একজন দাম্ভিক শাসক সাম্রাজ্য হারান
ভাববাদী দানিয়েল লিখেছিলেন, “রাজা বেল্শৎসর আপনার সহস্র মহল্লোকের নিমিত্ত মহাভোজ প্রস্তুত করিলেন, এবং সেই সহস্রের সাক্ষাতে দ্রাক্ষারস পান করিলেন।” কিন্তু সেই ভোজ চলাকালে, “রাজার মুখ বিবর্ণ হইল, তিনি ভাবনাতে বিহ্বল হইলেন; তাঁহার কটিদেশের গ্রন্থি শিথিল হইয়া পড়িল, এবং তাঁহার জানুতে জানু ঠেকিতে লাগিল।” সেই রাতেই, “কল্দীয় রাজা বেল্শৎসর হত হন। পরে মাদীয় দারিয়াবস রাজ্য প্রাপ্ত হন।”—দানিয়েল ৫:১, ৬, ৩০, ৩১.
বেল্শৎসর কে ছিলেন? তাকে কিভাবে “কল্দীয় রাজা” বলা হতো? নিও-বাবিলনীয় সাম্রাজ্যে তার পদমর্যাদা আসলে কী ছিল? কিভাবে তিনি সাম্রাজ্য হারিয়েছিলেন?
সহশাসক অথবা রাজা?
দানিয়েল, নবূখদ্নিৎসরকে বেল্শৎসরের পিতা হিসাবে উল্লেখ করেন। (দানিয়েল ৫:২, ১১, ১৮, ২২) কিন্তু এই সম্পর্ক আক্ষরিক নয়। রেমন্ড পি. ডয়ার্টির নেবোনাইডাস ও বেল্শৎসর (ইংরাজি) নামক বইটি উল্লেখ করে যে সম্ভবত নবূখদ্নিৎসর, বেল্শৎসরের মা নিটোক্রিসের পিতা ছিলেন অর্থাৎ তার পিতামহ। এটি হয়ত এমনও হতে পারে যে রাজকীয় পূর্বপুরুষ হিসাবে সিংহাসনে বসার দিক দিয়ে নবূখদ্নিৎসর বেল্শৎসরের “পিতা” ছিলেন। (আদিপুস্তক ২৮:১০, ১৩ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) যাই হোক না কেন, উনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ইরাকে আবিষ্কৃত মাটির সিলিন্ডারে কীলকাকার খোদাই করা কয়েকটি শিলালিপি বেল্শৎসরকে বাবিলনের রাজা নেবোনাইডাসের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসাবে বলে।
দানিয়েল ৫ অধ্যায়ের বর্ণনা যেহেতু সা.কা.পূ. ৫৩৯ সালে বাবিলনের পতনের রাতের ঘটনাগুলির বিষয়েই জানায়, তাই বেল্শৎসর কিভাবে রাজকীয় কর্তৃত্বে এসেছিলেন সেই বিষয়ে এটি কোন বর্ণনা দেয় না। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসগুলি নেবোনাইডাস ও বেল্শৎসরের সম্পর্কের বিষয়ে কিছু ধারণা দিয়ে থাকে। “বাবিলনীয় পুঁথিগুলি প্রকাশ করে যে নেবোনাইডাস একজন খামখেয়ালিপূর্ণ শাসক ছিলেন,” প্রত্নতাত্ত্বিক এবং প্রাচীন সেমেটিক ভাষার পণ্ডিত, অ্যালেন মিলার্ড বলেন। মিলার্ড আরও বলেন: “বাবিলনের দেবতাদের তিনি অগ্রাহ্য না করলেও, . . . অন্য দুটি শহর ঊর, এবং হারণের চন্দ্র দেবতার প্রতি তিনি আসক্ত ছিলেন। তার রাজত্বের বেশ কিছু বছর নেবোনাইডাস এমনকি বাবিলনে বাসও করেননি; পরিবর্তে তিনি উত্তর আরবের দূরবর্তী মরূদ্যান টেইমায় [অথবা টেমায়] ছিলেন।” স্পষ্টতই নেবোনাইডাস তার রাজত্বকালের অধিকাংশ সময়ই রাজধানী বাবিলনের বাইরে কাটিয়েছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে বেল্শৎসরকে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছিল।
বেল্শৎসরের প্রকৃত পদকে আরও স্পষ্ট করে দিয়ে “নেবোনাইডাস সম্বন্ধে ছন্দময় বিবরণ” হিসাবে বর্ণিত কীলকাকার প্রমাণপত্র উল্লেখ করে: “তিনি [নেবোনাইডাস] তার জ্যেষ্ঠ, প্রথমজাত [পুত্রের] উপর বিশ্বাস করে ‘সৈন্য শিবিরের’ দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং সেই দেশের সর্বত্র সৈন্যদলকে নেবোনাইডাস তার পুত্রের (আদেশেই) পরিচালিত করতেন। তিনি (সমস্তকিছুর) উপর তাকে ক্ষমতা দিয়েছিলেন, [তিনি] তাকে রাজপদ দিয়েছিলেন।” অতএব বেল্শৎসর একজন সহশাসক ছিলেন।
কিন্তু একজন সহশাসককে কি রাজা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে? ১৯৭০ এর দশকে উত্তর সিরিয়ায় প্রাপ্ত একজন প্রাচীন শাসকের প্রতিমূর্তি দেখায় যে একজন শাসকের প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্রতর উপাধি থাকলেও, তাকে একজন রাজা বলা আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রতিমূর্তিটি ছিল গোজানের শাসকের এবং সেটি অশূরীয় ও অরামীয় ভাষায় খোদাই করা হয়েছিল। অশূরীয় খোদাইকৃত শিলালিপি সেই ব্যক্তিকে গোজানের রাজ্যপাল বলে অভিহিত করে কিন্তু অরামীয় শিলালিপিটি তাকে রাজা হিসাবে অভিহিত করেছিল। তাই সরকারি বাবিলনীয় শিলালিপিতে বেল্শৎসরকে উত্তরাধিকারী রাজা বলা নজিরবিহীন কোন ঘটনা নয়। আর দানিয়েলের অরামীয় রচনাতে তাকে রাজা বলে অভিহিত করা হয়েছে।
নেবোনাইডাস ও বেল্শৎসরের যৌথ শাসনের ব্যবস্থাটি নিও-বাবিলনীয় সাম্রাজ্যের শেষ দিন পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। তাই, বাবিলনের পতনের রাতেই বেল্শৎসর দানিয়েলকে রাজ্যের দ্বিতীয় শাসক নয়, বরং তৃতীয় শাসক করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।—দানিয়েল ৫:১৬.
অত্যধিক আত্মবিশ্বাসী ও দাম্ভিক শাসক
বেল্শৎসরের রাজত্বের চূড়ান্ত ঘটনাগুলি ইঙ্গিত করে যে যুবরাজ অত্যধিক আত্মবিশ্বাসী এবং দাম্ভিক ছিলেন। সা.কা.পূ. ৫৩৯ সালের ৫ই অক্টোবর যখন তার রাজত্ব বিলুপ্ত হয়েছিল, নেবোনাইডাস মাদীয় পারসীক বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে বোরসিপ্পায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাবিলনকেও আক্রমণ করা হয়েছিল। কিন্তু বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা শহরে বেল্শৎসর এতই নিরাপদ বোধ করেছিলেন যে সেই রাতেই তিনি “আপনার সহস্র মহল্লোকের নিমিত্ত মহাভোজ” প্রস্তুত করেছিলেন। সা.কা.পূ. পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রীক ইতিহাসবেত্তা হেরোডোটাস বলেন যে শহরের ভিতরে লোকেরা “সেই সময় নৃত্য করছিল এবং নিজেরা আমোদে মেতে ছিল।”
কিন্তু বাবিলনের প্রাচীরের বাইরে মাদীয় পারসীক সৈন্যরা সতর্ক প্রহরারত ছিল। কোরসের নির্দেশাধীনে তারা ইউফ্রেটিস নদীর জলকে ভিন্নমুখী করেছিল যা শহরটির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। জল কমে যাওয়ায় তার যোদ্ধারা নদীগর্ভের উপর দিয়ে চলার জন্য প্রস্তুত ছিল। তারা প্রাচীরের ঢালে উঠেছিল এবং নদীর সামনের দিকের খোলা তাম্রনির্মিত কবাটের মধ্য দিয়ে শহরে প্রবেশ করেছিল।
বেল্শৎসর যদি শহরের বাইরের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে মনোযোগী হতেন, তাহলে তিনি তাম্রনির্মিত কবাটগুলি বন্ধ করতে পারতেন, নদীর তীরবর্তী প্রাচীরগুলিতে বলবান লোকেদের পাহাড়ায় রাখতে পারতেন ও শত্রুদের বন্দী করতে পারতেন। পরিবর্তে, মাতাল অবস্থায় উদ্ধত বেল্শৎসর যিহোবার মন্দিরের নানা পাত্র তার সামনে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। তারপর তিনি, তার অতিথিবর্গ, তার পত্নী এবং উপপত্নীগণ বাবিলনীয় দেবতাদের প্রশংসা করতে করতে অবজ্ঞাপূর্ণভাবে সেগুলিতে পান করেছিলেন। হঠাৎ, অলৌকিকভাবে একটি হাত দেখা গিয়েছিল এবং রাজপ্রাসাদের দেওয়ালে সেটি লিখতে শুরু করেছিল। ভীত বিহ্বল হয়ে বেল্শৎসর সেই বার্তাটির তাৎপর্য জানার জন্য তার দেশের বিজ্ঞ লোকেদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারা “সেই লেখা পড়িতে কিম্বা রাজাকে তাহার তাৎপর্য্য জানাইতে পারিল না।” পরিশেষে দানিয়েল “রাজার নিকটে আনীত হইলেন।” ঐশিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে যিহোবার সাহসী ভাববাদী দানিয়েল সেই অলৌকিক বার্তার অর্থ প্রকাশ করেছিলেন, মাদীয় ও পারসীকদের হাতে বাবিলনের পতন সম্বন্ধে পূর্বেই বলে দিয়েছিলেন।—দানিয়েল ৫:২-২৮.
মাদীয় ও পারসীকেরা অনায়াসেই শহরটি দখল করেছিল এবং বেল্শৎসর সেই রাতেই মারা গিয়েছিলেন। তার মৃত্যু এবং কোরসের নিকট নেবোনাইডাসের আপাত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিও-বাবিলনীয় সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।
[৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
দানিয়েল বাবিলনীয় সাম্রাজ্য ধ্বংস সম্বন্ধীয় বার্তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছিলেন