সুন্দর মথ
একদিন সন্ধ্যেবেলায় একটা মথ এক বিরাট রেস্তোরাঁর ভিতরে উড়ে আসে। সেখানে একজন মহিলা টেবিলে বসে খাচ্ছিলেন আর যখনই মথটা সেখানে গিয়ে তার ডানা ঝাপটাতে থাকে, তখন ওই মহিলা মথটাকে এমনভাবে তাড়িয়ে দেন যেন কোন রোগ বহনকারী মশা তাকে আক্রমণ করেছে! মথটা তখন অন্য টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে শেষে একজন ব্যক্তির কোটের কলারের ভাঁজ করা অংশের ওপর বসে পড়ে। এই ব্যক্তি ও তার স্ত্রী একেবারে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখান।। তারা সেই মথের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকান এবং ওই কোমল পতঙ্গের সৌন্দর্য ও নিরীহ স্বভাব নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করেন।
কানেকটিকাট প্রজাপতি সংঘের সহপ্রতিষ্ঠাতা জন হিমেলম্যান বলেন, ‘মথ খুবই নিরীহ পতঙ্গ। এদের দাঁত নেই এবং কিছু পরিণত মথ যেমন, সুপরিচিত লুনা মথ কিছুই খায় না। এরা রেবিস বা অন্য কোন রোগের জীবাণু বহন করে না, হুল ফোটায় না . . . সত্যি বলতে কী, বেশির ভাগ লোকেরা জানেই না যে প্রজাপতিগুলো হচ্ছে আসলে একধরনের মথ, যা দিনের বেলায় উড়ে বেড়ায়।’
প্রত্যেকে প্রজাপতি দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় কিন্তু খুব কম লোকেই মথের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয় এবং বৈচিত্র্য জানার চেষ্টা করে। ‘সৌন্দর্য?’ আপনি হয়তো সন্দেহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করতে পারেন। কেউ কেউ মথকে কেবল সুন্দর প্রজাপতির এক অসুন্দর বংশধর বলে মনে করে কিন্তু উভয়কেই বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে একই দলে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে—লেপিডপটেরা যার মানে “আঁশযুক্ত ডানা।” এই সুন্দর পতঙ্গ এত বিভিন্ন জাতের দেখতে পাওয়া যায় যে, তা সত্যিই আশ্চর্য করে দেয়। কীটপতঙ্গের বিশ্বকোষ (ইংরেজি) বলে যে লেপিডপটেরার ১,৫০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ পরিচিত প্রজাতি রয়েছে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ হল প্রজাপতি, বাকি সব মথ!
আরও অনেকের মতো আমিও মথগুলো নিয়ে খুব কমই চিন্তা করতাম কিন্তু আমার শীতের কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখার সময়, কাপড় কাটে এমন মথগুলো যাতে কাপড়ে ঢুকতে না পারে তার জন্য আমি যখন চারপাশে কর্পূর রাখি, কেবল সেই সময়েই তাদের চিন্তা মাথায় আসত। আমি জানতাম না যে পরিণত হওয়ার পর মথ কাপড় খায় না, তারা শুধু তখনই খায়, যখন শুঁয়োপোকা হিসেবে শূককীট অবস্থায় থাকে।a
মথ সম্বন্ধে আমার ধারণা কী কারণে পালটে গেছে? কিছুদিন আগে আমার স্বামী আর আমি, বব ও রোন্ডা নামে আমাদের দুজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। বব মথ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানত। সে আমাকে একটা ছোট্ট বাক্স দেখায়। সেটার মধ্যে যা ছিল তা দেখে আমি প্রথমে ভাবি যে এটা একটা সুন্দর প্রজাপতি। কিন্তু সে বলে যে সেটা হল এক সিকরোপিয়া বা রবিন মথ, যেটা উত্তর আমেরিকার এক বড় প্রজাতির মথ। এটার ডানা ছড়ানো অবস্থায় প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা হতে পারে এবং এটার জীবনচক্র এক বছর স্থায়ী হয়। আমি শুনে সত্যিই খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম যে, এটা পরিণত অবস্থায় মাত্র ৭ থেকে ১৪ দিন বেঁচে থাকে! এই সুন্দর সিকরোপিয়াকে কাছ থেকে দেখার ফলে মথ সম্বন্ধে আমি এক নতুন ধারণা লাভ করি।
বব আমাকে তার বাক্সের তলায় কিছু ক্ষুদ্র ফুটকি দেখায়। সে বলেছিল যে, ‘এই ক্ষুদ্র ফুটকিগুলোই হচ্ছে ডিম এবং আশা করি আমি এগুলোকে বড় করে তুলতে পারব।’ মথ বড় করে তোলা? এই বিষয়টা শুনে আমি খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠি। কিন্তু শেষে দেখা গিয়েছিল যে আসলে এই পরিকল্পনা মতো কাজ করা খুব সহজ ছিল না। প্রায় দুসপ্তা ধরে বব এই ডিমগুলো ফুটানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি। তাই সে হালকাভাবে জল ছিটিয়ে এগুলোকে স্যাঁতসেঁতে করবে বলে ঠিক করে। এটা করার মাত্র এক সপ্তার মধ্যে ২৯টা ডিমের মধ্যে ২৬টা ডিম এক দিনে ফোটে। এরপর বব মশার মতো লম্বা এই দুর্বল শূককীটগুলোকে একটা গোলাকার গভীর ও মসৃণ পাত্রে রাখে, যাতে তারা সেখান থেকে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে না যায়।
ডিম ফুটে বেরনো এই শূককীটগুলো সবচেয়ে প্রথমে তাদের নিজেদের ডিমের খোল খেয়েছিল। এরপর, ববকে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল, যেটা সত্যিই এক কঠিন কাজ ছিল। এই বিষয়ে কিছু গবেষণা করার পর সে তাদের ম্যাপেল গাছের পাতা খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল। শূককীটগুলো এই পাতাগুলোর ওপর গুটিগুটি পায়ে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু এগুলো খায়নি। কিন্তু বব যখন তাদের চেরি ও বার্চ গাছের পাতা খেতে দেয়, তারা সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো খেয়ে ফেলে।
এই ক্ষুদ্র শূককীটগুলো যখন বড় হয়ে শুঁয়োপোকা হয়ে যায়, তখন বব এগুলোকে এমন একটা কাঁচের বাক্সে রাখে, যেটার ওপর দিক ধাতব জাল দিয়ে ঢাকা। শুঁয়াপোকা ও পাতাগুলোর জন্য যে পরিমাণ আর্দ্রতা দরকার তা এই বাক্স দিয়ে থাকে। এছাড়াও, এই কাঁচের বাক্স শুঁয়োপোকাগুলোকে ভিতরে আটকে রাখতে পারে কারণ এগুলো যখনই গুটিগুটি করে চলতে পারে, তখনই তাদের মধ্যে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়।
২৬টা ক্ষুধার্ত শুঁয়োপোকার খাবারের ব্যবস্থা করার কাজ যতটা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। বব যখনই এই কাঁচের বাক্স পাতা দিয়ে ভরে দিত, শুঁয়োপোকাগুলো মাত্র দুদিনের মধ্যে সব পাতা খেয়ে শেষ করে ফেলত। এই সময়ে শূককীটগুলোকে লক্ষ্য রাখার ও খাবার দেওয়ার জন্য সে তার ছোট বোন এবং দুজন অল্পবয়স্ক বন্ধু আর একজন কিশোর ও কিশোরীর সাহায্য নিয়েছিল।
শুঁয়োপোকাগুলোর শুধু শূককীট অবস্থায় বৃদ্ধি পাওয়ার জন্যই নয় সেইসঙ্গে পরিণত অবস্থার পুষ্টির জন্যও প্রচুর খাবার খাওয়া দরকার। আপনি দেখতে পাবেন যে পরিণত সিকরোপিয়া মথের মুখে ছিদ্র থাকে না আর তাই তারা কিছুই খায় না! তাদের অল্প সময়ের পরিণত জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এগুলো শূককীট অবস্থায় যে খাবার খায় তার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে।
নতুন খোলস পাওয়া
শুঁয়োপোকাগুলো বড় হওয়ার সময় কয়েকবার খোলস বদলায়। খোলস পরিত্যাগ করে শুঁয়োপোকার উন্নীত হওয়ার এক একটা অবস্থাকে ইনস্টার বলা হয়।
সিকরোপিয়া শুঁয়োপোকার খোলস বাড়ে না, তাই শুঁয়োপোকাটা যখন এতটা বড় হয়ে যায় যে এর খোলস যতটা ছড়ানোর ছড়িয়ে যায়, তখন এর খোলস বদলানোর সময় হয়। বব জানত যে এটা কখন হবে কারণ সেই সময় শুঁয়োপোকা খাওয়া বন্ধ করে দেয়। রেশম সূতার গুটি তৈরি এবং সেটার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করার পর, শুঁয়োপোকাগুলো কয়েক দিনের জন্য কোনরকম নাড়াচাড়া করে না আর সেই সময় তাদের নতুন খোলস হতে থাকে। যখন নতুন খোলস তৈরি হয়ে যায়, তখন শুঁয়োপোকাগুলো তাদের পুরনো খোলসকে রেশম গুটির মধ্যে রেখে সেটা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। শুঁয়োপোকাগুলোকে শেষ ইনস্টার অবস্থায় দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম যে তারা কত বড় হয়ে গেছে। তারা প্রায় ১২ সেন্টিমিটার লম্বা এবং আমার তর্জনী থেকেও চওড়া ছিল।
কোকুন গঠন
শেষবারের মতো খোলস ছাড়ার পর, প্রত্যেকটা শুঁয়োপোকা একটা করে কোকুন অর্থাৎ ছাই রঙের সূতার এক বিরাট গুটি গঠন করে, যা একটা লাঠিতে আটকে থাকে। সিকরোপিয়াগুলো দুধরনের কোকুন গঠন করে। একধরনের কোকুন আকারে বড় হয়, ঠাসাভাবে বোনা নয় ও থলির মতো ঝোলা হয় যার তলাটা গোল এবং ওপরের দিক ক্রমাগত সরু হতে থাকে। আরেক ধরনের কোকুন আকারে ছোট, ঠাসাভাবে বোনা ও আয়তাকার হয় যেটার ওপরের দিক ও তলা সরু। এই দুধরনের কোকুনের মধ্যে ঠাসাভাবে বোনা আরেকটা কোকুন থাকে। সিকরোপিয়া কোকুনগুলো সাধারণত লালচে-বাদামি, বাদামি, ফ্যাকাসে সবুজ অথবা ছাই রঙের হয়। উত্তর আমেরিকার অন্যান্য প্রজাতির মথের কোকুনের তুলনায় সিকরোপিয়া মথের কোকুনগুলো বিশাল, যেগুলো ১০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার চওড়া হয়। কোকুনের এই বিশাল গঠন, এগুলোকে খুব ঠাণ্ডাতে যেমন হিমাঙ্কের নিচে ৩৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও বাঁচিয়ে রাখে।
একবার যখন শুঁয়োপোকাগুলো নিজেদের কোকুনের মধ্যে থাকতে শুরু করে, তখন আমাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। বব প্রথমবার পরিণত মথটা পাওয়ার প্রায় এক বছর পর, পরের বসন্তে শুঁয়োপোকাগুলো কোকুন থেকে বেরিয়ে এসেছিল। যে লাঠিগুলোতে কোকুনগুলো আটকে থাকে সেগুলোকে বব এক টুকরো প্লাস্টিকের ফোমে রাখে, যাতে এগুলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। শীঘ্রিই একটা বাদে সবকটা সিকরোপিয়া নিজেদের কোকুন থেকে বেরিয়ে আসে আর এভাবে ধৈর্য এবং কঠিন পরিশ্রমের ফল পাওয়া যায়।
মথগুলোর প্রতি উপলব্ধি বৃদ্ধি
সিকরোপিয়া মথের অসাধারণ জীবনচক্র নিজের চোখে দেখার ফলে আমি বাতির চারদিকে ডানা ঝাপটাতে থাকা ও বিল্ডিং এর ওপর চুপ করে বসে থাকা মথগুলোর প্রতি আরও বেশি করে মনোযোগ দিতে শুরু করি। আমার ওই অভিজ্ঞতা আমাকে এই চমৎকার পতঙ্গগুলো সম্বন্ধে আরও জানতে উৎসাহিত করেছে। যেমন, আমি জেনেছি যে মথ ও প্রজাপতিরা খুব ভাল উড়তে পারে কারণ কিছু প্রজাতির মথ ও প্রজাপতি অনেক দূর পর্যন্ত উড়ে যায়। ছোট্ট ডায়মণ্ডব্যাক মথ তার ডানা বিছালে তা মাত্র ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা কিন্তু এটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর উত্তর সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে ইউরোপ থেকে ব্রিটেনে যাওয়া-আসা করে। আর স্ফিংস মথ বা হক মথগুলো হামিংবার্ডগুলোর মতো ফুলের ওপর ভেসে থাকে।
সিকরোপিয়ার জীবনচক্র নিজের চোখে দেখার কিছুদিন পর আমি বাতির নিচে একটা ঝোপের ওপর একটাকে বসে থাকতে দেখি। আমি জানতাম যে মথের ডানাগুলোর ওপর যে আঁশগুলো থাকে তা খুবই নরম, তাই আপনার কখনও এটাকে তার ডানা ধরে তোলা উচিত নয়। কিন্তু আপনি যদি একটা মথের সামনে আপনার হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে এটা হয়তো আপনার আঙুলের ওপর হেঁটে আসবে। আমি যখন এভাবে চেষ্টা করি, তখন এই সুন্দর পতঙ্গটা আমার মধ্যমাঙুলির ওপর এসে বসে, যা আমাকে আনন্দিত করেছিল। কিন্তু পরে এটা গাছের ওপরে উড়ে চলে যায়। উড়ে যাওয়ার সময় আমি মনে করি এটা দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। এরপরে কখনও যদি মনে করেন যে আপনি প্রজাপতি দেখছেন, তাহলে আরেকবার দেখুন। হতে পারে যে আসলে সেটা এক সুন্দর, নিরীহ মথ।—নিবেদিত। (g০১ ৬/৮)
[পাদটীকা]
a কিছু মথের শূককীট ফসলেরও অনেক ক্ষতি করে।
[১৮, ১৯ পৃষ্ঠার তালিকা/চিত্রগুলো]
১. রবিন মথ (সিকরোপিয়া)
২. পোলিফিমাস মথ
৩. সানসেট মথ
৪. আ্যটলাস মথ
[সৌজন্যে]
Natural Selection© - Bill Welch
A. Kerstitch
[২০ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
সিকরোপিয়া মথ বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায়: ১. ডিম
২. শুঁয়োপোকা
৩. পরিণত মথ
[সৌজন্যে]
Natural Selection© - Bill Welch