রোগব্যাধি এবং মৃত্যুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম তাতে কি জয়লাভ করা যাচ্ছে?
ব্যাধি আর নেই, মৃত্যু আর নেই! অধিকাংশ লোকের কাছেই ইহা শোনাবে একেবারে খেয়াল-খুশীমত চিন্তার থেকে বেশী কিছু নয়। যাইহোক, চিকিৎসাবিদ ও জীবাণুবিদ্যার অধ্যাপক ওয়েড ডব্লু. অলিভার লিখেছিলেন: “লিখিত ইতিহাসের প্রাচীণতম সময় থেকে, রোগব্যাধি অত্যধিক মাত্রায় মানবজাতির নিয়তি নির্দিষ্ট করেছে . . . ভীতিজনক বেগে মানুষের ওপরে ব্যাপক মহামারী ঝাপিয়ে পড়েছে . . . অসুস্থতা চিরকাল তার পদক্ষেপ অনুসরণ করেছে।”
একটি আমূল পরিবর্তন যে আসন্ন তা বিশ্বাস করার কোন কারণ আছে কি? চিকিৎসা বিজ্ঞান কি সমস্ত ব্যাধি হয়তো এমনকি মৃত্যু পর্য্যন্ত নিশ্চিহ্ন করবে?
প্রশ্নাতীতভাবে, ডাক্তাররা এবং গবেষকরা রোগব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রামে আশ্চর্য্যরকম কাজ করেছেন। কোন্ সচেতন ব্যক্তি কলেরার সফল চিকিৎসা, যা অবশেষে ১৯ শতাব্দীর শেষের দিকে অর্জন করা হয়, অথবা ভয়ানক বসন্তরোগের বিরুদ্ধে একটি রোগ-প্রতিষেধক তৈরী করার জন্য কৃতজ্ঞতা দেখাতে ব্যর্থ হবে? এই রোগ-প্রতিষেধকটি ১৭৯৬ সালে এডুয়ার্ড জেনার তৈরী করেন একটি অপেক্ষাকৃত কম মারাত্মক গো-বসন্ত-ক্ষত থেকে। ১৮০৬ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি টমাস জেফারসন্ আরও অনেকের অনুভূতি প্রকাশ করেন যখন তিনি জেনারকে লেখেন: “আপনি যে জীবন যাপন করেছেন এই সান্ত্বনাদায়ক স্মৃতি মানবজাতি কখনো ভুলে যাবে না; ভবিষ্যতের জাতিগণ শুধুমাত্র ইতিহাস থেকে জানবে যে ঘৃণার্হ্য বসন্তরোগের অস্তিত্ব ছিল।”
উপরন্তু, ডিপথেরিয়া এবং পোলিওমাইলিটিস রোগ সম্বন্ধে চিকিৎসা-সংক্রান্ত গবেষনার সাফল্যের কথাও অনুকুলজনকরূপে এবং কৃতজ্ঞতাসহকারে উল্লেখ করা যেতে পারে। আর হৃদরোগ ও ক্যান্সারের চিকিৎসার বর্তমান অগ্রগতি সম্বন্ধে আজ খুব অল্প সংখ্যক লোকের প্রশংসা ছাড়া অন্য কিছু বলার থাকতে পারে। যাইহোক, লোকে এখনও হৃদরোগ এবং ক্যান্সার থেকে মারা যায়। সমস্ত রোগ এবং ব্যাধি দূর করার যে লক্ষ্য তা বেশ দুঃসাধ্য প্রমাণিত হয়েছে।
“নতুন” রোগব্যাধি
একটি পরস্পরবিরোধী সত্য, বর্তমান যুগ যা ক্যাট স্ক্যান এবং পুনর্গঠনমূলক শল্যচিকিৎসার আগমন দেখেছে বহু “নতুন” রোগব্যাধির উৎপত্তিও দেখেছে, যেমন লীজিওনেয়ারস্ রোগ, টক্সিক্ শক সিন্ড্রোম, এবং এইডস্ নামে বহু-আলোচিত ঘাতক।
মানতে হবে যে, অনেকে প্রশ্ন করে এই রোগব্যাধিগুলি কত নতুন। ইউ. এস্. নিউজ অ্যাণ্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ মন্তব্য করে যে, কিছু ক্ষেত্রে, কোন রোগব্যাধি বহুদিন যাবৎ রয়েছে কিন্তু সম্প্রতি সঠিকভাবে সনাক্ত করা হয়েছে অথবা নতুন নাম দেওয়া হয়েছে। লীজিওনেয়ারস্ রোগ, উদাহরণস্বরূপ, প্রথম সনাক্ত করা হয় ১৯৭৬ সালে, কিন্তু তার পূর্বে এটিকে হয়তো ভাইরাল নিউমোনিয়া হিসাবে ভুল নির্ণয় করা হয়। একইভাবে, টক্সিক্ শক সিন্ড্রোমকে পূর্বে হয়তো স্কার্লেট ফিভার বলে ভুল করা হত।
যাইহোক, বহু শারীরিক অসুস্থতা প্রশ্নাতীতভাবে নতুন। নিঃসন্দেহে এইডস্ এর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত। এই সামর্থহানীকারী এবং মারাত্মক রোগটি ১৯৮১ সালে প্রথম সনাক্ত ও নামকরণ করা হয়। আরেকটি অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত “নতুন” রোগ ব্রাজিলিয়ান পারপিউরিক ফিভার। ব্রাজিলে এটিকে ১৯৮৪ সালে সনাক্ত করা হয় এবং এটির মৃত্যুর হার হিসাব করা হয় ৫০ শতাংশ।
কোন আরোগ্য দৃষ্টিগোচর হয়নি
তাই, মানুষের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও, যে অসুস্থতাগুলি মানুষকে পীড়া দেয় তার সম্পূর্ণ এবং স্থায়ী আরোগ্যলাভ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সত্য যে ১৯০০ সাল থেকে গড়ে মানুষের প্রত্যাশিত জীবনকাল প্রায় ২৫ বছর বেড়ে গেছে। কিন্তু এই পরিবর্তন হয়েছে বিশেষত চিকিৎসাপদ্ধতির উন্নতির দ্বারা যা সদ্যজাত অবস্থায় অথবা শৈশবে মৃত্যুর সম্ভাবনা হ্রাস করেছে। মানুষের জীবনকাল বস্তুতপক্ষে এখনও বাইবেলের “তিনবিংশতি এবং দশ বছরের” কাছাকাছি সীমাবদ্ধ।—গীতসংহিতা ৯০:১০, কিং জেমস্ ভারশন.
তাই অ্যানা উলিয়ামস্ যখন ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে ১১৪ বছর বয়সে মারা যায় তা একটি সংবাদ হয়ে দাঁড়ায়। মিস্ উইলিয়ামস্-এর মৃত্যু সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন সাংবাদিক লেখেন: “বৈজ্ঞানিকরা মনে করেন যে ১১৫ থেকে ১২০ বছর হয়তো মানুষের দীর্ঘ জীবনের সর্বাধিক মাত্রা। কিন্তু কেন তা হওয়া উচিৎ? ৭০, ৮০ এমনকি ১১৫ বছর পরেও কেন মানুষের শরীর ভেঙে পড়বে?”
১৯৬০ দশকে বৈজ্ঞানিকরা আবিস্কার করেন যে মানব কোষের বিভক্ত হওয়ার ক্ষমতা আছে মাত্র ৫০ বারের মত। যখন এই মাত্রায় পৌঁছান হয় তখন মনে হয় কোন কিছুর মাধ্যমেই কোষগুলিকে জীবিত রাখা যাবে না। এটি পূর্বেকার বৈজ্ঞানিক ধারণা যে মানব কোষকে যদি সঠিক পরিস্থিতি দেওয়া হয় তাহলে তা অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারে তার বিরোধ করে।
তার সঙ্গে যোগ দিন যে মানুষের অধিকাংশ কষ্টভোগ মানুষ নিজেই সৃষ্টি করেছে। একজন গবেষক তার উপলব্ধির ওপর ভিত্তি করে এই উপসংহারে আসেন: “শুধুমাত্র জৈব-চিকিৎসাগত নিয়মের দ্বারা রোগব্যাধিকে পরাস্ত করা যায়নি। রোগব্যাধির ইতিহাস সামাজিক এবং নৈতিক বিষয়ের সাথে একান্তভাবে জড়িত।”
ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অরগ্যানাইজেশন উল্লেখ করে: “আমরা নিজেদের আহত করেছি, এই আশায় যে বিজ্ঞান, ডাক্তাররা এবং হাসপাতালগুলি একটি আরোগ্যলাভের উপায় বার করবে, অসুস্থতার মূল কারণ প্রতিরোধ করার পরিবর্তে। অবশ্যই যে সহজসাধ্য চিকিৎসাগত সেবা প্রকৃতপক্ষে জীবন বাঁচায় তা ছাড়া আমাদের চলত না, কিন্তু পরিষ্কারভাবে বোঝা উচিৎ যে ইহা আমাদের ‘স্বাস্থ্যের’ প্রতি কোনকিছু যোগ দেয় না—এইগুলি মৃত্যু থেকে আমাদের থামায়। . . . ধূমপানকারী এবং মদ্যপানকারীর আত্মধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি, মন এবং দেহের ওপর বেকারত্বের প্রভাব—এইগুলি ‘নতুন রোগব্যাধির’ কয়েকটি। আমরা কেন ‘রাস্তায় দুর্ঘটনার মহামারী’ ঘটতে দিই, যা জীবন নাশ করে এবং আমাদের আর্থিক সংগতি ধ্বংস করে?”
রোগব্যাধি, অসুস্থতা, কষ্টভোগ, এবং মৃত্যু এখনও আমাদের সাথে রয়েছে। যাইহোক, নিশ্চয়তার সাথে এমন একটি সময়ের দিকে তাকাবার কারণ রয়েছে যখন রোগব্যাধি আর থাকবে না এবং মৃত্যু আর থাকবে না। সব থেকে উত্তম, সেই সময় যে অতি নিকটে তা মনে করারও বহু কারণ রয়েছে। (w91 6/15)
[৪ পৃষ্ঠার বাক্স]
“মিস্রীয়দের যে সকল রোগ”
মানুষ যে অতি প্রাচীণকাল থেকে ব্যর্থতার সাথে রোগব্যাধির সঙ্গে সংগ্রাম করেছে তা এমনকি বাইবেলেও উল্লিখিত আছে। উদাহরণস্বরূপ, মোশি “মিস্রীয়দের যে সকল উৎকট রোগ” সেই সম্বন্ধে একটি কৌতুহলজনক উদ্ধৃতি করেন।—দ্বিতীয় বিবরণ ৭:১৫.
এর মধ্যে হয়তো অন্তর্ভুক্ত ছিল শ্লীপদ, রক্তামাশয়, বসন্তরোগ, গ্রন্থিস্ফীতিরোগ, এবং চক্ষুপ্রদাহ। মোশির লোকেরা এই সমস্ত অসুখ এড়িয়ে গিয়েছিল বিশেষত নিয়মচুক্তির দ্বারা তাদের ওপর আরোপিত উচ্চতর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অভ্যাসগুলির দ্বারা।
যাইহোক, মিশরের সংরক্ষিত শবদেহগুলি সাবধানতার সাথে পরীক্ষা করে, আরও বহু “মিস্রীয়দের রোগ” সনাক্ত করা গেছে। এর অন্তর্গত সন্ধিপ্রদাহ, স্পনডিলাইটিস্, দাঁত এবং চোয়ালের রোগ, অ্যাপেণ্ডিসাইটিস্, এবং গ্রন্থিপ্রদাহ। একটি প্রাচীণ জাগতিক চিকিৎসা-সংক্রান্ত লেখা, যার নাম এবারস্ প্যাপিরাস, এমনকি টিউমার, পেট এবং যকৃতের পীড়া, ডায়াবিটিস্, কুষ্ঠরোগ, নেত্রবর্ত্মকলা প্রদাহ, এবং বধিরতার কথা উল্লেখ করে।
প্রাচীণ মিশরীয় চিকিৎসকরা এই সমস্ত রোগব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে, কিছু তাদের চিকিৎসাক্ষেত্রে বেশ বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে। গ্রীক ইতিবৃত্তকার হেরোডোটাস লেখেন: “সেই দেশ [মিশর] চিকিৎসকদের দ্বারা পরিপূর্ণ; একজন শুধুমাত্র চোখের রোগের চিকিৎসা করে; অন্যজন মাথার, দাঁতের, পেটের, অথবা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলির চিকিৎসা করে।” যাইহোক, মিশরের “ঔষধগুলির” অধিকাংশই ছিল ধর্মীয় হাতুড়েবৈদ্যগিরি এবং বিজ্ঞান থেকে বহু দূরে।
রোগব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রামে আধুনিক চিকিৎসকরা আরও অনেক বেশী সাফল্য লাভ করেছেন। তবুও, চিকিৎসাবিদ্যার গবেষক জেসি ডবসন এই চিন্তাউদ্রেককারী উপসংহারে আসেন: “বিগত যুগের রোগব্যাধি পরীক্ষা করলে, তাহলে, কি জানা যায়? যে প্রমাণ রয়েছে তা পরিদর্শন করলে যে সাধারণ উপসংহারে আসা যায় তা হল সুদূর অতীতের রোগব্যাধি এবং পীড়াজনক অসুস্থতাগুলির বর্তমানের রোগব্যাধির সাথে খুব বেশী পার্থক্য নেই . . . স্পষ্টতই রোগব্যাধি নিশ্চিহ্ন করতে সমস্ত দক্ষতা এবং ধৈর্য্যসহকারে গবেষনার ফল খুব অল্পই সাধন করতে পেরেছে।”—ডিসিজ ইন এন্শিয়েন্ট ম্যান। (w91 6/15)