দৌরাত্ম্য সর্বত্র রয়েছে
ট্রাফিক লাইট পরিবর্তন হওয়ার জন্য নিজের গাড়ীতে তিনি বসে থাকার সময় চালকটি হঠাৎ করে লক্ষ্য করলেন যে এক বিশাল ব্যক্তি, গালিগালাজ ও আকাশের দিকে মুষ্টি ঘুরাতে ঘুরাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। চালক তার দরজা এবং জানালা বন্ধ করার জন্য উদ্যত হন, কিন্তু সেই বিশাল ব্যক্তিটি তার দিকে আসতেই থাকে। নিচের দিকে ঝুঁকে, সেই ব্যক্তিটি গাড়িটিকে নাড়াতে থাকে এবং গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করে। অবশেষে, হতাশ হয়ে সে তার দৃঢ় মুষ্টি তোলে এবং গাড়ির সামনের কাঁচ ভাঙচুর করে দেয়।
এটি কী কোন চলচিত্রের দৃশ্য থেকে তুলে নেওয়া কিছু? না! এটি একটি রাস্তার ঝগড়া মাত্র যা হাওয়াইয়ের ওএহু দ্বীপ পুঞ্জে ঘটে যা শান্তি এবং আরামদায়ক মনোভাবের জন্য খ্যাতিপ্রাপ্ত।
এই বিষয়টি কিন্তু অবাক করার মত কিছু নয়। দরজায় তালা, জানালায় গরাদ, বড় বড় অট্টালিকায় দারোয়ান এবং এমন সংকেত পর্যন্ত থাকে যা বলে যে, “চালকের কাছে টাকা নেই”—এই সবকিছুই একটি বিষয় দেখায়: দৌরাত্ম্য সর্বোত্রই রয়েছে!
গৃহেতে দৌরাত্ম্য
গৃহকে চিরদিন ধরে নেওয়া হয়েছে এক ব্যক্তির সুরক্ষার পরিবেশ হিসাবে। এই মনোরম ধারণাটি কিন্তু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবারে দৌরাত্ম্য, যার অন্তর্ভুক্ত শিশুর প্রতি অপব্যবহার, বিবাহ সাথীদের মারধর করা, হত্যা সারা জগতে খবরের শিরোনাম হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, মানচেস্টার গারজিয়ান উইকলি বলে যে, “ব্রিটেনে ৭,৫০,০০০ ছেলেমেয়ে গৃহেতে দৌরাত্ম্যের সম্মুখীন হওয়ার ফলে হয়ত দীর্ঘকালব্যাপী মানসিক আঘাত পেতে পারে।” এই রিপোর্টটি এক সমীক্ষার ভীত্তিতে ছিল যা এও লক্ষ্য করেছিল যে, “যে সব স্ত্রীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল তাদের চার জনের মধ্যে তিন জন বলে যে তাদের ছেলেমেয়েরা দৌরাত্ম্যমূলক ঘটনা দেখেছে এবং প্রায় দুই তৃতীয়াংশ তাদের মায়েদের প্রহারিত হতে দেখেছে।” একইভাবে, ইউ.এস. নিউস অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউ.এস. অ্যাডভাইসরী বোর্ড অন চাইল্ড অ্যাবুউস অ্যান্ড নেগলেক্ট অনুমান করে যে, “২,০০০ শিশু তাদের মধ্যে যাদের বেশির ভাগের বয়স ৪ বছরের নিচে, প্রতি বছর তাদের পিতামাতা অথবা তত্ত্বাবধায়কের হাতে মারা যায়।” রিপোর্টটি বলে, এটি ট্রাফিক দুর্ঘটনা, ডুবে মরা অথবা পড়ে গিয়ে মৃত্যুর সংখ্যার থেকে বেশি।
গৃহেতে দৌরাত্ম্যের অন্তর্ভুক্ত বিবাহ সাথীদের প্রতি অপব্যবহার, তা হয়ত ঠেলা দেওয়া, চর মারা, লাথি মারা, গলা টেপা, প্রহার করা, ছুরি বা বন্দুকের সাহায্যে ভয় দেখানো অথবা এমনকি হত্যা করাও হতে পারে। আর আজকে এইধরনের দৌরাত্ম্য উভয় পুরুষ এবং স্ত্রীর প্রতি প্রযোগ করা যেতে পারে। একটি সমীক্ষা লক্ষ্য করে যে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন দম্পতিদের মধ্যে দৌরাত্ম্য, এক চতুর্থাংশ পুরুষ শুরু করে এবং এক চতুর্থাংশ স্ত্রী শুরু করে এবং শেষভাগটি এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যেখানে উভয়কেই দোষারোপ করা যায়।
কর্মক্ষেত্রে দৌরাত্ম্য
গৃহ থেকে দূরে কার্যক্ষেত্র হল এমন একটি জায়গা যেখানে প্রথা অনুযায়ী এক ব্যক্তির নিয়ম, সম্মান এবং শৃঙ্খলা খুঁজে পাওয়া উচিত। কিন্তু তা এখন আর পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, ইউ.এস. ডিপার্টমেন্ট ওফ জাসটিস যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে তা দেখায় যে প্রতি বছর ৯,৭০,০০০ বেশি ব্যক্তিরা কর্মক্ষেত্রে দৌরাত্মমূলক অপরাধের শিকার হয়ে থাকে। আরেকভাবে বলতে গেলে, “কর্মীদের চার জনের মধ্যে একজনের কর্মক্ষেত্রে দৌরাত্মের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,” প্রফেশনাল সেফ্টি—জার্নাল অফ দ্যা অ্যামেরিকান সোসাইটি অফ সেফ্টি ইঞ্জিনিয়ার্স এর রিপোর্ট অনুযায়ী।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হল যে কার্যক্ষেত্রে দৌরাত্ম্য শুধু তর্কবিতর্কতে এবং গালিগালাজে সীমিত নয়। “দৌরাত্ম্য যা বিশেষ করে নিয়োগকর্তা এবং কর্মচারীর উপরে অন্য কর্মচারীর দ্বারা নির্দেশিত হয়ে থাকে তা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত-বৃদ্ধিরত নরহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে,” সেই একই রিপোর্ট বলে। ১৯৯২ সালে, ৬ জনের মধ্যে ১ জনের কার্য-সংক্রান্ত মৃত্যুর কারণ হল নরহত্যা; নারীদের ক্ষেত্রে এর সংখ্যা হল ২ জনের মধ্যে ১ জন। এই বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না যে এককালে নিয়মশৃঙ্খলাবদ্ধ কার্যক্ষেত্রে এখন এক দৌরাত্ম্যের ঢেউ বয়ে চলছে।
খেলাধূলা এবং আমোদপ্রমোদে দৌরাত্ম্য
খেলাধূলা এবং আমোদপ্রমোদকে বিনোদন এবং আরামের এক অবলম্বন হিসাবে ধরা হয় যাতে করে তা এক ব্যক্তিকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য সচেষ্ট করতে সতেজ করতে পারে। আজকে আমোদপ্রমোদ হল কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। এই লাভজনক ব্যবসায় যাতে করে আরও অধিক লাভ করা যায় তার জন্য, ব্যবসায়ীরা যে কোন রকম উপায় ব্যবহার করে। এর মধ্যে একটি হল দৌরাত্ম্য।
উদাহরণস্বরূপ, ফোর্বস, একটি ব্যবসা সংক্রান্ত পত্রিকা, রিপোর্ট করে একটি ভিডিও-গেম উৎপাদনকারীর একটি জনপ্রিয় যুদ্ধের খেলা আছে, যেখানে একজন যোদ্ধা তার বিপক্ষকের মাথা ও শিরদাঁড়া টেনে বার করে আনে এবং সেই একই সময়ে দর্শকেরা বলতে থাকে “মেরে ফেলো! মেরে ফেলো!” একই ভিডিও-গেম যা এক প্রতিদ্বন্দ্বি উৎপাদনকর্তা বাড় করেছে তাতে এই হত্যার দৃশ্য নেই। এর পরিণতি? যে ভিডিও-গেমটি বেশি দৌরাত্ম্যপূর্ণ সেটি তার প্রতিদ্বন্দ্বির থেকে ৩ এর পরিবর্তে ২ অনুপাতে বেশি বিক্রি হয়। আর এর অর্থ প্রচুর পরিমাণে টাকা। এই খেলাগুলির বাড়িতে খেলা যায় এমন সংস্করণটি যখন বাজারে আসে তখন কোম্পানিগুলি প্রথম দুই সপ্তাহে আন্তর্জাতিকভাবে $৬৫০ লক্ষ বিক্রি করে! যখন লাভ জড়িয়ে থাকে তখন দৌরাত্ম্য হয়ে থাকে খরিদ্দারদের জন্য আরেকটি টোপ মাত্র।
খেলাধূলায় দৌরাত্ম্য হল সম্পূর্ণ এক ভিন্ন বিষয়। খেলোয়াড়রা বেশির ভাগ সময়ে তারা যা ক্ষতি করে সেই বিষয়ে গর্ব করে থাকে। ১৯৯০ সালে একটি হকি খেলাতে, উদাহরণস্বরূপ ৮৬টি পেনালটি দেওয়া হয়—এটা এক সর্বোচ্চ শিখর। খেলাটি সাড়ে তিন ঘন্টার এক লড়াইয়ের দ্বারা ব্যাঘাতপ্রাপ্ত হয়। একজন খেলোয়াড়কে মুখের হাড় ভাঙ্গা, একটি আঘাতপ্রাপ্ত কর্ণিয়া এবং কাটার জন্য চিকিৎসা করা হয়। কেন এইধরনের দৌরাত্ম্য? একজন খেলোয়াড় ব্যাখ্যা করেন: “অনেক লড়াই সহ একটি প্রকৃত আবেগ ভরা খেলা যখন আপনি জয়লাভ করেন তখন আপনি বাড়ি যান এবং আপনার সহখেলোয়াড়দের আরও কাছের মনে করেন। আমার মনে হয় যে লড়াইগুলি প্রকৃতই খেলাটিকে আধ্যাত্মিক করে তোলে।” আজকাল বেশির ভাগ খেলাধূলায় দৌরাত্ম্য মনে হয় শুধুমাত্র কোন পরিণতিতে আসার প্রণালী নয় কিন্তু স্বয়ং পরিণতি।
স্কুলে দৌরাত্ম্য
স্কুলকে সবসময়ই মনে করা হয়েছে আশ্রয়স্থল যেখানে যুবক ব্যক্তি তাদের অন্যান্য চিন্তা রেখে দিয়ে, মন এবং দেহের উন্নতি সাধনে মনোযোগ দিতে পারে। আজকে, কিন্তু স্কুল আর সুরক্ষা এবং শান্তির স্থল নয়। ১৯৯৪ সালের একটি গ্যালপ সমীক্ষা আবিষ্কার করে যে দৌরাত্ম্য এবং সশস্ত্র দলগুলি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসাধারণের জন্য স্কুলের সর্বপ্রথম সমস্যা যা বিগত বছরের তালিকায় সর্বপ্রথম আর্থিক সমস্যাটিকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিটি কতখানি খারাপ?
এই প্রশ্ন, “স্কুলেতে অথবা স্কুলের কাছাকাছি আপনি কি কখনও দৌরাত্ম্যপূর্ণ ক্রিয়াকলাপের শিকার হয়েছেন?” সমীক্ষা নেওয়া হয়েছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৪ জনের মধ্যে ১ জন ছাত্র উত্তর দেয় হ্যাঁ। দশ ভাগের এক ভাগ বেশি শিক্ষক শিক্ষিকারা হ্যাঁ বলে উত্তর দেয়। সেই একই সমীক্ষা জানায় যে ১৩ শতাংশ ছাত্রেরা যাদের মধ্যে ছেলে এবং মেয়ে উভয় রয়েছে, স্বীকার করেছে যে কোন না কোন সময়ে তারা স্কুলে অস্ত্র নিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ দাবি করে যে অন্যদের প্রভাবিত করার জন্য অথবা নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য তারা তা করেছিল। কিন্তু একজন ১৭ বছর বয়স্ক ছাত্র তার শিক্ষককে বুকে গুলি করে যখন সেই শিক্ষকটি তার বন্দুকটি নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
এক দৌরাত্ম্যপূর্ণ সংস্কৃতি
এটি অস্বীকার করা যায় না যে আজকে দৌরাত্ম্য সর্বত্র আছে। গৃহেতে, কর্মক্ষেত্রে, স্কুলেতে এবং আমোদপ্রমোদে আমরা এক দৌরাত্ম্যপূর্ণ সংস্কৃতির মোকাবিলা করি। যেহেতু তারা তার প্রতিদিন সম্মুখীন হয়ে থাকে, অনেকে এটিকে সাধারণ বলে মনে করে—যতক্ষণ না তারা নিজে তার শিকার হয়। তখন তারা জিজ্ঞাসা করে, এর কি কখনও শেষ হবে? আপনিও কি এর উত্তর পেতে চান? তাহলে পরবর্তী প্রবন্ধটি পড়ুন।