অবিচার কি অনিবার্য?
“সমস্ত কিছু সত্ত্বেও, আমি এখনও বিশ্বাস করি যে মানুষ আসলেই ভাল। আমি আমার প্রত্যাশাগুলিকে বিভ্রান্তি, দুর্দশা এবং মৃত্যু দ্বারা গঠিত এক ভিত্তির উপর গড়ে তুলতে পারি না।”—অ্যানি ফ্র্যাংক।
অ্যানি ফ্র্যাংক নামে ১৫ বছর বয়সী এক যিহূদী কিশোরী, ওই মর্মস্পর্শী কথাগুলি মৃত্যুর কিছুক্ষণ পূর্বে তার ডায়েরিতে লিখে গিয়েছিল। দুই বছরেরও বেশি সময় তার পরিবার আমস্টারডামের এক চিলে কোঠায় লুকিয়ে ছিল। এক উত্তম জগতের জন্য তার প্রত্যাশা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল যখন একজন গুপ্তচর, নাৎসীদের কাছে তাদের অবস্থানের বিষয় বলে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। পরের বছর, ১৯৪৫ সালে, বার্গেন-বেলজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে এক সংক্রামক জ্বরে অ্যানি মারা গিয়েছিল। আরও ষাট লক্ষ যিহূদীও অনুরূপ দুর্দশা ভোগ করেছিলেন।
সমস্ত লোকেদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য হিটলারের প্রাণঘাতী কৌশল হয়ত আমাদের শতাব্দীতে জাতিগত অবিচারের ক্ষেত্রে সর্বাধিক জঘন্য বিষয় কিন্তু এটিই একমাত্র বিষয় নয়। ১৯৯৪ সালে রুয়াণ্ডায় পাঁচ লক্ষেরও বেশি টুটসিদের কেবল এক “ভিন্ন” উপজাতি হওয়ার কারণে গণহত্যা করা হয়েছিল। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, এক উপজাতিগত মুক্তিসংগ্রামে প্রায় দশ লক্ষ আর্মেনীয় মৃত্যুবরণ করেছিল।
অবিচারের নিষ্ঠুর দিকগুলি
সম্প্রদায়ের বিলোপসাধনই কেবল অবিচারের একমাত্র দিক নয়। সামাজিক অবিচার মানবজাতির এক পঞ্চমাংশ ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ জীবনকালকে নিদারুণ দরিদ্রতার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। এর চেয়েও মন্দ বিষয়টি হল যে ২০,০০,০০,০০০ জনেরও বেশি লোক দাসত্বে বদ্ধ রয়েছে, যা মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ক্রীতদাসত্ব-বিরোধী দল হিসাব করে। ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে সম্ভবত বর্তমানেই বিশ্বে সর্বাধিক ক্রীতদাস বিদ্যমান। তাদের হয়ত প্রকাশ্যে নিলামে বিক্রি করা হয়নি কিন্তু তাদের কাজের শর্তাবলি প্রায়ই পূর্বকালের অধিকাংশ দাসদের চেয়ে আরও মন্দ।
আইনবলে সৃষ্ট অবিচার লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিদের মৌলিক অধিকারগুলি হরণ করে নেয়। “মানবাধিকারের নৃশংসতা বিশ্বের কোথাও না কোথাও মূলত অহরহ ঘটে চলেছে,” অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর ১৯৯৬ সালের রিপোর্ট উল্লেখ করে। “সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা হলেন দরিদ্র এবং দুঃস্থরা, বিশেষভাবে নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং শরণার্থীরা।” রিপোর্টটি মন্তব্য করেছিল: “কিছু দেশে জাতীয় সরকার কাঠামো মূলত অধঃপতিত হয়েছে, বলবানদের হাত থেকে দুর্বলদের রক্ষা করার জন্য কোন বৈধ অধিকারই রাখা হয়নি।”
১৯৯৬ সালে একশটিরও বেশি দেশে হাজার হাজার ব্যক্তিদের কারাবন্দী ও নির্যাতিত করা হয়েছিল। আর সাম্প্রতিক বছরগুলিতে লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিরা নিখোঁজ হয়েছেন এবং স্পষ্টতই তাদের হয় নিরাপত্তা বাহিনী অথবা সন্ত্রাসবাদী দলগুলি অপহরণ করেছিল। তাদের অনেকেই মারা গিয়েছিলেন।
যুদ্ধগুলি অবশ্যই অনিবার্যরূপে অন্যায় অথচ সেগুলি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক যুদ্ধগুলি, নারী এবং শিশু সহ বেসামরিক জনগণকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। আর এটি কেবল শহরগুলিতে বাছবিচারহীনভাবে বোমা নিক্ষেপ করার কারণেই নয়। সামরিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসাবে নারী এবং কিশোরীদের পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয় এবং অনেক বিদ্রোহী দল হত্যাকারী হিসাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য জোরপূর্বক শিশুদের ধরে নিয়ে যায়। এইধরনের প্রবণতাগুলির উপর মন্তব্য করতে গিয়ে রাষ্ট্রসংঘের “শিশুদের উপর সশস্ত্র সংঘর্ষের প্রভাব” বিবৃতিটি উল্লেখ করে: “ক্রমান্বয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ জনগণই দুঃখজনক নৈতিকতা বর্জিত স্থানে পতিত হচ্ছে।”
নিঃসন্দেহে, এই নীতি বর্জন এমন এক বিশ্বের দিকে পরিচালিত করে যা অবিচারে পরিপূর্ণ—আর তা হতে পারে জাতিগত, সামাজিক, আইনগত অথবা সামরিক। এটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। আড়াই হাজার বছরেরও আগে একজন ইব্রীয় ভাববাদী বিলাপ করেছিলেন: “আইন দুর্বল এবং অকার্যকর আর কখনও ন্যায়বিচার করা হয় না। দুষ্ট লোকেরা ধার্মিককে পরাস্ত করে আর তাই ন্যায়বিচার বিপরীতমুখী হয়।” (হবক্কূক ১:৪, আজকের ইংরাজি সংস্করণ) যদিও অবিচার সর্বদাই হয়ে এসেছে তবুও আমাদের বিংশ শতাব্দীকে এমন এক যুগ বলে অভিহিত করা যায় যখন অবিচারের মাত্রা এক নতুন শীর্ষে পৌঁছেছে।
অবিচার কি একটি বিবেচ্য বিষয়?
ব্যক্তিগতভাবে আপনি যখন অবিচারের পরিণতি ভোগ করেন, তখন তা একটি বিবেচ্য বিষয় হয়। এটি একটি বিষয় কারণ এটি মানবজাতির অধিকাংশ ব্যক্তিদের সুখের অধিকার হরণ করে। এছাড়াও এটি একটি বিবেচ্য বিষয় কারণ অবিচার প্রায়ই রক্তাক্ত সংঘর্ষে ইন্ধন যুগিয়েছে আর ফলস্বরূপ তা অবিচারের শিখাকে প্রজ্বলিত রেখেছে।
ন্যায়বিচারের সঙ্গে শান্তি এবং সুখ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত কিন্তু অবিচার, প্রত্যাশাকে ভঙ্গ এবং আশাবাদকে চূর্ণবিচূর্ণ করে। অ্যানি ফ্র্যাংক যেমন দুঃখের সঙ্গে প্রকাশ করেছিল যে লোকেরা বিভ্রান্তি, দুদর্শা ও মৃত্যু দ্বারা গঠিত এক ভিত্তির উপর তাদের প্রত্যাশা গড়ে তুলতে পারে না। তার মত আমরা সকলে উত্তম কিছুর জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা করি।
এই আকাঙ্ক্ষা অকৃত্রিম ব্যক্তিদেরকে মানব সমাজে কিছুটা ন্যায়বিচার আনার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার দিকে পরিচালিত করেছে। এই কারণে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা উল্লেখ করে: “সব মানুষই স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করেছে এবং সকলের মর্যাদা ও অধিকার সমান। তাদের যুক্তি এবং নীতি-বোধে সমৃদ্ধ আর ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে একে অপরের প্রতি কাজ করা উচিত।”
নিশ্চিতরূপে এগুলি মহৎ বাক্য কিন্তু মানবজাতি এখনও আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে বহুদূরে—এক ন্যায়পূর্ণ সমাজ, যেখানে প্রত্যেকে সমান অধিকার উপভোগ করবেন এবং সহমানবদের ভাইয়ের মত দেখবেন। রাষ্ট্রসংঘের ঘোষণার ভূমিকাটি যেমন উল্লেখ করে যে এই লক্ষ্যের প্রতি উপলব্ধিবোধ “জগতে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং শান্তির ভিত্তি” হিসাবে কাজ করবে।
মানব সমাজের কাঠামোতে অবিচার কি এতটাই বদ্ধমূল যে এটিকে কখনও সমূলে উৎপাটন করা যাবে না? অথবা স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং শান্তির এক দৃঢ় ভিত্তি কি কোন না কোনভাবে স্থাপিত হবে? যদি তাই হয়, তাহলে কে এটি স্থাপন করতে এবং নিশ্চিত করতে পারেন যে সকলে উপকৃত হবেন?
[৩ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
UPI/Corbis-Bettmann