যীশুর অলৌকিক কাজগুলি ইতিহাস না গল্প?
“চতুর্থ প্রহর রাত্রিতে তিনি সমুদ্রের উপর দিয়া হাঁটিয়া তাঁহাদের নিকটে আসিলেন।”—মথি ১৪:২৫.
পৃথিবীব্যাপী লক্ষ লক্ষ ব্যক্তির কাছে যীশু অলৌকিক কাজ করেছিলেন বলে যে বিশ্বাস, তা স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস করার মতই গুরুত্বপূর্ণ। সুসমাচারের লেখকগণ—মথি, মার্ক, লূক এবং যোহন—যীশুর প্রায় ৩৫টি অলৌকিক কাজের বিবরণ দেন। কিন্তু তাদের বর্ণনা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে তিনি আরও অনেক অতিপ্রাকৃত কাজ করেছিলেন।—মথি ৯:৩৫; লূক ৯:১১.
এই অলৌকিক কাজগুলি লোকের মনরঞ্জনের জন্য করা হয়নি। কিন্তু যীশু যে ঈশ্বরের পুত্র, বহু প্রতীক্ষিত মশীহ, সেই দাবি প্রমাণ করার জন্য এগুলি ছিল অপরিহার্য। (যোহন ১৪:১১) দাসত্বে আবদ্ধ ইস্রায়েল জাতির প্রতিনিধিত্ব করার সময়ে মোশি আশ্চর্য কাজ করেছিলেন। (যাত্রাপুস্তক ৪:১-৯) যুক্তিপূর্ণভাবে মশীহ, যাকে মোশির থেকে অনেক মহান ব্যক্তিরূপে ভাববাণী করা হয়েছিল, সেইজন্য আশা করা হয়েছিল যে তিনিও ঐশিক উৎস হতে কিছু আশ্চর্য কাজ করবেন। (দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১৫) এজন্য বাইবেল যীশুকে এমন এক ব্যক্তিরূপে চিত্রিত করে যিনি “পরাক্রম-কার্য্য, অদ্ভুত লক্ষণ ও চিহ্ন সমূহ দ্বারা [যিহূদীদের] নিকটে” ছিলেন—প্রেরিত ২:২২.
অতীতকালে বিনা দ্বিধায়, লোকে সাধারণত বাইবেলে বর্ণিত যীশুকে অলৌকিক কার্যকারীরূপে গ্রহণ করত। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলিতে সুসমাচারের বিবরণগুলি সমালোচকদের দ্বারা এক সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। লয়েড গ্রাহাম, তার লিখিত ডিসেপসনস্ অ্যাণ্ড মিথস্ অফ দি বাইবেল বইটিতে বাইবেলে বর্ণিত যীশুর সমুদ্রের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন এবং একথাও বলেন: “আক্ষরিকভাবে এটা বিশ্বাস করার জন্য যথেষ্ট অজ্ঞানতার প্রয়োজন, তথাপি, আক্ষরিকভাবে লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি ঘটনাটিকে বিশ্বাস করে থাকে। আর তারপর আমরা আশ্চর্য হয়ে ভাবি যে এই জগতের কী ত্রুটি রয়েছে। এমন অজ্ঞতা থাকলে আপনি আরও ভাল জগৎব্যবস্থা কী করে আশা করতে পারেন?”
অসম্ভব?
যাইহোক, এইধরনের সমালোচনা যুক্তিপূর্ণ নয়। দি ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোপিডিয়া আলৌকিক কাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলে যে “এটা এমন একটা ঘটনা যাকে আমাদের জানা প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।” এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, একটি রঙ্গিন টিভি, একটি ভ্রাম্যমান টেলিফোন, অথবা একটি ল্যাপটপ কমপিউটারকেও এক শতাব্দী আগে অলৌকিক কাজের পর্যায়ে ফেলা হত! এটা কি যুক্তিযুক্ত, যে যেহেতু আমরা আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অনুসারে কোন কিছুর ব্যাখ্যা করতে পারি না, সেইহেতু বিষয়টিকে অসম্ভব বলে দেওয়া?
আর একটি বিষয় বিবেচনার যোগ্য: প্রকৃত গ্রীক ভাষাতে যখন “নতুন নিয়ম” লেখা হয়েছিল, তখন “অলৌকিক” শব্দটিকে সেখানে ডাইনা-মিস বলা হয়েছিল—এমন একটি শব্দ যার প্রকৃত অর্থ হল “শক্তি।” এটাকে “পরাক্রম কার্য্য” অথবা “সামর্থ”-ও বলা হয়ে থাকে। (লূক ৬:১৯; ১ করিন্থীয় ১২:১০; মথি ২৫:১৫) বাইবেল দাবি করে যে যীশুর অলৌকিক কার্যসকল হল “ঈশ্বরের মহিমায় চমৎকৃত” কার্যের বহিঃপ্রকাশ। (লূক ৯:৪৩) এমন কাজগুলি কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পক্ষে অসম্ভব—এমন একজন যার কাছে রয়েছে ‘সামর্থের অধিক শক্তি’?—যিশাইয় ৪০:২৬.
বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণসকল
সুসমাচারের চারটি পুস্তক আরও ভালভাবে পরীক্ষা করলে বিশ্বাসযোগ্যতার আরও অধিক প্রমাণ পাওয়া যায়। একটি বিষয় বিবেচনা করার মত, সেটা হল এই ঘটনাগুলি, রূপকথা এবং কাহিনীর থেকে সুস্পষ্টরূপে আলাদা ধরনের। উদাহরণস্বরূপ, বিবেচনা করে দেখুন যীশুর মৃত্যুর পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে তাকে কেন্দ্র করে যে সব মিথ্যা গল্পগুলি ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন সন্দেহজনক “টমাসের সুসমাচার” ব্যাখ্যা করে: “যখন বালক যীশুর বয়স মাত্র পাঁচ বৎসর . . . তিনি একটি গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর একটি ছেলে দৌড়ে যাওয়ার সময় যীশুর কাঁধে ধাক্কা দেয়। যীশু অতিশয় রেগে যান ও ছেলেটিকে বলেন: ‘তুমি তোমার গন্তব্যপথে আর যেও না,’ এবং শিশুটি তৎক্ষণাৎ সেখানে পড়ে মারা যায়।” এই গল্পটির প্রকৃতি কেমন, তা উপলব্ধি করা কঠিন নয়—একটি ফন্দি আঁটা উপন্যাস মাত্র। এছাড়াও এখানে এই খেয়ালী হীনচেতা ছেলেটির বিবরণ বাইবেলে বর্ণিত যীশুর সাথে কোন মিল রাখে না।—তুলনা করুন লূক ২:৫১, ৫২.
এবার নির্ভরযোগ্য সুসমাচারের ঘটনাগুলির কথা বিবেচনা করুন। এগুলি অতিরঞ্জিত এবং কাল্পনিকভাবে বাড়িয়ে বলার থেকে মুক্ত। খেয়ালের বশবর্তী হয়ে নয়, কিন্তু প্রকৃত প্রয়োজন উপলব্ধি করেই যীশু আশ্চর্য কাজগুলি করেছিলেন। (মার্ক ১০:৪৬-৫২) নিজের সুবিধার্থে যীশু কখনও সেই শক্তিকে ব্যবহার করেননি। (মথি ৪:২-৪) আর কখনও তিনি তাঁর শক্তিকে লোক দেখাবার জন্য ব্যবহার করেননি। বস্তুতপক্ষে, যখন রাজা হেরোদ উৎসুক হয়ে যীশুকে আশ্চর্য “চিহ্ন” দেখাতে বলেন, তখন যীশু “তাঁহাকে কোন উত্তর দিলেন না।”—লূক ২৩:৮, ৯.
যীশুর অলৌকিক কাজগুলি ছিল পেশাদার মায়াবাদী, জাদুকর এবং বিশ্বাস আরোগ্যকারীদের থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। তাঁর পরাক্রম কার্যগুলি সর্বসময়ে ঈশ্বরকে গৌরবান্বিত করত। (যোহন ৯:৩; ১১:১-৪) তাঁর অলৌকিক কাজগুলি ছিল শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান, জাদুমন্ত্র, লোক দেখানো ও সন্মোহনবিদ্যা বা চাতুরি থেকে মুক্ত। যখন যীশু বর্তীময় নামে একজন অন্ধ ভিক্ষুকের সম্মুখীন হন, যে চেঁচিয়ে বলছিল, “রব্বূণী, যেন দেখিতে পাই,” তখন যীশু সরলভাবে তাকে বলেছিলেন: “চলিয়া যাও, তোমার বিশ্বাস তোমাকে সুস্থ করিল। তখনই সে দেখিতে পাইল।”—মার্ক ১০:৪৬-৫২.
সুসমাচারের বিবরণ দেখায় যে যীশু পরাক্রম কার্য করেছিলেন কোনরকম অবলম্বল না নিয়েই, বিশেষ করে আগে থেকে পরিকল্পনা না করে, অথবা কোনরকম জাদুবিদ্যা বা প্রতারণা না করে। বিপরীতে, সেগুলি জনসমক্ষে বিস্তর লোকের সামনে করা হয়েছিল! (মার্ক ৫:২৪-২৯; লূক ৭:১১-১৫)। আধুনিক দিনের বিশ্বাস আরোগ্যকারীদের মত, যাদের প্রচেষ্টা প্রায়ই ব্যর্থ হয়, তেমন না হয়ে লোকেদের সুস্থ করার তাঁর যে পরিকল্পনা, তা কখনও ব্যর্থ হত না এই ভেবে যে তার বিশ্বাসের অভাব আছে। মথি ৮:১৬ পদ জানায়: “তিনি সকল পীড়িত লোককে সুস্থ করিলেন।”
পণ্ডিত আর্থার পিয়ারসেন তার লিখিত বইতে “অনেক অভ্রান্ত প্রমাণ” (ইংরাজী) খ্রীষ্টতত্ত্বের প্রমাণসকল যীশুর অলৌকিক কাজের বিষয়ে বলেন, “তিনি যে সব ব্যক্তিকে মুহূর্তমধ্যে আরোগ্য করেছিলেন, তার প্রকৃতি ও সংখ্যা, এমনকি পুনরুত্থানের একটি ক্ষেত্রেও তিনি ব্যর্থ হননি, যা সকল যুগের অন্যান্য অলৌকিক কাজের থেকে তাঁকে আলাদা করে রাখে।”
জাগতিক ব্যক্তিদের পক্ষ হতে দৃঢ় সমর্থন
পিয়ারসেন আর একটি যুক্তিকে খাড়া করেন, যা সুসমাচারের পুস্তকের ঘটনাগুলিকে এইভাবে সমর্থন জানায়: “শাস্ত্রে লিখিত অলৌকিক কার্যগুলি যে ধ্রুব সত্য, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল যে যিহূদী শত্রুরা একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিল।” যিহূদী নেতাদের এক প্রবল ইচ্ছা ছিল যে কী করে যীশুকে হেয় করা যায়, কিন্তু তাঁর অলৌকিক কাজগুলি এতই জানাজানি হয়ে গিয়েছিল যে বিরোধীরা তা অস্বীকার করতে ভয় পেত। যেটুকু অবজ্ঞা তারা করতে পারত, তা হল তারা বলত যে এগুলি পৈশাচিক শক্তিতে করা হয়েছে। (মথি ১২:২২-২৪) যীশুর মৃত্যুর বেশ কয়েক শতাব্দী পরে যিহূদী তালমুডের লেখক ক্রমাগতভাবে যীশুর অলৌকিক কাজের প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু “যীশুর প্রতি যিহূদীদের অভিব্যক্তি” (ইংরাজি) বইটি অনুসারে তারা যীশুকে “জাদুবিদ্যার মাধ্যমে এসব করেছেন” বলে প্রত্যাখ্যান করে। যদি যীশুর অলৌকিক কাজের মধ্যে এতটুকু গল্পের লেশমাত্র পাওয়া যেত, তাহলে কি এমন নীরবে সকলে তা সহ্য করে নিত?
আরও প্রমাণ পাওয়া যায় চতুর্থ শতাব্দীর গির্জার ইতিহাসবেত্তা ইউসিবিয়াসের কাছ থেকে। তার লিখিত খ্রীষ্টের সময় থেকে কনস্টানটাইন পর্যন্ত গির্জার ইতিহাস (ইংরাজি) বইটিতে তিনি সাধু কোয়াড্রাটাস সম্বন্ধে লেখেন যিনি খ্রীষ্টতত্ত্বের সপক্ষে সম্রাটের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কোয়াড্রাটাস লিখেছিলেন: “আমাদের ত্রাণকর্তার কর্মসকল সবসময়ই লোকে দেখেছে, কারণ সেগুলি সত্য ঘটনা—যে সব লোকেরা তখন আরোগ্য লাভ করেছিল এবং পুনরুত্থিত হয়েছিল, শুধুমাত্র তখনই নয়, কিন্তু সর্বসময়ে তারা এগুলি দেখেছিল, এমনকি তাঁর চলে যাওয়ার পরে অনেক সময় পর্যন্ত; বস্তুতপক্ষে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমার জীবদ্দশা পর্যন্ত।” পণ্ডিত উইলিয়াম বার্কলে বলেছিলেন: “কোয়াড্রাটাস বলছেন যে তার জীবদ্দশা পর্যন্ত সেই সব ব্যক্তিরা ছিল যারা যীশুর অলৌকিক কাজ থেকে উপকৃত হয়েছিল, সেইসব ব্যক্তিরাও সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ছিল। এসব ঘটনা যদি অসত্য হত, তাহলে রোমীয় সরকারের পক্ষে তা মিথ্যা বলে প্রমাণ করা কতই না সহজ হত।”
যীশুর অলৌকিক কাজের প্রতি বিশ্বাস প্রদর্শন হল যুক্তিযুক্ত, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন এবং সম্পূর্ণরূপে প্রমাণের প্রতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। তৎসত্ত্বেও, যীশুর অলৌকিক কাজগুলি মৃত ইতিহাসমাত্র নয়। ইব্রীয় ১৩:৮ পদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়: “যীশু খ্রীষ্ট কল্য ও অদ্য এবং অনন্তকাল যে, সেই আছেন।” হ্যাঁ, তিনি বর্তমানে স্বর্গে জীবিত আছেন এবং তাঁর অলৌকিক শক্তিকে পৃথিবীতে মানবরূপে থাকাকালীন যতটা ব্যবহার করেছিলেন, তার চেয়ে আরও ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে পারেন। তাছাড়াও সুসমাচারের পুস্তকে বর্ণিত যীশুর অলৌকিক কার্যসকল (১) খ্রীষ্টানদের বর্তমান দিনে বাস্তবধর্মী শিক্ষা দেয়, (২) যীশুর বক্তিত্বের আকর্ষণীয় বিষয়গুলিকে তুলে ধরে এবং (৩) নিকট ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করায়, যখন আরও বেশি আশ্চর্যজনক ঘটনাসকল ঘটবে!
পরবর্তী প্রবন্ধ এই বিষয়গুলিকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে তিনটি সর্বজনবিদিত বাইবেলের ঘটনার প্রতি আলোকপাত করবে।