মানচিত্র উচ্চতার রকমভেদ দেখাতে পারে? দৈর্ঘ প্রস্থের গভীরতাকে প্রকাশ করার জন্য তির্যক বক্ররেখার অঙ্কন ব্যবহার একটি সাহায্যকারী বস্তু হতে পারে। সূর্যোদয় দেখা যায় মানচিত্রের উপরে ঠিক বাঁ-ধারের কোণে। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের ঢালু অঞ্চলগুলিকে অপেক্ষাকৃত গাঢ় রঙের মাধ্যমে দেখানো হয়। আধুনিক মানচিত্রগুলিতে প্রায়ই সমোন্নতি রেখা দেখা যায় যা সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতার পরিচয় দেয়। হালকা রঙে এই চিহ্নগুলি ছাপানোর ফলে মানচিত্রের অন্যান্য দিকগুলি বিঘ্নিত হয় না
আপনার অবস্থানকে পরিষ্কারভাবে বোঝানোর জন্য অনেক মানচিত্র আড়াআড়িভাবে বিভিন্ন রেখার পদ্ধতি ব্যবহার করে। এটি, যাকে গ্রিড বলা হয় সেটি আক্ষরিক বা সংখ্যাসূচকভাবে যে কোন অবস্থানেরই ইঙ্গিত করুক না কেন, সেটি সেই গ্রিড রেখার মধ্যেই পাওয়া যাবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি শহর হয়ত জি-১৩-এ অবস্থিত অর্থাৎ উল্লম্ব দিকে জি আর দিগন্ত দিকে ১৩ সংখ্যা। যেখানে এই দুটিকে আপনি এক সাথে দেখবেন সেখানেই আপনি সেই শহরটিকে খুঁজে পাবেন। কিন্তু কিভাবে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে আপনার মানচিত্র আপনাকে সঠিক ছবিটি দেখাচ্ছে?
কম্পিউটারের যুগে মানচিত্র
সামরিক চাহিদার ফলে একদম সঠিক এমন অনেক মানচিত্রের প্রকাশন ঘটেছে। গত ৪০ বছর ধরে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিমাপের জন্য এরিয়েল ফোটোগ্রাফের মাধ্যমে স্টিরিওস্কপিক তুলনার ব্যবহার বাস্তবায়িত হয়েছে আর বহু দেশ এই প্রকল্পের ব্যবহার করছে।
ইতিমধ্যেই, কয়েকটি গাড়ির মধ্যে কম্পিউটার চালিত মানচিত্রের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, এমনকি ঘরের কম্পিউটারের সাহায্যেও ভ্রমণ মানচিত্রের খুঁটিনাটি তথ্য পাওয়া সম্ভবপর হচ্ছে। “মাইক্রোচিপস চালকের ভূমিকা নিয়েছে,” এই শিরোনামটি দি অবসারভার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রিপোর্টি একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্পের ব্যাখ্যা দেয় যেখানে স্পিচ সিন্থেসাইজারের সাথে যুক্ত মানচিত্রের তথ্যের সঙ্গে কম্পিউটার ডিস্কের ব্যবহার করা হয়েছে। ড্রাইভার তার গন্তব্যস্থান সম্পর্কে কম্পিউটারের পর্দায় ভাসমান মানচিত্রে কয়েকটি অক্ষর টাইপ করতে হবে। বিভ্রান্তিকর রাস্তার মোড়গুলি সম্পর্কে চিন্তা করার আর কোন প্রয়োজন নেই! কেন? কারণ যতবার গাড়িটি এক একটি মোড়ে এসে পৌঁছাবে, কণ্ঠস্বরটি ড্রাইভারকে কোন্ দিক নিতে হবে তা বলে দেবে। কম্পাস ও গাড়ির চাকায় সেন্সর পথকে পরিচালনা করে। সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলি আরও বেশি নির্ভরযোগ্য ও সহজ।
এটি ভবিষ্যতের মানচিত্র সম্বন্ধে কী অর্থ রাখে? কাগজের মানচিত্রগুলি কি সংগ্রহশালার এক সামগ্রী হয়ে দাঁড়াবে? সময়ই এর উত্তর দেবে। কিন্তু যে কোন ক্ষেত্রেই হোক না কেন আপনার ভ্রমণের জন্য এই মানচিত্র সবসময়ই এক কার্যকারী বস্তু হিসাবে থেকে যাবে।
[২২ পৃষ্ঠার মানচিত্র/চিত্র]
বহু মানচিত্রের মধ্যে চিহ্নের পরিভাষা দেওয়ার জন্য চাবি অথবা আখ্যানের ব্যবহার করা হয়েছে
উচ্চতার রকমভেদ দেখানোর জন্য সাধারণত হাল্কা রঙের সাহায্যে বর্ণালী রেখা দেখানো হয়েছে
গ্রিড পদ্ধতি মানচিত্রের মধ্যেই স্থানটিকে শনাক্ত করতে সাহায্য করে
সাধারণত মানচিত্র দেখিয়ে থাকে যে এক ইঞ্চি বা এক সেন্টিমিটার, পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশের কতটা সমতুল্য (এখানে দেখানো হয়নি)
মাইল অথবা কিলোমিটারের স্কেল দুটি স্থানের দূরত্ব মাপতে আপনাকে সাহায্য করে
[সৌজন্যে]
Crown Copyright Reserved
[২১ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্য]
From the book Die Heiligkeit der Gesellschaft Jesu