বাস্তবতা আমার কল্পনাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে
উইলিয়াম ভ্যান স্যায়েল দ্বারা কথিত
সেই ১৯৪২ সালের কথা যখন আমাদের দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। আমরা পাঁচজন যুবক নেদারল্যান্ডের গ্রোনিনজেন শহরে নাৎসীদের কাছ থেকে গা ঢাকা দিয়েছিলাম। একটা ছোট্ট কামরায় বসে আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু তা-ই নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম।
আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম যে আমাদের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। আর শেষ পর্যন্ত আমাদের অনুমানই ঠিক হয়েছিল, আমাদের পাঁচ জনের মধ্যে তিনজনকে খুব নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল। সত্যি বলতে কী শুধু আমিই এই বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেঁচে আছি। বাস্তব আমার কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এটা ছিল মাত্র একটা উদাহরণ।
ওপরে বলা এই ঘটনাটা সেইসময়ে ঘটেছিল যখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর আর যখন আমি বাইবেল কিংবা ধর্ম সম্বন্ধে বেশি কিছু জানতাম না। আসলে, আমার বাবা ধর্মের নাম পর্যন্ত শুনতে পারতেন না। মা একটা ধর্ম খুঁজে বেড়াতেন আর তাই শেষ পর্যন্ত তিনি প্রেতচর্চা শুরু করেন। আর আমার কথা কী আর বলব, আমার কোন আশাই ছিল না। আমি ভাবতাম যে আমি যদি বোমা হামলায় বা অন্য কোনভাবে মারা যাই, তবে আমাকে মনে রাখার মতো কোন কারণই ঈশ্বরের নেই। এমনকি তাঁর সম্বন্ধে জানার কোনরকম চেষ্টাও আমি করিনি।
অনুসন্ধান সফল হয়েছিল
সেই চারজন যুবকের সঙ্গে কথা বলার অল্প সময় পরেই আমি নাৎসীদের হাতে ধরা পড়ি এবং আমাকে ইমেরিকের কাছাকাছি জার্মানির বন্দি শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। ইট পাথরের টুকরো পরিষ্কার করা এবং মিত্রবাহিনীর বোমা হামলার পর ভাঙাচোরা মেরামত করাই ছিল আমাদের কাজ। ১৯৪৩ সালের শেষ দিকে আমি শিবির থেকে পালাই এবং তুমুল যুদ্ধের মধ্যেও কোনরকমে নেদারল্যান্ডে ফিরে আসি।
একদিন কোনভাবে একটা ছোট্ট পুস্তিকা আমার হাতে আসে যেটা অনেক প্রশ্ন এবং বাইবেলের পদে ভরা ছিল। এটা যিহোবার সাক্ষিদের প্রকাশিত পরিত্রাণ (ইংরেজি) বই অধ্যয়নের জন্য ব্যবহার করা হতো। যখন আমি এই প্রশ্নগুলো পড়ি ও সেইসঙ্গে বাইবেলের পদগুলো মিলিয়ে দেখি, আমি বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণতা সম্বন্ধে জানার জন্য ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠি।
আমি যা-ই পড়তাম সেই বিষয়ে আমার বাগদত্তা ক্রের সঙ্গে কথা বলতাম, প্রথম দিকে সে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু এদিকে ওই পুস্তিকাটাই যেন আমার মায়ের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠেছিল। আমার মা এত খুশি হয়েছিলেন যে বলার নয়, তিনি বিস্ময়ে বলে উঠেছিলেন: “এটাই সেই সত্য যা আমি সারা জীবন ধরে খুঁজেছি!” আমিও যা শিখছিলাম তা বন্ধুদের কাছে বলতাম আর তাদের কেউ কেউ আরও জানতে চাইত। শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে একজন সাক্ষিও হয়েছিল। আমরা একজন আরেকজনকে চিঠি লিখতাম ও মাঝে মধ্যে দেখা করতেও যেতাম আর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আমরা যোগাযোগ রেখেছিলাম যতদিন পর্যন্ত না মৃত্যু আমাদের আলাদা করে দিয়েছিল।
এরই মধ্যে, ক্রে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিল এবং ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা দুজনে একসঙ্গে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। এর কয়েক মাস পরেই যুদ্ধ থেমে যায়। বিয়ের পর আমরা অগ্রগামী হতে চেয়েছিলাম, যিহোবার সাক্ষিদের পূর্ণ-সময়ের সেবকদের যে নামে ডাকা হয়। কিন্তু আমাদের সামনে অনেক সমস্যা ছিল, বিশেষ করে অসুস্থতা ও টাকাপয়সার সমস্যা। তাছাড়া, অনেক টাকা রোজগার করার সুযোগও আমাদের এসেছিল। আমরা কি প্রথমে কিছু টাকাপয়সা করে নেব আর তারপরে অগ্রগামীর কাজ শুরু করব নাকি তখনই শুরু করে দেব?
নেদারল্যান্ডে আমাদের পরিচর্যা
আমরা তখনই অগ্রগামীর কাজ শুরু করব বলে ঠিক করি আর ১৯৪৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে তা শুরু করি। সেই দিনই একটু বেশি রাতে ঘরে ফেরার পথে আমি কিছু পান করার জন্য একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকি। আমি বেয়ারাকে এক গুল্ডেন মনে করে একটা নোট দিয়েছিলাম এবং তাকে বলেছিলাম: “খুচরো পয়সা রেখে দিও।” ঘরে ফিরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি তাকে ১০০ গুল্ডেনের নোট দিয়ে ফেলেছি! এই ভুলের জন্য আমাদের মাত্র এক গুল্ডেন নিয়ে অগ্রগামীর কাজ শুরু করতে হয়েছিল!
১৯৪৬ সালে আমি যখন লোকেদের সামনে বক্তৃতা দিতে শুরু করি, তখন আমার শুধু একটা চামড়ার জ্যাকেট ছিল। আমার এক বন্ধু যার শরীরের গড়ন কিছুটা আমার মতোই ছিল, সে বক্তৃতার সভাপতি হতো। বক্তৃতার বিষয়বস্তু বলেই সে তাড়াতাড়ি মঞ্চের পিছনে চলে আসত এবং আমাকে তার কোটটা দিত। তারপর সেটা পরে আমি বক্তৃতা দিতাম। বক্তৃতা শেষ হয়ে গেলেই আমি তাড়াতাড়ি এসে কোটটা আবার তাকে দিয়ে দিতাম!
১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে, ক্রে এবং আমি সীমার কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ পাই। আমরা যিহোবার সাক্ষিদের মণ্ডলীগুলোকে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য পরিদর্শন করতাম। ফ্রিটস্ হার্টস্টেং আমাকে সীমার কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, যিনি যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধ চলাকালে যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি আমাকে খুব ভাল এক উপদেশ দিয়েছিলেন: “উইম, যিহোবার সংগঠন থেকে তুমি যে শিক্ষাগুলো পাও তা মেনে চলবে, এমনকি যদি প্রথম প্রথম তোমার সেগুলোকে সবচেয়ে ভাল বলে মনে নাও হয়। আর যদি তুমি তা করো, তুমি কখনও পস্তাবে না।” তিনি ঠিক কথাই বলেছিলেন।
১৯৫১ সালে ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটির তখনকার প্রেসিডেন্ট নেথেন এইচ. নর নেদারল্যান্ডে আসেন। তখন ক্রে ও আমি যুক্তরাষ্ট্রে মিশনারি প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আবেদন করি। কিছু দিন পরেই আমাদের ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডের ২১তম ক্লাশে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। ১৯৪৫ সালে আমরা যখন অগ্রগামীর কাজ শুরু করি, তখন নেদারল্যান্ডে প্রায় ২,০০০ জন সাক্ষি ছিলেন কিন্তু ১৯৫৩ সালের মধ্যে তা বেড়ে ৭,০০০ জনে দাঁড়ায়, এক বাস্তবতা যা আমাদের কল্পনাকে অনেক দূর পর্যন্ত ছাড়িয়ে গিয়েছিল!
নতুন দেশে পরিচর্যা
ট্রেনিংয়ের পর আমাদের ডাচ নিউ গিনিয়ায় পাঠানো হয়, যেটা এখন ইন্দোনেশিয়ার একটা এলাকা কিন্তু আমরা যখন সেখানে ঢোকার অনুমতি পাইনি, তখন আমাদের সুরিনামে পাঠানো হয়। এটা ছিল দক্ষিণ আমেরিকার একটা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে আমরা সেখানে পৌঁছাই। সুরিনামে তখন মাত্র একশ জনের মতো সাক্ষি ছিলেন কিন্তু তারা আমাদের খুবই সাহায্য করেছিলেন। আমরা বুঝতেই পারিনি যে আমরা বিদেশে আছি।
এটা ঠিক যে আমাদের নানা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছিল আর কখনও কখনও তা করা কিছুটা কঠিনও ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ক্রে সবরকমের পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গকে ভয় করত। আমরা যখন নেদারল্যান্ডে ছিলাম, সেইসময় একবার আমাদের শোয়ার ঘরে সে একটা ছোট মাকড়সা দেখেছিল, আমি সেটাকে না মারা পর্যন্ত সে ঘুমাতে যেতে পারেনি। কিন্তু সুরিনামের মাকড়সাগুলো নেদারল্যান্ডের মাকড়সার চেয়ে দশ গুণ বড় ছিল আর এগুলোর কয়েকটা বিষাক্তও ছিল! এছাড়াও আমাদের মিশনারি হোমে তেলাপোকা, ইঁদুর, পিঁপড়ে, মশা ও ফড়িংরাও এসে বাসা বেঁধেছিল। এমনকি সাপেরাও মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসত। ক্রে এই প্রাণীগুলোকে দেখে দেখে এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে এগুলোর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করা তার রোজকার কাজ হয়ে উঠেছিল।
৪৩ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা এই দেশকে এত ভালভাবে জেনেছি যা কিনা এখানে জন্মেছে এমন অনেকে জানে না। আমাদের কাছে এর নদীনালা, বৃষ্টিবহুল অরণ্য এবং উপকূলের জলোচ্ছ্বাস সবকিছুই ভীষণ ভাল লাগার জিনিস। আমরা এখানকার অনেক জন্তুদের চিনি যেমন শজারু, স্লথ, জাগোয়ার আর এমনকি সুন্দর সুন্দর রঙের বিভিন্ন জাতের সাপ। কিন্তু আমরা বিশেষ করে এখানকার বিভিন্ন ধরনের লোকেদের দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিছু কিছু লোকেদের পূর্বপুরুষেরা ভারত, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকা, চিন এবং অন্যান্য দেশ থেকে এসেছিল। আবার কিছু লোকেরা আমেরিকার আদিবাসী, যাদের পূর্বপুরুষেরা এখানকার মূল বাসিন্দা।
আমাদের প্রচার কাজের সময় আমরা যখন ঘরে ঘরে যেতাম তখন এই বিভিন্ন জাতির লোকেদের দেখা পেতাম। কিংডম হলেও আমরা বিভিন্ন জাতি থেকে আসা আমাদের খ্রীষ্টান ভাইবোনদের সঙ্গে মেলামেশা করে আনন্দ পাই। ১৯৫৩ সালে আমাদের মাত্র একটা ভাঙাচোরা কিংডম হল ছিল কিন্তু আজ সেখানে সুন্দর সুন্দর ৩০টা কিংডম হল এবং একটা চমৎকার সম্মেলন হল আছে আর খুব সুন্দর একটা শাখা অফিসও সেখানে আছে যেটা ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উৎসর্গ করা হয়েছে।
আমি যা যা শিখেছি
সুরিনামের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশ কিছু মণ্ডলী আছে যেখানে বুশ নিগ্রো বলে পরিচিত লোকেরা আছেন, যাদের পূর্বপুরুষেরা আফ্রিকার দাস ছিলেন আর যারা বিদেশি প্রভুদের কাছ থেকে পালিয়ে নদীগুলোর উৎসের কাছাকাছি এসে বাস করতে শুরু করেছিলেন। তাদের কাজকর্ম দেখে আমি বারবার অবাক হয়েছি যেমন, তারা কীভাবে যাতায়াতের জন্য নদীকেই ব্যবহার করে এবং বৃষ্টিবহুল অরণ্যকে কত সহজে তারা তাদের বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে। তারা গাছ কেটে নৌকা বানিয়ে সেগুলোকে ঝরনা ও খরস্রোতা নদীর মধ্যে দিয়ে চালায়। তারা শিকার করে ও মাছ ধরে তাদের খাদ্য জুটিয়ে থাকে, কোনরকম আধুনিক সরঞ্জাম ছাড়াই রান্না করে, এছাড়া আরও অনেক কিছু করে যা আমাদের কাছে খুবই কঠিন বলে মনে হবে।
আমরা সুরিনামে এত বছর ধরে থাকায় এখানকার অন্যান্য লোকেদের, তাদের রীতি-রেওয়াজ, চিন্তাভাবনা ও জীবনযাত্রা সম্বন্ধে জেনেছি। ১৯৫০ দশকে একবার আমেরিকার আদিবাসীদের একটা গ্রামে যাওয়ার ঘটনা আমার মনে আছে। মাঝ রাতে, আমি জঙ্গলের একটা নির্জন ক্যাম্পে পৌঁছাই যেখান থেকে আমার ও আমার আদিবাসী গাইডের নৌকাতে করে যাত্রা শুরু করার কথা ছিল। তিনি আগুন ধরিয়েছিলেন, রান্না করেছিলেন, বিছানা টাঙিয়েছিলেন। আমার সব কাজও করে দেওয়া তার কাছে খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল কারণ তিনি জানতেন যে আমি এই কাজগুলো করতে পারব না।
মাঝ রাতে আমি যখন আমার বিছানা ছিঁড়ে পড়ে যাই, তখন তিনি একটুও হাসেননি। বরং, তিনি আমার কাপড়ের ধুলো ঝেড়ে দিয়েছিলেন আর আবার আমার বিছানা টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা যখন একটা সরু নদী দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন চারিদিকে এত ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল যে আমি আমার হাতও দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু আমার গাইড খুব সহজেই প্রতিটা বাঁক ও বাধা পেরিয়ে নৌকা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কীভাবে তিনি তা করছেন, তিনি বলেছিলেন: “আপনি ভুল জায়গায় দেখছেন। ওপরের দিকে তাকান এবং গাছের আগা ও আকাশের মধ্যে যে ফাঁক আছে তা দেখুন। এটা আপনাকে নদীর বাঁক দেখাবে। নিচের দিকে তাকান এবং ছোট ছোট ঢেউগুলো মন দিয়ে দেখুন। এগুলো আপনাকে বলে দেবে যে সামনে কোথায় পাথর বা অন্য কোন বাধা আছে। আর কান পেতে শুনুন। সামনে কী আছে না আছে শব্দও তা বলে দেয়।”
গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি নৌকায় চড়ে আঁকাবাঁকা নদীতে চলা এবং ঝরনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া বিপদজনক ও খুবই পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু যাত্রা শেষে যখন আমরা ঠিকমতো পৌঁছে গিয়ে দেখি যে আমাদের খ্রীষ্টান ভাইবোনেরা আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষা করে আছেন, তখন আমাদের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। তারা সবসময়ই অতিথিদের জন্য খাবার নিয়ে তৈরি থাকেন, কিছু না হলেও অন্তত এক বাটি সুপ থাকবেই। মিশনারি জীবন প্রায়ই অসুবিধা ও কঠিন পরিস্থিতিতে ভরা কিন্তু কখনই তা আমাদের হতাশ করে না।
লেগে থাকতে যা আমাদের সাহায্য করেছে
আমাদের স্বাস্থ্য খুব ভাল ছিল না। আর আমাদের আত্মীয়দের কাছ থেকেও আমরা খুব একটা উৎসাহ কখনও পাইনি কারণ শুধু আমার মা-ই একা সাক্ষি ছিলেন। কিন্তু আমাদের প্রিয় বন্ধুরা সবসময়ই আমাদের চাহিদাগুলোর দিকে নজর রেখেছেন ও কাজে লেগে থাকতে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে মা আমাদের অনেক উৎসাহ দিতেন।
আমরা এখানে আসার ছয় বছর পর মা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। বন্ধুরা মাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য আমাদের আসতে বলেছিলেন কিন্তু মা লিখেছিলেন: “দয়া করে তোমরা তোমাদের কাজ চালিয়ে যাও। মনে কর অসুখ হওয়ার আগে আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি। আমি পুনরুত্থানে তোমাদেরকে দেখার আশা রাখি।” তার বিশ্বাস খুবই দৃঢ় ছিল।
১৯৬৬ সালের আগে ছুটি কাটানোর জন্য আমাদের নেদারল্যান্ডে ফেরা হয়ে ওঠেনি। যদিও পুরনো বন্ধুদের দেখে আমরা খুবই খুশি হয়েছিলাম কিন্তু মন বলছিল যে সুরিনামই এখন আমাদের বাড়ি। সেইসময় আমরা সংগঠনের পরামর্শের পিছনে যে প্রজ্ঞা আছে তা দেখতে পেয়েছিলাম আর এই পরামর্শটা হল যে মিশনারিরা তাদের নতুন জায়গায় কম পক্ষে তিন বছর সেবা না করে ছুটি কাটানোর জন্য নিজেদের দেশে যেতে পারবে না।
আরেকটা জিনিস আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল আর তা ছিল রসিক হওয়া অর্থাৎ অন্যকে হাসাতে পারা ও কখনও কখনও নিজেদের নিয়েও হাসা। যিহোবা এমনকি কিছু জীবজন্তুর মধ্যেও হাসানোর ক্ষমতা দিয়েছেন। আপনি যখন শিম্পাঞ্জি ও ভোঁদর এবং বিশেষ করে অন্যান্য পশুপাখির ছানাদের অদ্ভুত কাজ-কারবার দেখেন, তখন আপনার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এছাড়াও সব জিনিসের ভাল দিকগুলো দেখা এবং নিজেদের বড় মনে না করাও খুব জরুরি আর এইসব আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে শিখেছি।
পরিচর্যায় আমরা যে পুরস্কার পেয়েছি তা বিশেষ করে আমাদের কাজে লেগে থাকতে সাহায্য করেছিল। ক্রে প্যারামারিবোতে বৃদ্ধদের একটা আশ্রমে নয়জন লোকের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিল। তাদের বয়স আশির ওপরে ছিল। তারা প্রত্যেকে হয় বালাটেবলেডার (রাবার গাছের আঠা সংগ্রহকারী) নতুবা সোনার খনিতে কাজ করতেন। তারা সকলেই যা শিখেছিলেন তা ভালবেসেছিলেন, বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন এবং তাদের মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে প্রচার কাজ করেছিলেন।
সুইডেনবোর্গের নিউ চার্চের এক সদস্য রিভার্স নামে একজন বৃদ্ধ প্রচারক, আমাদের অধ্যয়নের সময় এসে শুনতেন এবং ঠাট্টা করতেন। কিন্তু প্রতি সপ্তাহেই তিনি আরেকটু কাছে এসে বসতেন আর তার ঠাট্টাও আস্তে আস্তে কমে যায়। একসময় তিনিও অন্যদের সঙ্গে এসে বসতেন ও উত্তর দিতেন। সেইসময় তার বয়স ছিল ৯২ বছর আর তিনি ঠিক করে দেখতে পেতেন না ও কানে ভাল শুনতেনও না কিন্তু তিনি এমনভাবে বাইবেলের পদ মুখস্থ বলতে পারতেন যে মনে হতো যেন তিনি বাইবেল থেকে পড়ছেন। পরে তিনি আমাদের সঙ্গে প্রচারে যেতেও শুরু করেছিলেন এবং যারা শুনত তাদের সকলের কাছে তিনি প্রচার করেছিলেন। মারা যাওয়ার ঠিক আগে আগে, তিনি আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা পৌঁছানোর আগেই তিনি মারা গিয়েছিলেন আর তার বালিশের নিচে আমরা তার সেই মাসের প্রচারের রিপোর্ট পেয়েছিলাম।
২৫ বছরের বেশি পূর্ণ-সময় প্রচার কাজ করার পর ১৯৭০ সালে আমাকে সুরিনাম শাখা অফিস দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সারাদিন এক জায়গায় বসে কাজ করা আমার কাছে খুব মুশকিল বলে মনে হতো কিন্তু ক্রে তখনও প্রতিদিন প্রচারে বের হতো। তখন ক্রেকে দেখে আমার হিংসে হতো। এখন ক্রেও শাখা অফিসে কাজ করে আর এই বুড়ো বয়সেও ঈশ্বর আমাদের কাজে লাগাচ্ছেন বলে আমরা খুব খুশি।
১৯৪৫ সালে ১,৬০,০০০ জন রাজ্য ঘোষণাকারী ছিল আর আজকে তা বেড়ে প্রায় ৬০,০০,০০০ জন হয়েছে আর আমি স্পষ্ট দেখতে পাই যে বাস্তবতা আমার কল্পনাকে আবারও একবার অনেক দূর পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৫৫ সালে সুরিনামে আসা থেকে আজকে পর্যন্ত প্রকাশকদের সংখ্যা প্রায় ১৯ গুণ বেড়েছে—প্রায় ১০০ জন থেকে আজকে ১,৯০০ জনেরও বেশি!
আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি যে ভবিষ্যতে আমরা যিহোবার উদ্দেশ্যগুলোকে বাস্তব হতে দেখতে পারব যদি কিনা কেবল আমরা বিশ্বস্ত থাকি। আর তা করব বলেই আমরা ঠিক করেছি।
[১১ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৫৫ সালে আমরা যখন সুরিনামে এসেছিলাম
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
নৌকায় চড়ে প্রচারে বের হওয়া
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমার স্ত্রীর সঙ্গে