আপনার ছেলেমেয়েদের সামনে কেন জোরে জোরে পড়বেন?
“এখান-সেখান পিনাট বাটার মাখানো একটা বইয়ের মুচড়ানো পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে আমার কোলে বসে ও বলে . . . , ‘বাবা, বল না কীভাবে পড়ব; বল না বাবা।’”—ড. ক্লিফার্ড সিমেল্স, শিক্ষা ব্যবস্থার অধ্যাপক।
ছেলেমেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি শিখতে পারে। গবেষণা দেখায় যে তিন বছরের চেয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি খুব তাড়াতাড়ি হয়। বাবামাদের রোজকার কাজকর্ম যেমন পড়া, গান করা ও ভালবাসা দেখানো বাচ্চার সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু একটা গবেষণা অনুযায়ী দুই থেকে আট বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের বাবামাদের মধ্যে মাত্র অর্ধেক বাবামা, তাদের ছেলেমেয়েদেরকে রোজ পড়ে শোনান। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন ‘আমার সন্তানকে পড়ে শোনানো কি বিরাট কোন পরিবর্তন আনে?’
পড়ার প্রতি ভালবাসা গড়ে তুলুন
বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, এর উত্তর হল হ্যাঁ। পাঠকদের এক জাতি হওয়া (ইংরেজি) বইটা বলে, ‘পাঠ করায় সফল হতে হলে যে জ্ঞান গড়ে তোলা দরকার তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা হল ছেলেমেয়েদের সামনে জোরে জোরে পড়া। আর বিশেষ করে স্কুলে যাওয়ার আগের বছরগুলোতে তা করা জরুরি।’
একটা বই থেকে গল্প পড়ে শোনানোর সময় ছেলেমেয়েরা খুব অল্প বয়সে শিখে ফেলে যে, আমরা মুখে যে শব্দগুলো বলছি তা বইয়ের পাতায় লেখা আছে। তারা বইয়ের ভাষার সঙ্গেও পরিচিত হয়। জোরে জোরে পড়ার বিষয়ে একটা পুস্তিকা বলে “যতবারই আমরা একটা সন্তানকে পড়ে শুনাই, ততবারই আমরা তার মস্তিষ্কে এক ‘আনন্দের’ খবর পাঠাচ্ছি। এমনকি এটাকে আপনি একটা বিজ্ঞাপনও বলতে পারেন, যা সন্তানকে আনন্দের সঙ্গে বিভিন্ন বই ও ছাপানো পুস্তকগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করে।” যে বাবামারা বইয়ের প্রতি এই প্রেমকে জাগিয়ে তোলেন তারা তাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পাঠক হওয়ার এক চির ইচ্ছা গড়ে তোলেন।
তাদেরকে আশেপাশের জগৎ সম্বন্ধে বুঝতে সাহায্য করা
যে বাবামারা তাদের ছেলেমেয়েদের সামনে জোরে জোরে পড়েন তারা এক মূল্যবান উপহার যেমন বিভিন্ন লোক, জায়গা ও বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান দিতে পারেন। মাত্র অল্প খরচে, তারা বইয়ের পাতায় জগৎ “পরিদর্শন” করতে পারেন। দুবছর বয়সী আ্যন্থোনির কথা বিবেচনা করুন, যার মা তার জন্ম হওয়ার পর থেকে তাকে পড়ে শোনাতেন। তিনি বলেন: “চিড়িয়াখানায় প্রথমবার যাওয়া ছিল তার জন্য আবারও আবিষ্কারের এক যাত্রা।” আবারও আবিষ্কার? হ্যাঁ, যদিও আ্যন্থোনি এই প্রথম জেব্রা, সিংহ, জিরাফ ও অন্যান্য জন্তু জীবন্ত দেখতে পেয়েছিল কিন্তু সে এই জন্তুগুলোর সঙ্গে ইতিমধ্যেই পরিচিত ছিল।
তার মা আরও বলেন: “আ্যন্থোনি তার জীবনের প্রথম দুবছর বিভিন্ন বই থেকে আনন্দের সঙ্গে অসংখ্য লোক, জীবজন্তু, বস্তু ও চিন্তাধারার সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করেছে।” হ্যাঁ, ছেলেমেয়েরা যখন ছোট থাকে, তখন তাদের সামনে জোরে জোরে পড়া তাদেরকে এই জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করে, যেখানে তারা বসবাস করে।
এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা
বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা এমন মনোভাব গড়ে তোলে, যা ভবিষ্যতে তাদের কাজে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই বাবামাদের এমন এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য ভিত তৈরি করে দেওয়া দরকার, যার মধ্যে আস্থা, পরস্পরের প্রতি সম্মান ও বোঝাপড়া থাকে। পড়া, এই বিষয়ে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
বাবামারা যখন ছেলেমেয়েদেরকে কোলে নিয়ে তাদের সামনে পড়ার জন্য সময় করে নেন, তখন তারা যা বলতে চান, তা স্পষ্ট হয়ে যায়: “আমি তোমাকে ভালবাসি।” ফিবি নামে কানাডার একজন মা তার ছেলের সামনে পড়ার সম্বন্ধে বলেছিলেন, যে এখন আট বছরের: “আমার স্বামী ও আমি মনে করি যে এটা ন্যাথেনকে আমাদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য অনেক সাহায্য করেছে। সে আমাদের কাছে সব খুলে বলে ও প্রায়ই তার অনুভূতির কথা বলে। এটা আমাদের মধ্যে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।”
সিনডির মেয়ের বয়স যখন প্রায় এক বছর এবং এক বা দুই মিনিটের জন্য বসতে ও শুনতে পারার মতো অবস্থা হয়েছে, তখন থেকেই সিনডি তার সামনে জোরে জোরে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। কিন্তু, এই সময়গুলো ও চেষ্টার কি কোন মূল্য রয়েছে? সিনডি বলেন: “বন্ধুত্বপূর্ণ ও শান্ত পরিবেশে একসঙ্গে পড়ার কারণে প্রায়ই আবিগেল আমাদের কাছে তার স্কুলের সমস্ত কথা অথবা কোন বন্ধুর সঙ্গে কোন সমস্যা হলে তা মন খুলে বলে। সব বাবামাই কি এইধরনের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য আগ্রহী নন?” কোন সন্দেহ নেই যে, জোরে জোরে পড়লে তা বাবামা ও ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক কাছের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।
জীবনের জন্য দরকারি এমন দক্ষতাগুলো শেখানো
এক মজবুত পরিবার গড়ার ৩টে ধাপ (ইংরেজি) বই বলে, “আজকে আমাদের ছেলেমেয়েরা টেলিভিশন ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে এত বাজে বিষয়গুলো গ্রহণ করে যে এর জন্য আগের চেয়ে তাদের আরও বেশি মানসিক পুষ্টি, তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধি, প্রজ্ঞা এবং মানসিক স্থিরতা দরকার, যা তাদেরকে নীতিগুলো মেনে চলতে এবং জীবনকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে সাহায্য করবে।” এক্ষেত্রে এক ইতিবাচক ও গঠনমূলক প্রভাব ফেলার জন্য বাবামারাই হচ্ছেন সবচেয়ে উত্তম।
কোন সন্তানকে বইয়ের মধ্যে পাওয়া কঠিন ও জটিল বাক্যগুলোর সঙ্গে পরিচিত করানো হল, তাকে নিজের ভাষায় বলতে ও লিখতে শেখানোর এক কার্যকারী উপায়। শিশুদের বই দরকার (ইংরেজি) বইয়ের লেখক, ডরোথি বাটলার বলেন: “একজন ব্যক্তির চিন্তাভাবনা কতটা উত্তম, তা নির্ভর করে তার ভাষা কতটা উত্তম সেটার ওপর। শিক্ষা ও বুদ্ধির জন্য আসলে ভাষার জ্ঞান থাকা খুবই জরুরি।” ভাববিনিময় করার দক্ষতা হল, ভাল সম্পর্কের জীবনীশক্তি।
বিভিন্ন উপযুক্ত বই পড়া উত্তম নীতি ও মূল্যবোধ গড়ে তোলে। যে বাবামারা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পড়েন ও যুক্তি করেন তারা তাদেরকে সমস্যা সমাধান করার দক্ষতাকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। সিনডি যখন তার মেয়ে আবিগেলের সঙ্গে পড়তেন, তখন তিনি গল্পের মধ্যে দেওয়া পরিস্থিতির প্রতি আবিগেলের প্রতিক্রিয়াকে ভালভাবে লক্ষ্য করতেন। “বাবামা হিসেবে আমরা তার ব্যক্তিত্বে যে সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলো আছে, তা আরও বেশি করে জানতে এবং খুব অল্প বয়সে তার মধ্যে থেকে খারাপ চিন্তাধারাকে দূর করতে সাহায্য করতে পারি।” সত্যিই, ছেলেমেয়েদের সামনে জোরে জোরে পড়া তাদের হৃদয় ও মন উভয়কেই শিক্ষিত করতে পারে।
পড়াকে আনন্দের বিষয় করে তুলুন
‘ছেলেমেয়েদের ওপর চাপ না দিয়ে’ পরিবেশকে হাল্কা, সাধারণ ও আনন্দজনক রেখে পড়ুন। বিচক্ষণ বাবামারা জানেন যে কখন পড়া বন্ধ করতে হবে। লেনা বলেন: “দুবছর বয়সের আ্যন্ড্রু মাঝে মধ্যে খুবই ক্লান্ত থাকে এবং বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসে না। তার মেজাজ অনুযায়ী আমরা আমাদের পড়ার অংশটুকু ছোট করি। পড়ার ব্যাপারে আ্যড্রু কোন নেতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলুক, তা আমরা চাই না। তাই সে যতটুকু পারে তার চেয়ে বেশি সময় পড়ার জন্য আমরা তাকে জোর করি না।”
জোরে জোরে পড়ার সঙ্গে শুধু ছাপানো বিষয়বস্তু থেকে পড়ার চেয়ে আরও বেশি কিছু জড়িত রয়েছে। উৎসুকতা বাড়ানোর জন্য কখন একটা ছবির বইয়ের পৃষ্ঠা পালটাতে হবে, তা জানুন। সাবলীলভাবে পড়ুন। স্বরের ওঠানামা ও অর্থের ওপর জোর দেওয়াও গল্পকে জীবন্ত করে তুলতে পারে। আপনার স্বরের উষ্ণতা আপনার সন্তানের মধ্যে সুরক্ষার এক অনুভূতি এনে দিতে পারে।
আপনার সন্তান যদি সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়, তাহলে অনেক উপকার রয়েছে। মাঝেমধ্যে একটু থামুন এবং এমন কিছু প্রশ্ন করুন, যার জন্য তাকে বেশ কয়েকটা শব্দে উত্তর দিতে হয়। অন্যান্য সম্ভাব্য বিষয়গুলো তুলে ধরে সন্তানের উত্তরগুলোকে প্রসারিত করুন
বই পছন্দ করার সময় বাছাই করুন
কিন্তু, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হল ভাল বই বাছাই করা। এটা করার জন্য আপনাকে আগে থেকেই সামান্য প্রস্তুতি নিতে হবে। বইগুলোতে ভালভাবে চোখ বুলান এবং এমন বইগুলো ব্যবহার করুন, যেগুলোর মধ্যে গঠনমূলক ও শিক্ষামূলক বিষয় আছে এবং গল্পের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা রয়েছে। বইয়ের প্রচ্ছদ পাতা, নকশা ও লেখার ধরন ভাল করে পরীক্ষা করুন। এমন বইগুলো বেছে নিন, যেগুলো বাবামা ও সন্তান উভয়ই পচ্ছন্দ করবে। কারণ প্রায়ই ছেলেমেয়েরা বারবার একই গল্প পড়ার কথা বলে।
পৃথিবীব্যাপী বাবামারা বিশেষ করে আমার বাইবেলের গল্পের বইa পড়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন। এটা এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে বাবামারা তাদের ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পড়তে পারেন এবং এটা ছেলেমেয়েদেরকে শুধু ভাল পাঠক হতেই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে বাইবেলের প্রতি তাদের আগ্রহকেও বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।
যে বাবামারা ছেলেমেয়েদের সামনে জোরে জোরে পড়েন, তারা তাদের মধ্যে পড়ার ভাল অভ্যাস গড়ে তোলেন, যেটা জীবনভর ভাল ফল নিয়ে আসবে। জোয়ান তার মেয়ের বিষয়ে বলেছিলেন: “স্কুলে যাওয়ার আগে জেনিফার শুধু পড়তে ও লিখতে শেখা এবং পড়ার প্রতি ভালবাসাই গড়ে তোলেনি কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, সে মহান সৃষ্টিকর্তা যিহোবার প্রতি ভালবাসাও গড়ে তুলেছে। জেনিফা যিহোবার লিখিত বাক্য, বাইবেলের ওপর আস্থা গড়ে তুলতে শিখেছে, যাতে সেটা তাকে তার সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়।” সত্যিই, একটা সন্তানকে আপনি যা শিখতে সাহায্য করছেন, তার চেয়ে আপনি তাকে যে বিষয়গুলো ভালবাসতে সাহায্য করছেন সেটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। (g০১ ১১/২২)
[পাদটীকা]
a যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত।
[২৮ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
আপনি যখন সন্তানের সামনে পড়েন
• ছেলে বা মেয়ে একেবারে শিশু থাকতেই পড়া শুরু করুন।
• পড়ার জন্য শান্ত হয়ে বসতে আপনার সন্তানকে সময় দিন।
• দুজনেরই যে গল্পগুলো পছন্দ হয়, সেগুলোকে পড়ুন।
• আপনি যতবার পারেন ততবার পড়ুন এবং তা অনুভূতির সঙ্গে পড়ুন।
• কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আপনার সন্তানকে তাতে অংশ নিতে দিন।
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
Photograph taken at the Wildlife Conservation Society’s Bronx Zoo