মহান কনস্টানটাইন—খ্রীষ্টতত্ত্বের এক সমর্থক?
ইতিহাসে যাদের “মহান” উপাধি দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছে এমন অল্প কয়েকজনের মধ্যে রোমীয় সম্রাট কনস্টানটাইন আছেন। খ্রীষ্টীয় জগৎ “সাধু,” “ত্রয়োদশ প্রেরিত,” “পবিত্রতায় প্রেরিতদের সমতুল্য” এবং ‘সমস্ত জগতে সর্বাধিক পরিবর্তন সাধনের জন্য ঈশ্বরের দূরদর্শিতার গুণে মনোনীত’ অভিব্যক্তিগুলি যুক্ত করেছে। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, কেউ কেউ কনস্টানটাইনকে “রক্তে রঞ্জিত, অগণিত অন্যায়ের দ্বারা কলঙ্কিত এবং প্রবঞ্চনাপূর্ণ, . . . ভয়ঙ্কর শাসক, বীভৎস অপরাধে পরিপূর্ণ” ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করেন।
অনেক নামধারী খ্রীষ্টানেরা শিখে এসেছেন যে মহান কনস্টানটাইন খ্রীষ্টতত্ত্বের অন্যতম বিখ্যাত উপকারী ব্যক্তি ছিলেন। তারা তাকে রোমীয় নির্যাতনের দুর্দশা থেকে খ্রীষ্টানদের মুক্ত করার ও তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের কৃতিত্ব প্রদান করেন। এছাড়াও, এই ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত যে তিনি খ্রীষ্টীয় নীতিকে অগ্রসর করার জন্য এক দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যীশু খ্রীষ্টের একজন বিশ্বস্ত পদচিহ্ন অনুসরণকারী ছিলেন। ইস্টার্ণ অর্থোডক্স ও কপ্টিক গির্জা কনস্টানটাইন ও তার মা হেলেনা উভয়কে “সাধু ও সাধ্বী” হিসাবে ঘোষণা করেছে। তাদের উপলক্ষে ৩রা জুন অথবা গির্জার ক্যালেন্ডার অনুসারে ২১শে মে উৎসব উদ্যাপন করা হয়।
মহান কনস্টানটাইন আসলে কে ছিলেন? প্রেরিতদের পরবর্তীকালীন খ্রীষ্টতত্ত্বের অগ্রগতিতে তার ভূমিকা কী ছিল? ইতিহাস এবং পণ্ডিত ব্যক্তিদের এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে দেওয়া খুবই বিজ্ঞতার কাজ হবে।
ঐতিহাসিক কনস্টানটাইন
কনস্টানটায়াস ক্লোরাসের পুত্র, কনস্টানটাইন প্রায় সা.কা. ২৭৫ সালে সার্বিয়ার নেইসাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সা.কা. ২৯৩ সালে যখন তার পিতা রোমের পশ্চিমাঞ্চলের সম্রাট হয়েছিলেন, তিনি সম্রাট গ্যালেরিওর আদেশে ডানুব নদীতে লড়াই করছিলেন। সা.কা. ৩০৬ সালে কনস্টানটাইন তার মুমূর্ষু পিতার কাছে ব্রিটেনে ফিরে এসেছিলেন। তার পিতার মৃত্যুর পর পরই কনস্টানটাইন সৈন্যদের দ্বারা সম্রাটের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
তখন পাঁচজন অন্যান্য ব্যক্তিবিশেষেরাও দাবি করেছিলেন যে তারা হলেন অগাস্টি (সম্রাট)। সা.কা. ৩০৬ থেকে ৩২৪ সালের মধ্যবর্তী সময়টি ছিল ক্রমাগত গৃহযুদ্ধের, যার পর কনস্টানটাইন অদ্বিতীয় সম্রাটে পরিণত হয়েছিলেন। দুটি সামরিক অভিযানে বিজয় কনস্টানটাইনকে রোমীয় ইতিহাসে একটি স্থানের নিশ্চয়তা দিয়েছিল এবং তাকে রোমীয় সাম্রাজ্যের একক শাসকে পরিণত করেছিল।
সাধারণ কালের ৩১২ সালে, কনস্টানটাইন রোমের বাইরে মিল্ভিয়ান সেতুর যুদ্ধে, তার প্রতিপক্ষ ম্যাক্সেনটিয়াসকে পরাজিত করেছিলেন। খ্রীষ্টীয় মতামত সমর্থনকারী লেখকেরা দাবি করেছিলেন যে সেই অভিযানের সময়ে সূর্যের নিচে একটি জ্বলন্ত ক্রুশ দেখা গিয়েছিল যেটিতে ইন হক্ সেগনো ভিনকেস, এই ল্যাটিন শব্দগুলি লেখা ছিল যার অর্থ “এই চিহ্নের দ্বারা বিজয়ী হও।” এটিও মনে করা হয় যে একবার কনস্টানটাইনকে স্বপ্নে তার সৈন্যদলের ঢালের মধ্যে খ্রীষ্টের নামের প্রথম দুটি অক্ষর গ্রীক ভাষায় অঙ্কন করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এই কাহিনীর সংগতি নিয়ে অনেক সন্দেহ রয়েছে। খ্রীষ্টতত্ত্বের ইতিহাস (ইংরাজি) নামক বইটি উল্লেখ করে: “এই দর্শনের যথার্থ সময়, স্থান ও বিশদ বর্ণনার প্রমাণ সম্বন্ধে পরস্পরবিরোধী মতামত রয়েছে।” একজন পৌত্তলিক সেনেট, কনস্টানটাইনকে রোমে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে প্রধান অগাস্টাস ও পন্টিফেক্স মেক্সিমাস অর্থাৎ সাম্রাজ্যের পৌত্তলিক ধর্মের মহাযাজক বলে ঘোষণা করেছিলেন।
সাধারণ কালের ৩১৩ সালে, কনস্টানটাইন পূর্ব সাম্রাজ্যের শাসক, সম্রাট লাইসিনিয়াসের সাথে অংশীদারিত্বের দলিল তৈরি করেছিলেন। মিলানের অনুশাসনের মাধ্যমে, তারা একত্রে উপাসনার স্বাধীনতা এবং সমস্ত ধর্মীয় দলগুলির সমান অধিকার অনুমোদন করেছিলেন। এটি কেবল একটি প্রথাসিদ্ধ সরকারি পত্র ছিল আর খ্রীষ্টতত্ত্বের কার্যপ্রণালীতে কোন পরিবর্তন ইঙ্গিত করার মত কোন বৃহৎ সম্রাটসংক্রান্ত দলিল এটি নয়, এই কথা বলার মাধ্যমে অনেক ইতিহাসবেত্তা এই দলিলের গুরুত্বকে খর্ব করেছিলেন।
পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে কনস্টানটাইন, তার সর্বশেষ অবশিষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বী লাইসিনিয়াসকে পরাজিত করেছিলেন এবং রোমীয় জগতের অপ্রতিহত শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। সা.কা. ৩২৫ সালে, তখনও অবাপ্তাইজিত অবস্থায় তিনি প্রথম বৃহৎ “খ্রীষ্টীয়” গির্জার গির্জাগোষ্ঠীয় ঐক্য পরিষদের তত্ত্বাবধান করেছিলেন, যা আরিয়ান্বাদকে নিন্দা করেছিল এবং অপরিহার্য বিশ্বাসগুলির বিবৃতিসহ একটি দলিল প্রস্তুত করেছিল, যেটিকে নাইসিন ধর্মমত বলা হয়।
সাধারণ কালের ৩৩৭ সালে কনস্টানটাইন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি বাপ্তাইজিত হন এবং তারপর মারা যান। তার মৃত্যুর পর সেনেট তাকে রোমীয় দেবতাদের স্থানে স্থাপন করেছিল।
কনস্টানটাইনের কর্ম-পরিকল্পনায় ধর্ম
ধর্মের প্রতি তৃতীয় এবং চতুর্থ শতাব্দীর রোমীয় সম্রাটদের সাধারণ মনোভাব প্রসঙ্গে ইস্টোরিয়া টো ইলিনিকো এথনৌস (গ্রীক জাতির ইতিহাস) নামক রচনা বলে: “এমনকি যখন সম্রাটসংক্রান্ত সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের ধর্মের ব্যাপারে এইধরনের কোন গভীর আগ্রহ ছিল না, তখন কালের ভাবানুসারে তারা ধর্মকে তাদের রাজনৈতিক কার্যপ্রণালী কাঠামোর মধ্যে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন, অন্তত তাদের কাজের মধ্যে এক ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য সরবরাহ করা।”
নিশ্চিতরূপে, কনস্টানটাইন তার কালের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একজন ব্যক্তি ছিলেন। তার কর্মজীবনের শুরুতে তার কিছু “ঐশিক” সাহায্যের প্রয়োজন ছিল আর নির্জীব রোমীয় দেবতারা তা সরবরাহ করতে পারেনি। ধর্ম ও এর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলিসহ সাম্রাজ্যটির অধঃপতন হচ্ছিল আর এটিকে পুনরায় শক্তিশালী করার জন্য পূর্বের চেয়ে নতুন ও প্রাণবন্ত কিছুর প্রয়োজন ছিল। এনসাইক্লোপিডিয়া হাইড্রিয়া বলে: “কনস্টানটাইন খ্রীষ্টতত্ত্বের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন কারণ এটি শুধু তার বিজয়েই নয় কিন্তু তার সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনেও তাকে সমর্থন যুগিয়েছিল। সর্বত্র যে খ্রীষ্টীয় গির্জাগুলি বিদ্যমান ছিল সেগুলি তার জন্য রাজনৈতিক সমর্থনকারী হয়েছিল। . . . তিনি সেই সময়ের উচ্চপদস্থ যাজকদের তার চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিলেন . . . আর তিনি তাদের একতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন।”
কনস্টানটাইন বুঝেছিলেন যে “খ্রীষ্ট” ধর্ম—তখন ভাক্ত ও অত্যন্ত কলুষিত থাকা সত্ত্বেও—সেটি সম্রাটসংক্রান্ত শাসন সম্বন্ধে তার মহান কর্মপরিকল্পনা সম্পন্ন করার জন্য পুনরুজ্জীবিত ও একত্রীকরণের এক শক্তি হিসাবে কার্যকারীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। তার নিজস্ব রাজনৈতিক সীমা বৃদ্ধি করতে সমর্থন লাভের জন্য ভাক্ত খ্রীষ্টতত্ত্বের ভিত্তি গড়ে তোলার পর, তিনি লোকেদের একটি “ক্যাথলিক” অথবা সর্বজনীন ধর্মের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পৌত্তলিক প্রথা ও উদ্যাপনগুলিকে “খ্রীষ্টীয়” নাম দেওয়া হয়েছিল। আর “খ্রীষ্টান” পাদ্রিদের পৌত্তলিক যাজকদের মত পদমর্যাদা, বেতন এবং ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।
রাজনৈতিক কারণগুলির জন্য ধর্মীয় সংহতি খুঁজতে গিয়ে, শীঘ্রই কনস্টানটাইন যে কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতবিরোধকে দমন করেছিলেন, মতবাদসংক্রান্ত সত্যের উপর ভিত্তি করে নয় কিন্তু অধিকাংশের দ্বারা গৃহীত মতামতের উপর ভিত্তি করে। চরমভাবে বিভক্ত “খ্রীষ্টীয়” গির্জার মধ্যে গভীর মতবাদসংক্রান্ত পার্থক্যগুলি তাকে একজন “ঈশ্বর-প্রেরিত” মধ্যস্থ হিসাবে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দিয়েছিল। উত্তর আফ্রিকাতে ডোনাটবাদী ও সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের আরিয়াসের অনুসারীদের সাথে তার আলোচনার মাধ্যমে তিনি দ্রুত আবিষ্কার করেছিলেন যে, এক দৃঢ়, সমন্বয়সাধিত বিশ্বাসকে জাল করার জন্য দৃঢ়প্রত্যয় উৎপাদনই যথেষ্ট ছিল না।a আরিয়ান মতবিরোধকে সমাধান করার প্রচেষ্টায়, তিনি গির্জার ইতিহাসে সর্বপ্রথম গির্জাগোষ্ঠীয় ঐক্য পরিষদ আহ্বান করেছিলেন।—“কনস্টানটাইন এবং নাইসিয়ার পরিষদ” নামক বাক্সটি দেখুন।
কনস্টানটাইন সম্বন্ধে ইতিহাসবেত্তা পল জনসন উল্লেখ করেন: “তার খ্রীষ্টতত্ত্বকে অনুমোদন করার একটি প্রধান কারণ হয়ত এটি হতে পারে যে খ্রীষ্টতত্ত্ব তাকে এবং তার রাষ্ট্রকে অর্থোডক্স ও ন-অর্থোডক্স গির্জার কর্মপন্থার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দান করেছিল।”
তিনি কি কখনও একজন খ্রীষ্টান হয়েছিলেন?
জনসন উল্লেখ করেন: “কনস্টানটাইন কখনও সূর্য উপাসনাকে পরিত্যাগ করেননি আর তিনি তার মুদ্রায় সূর্যের প্রতীক রেখেছিলেন।” ক্যাথলিক এনসাইক্লোপিডিয়া মন্তব্য করে: “কনস্টানটাইন উভয় ধর্মের প্রতি সমান আনুকূল্য দেখিয়েছিলেন। পন্টিফেক্স মেক্সিমাস হিসাবে তিনি অখ্রীষ্টীয় উপাসনার তত্ত্বাবধান এবং এর অধিকারগুলির সুরক্ষা করতেন।” “কনস্টানটাইন কখনও একজন খ্রীষ্টান হননি” এনসাইক্লোপিডিয়া হাইড্রিয়া উল্লেখ করে, এটি আরও বলে: “কৈসরিয়ার ইউসেবিয়াস, যিনি কনস্টানটাইনের আত্মজীবনী লিখেছিলেন, তিনি বলেন যে তার জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি একজন খ্রীষ্টান হয়েছিলেন। বাপ্তিস্মের এই আচরণ দৃঢ়প্রত্যয় উৎপাদক নয়, কারণ তার বাপ্তিস্মের আগের দিন [কনস্টানটাইন] যিয়ূসের উদ্দেশে বলি উৎসর্গ করেছিলেন যেহেতু তার পন্টিফেক্স মেক্সিমাসের উপাধিটিও ছিল।”
সাধারণ কালের ৩৩৭ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত কনস্টানটাইন ধর্মীয় বিষয়গুলির সর্বোচ্চ নেতা, পন্টিফেক্স মেক্সিমাসের পৌত্তলিক উপাধি ধারণ করেছিলেন। তার বাপ্তিস্ম সম্বন্ধে এটি জিজ্ঞাসা করা যুক্তিযুক্ত যে, শাস্ত্রে যেভাবে চাওয়া হয়েছে, এটি কি সেই অনুসারে প্রকৃত অনুতাপ ও ধর্মান্তরিতকরণ ছিল? (প্রেরিত ২:৩৮, ৪০, ৪১) যিহোবা ঈশ্বরের প্রতি কনস্টানটাইনের উৎসর্গীকরণের প্রতীকস্বরূপ এটি কি সম্পূর্ণরূপে জলে নিমজ্জন ছিল?—প্রেরিত ৮:৩৬-৩৯ পদের সাথে তুলনা করুন।
একজন “সাধু”?
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা উল্লেখ করে: “কনস্টানটাইন যা ছিলেন তার চেয়ে বরং তিনি যা সম্পন্ন করেছিলেন সেই কর্মদক্ষতার গুণে মহান হিসাবে আখ্যাত হওয়ার যোগ্য ছিলেন। চরিত্রের মূল্যায়ন করা হলে বস্তুতপক্ষে তিনি প্রাচীন ও আধুনিক সময়ে যাদের গুণবাচক বিশেষণ [মহান] আখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাদের সকলের মধ্যে নিম্নতম স্থানে অবস্থান করেন।” আর খ্রীষ্টতত্ত্বের ইতিহাস (ইংরাজি) নামক বইটি আমাদের জানায়: “তার বদমেজাজ ও ক্রোধপূর্ণ নিষ্ঠুর আচরণের প্রাথমিক বিবৃতিগুলি ছিল। . . . মানব জীবনের প্রতি কোন সম্মান তার ছিল না . . . তিনি যখন বৃদ্ধ হয়েছিলেন তার ব্যক্তিগত জীবন অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছিল।”
স্পষ্টতই কনস্টানটাইনের ব্যক্তিত্বে গুরুতর সমস্যা ছিল। একজন ইতিহাসের গবেষক উল্লেখ করেন যে “তার উত্তেজনাপ্রবণ চরিত্র প্রায়ই অপরাধ সংঘটনের কারণ ছিল।” (“রাজবংশীয় হত্যাগুলি” নামক বাক্সটি দেখুন।) কনস্টানটাইন “একজন খ্রীষ্টীয় চরিত্র” ছিলেন না, ঐতিহাসিক এইচ. ফিশার তার ইউরোপের ইতিহাস (ইংরাজি) নামক বইটিতে উল্লেখ করেন। তথ্যগুলি তাকে একজন সত্য খ্রীষ্টান হিসাবে চিহ্নিত করে না যিনি “নূতন মনুষ্যকে” পরিধান করেছিলেন আর যার মধ্যে ঈশ্বরের আত্মার ফল—প্রেম, আনন্দ, শান্তি, দীর্ঘসহিষ্ণুতা, মাধুর্য, মঙ্গলভাব, বিশ্বস্ততা, মৃদুতা, ও ইন্দ্রিয়দমন দেখতে পাওয়া যায়।—কলসীয় ৩:৯, ১০; গালাতীয় ৫:২২, ২৩.
তার প্রচেষ্টার ফলগুলি
পৌত্তলিক পন্টিফেক্স মেক্সিমাস—আর তারপর রোমীয় সাম্রাজ্যের ধর্মীয় প্রধান হিসাবে—কনস্টানটাইন ভাক্ত গির্জার বিশপদের সাথে মিত্রতা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তাদের রোমের রাষ্ট্রীয় ধর্মের আধিকারিক হিসাবে ক্ষমতাসম্পন্ন পদ, খ্যাতি এবং সম্পদ প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ক্যাথলিক এনসাইক্লোপিডিয়া স্বীকার করে: “কিছু বিশপেরা রাজসভার জাঁকজমকতা দেখে এতটাই অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে তারা সম্রাটকে ঈশ্বরের একজন দূত, এক পবিত্র সত্তা বলে তার গুণকীর্তন করেছিলেন আর তার সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তিনি ঈশ্বরের পুত্রের মত স্বর্গে রাজত্ব করবেন।”
ভাক্ত খ্রীষ্টতত্ত্ব যখন রাজনৈতিক সরকারের আনুকুল্যে আসতে থাকে এটি আরও অধিকমাত্রায় এই জগতের, জাগতিক বিধিব্যবস্থার অংশ হয়ে পড়েছিল এবং যীশু খ্রীষ্টের শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। (যোহন ১৫:১৯; ১৭:১৪, ১৬; প্রকাশিত বাক্য ১৭:১, ২) ফলস্বরূপ, “খ্রীষ্টতত্ত্ব” এর সাথে মিথ্যা মতবাদ ও অভ্যাসগুলি মিশ্রিত হয়েছিল—ত্রিত্ব, প্রাণের অমরত্ব, নরকাগ্নি, পুরাগাতরি, মৃতদের জন্য প্রার্থনা, জপমালা, প্রতীক, মূর্তি এবং এইরকম আরও অন্যান্য বিষয়গুলি।—২ করিন্থীয় ৬:১৪-১৮ পদের সাথে তুলনা করুন।
কনস্টানটাইনের সময় থেকেই, গির্জা কর্তৃত্বকারী হওয়ার প্রবণতাটিও লাভ করেছিল। পণ্ডিত হেন্ডারসন ও বাক্ বলেন: “সুসমাচারের সরলতা কলুষিত হয়ে পড়েছিল, আড়ম্বরপূর্ণ আচারানুষ্ঠান এবং উপলক্ষগুলি প্রবেশ করেছিল, খ্রীষ্টতত্ত্বের শিক্ষকদের জাগতিক সম্মান ও বেতন দেওয়া হয়েছিল এবং খ্রীষ্টের রাজ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই জগতের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।”
প্রকৃত খ্রীষ্টতত্ত্ব কোথায়?
ঐতিহাসিক তথ্যগুলি কনস্টানটাইনের “মহত্ত্বের” পিছনে যে সত্যটি রয়েছে তা প্রকাশ করে। সত্য খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর মস্তক যীশু খ্রীষ্টের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠার পরিবর্তে, খ্রীষ্টীয় জগৎ আংশিকভাবে রাজনৈতিক উপযোগিতা ও পৌত্তলিক সম্রাটের কৌশলী পরিচালনার ফলে পরিণত হয়েছিল। অত্যন্ত উপযুক্তভাবেই ইতিহাসবেত্তা পল জনসন জিজ্ঞাসা করেন: “সাম্রাজ্য কি খ্রীষ্টীয় জগতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল অথবা খ্রীষ্টতত্ত্ব নিজেই সাম্রাজ্যের সাথে ব্যভিচার করেছিল?”
যারা বিশুদ্ধ খ্রীষ্টতত্ত্বের সাথে প্রকৃতই যুক্ত হতে চান তাদের সকলকেই আজকে সত্য খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীকে শনাক্ত এবং এর সাথে মেলামেশা করতে সাহায্য করা যেতে পারে। সহৃদয় ব্যক্তিদের সত্য খ্রীষ্টতত্ত্বকে শনাক্ত করতে এবং ঈশ্বরের কাছে গ্রহণযোগ্য এমনভাবে তাঁকে উপাসনা করতে সাহায্য করার জন্য বিশ্বব্যাপী যিহোবার সাক্ষীরা অত্যন্ত আগ্রহী।—যোহন ৪:২৩, ২৪.
[পাদটীকাগুলো]
a ডোনাটবাদ সাধারণ কালের চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর একটি “খ্রীষ্টীয়” সম্প্রদায়। এর ভক্তরা দাবি করতেন যে সংস্কারের বৈধতা পরিচারকের নৈতিক চরিত্রের উপর নির্ভর করে এবং গির্জাগুলির অবশ্যই গুরুতর পাপের দোষে দোষী লোকেদের এর সদস্যপদ থেকে বাদ দেওয়া উচিত। আরিয়ান্বাদ চতুর্থ শতাব্দীর একটি “খ্রীষ্টীয়” আন্দোলন ছিল যা যীশু খ্রীষ্টের ঈশ্বরত্বকে অস্বীকার করেছিল। আরিয়াস শিক্ষা দিয়েছিলেন যে ঈশ্বর কারও দ্বারা জাত হননি আর তাঁর কোন শুরু নেই। আর জাত হওয়ার কারণে পিতা যে অর্থে ঈশ্বর, পুত্র তা হতে পারেন না। ঈশ্বরের মত পুত্রের অনন্তকাল অস্তিত্ব ছিল না কিন্তু তিনি সৃষ্ট হয়েছিলেন এবং পিতার ইচ্ছার দ্বারাই অস্তিত্বে আছেন।
[২৮ পৃষ্ঠার বাক্স]
কনস্টানটাইন এবং নাইসিয়ার পরিষদ
নাইসিয়ার পরিষদে অবাপ্তাইজিত সম্রাট কনস্টানটাইন কোন্ ভূমিকা পালন করেছিলেন? এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা উল্লেখ করে: “কনস্টানটাইন স্বয়ং তত্ত্বাবধান করেছিলেন, সক্রিয়ভাবে আলোচনায় নেতৃত্ব নিয়েছিলেন . . . সম্রাট কর্তৃক অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে, দুইজন বিশপ ছাড়া অন্য সমস্ত বিশপ তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খ্রীষ্টীয় ধর্মমতগুলিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।”
দুই মাস প্রচণ্ড ধর্মীয় বিতর্কের পর, এই পৌত্তলিক রাজনীতিবিদ হস্তক্ষেপ করেছিলেন এবং তাদের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যারা বলেছিলেন যে যীশুই ঈশ্বর। কিন্তু কেন? “গ্রীক ঈশ্বরতত্ত্বে যে প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কনস্টানটাইনের সেই সম্বন্ধে মৌলিক কোন জ্ঞানই ছিল না,” খ্রীষ্টীয় মতবাদের এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (ইংরাজি) নামক বইটি বলে। তিনি যা বুঝতে পেরেছিলেন তা হল ধর্মীয় বৈষম্য তার সাম্রাজ্যের প্রতি এক হুমকিস্বরূপ ছিল আর তিনি তার সাম্রাজ্যকে দৃঢ় করার জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিলেন।
কনস্টানটাইনের পৃষ্ঠপোষকতায় নাইসিয়ায় যে চূড়ান্ত দলিলটি নির্বাচন করা হয়েছিল সেই সম্বন্ধে ইস্টোরিয়া টো ইলিনিকো এথনৌস (গ্রীক জাতির ইতিহাস) মন্তব্য করে: “এটি মতবাদসংক্রান্ত বিষয়গুলির প্রতি [কনস্টানটাইনের] উদাসীনতা, . . . যে কোন মূল্যে গির্জার একতা পুনর্স্থাপন করতে চেষ্টা করার জন্য তার একগুঁয়ে জিদ্ আর অবশেষে তার এই প্রত্যয়কে প্রদর্শন করেছিল যে ‘গির্জার বাইরের লোকেদের বিশপ’ হওয়ার কারণে যে কোন ধর্মীয় ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র তারই আছে। সেই পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির পিছনে কি সম্ভবত ঈশ্বরের আত্মা কাজ করেছিল?—প্রেরিত ১৫:২৮, ২৯ পদের সাথে তুলনা করুন।
[২৯ পৃষ্ঠার বাক্স]
“রাজবংশীয় হত্যাগুলি”
এই শিরোনামের অধীনে ইস্টোরিয়া টো ইলিনিকো এথনৌস (গ্রীক জাতির ইতিহাস) নামক রচনা “কনস্টানটাইনের কৃত ঘৃণার্হ আভ্যন্তরীণ অপরাধ” সম্বন্ধে বর্ণনা করে। তার রাজবংশ গঠন করার পর অবিলম্বেই তিনি কিভাবে অপ্রত্যাশিত অর্জনকে উপভোগ করা যায়, সেই বিষয়ে ভুলে গিয়েছিলেন এবং তার চতুর্দিকে যে বিপদগুলি ছিল সেই বিষয়ে সতর্ক হয়ে পড়েছিলেন। একজন সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি হওয়ায় এবং সম্ভবত তোষামোদকারীর দ্বারা প্ররোচিত হওয়ায় তিনি প্রথমে সহ-অগাস্টাসের পুত্র—লাইসিনিয়াসের ভাইপোর প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েন যাকে একজন সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে তিনি ইতিমধ্যেই মত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। তার হত্যাকাণ্ডটি কনস্টানটাইনের নিজের প্রথম পুত্র ক্রিস্পাসের মৃত্যুদণ্ডের পরেই হয়েছিল, যাকে তার সৎ মা ফোস্টা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন কারণ তাকে তিনি তার নিজের সন্তানের সম্পূর্ণ ক্ষমতালাভের পথে প্রতিবন্ধকস্বরূপ মনে করেছিলেন।
ফোস্টার এই কাজ অবশেষে নাটকীয়ভাবে তারই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটি মনে হয় যে অগাস্টা হেলেনা যিনি তার পুত্র কনস্টানটাইনের উপর শেষ পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। কনস্টানটাইনকে প্রায়ই নিয়ন্ত্রণকারী অযৌক্তিক আবেগ তার অনেক বন্ধু ও সহযোগীদের ব্যাপকভাবে মৃত্যুদণ্ড প্রদানে অবদান রেখেছিল। মধ্যযুগের ইতিহাস (ইংরাজি) নামক বইটি উপসংহার করে: “তার নিজ পুত্র ও স্ত্রীর—মৃত্যুদণ্ড—বলাই বাহুল্য হত্যা, ইঙ্গিত করে যে তিনি খ্রীষ্টতত্ত্বের কোন প্রকার আধ্যাত্মিক প্রভাব থেকে অস্পৃষ্ট ছিলেন।”
[৩০ পৃষ্ঠার চিত্র]
রোমের এই স্থাপত্য কনস্টানটাইনকে গৌরবান্বিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
Musée du Louvre, Paris