যিহোবা কে?
যিহোবা তাঁর একজন বিশ্বস্ত উপাসককে বলেছিলেন: “মনুষ্য আমাকে দেখিলে বাঁচিতে পারে না।” (যাত্রাপুস্তক ৩৩:২০) “ঈশ্বর আত্মা” আর মানুষ তাদের শারীরিক চোখ দিয়ে তাঁকে দেখতে পারে না। (যোহন ৪:২৪) মধ্যাহ্নের সূর্যের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকা ঠিক যেমন আমাদের চোখের জন্য ক্ষতিকর, তেমনিই অকল্পনীয় শক্তির উৎসের দিকে তাকানো হানিকর, যিনি কেবল আমাদের দেদীপ্যমান সূর্যকেই সৃষ্টি করেননি কিন্তু মহাবিশ্বের অগণিত অন্যান্য সূর্যকেও সৃষ্টি করেছিলেন।
আনন্দের বিষয় যে, তাঁর সম্বন্ধে জানার জন্য আমাদের ঈশ্বরকে দেখার প্রয়োজন নেই। বাইবেল দুটি বিষয়কেই শনাক্ত করে, যিনি আমাদের জন্য এই চমৎকার মোড়ক, পৃথিবীকে তৈরি করেছিলেন তাঁকে এবং তাঁর ব্যক্তিত্বকে। তাই যিনি আমাদের জীবন দান করেছেন ও জীবন উপভোগ করার জন্য এক মনোরম গৃহ সরবরাহ করেছেন, সেই পিতার সম্বন্ধে জানার জন্য বাইবেল পরীক্ষা করা যথোপযুক্ত।
তাঁর নামের তাৎপর্য
সব নামেরই অর্থ রয়েছে, যদিও আজকে অনেকে সেই বিষয়ে হয়ত সচেতন নন। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রচলিত ইংরেজি নাম ডেভিড, এক ইব্রীয় শব্দ থেকে এসেছে যেটির অর্থ “প্রিয়তম।” সৃষ্টিকর্তার যিহোবা নামটিরও একটি অর্থ রয়েছে। এটি কী? বাইবেলের মূল ভাষা ইব্রীয়তে, ঐশিক নামটি চারটি অক্ষর YHWH দিয়ে লিখিত এবং বাইবেলের ইব্রীয় শাস্ত্রে এটি প্রায় ৭,০০০ বার দেখা যায়। ঐশিক নামটির অর্থ এই বোঝা যায়, “তিনি অস্তিত্বে আনেন।” এটি ইঙ্গিত দেয় যে, তাঁর উদ্দেশ্যগুলি সম্পাদনের জন্য যা কিছুই করার প্রয়োজন হোক না কেন, যিহোবা জ্ঞানপূর্বক নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করে থাকেন। তিনি সৃষ্টিকর্তা, বিচারক, পরিত্রাতা, জীবনের সংরক্ষক আর তাই তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞাগুলি পরিপূর্ণ করতে পারেন। এছাড়াও ইব্রীয়তে যিহোবা নামটির মৌখিক অর্থ, সম্পূর্ণ হওয়ার অবস্থায় থাকা কাজ। হ্যাঁ, যিহোবা তাঁর উদ্দেশ্যগুলির পরিপূর্ণকারী হিসাবে এখনও অস্তিত্বে এনে চলেছেন। তিনি একজন জীবন্ত ঈশ্বর!
যিহোবার মুখ্য গুণাবলি
বাইবেল সৃষ্টিকর্তাকে একজন “স্নেহশীল ও কৃপাময় ঈশ্বর, ক্রোধে ধীর এবং দয়াতে [“প্রেমপূর্ণ দয়া,” “NW”] ও সত্যে মহান্; সহস্র সহস্র [পুরুষ] পর্য্যন্ত দয়ারক্ষক, অপরাধের, অধর্ম্মের ও পাপের ক্ষমাকারী” হিসাবে বর্ণনা করে। (যাত্রাপুস্তক ৩৪:৬, ৭) “প্রেমপূর্ণ দয়া” অভিব্যক্তিটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ একটি ইব্রীয় শব্দ থেকে অনুবাদিত হয়েছে। এটি এমন এক দয়াকে বোঝায় যা প্রেম সহকারে একটি বস্তুর সাথে যুক্ত হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই বস্তুর জন্য এর উদ্দেশ্যটি পরিপূর্ণ হয়। এটিকে “নিষ্ঠাপূর্ণ প্রেম” হিসাবেও অনুবাদ করা যায়। যিহোবার দয়া প্রেম সহকারে তাঁর সৃষ্টির সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে এবং তাঁর চমৎকার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করে। যিনি আপনাকে জীবন দান করেছেন তাঁর কাছ থেকে এইধরনের প্রেমকে কি আপনি উপলব্ধি করেন না?
যিহোবা ক্রোধে ধীর এবং আমাদের ভুলগুলি ক্ষমা করার ক্ষেত্রে তৎপর। এইধরনের একজন ব্যক্তির নিকটবর্তী হওয়া হৃদয়উষ্ণকারী। কিন্তু, এটির অর্থ এই নয় যে তিনি অপরাধকে মার্জনা করে চলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন: “আমি সদাপ্রভু ন্যায়বিচার ভালবাসি, অধর্ম্মযুক্ত অপহরণ ঘৃণা করি।” (যিশাইয় ৬১:৮) ন্যায়বিচারক ঈশ্বর হিসাবে তিনি ধৃষ্টতাপূর্ণ পাপী, যারা তাদের দুষ্টতায় নাছোড়বান্দা থাকে তাদের চিরকাল সহ্য করবেন না। অতএব, আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে তাঁর নিরূপিত সময়ে, যিহোবা জগতের অন্যায়কে সংশোধন করবেন। তিনি দুর্দশাগ্রস্তদের কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবেন না।
প্রেম ও ন্যায়বিচারের মধ্যে একটি নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রাখা সহজ নয়। আপনি যদি একজন পিতা বা মাতা হন, আপনার সন্তান যখন অন্যায় আচরণ করে, আপনি কি কখন, কিভাবে এবং কোন্ সীমা পর্যন্ত তাদের সংশোধন করার প্রয়োজন আছে তা স্থির করা কঠিন বোধ করেন? ন্যায়বিচারকে প্রেমপূর্ণ করুণার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য প্রচুর প্রজ্ঞার প্রয়োজন। মানুষদের সাথে তাঁর আচরণে যিহোবা প্রচুররূপে সেই গুণ প্রদর্শন করেন। (রোমীয় ১১:৩৩-৩৬) বাস্তবিকই, সৃষ্টিকর্তার প্রজ্ঞা সর্বত্র দেখা যেতে পারে, উদাহরণস্বরূপ, আমাদের চতুর্দিকে বেষ্টিত সৃষ্টির বিস্ময়ে।—গীতসংহিতা ১০৪:২৪; হিতোপদেশ ৩:১৯.
কিন্তু, প্রজ্ঞা থাকাই যথেষ্ট নয়। তাঁর ইচ্ছা সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টিকর্তার অবশ্যই ক্ষমতা থাকতে হবে আর বাইবেল প্রকাশ করে যে তিনি অনেক ক্ষমতাবান: “ঊর্দ্ধ্বদিকে চক্ষু তুলিয়া দেখ, ঐ সকলের সৃষ্টি কে করিয়াছে? তিনি বাহিনীর ন্যায় সংখ্যানুসারে তাহাদিগকে বাহির করিয়া আনেন, সকলের নাম ধরিয়া তাহাদিগকে আহ্বান করেন; তাঁহার সামর্থ্যের আধিক্য ও শক্তির প্রাবল্য প্রযুক্ত তাহাদের একটাও অনুপস্থিত থাকে না।” (যিশাইয় ৪০:২৬) ‘সামর্থ্যের আধিক্যের’ দরুণ যিহোবা বিষয়গুলি সম্পাদন করেন। এইধরনের একটি গুণ কি আপনাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে না?
সমস্ত জাতির ঈশ্বর
‘কিন্তু যিহোবা কি “পুরাতন নিয়ম” অর্থাৎ, প্রাচীন ইস্রায়েলের ঈশ্বর নন?’ আপনি হয়ত চিন্তা করতে পারেন। এটি সত্য যে যিহোবা নিজেকে ইস্রায়েলীয়দের কাছে প্রকাশ করেছিলেন। তথাপি, প্রথম মানব দম্পতিকে সৃষ্টি করার দরুণ যিহোবা হলেন সেই ঈশ্বর, “পৃথিবীস্থ সমস্ত পিতৃকুল যাঁহা হইতে নাম পাইয়াছে।” (ইফিষীয় ৩:১৪) আপনি যদি মনে করেন যে আপনার পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান দেখানো যথার্থ, তাহলে বর্তমানে পৃথিবীতে বিদ্যমান সমস্ত বংশবৃত্তান্তের মূল, আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ, প্রথম মানবকে যিনি জীবন দিয়েছিলেন তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা কি যথার্থ হবে না?
মানবজাতির সৃষ্টিকর্তা সংকীর্ণমনা নন। এটি সত্য যে, এক সময় ইস্রায়েল জাতির সাথে তাঁর এক বিশেষ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তিনি যারা তাঁর নামে ডাকেন তাদের সকলের প্রতি তাঁর বাহু উন্মুক্ত করেছেন। ইস্রায়েলের একজন বিজ্ঞ রাজা প্রার্থনায় যিহোবাকে বলেছিলেন: “তোমার প্রজা ইস্রায়েল গোষ্ঠীয় নয়, এমন কোন বিদেশী যখন তোমার নামের অনুরোধে দূর দেশ হইতে আসিবে, . . . তখন তুমি . . . স্বর্গে তাহা শুনিও . . . এবং সেই বিদেশী তোমার নিকটে যে কিছু প্রার্থনা করিবে, তদনুসারে করিও; যেন . . . পৃথিবীস্থ সমস্ত জাতি তোমার নাম জ্ঞাত হয়।” (১ রাজাবলি ৮:৪১-৪৩) আজকের দিনেও সমস্ত জাতির লোকেরা যিহোবাকে জানতে পারেন এবং তাঁর সাথে এক অর্থপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে পারেন। কিন্তু কিভাবে তা আপনাকে প্রভাবিত করে?
যিহোবাকে জানার উপকারগুলি
পূর্ববর্তী প্রবন্ধের সেই দৃষ্টান্তে ফিরে গেলে দেখা যায় যে আপনি যদি সুন্দরভাবে মোড়ানো একটি মোড়ক পান, তবে স্বাভাবিকভাবেই সেই উপহারটি কিসের জন্য ছিল, আপনি তা জানতে চাইবেন। ভাববেন কিভাবে এটির ব্যবহার ও যত্ন নেওয়া উচিত? অনুরূপভাবে, আমরা জানতে চাই যে তিনি যখন আমাদের জন্য পৃথিবী তৈরি করেছিলেন তখন ঈশ্বরের মনে কী ছিল। বাইবেল বলে যে তিনি এটি “অনর্থক সৃষ্টি না করিয়া” বরং মানুষদের “বাসস্থানার্থে নির্ম্মাণ করিয়াছেন।”—যিশাইয় ৪৫:১৮.
কিন্তু অধিকাংশ মানুষই, সৃষ্টিকর্তার উপহারের যত্ন নেননি। তারা পৃথিবীকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় রত, যা যিহোবাকে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট করে। তথাপি, তাঁর নামের অর্থ অনুসারে যিহোবা মানুষ ও পৃথিবীর জন্য তাঁর আদি উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করতে স্থিরসংকল্পবদ্ধ। (গীতসংহিতা ১১৫:১৬; প্রকাশিত বাক্য ১১:১৮) তিনি পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করবেন এবং যারা তাঁর বাধ্য সন্তান হিসাবে বাস করতে ইচ্ছুক তাদের উত্তরাধিকার হিসাবে এটি দান করবেন।—মথি ৫:৫.
যখন তা ঘটবে তখন পরিস্থিতি কেমন হবে সেই সম্বন্ধে বাইবেলের শেষ পুস্তক বর্ণনা করে: “দেখ, মনুষ্যদের সহিত ঈশ্বরের আবাস; তিনি তাহাদের সহিত বাস করিবেন, এবং তাহারা তাঁহার প্রজা হইবে; . . . আর তিনি তাহাদের সমস্ত নেত্রজল মুছাইয়া দিবেন; এবং মৃত্যু আর হইবে না; শোক বা আর্ত্তনাদ বা ব্যথাও আর হইবে না; কারণ প্রথম বিষয় সকল লুপ্ত হইল।” (প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪) তখন কেউই দুঃখে অথবা প্রিয়জনকে হারানোর শোকে চোখের জল ফেলবেন না। কেউই হতাশাগ্রস্ত হয়ে সাহায্যের জন্য আর্ত চিৎকার করবেন না অথবা প্রাণঘাতী রোগগুলির যন্ত্রণা ভোগ করবেন না। এমনকি “মৃত্যু, সেও বিলুপ্ত হইবে।” (১ করিন্থীয় ১৫:২৬; যিশাইয় ২৫:৮; ৩৩:২৪) যিহোবা যখন আমাদের প্রথম পূর্বপুরুষদের সৃষ্টি করেছিলেন, আমাদের উপভোগ করার জন্য মূলত যে ধরনের জীবন তিনি চেয়েছিলেন, এটি সেই সম্বন্ধে বর্ণনা করে।
বাস্তবিকপক্ষে, এখনই আপনি যিহোবার উপাসকদের মধ্যে এইধরনের পরমদেশীয় অবস্থা পূর্বদর্শন করতে পারেন। তিনি তাদের বলেন: “আমি সদাপ্রভু তোমার ঈশ্বর, আমি তোমার উপকারজনক শিক্ষা দান করি, ও তোমার গন্তব্য পথে তোমাকে গমন করাই।” (যিশাইয় ৪৮:১৭) যিহোবা একজন দয়ালু পিতা যিনি তাঁর সন্তানদের অর্থাৎ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সর্বোত্তম পথটি সম্বন্ধে শিক্ষা দেন। মানুষের জন্য সরবরাহকৃত তাঁর নির্দেশাবলি অযৌক্তিক সীমাবদ্ধতা আরোপ করে না, বরং প্রেমপূর্ণ সুরক্ষা প্রদান করে। সেগুলি অনুসরণ করলে প্রকৃত স্বাধীনতা ও সুখ আসবে, ঠিক যেমন লেখা আছে: “আর প্রভুই [“যিহোবাই,” “NW”] সেই আত্মা; এবং যেখানে প্রভুর [“যিহোবার,” “NW”] আত্মা, সেইখানে স্বাধীনতা।” (২ করিন্থীয় ৩:১৭) বাইবেলে লিপিবদ্ধ নির্দেশাবলি পালন করার দ্বারা যারা তাঁর শাসন গ্রহণ করেন, তারা এখন মানসিক শান্তি উপভোগ করছেন যা একদিন মানবজাতির সমগ্র জগতে পরিব্যাপ্ত হবে।—ফিলিপীয় ৪:৭.
যিহোবা কী এক উত্তম পিতা! সমস্ত সৃষ্টির বিস্ময়ের পিছনে যিনি আছেন আপনি কি তাঁর সম্বন্ধে অধিক জানতে ইচ্ছুক? যারা ইচ্ছুক তাদের জন্য উপকারগুলি এমনকি এখনও অমূল্য। আর ভবিষ্যতে আশীর্বাদগুলি হবে অনন্ত।
[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
চারটি ইব্রীয় অক্ষরে লিখিত ঐশিক নামটি অনেক পুরনো গির্জার দেওয়ালে দেখা যেতে পারে