বিজ্ঞান, ধর্ম আর সত্যের অন্বেষণ
“বহু মিথ্যা ধর্মের যে প্রসার ঘটেছে, তা আমাকে কিছুটা প্রভাবিত করেছিল।”—চালর্স ডারউইন
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে, বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে একটি প্রীতির সম্পর্ক ছিল। “এমনকি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলিতেও,” ডারউইন: আগে ও পরে (ইংরাজী) বইটি জানিয়েছে, “লেখকেরা স্বাভাবিক এবং আন্তরিকভাবে ঈশ্বরের সম্বন্ধে উল্লেখ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না।”
ডারউইনের প্রজাতিগুলির উৎপত্তি এইসব কিছু পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। বিজ্ঞান এবং ক্রমবিবর্তনের মধ্যে একটি সম্পর্ক সৃষ্টি হয় যার থেকে ধর্ম —এবং ঈশ্বরকে—দূরে সরিয়ে রাখা হয়। “ক্রমবিবর্তনবাদের চিন্তাধারায়,” স্যার জুলিয়ান হাক্সলি বলেছেন, “অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ের কোন প্রয়োজন অথবা স্থান নেই।”
বর্তমানে, ক্রমবিবর্তনবাদকে বিজ্ঞানের একটি অপরিহার্য ভিত্তি হিসাবে দেখা হয়। এই সম্পর্কের একটি প্রধান কারণকে পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল শনাক্ত করেছেন: “গোঁড়া বৈজ্ঞানিকরা সত্য অন্বেষণ করবার তুলনায়, অতীতকালের ধর্মের অবাস্তব চিন্তাধারায় ফিরে না যাওয়ার প্রতি বেশি আগ্রহী।” কী ধরনের অবাস্তবতা ধর্মকে বিজ্ঞানের কাছে এত বিতৃষ্ণাজনক করে তুলেছে?
ধর্ম সৃষ্টির দুর্নাম করেছে
বাইবেলকে সমর্থন করার প্রচেষ্টায়, “সৃষ্টিবাদীরা”—ফাণ্ডামেন্টালিস্ট প্রোটেস্টান্টদের সাথে—দাবি করেছে যে পৃথিবী এবং মহাবিশ্বের বয়স ১০,০০০ বছরের কম। এই অবাস্তব চিন্তাধারা ভূতত্ত্ববিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ এবং পদার্থবিজ্ঞানীদের উপহাসের বিষয় হয়েছে, কারণ তাদের আবিষ্কারের সাথে তা মেলেনি।
কিন্তু বাইবেল সত্যিই কি বলেছে? “আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন।” (আদিপুস্তক ১:১) সময় সম্বন্ধে কিছু বলা হয়নি। সৃষ্টির “প্রথম দিবস” সম্বন্ধে আদিপুস্তক ১:৩-৫ পদের আগে উল্লেখই করা হয়নি। যখন প্রথম “দিবস” শুরু হয়েছিল, তার আগে থেকেই “আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর” অস্তিত্ব ছিল। সুতরাং, বৈজ্ঞানিকেরা যেমন দাবি করেন, আকাশমণ্ডল এবং পৃথিবী কি কোটি কোটি বছর পুরনো হতে পারে? অবশ্যই পারে। কতদিন সময় লেগেছিল সেই সম্বন্ধে বাইবেলে কিছু বলা হয়নি।
ধর্মের আরেকটি অবাস্তবতা হল যেভাবে তারা সৃষ্টির ছয় ‘দিবসকে’ চিত্রিত করে। কিন্তু ফাণ্ডামেন্টালিস্টরা দাবি করে যে এই দিনগুলি হল আক্ষরিক অর্থাৎ পার্থিব সৃষ্টি ১৪৪ ঘন্টার মধ্যে হয়েছে। এইজন্য বৈজ্ঞানিকদের মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়, কারণ তারা জানেন যে স্পষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য এই চিন্তাধারাকে সমর্থন করে না।
কিন্তু, বিজ্ঞানের সঙ্গে মতবিরোধ হল বাইবেলের ফাণ্ডামেন্টাল ব্যাখ্যার—স্বয়ং বাইবেলের সঙ্গে নয়। বাইবেল বলে না যে সৃষ্টির প্রত্যেকটি দিনের মেয়াদ ২৪ ঘন্টা ছিল; প্রকৃতপক্ষে, এই সমস্ত ‘দিবসগুলিকে’ সেই আরও অনেক বড় দিনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ‘যে দিন সদাপ্রভু ঈশ্বর পৃথিবী ও আকাশমণ্ডল নির্ম্মাণ করেছিলেন’ যা দেখায় বাইবেলের সব ‘দিবসগুলি’ শুধু ২৪ ঘন্টা নয়। (আদিপুস্তক ২:৪) কিছু, হয়ত অনেক হাজার বছর বড় ছিল।a
সুতরাং, সৃষ্টিবাদীরা এবং ফাণ্ডামেন্টালিস্টরা সৃষ্টির চিন্তাধারাকে দুর্নাম করেছে। মহাবিশ্বের বয়স এবং সৃষ্টির ‘দিবসগুলির’ মেয়াদ সম্বন্ধে তাদের শিক্ষা যুক্তিযুক্ত বিজ্ঞান বা বাইবেল, কোনটির সাথেই সামঞ্জস্য রাখে না। কিন্তু আরও অন্যান্য অবাস্তবতা আছে যা ধর্মকে বিজ্ঞানের কাছে বিতৃষ্ণাজনক করে তুলেছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার
বহুকাল ধরে, ধর্ম অনেক অন্যায়ের কারণ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যযুগে ইউরোপীয় একনায়ক শাসনব্যবস্থার প্রতি গির্জার সমর্থনের পিছনে যুক্তি দেখানোর জন্য সৃষ্টির মতবাদকে বিকৃত করা হয়েছিল। তারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল যে ঈশ্বরের ইচ্ছায় মানুষকে ধনী বা দরিদ্রের পর্যায় রাখা হয়। বুদ্ধিমান মহাবিশ্ব (ইংরাজী) বইতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: “ধনী ব্যক্তিদের কনিষ্ঠপুত্রদের বলা হত যে ‘ঈশ্বরের ব্যবস্থা’ হল যে তারা উত্তরাধিকারসূত্রে পারিবারিক বিষয়সম্পত্তির অল্প অথবা কিছুই পাবে না এবং শ্রমিকদের ক্রমাগত বলা হত ‘ঈশ্বর যে পর্যায় তদের রাখতে ইচ্ছা করেছেন’ তাতেই যেন তারা খুশি থাকে।”
সুতরাং আশ্চর্যের বিষয় নয় যে অনেকে “অতীতের ধর্মীয় অবাস্তবতায়” ফিরে যেতে ভয় পায়! মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদা মিটানোর পরিবর্তে ধর্ম প্রায়ই তাদের অবস্থার সুযোগ নিয়েছে। (যিহিষ্কেল ৩৪:২) ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে: “ধর্ম যে ধরনের কাজকর্ম করেছে তা সত্ত্বেও, লোকের যে এখনও সামান্য বিশ্বাস আছে, তা আশ্চর্যের বিষয়। . . . সর্বেসর্বা সৃষ্টিকর্তার নামে, . . . মানুষে সহমানবের প্রতি অত্যন্ত নির্মম ব্যবহার করেছে।”
মিথ্যা ধর্মের সাংঘাতিক রেকর্ড ডারউইনের চিন্তাধারায় বেশ বড় প্রভাব ফেলেছিল। “ক্রমে আমার ধারণা হয়েছিল যে খ্রীষ্টধর্ম ঈশ্বরের প্রকাশ দ্বারা আসেনি,” তিনি লিখেছিলেন। “বহু মিথ্যা ধর্মের যে প্রবল প্রসার ঘটেছে, তা আমাকে কিছুটা প্রভাবিত করেছিল।”
সত্য ধর্মের জয়
ধর্মভ্রষ্টতা পৃথিবীতে এই প্রথম নয়। যীশু তাঁর দিনের ক্ষমতা-লোভী ধর্মীয় নেতাদের বলেছিলেন: “বাইরে তোমরা ভদ্রলোকেদের মত দেখতে—কিন্তু ভিতরে তোমরা প্রতারণা ও মন্দতায় পরিপূর্ণ।”—মথি ২৩:২৮, ফিলপস্।
কিন্তু, প্রকৃত খ্রীষ্টতত্ত্ব “এ জগতের অংশ” নয়। (যোহন ১৭:১৬) তার অনুগামীরা ভ্রষ্ট ধর্ম এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে না; যে দর্শনবাদ ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তার দ্বারাও তারা ভ্রান্ত হয় না। “এই জগতের যে জ্ঞান, তাহা ঈশ্বরের নিকটে মূর্খতা,” প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন।—১ করিন্থীয় ৩:১৯.
কিন্তু এর অর্থ নয় যে খ্রীষ্টানেরা বিজ্ঞান সম্বন্ধে অজ্ঞ। বরং, সত্য ধর্মের অনুগামীরা বিজ্ঞানের দ্বারা অভিভূত। “ঊর্দ্ধদিকে চক্ষু তুলিয়া দেখ,” ভাববাদী যিশায়ইকে বলা হয়েছিল। “ঐ সকলের সৃষ্টি কে করিয়াছে?” (যিশাইয় ৪০:২৬) একইভাবে, সৃষ্টিকর্তাকে আরও ভালভাবে জানবার জন্য, প্রকৃতি এবং মহাবিশ্বের আশ্চর্য বিষয়গুলিকে জানতে ইয়োবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।—ইয়োব, ৩৮-৪১ অধ্যায়।
হ্যাঁ, যারা সৃষ্টিকর্তাতে বিশ্বাস করে, তারা সৃষ্টিকে শ্রদ্ধামিশ্রিত সম্মানের সাথে দেখে। (গীত ১৩৯:১৪) এছাড়াও, সৃষ্টিকর্তা যিহোবা, ভবিষ্যতের অপূর্ব আশা সম্বন্ধে যা বলেন তা তারা বিশ্বাস করে। (প্রকাশিত বাক্য ২১:১১-৪) বাইবেল অধ্যয়ন করবার মাধ্যমে, লক্ষ লক্ষ লোক জানতে পারছে যে মানুষের উৎস অথবা তার ভবিষ্যৎ কোন আকস্মিক ঘটনার উপরে নির্ভরশীল নয়। বরং, মানুষকে সৃষ্টি করার পিছনে যিহোবার একটি উদ্দেশ্য আছে এবং সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে—সমস্ত বাধ্য মানবজাতি আশীর্বাদ লাভ করবে। আমরা আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি যে আপনি নিজে এই বিষয়টি জানবার চেষ্টা করুন।
[পাদটীকাগুলো]
a দ্যা ওয়াচটাওয়ার বাইবেল অ্যাণ্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত সচেতন থাক! পত্রিকার নভেম্বর ৮, ১৯৮২ সালের সংখ্যার পৃষ্ঠা ৬-৯ এবং শাস্ত্রের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৫৪৫ দেখুন। সৃষ্টিবাদ এবং বিজ্ঞানের সঙ্গে তার মতবিরোধ সম্বন্ধে আরও তথ্যের জন্য সচেতন থাক! পত্রিকার মার্চ ৮, ১৯৮৩ সালের সংখ্যার পৃষ্ঠা ১২-১৫ এবং মার্চ ২২, ১৯৮৩ সালের সংখ্যার পৃষ্ঠা ১২-১৫ দেখুন।
[৬ পৃষ্ঠার বাক্স]
প্রমাণ সম্বন্ধে অজ্ঞ?
“এমনকি যিহোবার সাক্ষীরাও বেশ ভালভাবে জীববিজ্ঞান সম্বন্ধে শিখেছে,” উকিল নর্মান ম্যাক্বেথ ১৯৭১ সালে ডারউইনের পুনর্বিচার—যুক্তির প্রতি একটি আবেদন (ইংরাজী) নামক তার বইতে লিখেছিলেন। ক্রমবিবর্তনবাদ সম্বন্ধে একটি আওয়েক! প্রবন্ধ পড়ে ম্যাক্বেথ লিখেছিলেন: “ডারউইনবাদের বিরুদ্ধে কিছু তীক্ষ্ম সমালোচনা যে এতে ছিল, আমি তা দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম।” প্রচুর গবেষণা এবং নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে উক্তিগুলি লক্ষ্য করে, লেখক এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন: “এখন আর সিম্পসনের বলা উচিত নয় যে’ . . . যারা এতে [ক্রমবিবর্তনবাদে] বিশ্বাস করে না, স্পস্টতই তাদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সম্বন্ধে জানে না।’”
[Picture appearing only in English]