যুক্তিবাদিতা গড়ে তুলুন
“তোমাদের যুক্তিবাদিতা মনুষ্যমাত্রের বিদিত হোক। প্রভু নিকটবর্ত্তী।”—ফিলিপীয় ৪:৫, NW.
১. বর্তমান জগতে যুক্তিবাদী হওয়া কঠিন কেন?
“যুক্তিবাদী পুরুষ”—ইংরেজ সাংবাদিক স্যার অ্যালেন্ প্যাট্রিক হার্বাট তাকে বলেছিলেন রূপকথার পুরুষ। বাস্তবিকই, কয়েকসময়ে মনে হতে পারে যে এই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জগতে আর একজনও যুক্তিবাদী ব্যক্তি জীবিত নেই। বাইবেল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে সঙ্কটময় “শেষ কালে” লোকে “প্রচণ্ড,” “দুঃসাহসী,” এবং ক্ষমাহীন” হবে—অর্থাৎ মোটেই যুক্তিবাদী হবে না। (২ তীমথিয় ৩:১-৫) কিন্তু সত্য খ্রীষ্টানেরা যুক্তিবাদিতাকে গুরুত্ব দেয়, কারণ তারা জানে যে তা হল ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞার চিহ্ন। (যাকোব ৩:১৭) আমরা মনে করি না যে অযৌক্তিক জগতে থেকে যুক্তিবাদী হওয়া সম্ভব নয়। বরং, ফিলিপীয় ৪:৫ পদের অনুপ্রাণিত উপদেশে প্রেরিত পৌল যে চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করেছিলেন, আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে তা গ্রহণ করি: “তোমাদের যুক্তিবাদিতা মনুষ্যমাত্রের বিদিত হউক।”
২. ফিলিপীয় ৪:৫ পদের পৌলের বাক্য কিভাবে আমাদের বুঝতে সাহায্য করে আমরা যুক্তিবাদী কি না?
২ আমরা যুক্তিবাদী কি না, তা পরীক্ষা করতে পৌলের বাক্য আমদের কিভাবে সাহায্য করে তা লক্ষ্য করুন। আমরা নিজেদের যা মনে করি সেটি বড় কথা নয়; প্রশ্ন হল অন্যেরা আমাদের কিভাবে দেখে, আমরা কিভাবে পরিচিত। এই পদটিকে ফিলিপস্-এর অনুবাদ এইভাবে বলেছে: “যুক্তিবাদী হওয়ার সুনাম রাখ।” আমাদের প্রত্যেকের নিজেকে জিজ্ঞাসা করা উচিত, আমি কিভাবে পরিচিত? ‘আমার কি যুক্তিবাদী, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং নম্র হওয়ার সুনাম আছে? অথবা আমি কঠোর, রূঢ় বা দুঃসাহসী হিসাবে পরিচিত?
৩. (ক) যে গ্রীক শব্দটিকে “যুক্তিবাদী” অনুবাদ করা হয়েছে, তার অর্থ কী এবং এই গুণটি আকর্ষণীয় কেন? (খ) একজন খ্রীষ্টান কিভাবে আরও বেশি যুক্তিবাদী হওয়া শিখতে পারে?
৩ এই বিষয়ে আমাদের সুনামের মধ্যে দিয়ে, আমরা যীশু খ্রীষ্টকে কতটা অনুকরণ করি, তা প্রকাশ পাবে। (১ করিন্থীয় ১১:১) পৃথিবীতে থাকাকালীন, যীশু তাঁর পিতার যুক্তিবাদিতার উদাহরণ নিখুঁতভাবে অনুকরণ করেছিলেন। (যোহন ১৪:৯) বাস্তবপক্ষে, পৌল যখন ‘খ্রীষ্টের মৃদুতা ও সৌজন্যের যে গ্রীক শব্দটি (ইপাইকিয়াস) ব্যবহার করেছিলেন তা “যুক্তিবাদিতা,” অথবা আক্ষরিক অর্থে “মানিয়ে নেওয়াকেও” বুঝায়। (২ করিন্থীয় ১০:১) এক্সপোজিটরস্ বাইবেল কমেন্টারি এটিকে বলে “নূতন নিয়মের সবচেয়ে মহান চরিত্র-বর্ণনার মধ্যে একটি।” এর মাধ্যমে এমন আকর্ষণীয় একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বর্ণনা করা হয়েছে, যে একজন বিশেষজ্ঞ এটিকে “সুন্দর যুক্তিবাদিতা” বলেছেন। সুতরাং, আসুন আমরা তিনটি বিষয় আলোচনা করি, যেভাবে যীশু তাঁর পিতা যিহোবার মত যুক্তিবাদিতা দেখিয়েছেন। এইভাবে আমরা নিজেরা কিভাবে আরও বেশি যুক্তিবাদী হতে পারি, তা শিখতে পারি।—১ পিতর ২:২১.
“ক্ষমাবান্”
৪. যীশু কিভাবে নিজেকে “ক্ষমাবান্” দেখিয়েছিলেন?
৪ তাঁর পিতার মত যীশুও বার বার “ক্ষমাবান্” হয়ে যুক্তিবাদিতা দেখিয়েছেন। (গীতসংহিতা ৮৬:৫) যখন একজন ঘনিষ্ট সহচর, পিতর, যীশুর বন্দী হওয়া এবং বিচার হওয়ার রাতে, তিনবার যীশুকে অস্বীকার করেছিলেন, সেই সময়টির কথা বিবেচনা করুন। আগে যীশু নিজেই বলেছিলেন: “যে কেহ মনুষ্যদের সাক্ষাতে আমাকে অস্বীকার করে, আমিও আপন স্বর্গস্থ পিতার সাক্ষাতে তাহাকে অস্বীকার করিব।” (মথি ১০:৩৩) যীশু কি কঠোর ও নির্দয়ভাবে এই নীতিটি পিতরের প্রতি প্রয়োগ করেছিলেন? না; পুনরুত্থিত হওয়ার পরে, যীশু ব্যক্তিগতভাবে পিতরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, নিঃসন্দেহে সেই অনুতপ্ত, ভগ্নহৃদয় প্রেরিতকে সান্ত্বনা ও আশা দেওয়ার জন্য। (লূক ২৪:৩৪; ১ করিন্থীয় ১৫:৫) তার কিছু পরেই, যীশু পিতরের হাতে খুব বড় দায়িত্ব দিয়েছিলেন। (প্রেরিত ২:১-৪১) এইক্ষেত্রে যুক্তিবাদিতা খুবই সুন্দরভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল! যিহোবা যে যীশুকে সমস্ত মানবজাতির বিচারকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করেছেন, তা কি সান্ত্বনাদায়ক নয়?—যিশাইয় ১১:১-৪; যোহন ৫:২২.
৫. (ক) পালের মধ্যে প্রাচীনদের কী সুনাম থাকা উচিত? (খ) বিচার করার আগে, প্রাচীনদের কোন্ তথ্য বিবেচনা করা উচিত এবং কেন?
৫ প্রাচীনেরা যখন মণ্ডলীতে বিচারক হিসাবে কাজ করেন, তখন তারা যীশুর যুক্তিবাদী উদাহরণ অনুসরণ করতে চেষ্টা করে। তারা চান না যে পাল তাদের শাস্তিদাতা হিসাবে ভয় করুক। বরং, তারা যীশুকে অনুকরণ করেন যাতে প্রেমময় পালক হিসাবে পাল তাদের কাছে নিরাপদ বোধ করে। বিচার করার সময়ে, তারা সবসময়ে যুক্তিবাদী এবং ক্ষমাশীল হওয়ার চেষ্টা করেন। এই সব ক্ষেত্রে, কিছু প্রাচীন দেখেছেন যে জুলাই ১, ১৯৯২ সালের প্রহরীদুর্গ থেকে, “যিহোবা, ‘সমস্ত পৃথিবীর নিরপেক্ষ বিচারকর্তা’” এবং “প্রাচীনগণ, ধার্মিকতার সাথে বিচার করুন” প্রবন্ধগুলি বিবেচনা করলে সাহায্য পাওয়া যায়। বিচার করা সম্বন্ধে যিহোবার নীতির সারমর্ম তাই তারা মনে রাখেন: “প্রয়োজন হলে দৃঢ়তা, সম্ভব হলে করুণা।” করুণা দেখানোর উপযুক্ত কারণ থাকলে, ক্ষমা করা ভুল নয়। (মথি ১২:৭) কিন্তু কঠোর বা নির্দয় হওয়া হল খুব বড় ভুল। (যিহিষ্কেল ৩৪:৪) তাই, ন্যায়বিচারের সীমার মধ্যে থেকে, সবচেয়ে প্রেমময় ও করুণাময় পথ বেছে নিয়ে প্রাচীনেরা ভুল করা এড়িয়ে চলেন।—তুলনা করুন মথি ২৩:২৩; যাকোব ২:১৩.
পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়া
৬. যে পরজাতীয় নারীটির মেয়ে ভূতগ্রস্ত ছিল, তার প্রতি যীশু কিভাবে যুক্তিবাদিতা দেখিয়েছিলেন?
৬ নতুন পরিস্থিতি দেখা দিলে, যিহোবার মত যীশুও শীঘ্রই পথ পরিবর্তন করার এবং মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। একবার, একজন পরজাতীয় স্ত্রী তার ভূতগ্রস্ত মেয়েকে সুস্থ করার জন্য তাঁকে অনুনয় করেছিল। প্রথমে, তিনভাবে যীশু ইঙ্গিত করেছিলেন যে তিনি তাকে সাহায্য করবেন না—প্রথমত, তাকে উত্তর না দিয়ে; দ্বিতীয়ত, সরাসরি বলে যে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল যিহুদীদের কাছে, পরজাতীয়দের কাছে নয়; এবং তৃতীয়ত, একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে যা এই একই বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু, সেই মহিলাটি এই সব কিছু সহ্য করে অসামান্য বিশ্বাসের পরিচয় দিয়েছিল। এই বিশেষ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে যীশু বুঝতে পেরেছিলেন যে কোন নিয়ম স্থাপন করার সময় এটি ছিল না; আরও মহান নীতির সপক্ষে এখন ছিল মানিয়ে নেওয়ার সময়।a তাই, যীশু তিনবার যা বলেছিলেন করবেন না, এবারে ঠিক তাই করলেন। তিনি মহিলাটির মেয়েকে সুস্থ করে তুললেন!—মথি ১৫:২১-২৮.
৭. পিতামাতারা কিভাবে যুক্তিবাদিতা দেখাতে পারেন এবং কেন?
৭ প্রয়োজন হলে আমরাও কি মানিয়ে নেওয়ার জন্য পরিচিত? পিতামাতাদের প্রায়ই এইরকম যুক্তিবাদিতা দেখাতে হয়। যেহেতু প্রতিটি শিশু ভিন্ন প্রকৃতির একজনের সাথে যে পদ্ধতি কাজ করে, অন্যজনের ক্ষেত্রে তা অনুপযুক্ত হতে পারে। এছাড়াও, ছেলেমেয়েরা বড় হলে, তাদের প্রয়োজনেরও পরিবর্তন হয়। কখন বাড়ি ফিরতে হবে, তার সময় কি পরিবর্তন করতে হবে? পারিবারিক অধ্যয়ন আরও উপভোগ্য করে তুললে কি লাভ হতে পারে? সামান্য কিছু ভুলের জন্য যদি পিতামাতা খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখান, তাহলে শুধরে নেওয়ার জন্য তিনি কি যথেষ্ট নম্র? এই সব বিষয়ে যে পিতামাতারা মানিয়ে নেওয়ার মনোভাব রাখেন, তারা তাদের ছেলেমেয়েদের অযথা বিরক্ত করেন না এবং যিহোবার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যান না।—ইফিষীয় ৬:৪.
৮. এলাকার প্রয়োজন অনুযায়ী মণ্ডলীর প্রাচীনেরা কিভাবে মানিয়ে নিতে পারেন?
৮ নতুন পরিস্থিতি উত্থাপিত হলে প্রাচীনদেরও মানিয়ে নিতে হবে, কিন্তু তারা ঈশ্বরের কোন বিশেষ নিয়মের সাথে আপোশ করতে পারে না। প্রচার কাজ দেখাশোনা করাতে, আপনার এলাকায় কোন পরিবর্তন সম্বন্ধে কি আপনি সচেতন থাকেন? আপনার এলাকাতে জীবনধারায় পরিবর্তনের সাথে সাথে হয়ত বিকালে সাক্ষ্য দেওয়া, রাস্তায় প্রচার করা এবং টেলিফোনের মাধ্যমে সাক্ষ্য দেওয়া বাড়িয়ে তোলা উচিত। এই সব ক্ষেত্রে মানিয়ে নিলে, আমরা আরও ভালভাবে প্রচার করার দায়িত্ব পালন করতে পারব। (মথি ২৮:১৯, ২০; ১ করিন্থীয় ৯:২৬) পৌলও পরিচর্যায় সব ধরনের লোকেদের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। আমরা কি তাই করি, উদাহরণস্বরূপ আমরা কি স্থানীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে যথেষ্ট জানতে চেষ্টা করি যাতে লোকেদের সাহায্য করতে পারি?—১ করিন্থীয় ৯:১৯-২৩.
৯. একজন প্রাচীন অতীতে যেভাবে সমস্যার মোকাবিলা করেছেন, সেই একই ধারা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কেন তার জোর করা উচিত নয়?
৯ এই শেষকাল যত বেশি সঙ্কটপূর্ণ হয়ে উঠবে, পালের সামনে যে সব বিভ্রান্তিকর এবং অপ্রিয় সমস্যা দেখা দেবে, সেগুলির সাথে পালকদের মানিয়ে নিতে হতে পারে। (২ তীমথিয় ৩:১) প্রাচীনেরা, গোঁড়া মনোভাব রাখবার সময় এটি নয়! একজন প্রাচীন অতীতে যেভাবে সমস্যার মোকাবিলা করেছেন তা যদি অকার্যকরী হয়ে পড়ে অথবা “বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান দাসশ্রেণী” যদি সেই বিষয়ে নতুন কোন তথ্য প্রকাশিত করেন, তাহলে তিনি নিশ্চয় সেই একইভাবে কাজ করে যেতে চাইবেন না। (মথি ২৪:৪৫; তুলনা করুন উপদেশক ৭:১০; ১ করিন্থীয় ৭:৩১.) একজন বিশ্বস্ত প্রাচীন সত্যিই একজন মানসিক অবসাদগ্রস্ত ভগ্নীকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেছিলেন, যার একজন ভাল শ্রোতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি তার সমস্যাকে সাধারণ মনে করেছিলেন এবং সহজ কিছু সমাধান দিয়েছিলেন। তারপরে, ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটি সেই একই সমস্যার উপরে কিছু বাইবেলভিত্তিক তথ্য প্রকাশিত করেছিল। প্রাচীনটি আবার সেই ভগ্নীর সাথে কথা বলেছিলেন, আর এইবারে নতুন তথ্য প্রয়োগ করে তার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছিলেন। (তুলনা করুন ১ থিষলনীকীয় ৫:১৪, ১৫.) যুক্তিবাদিতার কী অপূর্ব উদাহরণ!
১০. (ক) পরস্পরের প্রতি এবং প্রাচীনগোষ্ঠীর প্রতি প্রাচীনেরা কিভাবে মেনে নেওয়ার মনোভাব দেখাতে পারেন? (খ) যে ব্যক্তিরা অযৌক্তিক, প্রাচীনগোষ্ঠীর তাদের কিভাবে দেখা উচিত?
১০ প্রাচীনদের পরস্পরের প্রতিও মানিয়ে নেওয়ার মনোভাব রাখতে হবে। যখন প্রাচীনদের গোষ্ঠী একত্রিত হয়, তখন কোন একজন প্রাচীনের কর্তৃত্ব না করা কত গুরুত্বপূর্ণ! (লূক ৯:৪৮) যে পরিচালনা করেছেন, তাকে বিশেষভাবে এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আর যদি গোষ্ঠীর সঙ্গে একজন বা দুজন প্রাচীনের মতের মিল না হয়, তাহলে তারা নিজেদের মতামত জারি করতে চেষ্টা করবেন না। বরং, কোন শাস্ত্রীয় নীতি লঙ্ঘন না করা হলে, তাদের মনে নিতে হবে এবং মনে রাখতে হবে যে প্রাচীনদের যুক্তিবাদী হওয়া এবং মনে রাখতে হবে যে প্রাচীনদের যুক্তিবাদী ওয়া প্রয়োজন। (১ তীমথিয় ৩:২, ৩) অপরপক্ষে, প্রাচীনগোষ্ঠীর মনে রাখা উচিত যে পৌল করিন্থীয় মণ্ডলীকে ভর্ৎসনা করেছিলেন কারণ তারা ‘নির্ব্বোধ লোকদের’ সহ্য করত, যারা নিজেদের “প্রেরিত চূড়ামণি” বলে ঘোষণা করত। (২ করিন্থীয় ১১:৫, ১৯, ২০) সুতরাং কোন সহপ্রাচীন যদি একগুঁয়ে, অযৌক্তিক আচরণ করেন, তাহলে তাদের উচিত তাকে উপদেশ দেওয়া, কিন্তু তাদের মৃদুতা ও নম্রতার সাথে তা করতে হবে।—গালাতীয় ৬:১.
কর্তৃত্ব জারি করায় যুক্তিবাদিতা
১১. যীশুর দিনের যিহুদী ধর্মীয় নেতারা এবং যীশু যেভাবে কর্তৃত্ব ব্যবহার করতেন, তার মধ্যে কী পার্থক্য ছিল?
১১ যীশু যখন পৃথিবীতে ছিলেন, তখন তিনি যেভাবে তাঁর ঈশ্বর-দত্ত কর্তৃত্ব ব্যবহার করতেন, তার মধ্যে দিয়ে সত্যিই যুক্তিবাদিতা প্রকাশ পেত। তখনকার ধর্মীয় নেতাদের থেকে তিনি কত পৃথক ছিলেন! একটি উদাহরণ বিবেচনা করুন। ঈশ্বরের নিয়মে আদেশ দেওয়া হয়েছিল যে বিশ্রামবারে কোন কাজ করা হবে না, এমনকি কাঠও সংগ্রহ করা যাবে না। (যাত্রাপুস্তক ২০:১০; গণনাপুস্তক ১৫:৩২-৩৬) লোকেরা কিভাবে এই নিয়মটি প্রয়োগ করবে, ধর্মীয় নেতারা তা নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেছিল। তাই তারা নিজেদের মত অনুযায়ী জারি করেছিল যে বিশ্রাম বারে লোকে কী কী তুলতে পারে। তাদের নিয়ম ছিল: দুটি শুকনো ডুমুর ফলের থেকে ভারি কিছুই তোলা যাবে না। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে যে চটিতে পেরেক থাকত, সেগুলিও অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাদের যুক্তি ছিল যে পেরেকের অতিরিক্ত ভার তুললে, তা কাজ করা সামিল হবে! বলা হয়েছে যে বিশ্রামবার সম্বন্ধে ঈশ্বরের নিয়মের সাথে রব্বিরা সর্বমোট ৩৯টি আইন যোগ করেছিল আর পরে তার সঙ্গে আরও অসংখ্য নিয়ম জারি করেছিল। বিপরীতে, যীশু বহু নিষেধাজ্ঞা জারি করে অথবা কঠিন, অসাধ্য মান স্থাপন করে লোকেদের লজ্জিত করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাননি।—মথি ২৩:২-৪; যোহন ৭:৪৭-৪৯.
১২. আমরা কেন বলতে পারি, যে যিহোবার ধার্মিক মানের ক্ষেত্রে যীশু আপোশ করতেন না?
১২ তাহলে আমাদের কি ধরে নেওয়া উচিত যে যীশু ঈশ্বরের ধার্মিক মানকে দৃঢ়ভাবে পালন করেননি? তিনি অবশ্যই করেছিলেন! তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে নিয়ম সবচেয়ে বেশি কার্যকারী হয় যখন লোকে সেই নিয়মের অন্তর্নিহিত নীতিটি গ্রহণ করতে পারে। তাই ফরীশীরা যখন অসংখ্য নিয়ম স্থাপন করে লোকেদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করছিল, তখন যীশু তাদের হৃদয়ে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ভালভাবেই জানতেন যে “ব্যভিচার হইতে পলায়ন কর,” এইধরনের ঐশ্বরিক নিয়মের সাথে কোন আপোশ করা যায় না। (১ করিন্থীয় ৬:১৮) তাই যে ধরনের চিন্তা অনৈতিকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যীশু লোকেদের সেই সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিলেন। (মথি ৫:২৮) কঠিন, অবশ্য-করণীয় নিয়মের থেকে এইরকম শিক্ষার জন্য অনেক বেশি প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন হয়।
১৩. (ক) প্রাচীনদের কেন কঠোর নিয়ম ও আইন সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে হবে? (খ) কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে লোকেদের বিবেককে সম্মান দেখানো ভাল?
১৩ বর্তমানে, দায়িত্বসম্পন্ন ভাইরাও হৃদয়ে পৌঁছানোর জন্য আগ্রহী। সুতরাং, তারাও স্বেচ্ছাচারী, কঠোর নিয়ম স্থাপন করা অথবা নিজেদের মতামত বা ইচ্ছাকে আইন করে তোলা এড়িয়ে চলেন। (তুলনা করুন দানিয়েল ৬:৭-১৬.) কখনও কখনও পোশাকপরিচ্ছদ পরা সম্বন্ধে নম্রভাবে মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু একজন প্রাচীন যদি এই বিষয়ে অতিরিক্ত জোর দেন বা তার নিজস্ব পছন্দ জারি করতে চেষ্টা করেন, তাহলে একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তি হিসাবে তিনি নিজের সুনাম নষ্ট করবেন। প্রকৃতই, মণ্ডলীর সকলের উচিত অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করা এড়িয়ে চলা।—তুলনা করুন ২ করিন্থীয় ১:২৪; ফিলিপীয় ২:১২.
১৪. অন্যদের থেকে কিছু আশা করা সম্বন্ধে যীশু কিভাবে দেখিয়েছিলেন যে তিনি যুক্তিবাদী?
১৪ আরেকটি বিষয়েও প্রাচীনদের নিজেদের পরীক্ষা করা উচিত: ‘অন্যদের কাছ থেকে আমি যা আশা করি, সেই বিষয়ে কি আমি যুক্তিবাদী?’ যীশু অবশ্যই ছিলেন। তিনি সবসময়ে তাঁর অনুগামীদের দেখিয়েছিলেন যে তাদের পূর্ণ-হৃদয় প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই তিনি চান না এবং সেই প্রচেষ্টাকে তিনি খুবই মূল্যবান মনে করতেন। দরিদ্র বিধবাটি যখন অল্প মূল্যের পয়সা দান করেছিল, তখন তিনি তাকে প্রশংসা করেছিলেন। (মার্ক ১২:৪২, ৪৩) দামী তেল দান করার জন্য যখন তাঁর শিষ্যরা মরিয়মের সমালোচনা করেছিল, তিনি তাদের ভর্ৎসনা করেছিলেন এবং প্রশংসা করেছিলেন। (মার্ক ১২:৪২, ৪৩) দামী তেল দান করার জন্য যখন তাঁর শিষ্যরা মরিয়মের সমালোচনা করেছিল, তিনি তাদের ভর্ৎসনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন: “ইহাকে থাকিতে দেও, . . . এ যাহা করিতে পারিত, তাহাই করিল।” (মার্ক ১৪:৬, ৮) এমনকি যখন তাঁর অনুগামীরা কোন ভুল কাজ করত, তখনও তিনি যুক্তিবাদী মনোভাব রাখতেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বন্দী হওয়ার রাতে যখন তাঁর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ তিনজন প্রেরিতকে তিনি বলেছিলেন তাঁর সাথে জেগে থেকে পাহারা দিতে, তখন বার বার ঘুমিয়ে পড়ে তারা তাঁকে হতাশ করেছিল। তবুও, তিনি সমবেদনার সাথে বলেছিলেন: “আত্মা ইচ্ছুক বটে, কিন্তু মাংস দুর্ব্বল।”—মার্ক ১৪:৩৪-৩৮.
১৫, ১৬. (ক) প্রাচীনদের কেন সাবধান থাকতে হবে যে তারা যেন পালকে বিরক্ত না করে বা তাদের উপরে চাপ না দেয়? (খ) একজন বিশ্বস্ত ভগ্নী কিভাবে অন্যদের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করার ক্ষেত্রে পরিবর্তন করেছিলেন?
১৫ হ্যাঁ, যীশু তাঁর অনুগামীদের উৎসাহ দিয়েছিলেন ‘প্রাণপণ করতে।’ (লূক ১৩:২৪) কিন্তু তিনি কখনও তাদের উপরে চাপ দেননি! তিনি তাদের প্রেরণা দিয়েছিলেন, উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন, নেতৃত্ব নিয়েছিলেন এবং তাদের হৃদয়ে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছিলেন। বাকি কাজের জন্য তিনি যিহোবার আত্মার ক্ষমতার উপরে নির্ভর করেছিলেন। একইভাবে বর্তমা নেও প্রাচীনদের উচিত পূর্ণ-হৃদয়ে যিহোবার সেবা করার জন্য পালকে উৎসাহ দেওয়া, কিন্তু কখনও তাদের মনে অপরাধবোধ বা লজ্জা জাগিয়ে তোলা উচিত নয়, যেন যিহোবার পরিচর্যায় এখন তারা যা করেছে তা অযোগ্য বা যথেষ্ট নয়। যারা যতটা সম্ভব তাই করছে, তাদের যদি কঠোরভাবে বলা হয় “আরও কর, আরও কর, আরও কর,” তাহলে তারা হতাশ হয়ে পড়তে পারে। কোন প্রাচীন সম্বন্ধে যদি বলা হয় যে তাকে “সহজে খুশি করা যায় না,” তাহলে তা কত দুঃখজনক—যুক্তিবাদিতা থেকে তিনি কত দূরে সরে পড়েছেন!—১ পিতর ২:১৮.
১৬ অন্যদের কাছ থেকে যা আশা করি, সেই সম্বন্ধে আমাদের সকলের যুক্তিবাদী হওয়া উচিত! একজন ভগ্নী, তার স্বামীর সঙ্গে মিশনারী কাজ ছেড়ে তার অসুস্থ মায়ের দেখাশোনা করার জন্য ফিরে এসে লিখেছিলেন: “মণ্ডলীর প্রকাশকদের জন্য এই সময়টি সত্যিই কষ্টকর। সীমা ও জেলার কাজে, সমস্ত রকম চাপ থেকে সুরক্ষিত থেকে, আমরা হঠাৎ বাস্তব সম্বন্ধে জানতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, আমি নিজের মনে চিন্তা করতাম, ‘এই ভগ্নীটি এই মাসের সঠিক সাহিত্য দিচ্ছে না কেন? ও কি আমাদের রাজ্যের পরিচর্য্যা পড়ে না?’ এখন আমি জানি কেন। শুধুমাত্র প্রচারে যাওয়াই কয়েকজনের পক্ষে সম্ভব হয়।” আমাদের ভাইরা যা করতে পারে না, সেইজন্য তাদের বিচার করার পরিবর্তে যা তারা করতে পারে, সেইজন্য তাদের প্রশংসা করা কত বেশি ভাল!
১৭. যুক্তিবাদিতা সম্বন্ধে যীশু কিভাবে আমাদের জন্য উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন?
১৭ একটি শেষ উদাহরণ বিবেচনা করুন, যে বিষয়ে যীশু যুক্তিবাদিতার সাথে কর্তৃত্ব ব্যবহার করেন। তাঁর পিতার মত, যীশুও প্রবলভাবে তাঁর কর্তৃত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করেন না। তিনিও কাজ ভাগ করে দেন, পৃথিবীতে তাঁর “নিজ পরিজনের” যত্ন নেওয়ার জন্য তিনি বিশ্বস্ত দাসশ্রেণীকে নিযুক্ত করেছেন। (মথি ২৪:৪৫-৪৭) আর তিনি অন্যদের ইচ্ছা শুনতে ভয় পান না। তিনি প্রায়ই তাঁর শ্রোতাদের জিজ্ঞাসা করতেন: “তোমাদের কেমন বোধ হয়?” (মথি ১৭:২৫; ১৮:১২; ২১:২৮;২২:৪২) বর্তমানে খ্রীষ্টের সকল অনুগামীদের মধ্যেও তাই হওয়া উচিত। যতটা কর্তৃত্বই থাকুক না কেন, তাদের অন্যদের মতামত শুনতে অনিচ্ছুক হওয়া উচিত নয়। পিতামাতারা, শুনুন! স্বামীরা, শুনুন! প্রাচীনেরা, শুনুন!
১৮. (ক) আমাদের যুক্তিবাদী হওয়ার সুনাম আছে কি না, আমরা তা কিভাবে জানতে পারি? (খ) আমাদের সকলের কী করা উচিত?
১৮ আমাদের মধ্যে সকলে নিশ্চয় “যুক্তিবাদী হওয়ার সুনাম” রাখতে চাই। (ফিলিপীয় ৪:৫, ফিলিপস্) কিন্তু আমরা কিভাবে জানব যে আমাদের সেই সুনাম আছে? লোকে যীশুর সম্বন্ধে কী বলছে, তা জানবার আগ্রহ যখন তাঁর হয়েছিল, তখন তিনি তাঁর বিশ্বস্ত অনুগামীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন। (মথি ১৬:১৩) তাঁর উদাহরণ অনুকরণ করুন না কেন? যার উপরে আপনি বিশ্বাস রাখেন, তাকে স্পষ্টভাবে বলতে বলুন যে যুক্তিবাদী, বাস্তবিক ব্যক্তি হিসাবে আপনার সুনাম আছে কি না? যুক্তিবাদিতা সম্বন্ধে যীশুর নিখুঁত উদাহরণ আরও ভালভাবে অনুকরণ করার জন্য আমরা সকলে অবশ্যই আরও কিছু করতে পারি! বিশেষত আমাদের যদি অন্যদের উপরে কর্তৃত্ব করার কিছুটা অধিকার থাকে, তাহলে আমাদের উচিত সবসময়ে যিহোবা ও যীশুর উদাহরণ অনুকরণ করা, সবসময়ে যুক্তির সাথে সেই কর্তৃত্ব ব্যবহার করা, প্রয়োজন হলে সবসময়ে ক্ষমা করতে, পরিবর্তন করতে এবং মানিয়ে নিতে প্রস্তুত থাকা। বাস্তবিকই, আমাদের সকলের উচিত “যুক্তিবাদী” হওয়ার চেষ্টা করা!—তীত ৩:২, NW.
[পাদটীকাগুলো]
a নিউ টেস্টামেন্ট ওয়ার্ডস্ বইটি উল্লেখ করে যে: “যে ব্যক্তি ইপাইকেস্ [যুক্তিবাদী], সে জানে যে কয়েকসময় এমন বিষয় উপস্থিত হয় যা হয়ত আইনত সম্পূর্ণরূপে সঠিক, কিন্তু নৈতিকভাবে সম্পূর্ণ ভুল হতে পারে। যে ব্যক্তি ইপাইকেস্, সে জানে কখন আইনের থেকেও বড় এবং মহান নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে, আইনের বাইরে যেতে হয়।”
আপনি কিভাবে উত্তর দেবেন?
▫ খ্রীষ্টানদের কেন যুক্তিবাদী হওয়া উচিত?
▫ ক্ষমাশীল হওয়া সম্বন্ধে প্রাচীনেরা কিভাবে যীশুকে অনুকরণ করতে পারেন?
▫ যীশু যেমন মানিয়ে নিতেন, আমাদের কেন সেইরকম হওয়ার চেষ্টা করা উচিত?
▫ আমরা যেভাবে কর্তৃত্ব ব্যবহার করি, তার মাধ্যমে আমরা কিভাবে যুক্তিবাদিতা দেখাতে পারি?
▫ আমরা সত্যিই যুক্তিবাদী কি না, তা আমরা কিভাবে পরীক্ষা করতে পারি?
[১৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
অনুতপ্ত পিতরকে যীশু ক্ষমা করেছিলেন
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
যখন একজন নারী অসামান্য বিশ্বাস দেখিয়েছিল, যীশু বুঝতে পেরেছিলেন যে সেটি কোন নিয়ম স্থাপন করার সময় ছিল না
[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
পিতামাতার শুনুন!
[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
স্বামীরা শুনুন!
[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
প্রাচীনেরা শুনুন!