কলিজিয়ন্টরা—বাইবেল অধ্যয়ন যাদেরকে আলাদা করেছিল
আপনি কি কখনও কলিজিয়ন্টদের কথা শুনেছেন?
সপ্তদশ শতাব্দীতে হল্যান্ডের এই ছোট ধর্মীয় দল সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত গির্জাগুলো থেকে আলাদা ছিল। কোন্ দিক দিয়ে তারা আলাদা ছিল আর আমরা তাদের কাছ থেকে কী শিখতে পারি? উত্তর পাওয়ার জন্য আসুন সেই সময়ে ঘুরে আসা যাক।
পনেরশ সাতাশি সালে জ্যাকোবাস আর্মিনিয়াস (বা জ্যাকোব হারম্যানসেন) আমস্টারডাম শহরে আসেন। ভাল যোগ্যতা থাকায় চাকরি পেতে তার কোন অসুবিধাই হয়নি। ২১ বছর বয়সে তিনি হল্যান্ডের লিডেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছিলেন। এর পর তিনি সুইজারল্যান্ডে ঈশ্বরতত্ত্বের ওপর পড়াশুনা করে ছয় বছর কাটান আর সেখানে তিনি থিওডর বেজার কাছে পড়াশোনা করেছিলেন যিনি প্রটেস্টান্ট ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা জন ক্যালভিনের উত্তরসূরী ছিলেন। এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে আমস্টারডামের প্রটেস্টান্টরা ২৭ বছর বয়সী আর্মিনিয়াসকে তাদের পাদ্রি বানিয়ে খুবই খুশি হয়েছিল! কিন্তু কয়েক বছর পরে গির্জার অনেক সদস্যই তাদের এই সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ করেছিলেন। কেন?
অদৃষ্টবাদ নিয়ে বিতর্ক
আর্মিনিয়াস পাদ্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অদৃষ্টের মতবাদ নিয়ে আমস্টারডামের প্রটেস্টানদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা দেখা দেয়। এই মতবাদ ক্যালভিনবাদের মূল শিক্ষা ছিল কিন্তু গির্জার কিছু সদস্যরা ভাবতে থাকেন যে ঈশ্বর যদি কিছুজনের জন্য পরিত্রাণ আর কিছুজনের জন্য ধ্বংস আগে থেকে ঠিক করেই রাখেন তাহলে তিনি কঠোর আর অবিচারক। ক্যালভিনবাদীরা আশা করেছিলেন যে বেজার শিষ্য হওয়ায় আর্মিনিয়াস এই বিরোধীদের শুধরে দেবেন। কিন্তু ক্যালভিনবাদীদের অবাক করে দিয়ে আর্মিনিয়াস বিরোধীদের সমর্থন করেছিলেন। ১৫৫৩ সালের মধ্যে এই ঝগড়া এতই বেড়ে গিয়েছিল যে এর ফলে সেই শহরের প্রটেস্টান্টরা দুই দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এক দল এই মতবাদকে মানত আর অন্যদল এটাকে মানত না যাদের মধ্যপন্থী বলা হতো।
কয়েক বছরের মাথায় এক গির্জায় শুরু হওয়া এই ঝগড়া গোটা দেশের প্রটেস্টান্টদের মধ্যে বিভেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শেষে ১৬১৮ সালের নভেম্বর মাসে বিষয়টা মীমাংসা করার সময় এসে পৌঁছায়। ক্যালভিনবাদীরা সৈন্য ও জনগণের সমর্থন পেয়ে বিরোধীদের (যাদের তখন রেমোনস্ট্রান্টa বলা হত) দেশের আদালত অর্থাৎ প্রটেস্টান্ট ডরড্রেক্ট পরিষদে হাজির হওয়ার হুকুম দেয়। সভার শেষে, সব রেমনস্ট্রান্ট পাদ্রিদের সামনে একটা বিষয় বেছে নেওয়ার জন্য রাখা হয়: আর কখনও প্রচার না করার চুক্তিপত্রে সাক্ষর করা নতুবা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। বেশিরভাগই দেশ ছেড়ে যাওয়াকেই বেছে নিয়েছিলেন। রেমনস্ট্রান্ট পাদ্রিরা চলে গেলে গোঁড়া ক্যালভিনবাদী পাদ্রিরা তাদের জায়গা নিয়েছিল। ক্যালভিনবাদের জয় হয়—অথবা শুধু পরিষদ তা মনে করে।
কলিজিয়ন্টদের শুরু ও বৃদ্ধি
রেমনস্ট্রান্ট পাদ্রিরা চলে যাওয়ায় তাদের কোন মণ্ডলীতেই আর কোন পাদ্রি ছিল না আর লিডেনের কাছে ওয়ারমন্ড গ্রামের মণ্ডলীতেও তাই ঘটেছিল। পরিষদ এই মণ্ডলীগুলোতে তাদের পাদ্রি পাঠিয়েছিল কিন্তু ওয়ারমন্ড গ্রামের মণ্ডলী পরিষদের পাঠানো পাদ্রিকে মেনে নেননি। উপরন্তু, ১৬২০ সালে একজন রেমনস্ট্রান্ট পাদ্রি যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মণ্ডলী দেখাশোনা করার জন্য ওয়ারমন্ডে ফিরে আসেন তখন মণ্ডলীর কিছু সদস্যরা তাকেও মেনে নেননি। এই সদস্যরা এখন কোন পাদ্রি ছাড়াই তাদের ধর্মীয় সভাগুলো গোপনে করতে শুরু করেছিলেন। পরে, এই সভাগুলোকে কলেজ নাম দেওয়া হয়েছিল আর যারা সেখানে যেতেন তাদেরকে কলিজিয়ন্ট বলা হত।
যদিও কলিজিয়ন্টদের এইরকম শুরু কোন ধর্মীয় নীতির কারণে নয় কিন্তু পরিস্থিতিতে পড়ে তাদের বিনা পাদ্রিতে সভা চালাতে হয়েছিল, তবে খুব শীঘ্রিই তাদের অবস্থা বদলে যায়। মণ্ডলীর একজন সদস্য গিসবার্ট ভান ডের কোডে দাবি করেছিলেন যে পাদ্রিদের ছাড়া সভা করায় তাদের দল সেই সময়ের গির্জাগুলোর থেকে আরও ভাল করে বাইবেলের নীতি মেনে চলছেন আর প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের মতো করে কাজ করছেন। তিনি বলেছিলেন, প্রেরিতদের মৃত্যুর পর পাদ্রি শ্রেণীর জন্ম হয়েছে যাতে করে সেইসমস্ত লোকেদের জীবিকার ব্যবস্থা করা যায় যারা কোন কাজ করতে চান না।
১৬২১ সালে, ভান ডের কোডে আর তারই মতো ভাবতেন এমন অন্য সদস্যরা তাদের সভার জায়গা বদল করেন আর রিন্সবার্গ নামে কাছেরই একটা গ্রামে তাদের সভা করতে শুরু করেন।b কিছু বছর পরে যখন ধর্মীয় অত্যাচার বন্ধ হয়ে সহনশীলতা আসে তখন কলিজিয়ন্টদের সভার সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আর এর ফলে যেভাবে ইতিহাসকার স্যাগফ্রেড জিলভারবার্গ বলেছিলেন “বিভিন্ন রকমের লোক” এই সভায় আসতে লাগেন। তাদের মধ্যে অনেকেই রেমনস্ট্রান্ট, ম্যানোনাইট, সোশিনিয়ান দলের ছিলেন আর এমনকি ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করেছেন এমন লোকেরাও ছিলেন। কিছুজন ছিলেন কৃষক। অন্যেরা ছিলেন কবি, মুদ্রাকর, চিকিৎসক ও দোকানদার। দার্শনিক স্পিনোজা (বেনেডিক্টাস ডি স্পিনোজা) আর শিক্ষক যোহান অ্যামোস কমিনিয়াস (অথবা যান কমেনস্কি) ও সেইসঙ্গে বিখ্যাত চিত্রকর রেমব্রান্ট ভান রিনও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। এই ধার্মিক লোকেরা তাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা ধারণা নিয়ে এসেছিলেন যা কলিজিয়ন্টদের বিশ্বাসে ছাপ ফেলেছিল।
১৬৪০ সালের পরে এই প্রগতিশীল দল খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। রটেরডাম, আমস্টারডাম, লিওয়ারডেন এবং অন্য অন্য শহরেও কলেজগুলো খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসের অধ্যাপক এন্ড্রো সি. ফিক্স বলেন যে ১৬৫০ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে “সপ্তদশ শতাব্দীর হল্যান্ডে কলিজিয়ন্টরা . . . সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ধর্মীয় দল হয়ে উঠেছিল।”
কলিজিয়ন্টদের বিশ্বাসগুলো
কলিজিয়ন্টদের বৈশিষ্ট্য ছিল যে কোন বিষয়কে যুক্তি দিয়ে বোঝা, সহনশীলতা দেখানো আর খোলাখুলি কথা বলার স্বাধীনতা দেওয়া আর তাই তাদের সদস্যরা আলাদা আলাদা মতবাদে বিশ্বাস করতে পারতেন। কিন্তু তবুও তাদের কিছু সাধারণ বিশ্বাস ছিল যা সকলে মানতেন আর তাই তারা এক ছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সব কলিজিয়ন্টই ব্যক্তিগত বাইবেল অধ্যয়নের গুরুত্বকে মূল্য দিতেন। একজন কলিজিয়ন্ট লিখেছিলেন, প্রত্যেক সদস্যের “অন্য কারও কাছ থেকে শুনে নয় কিন্তু নিজে নিজে পরীক্ষা করা উচিত যে ঈশ্বর কে।” আর তারা নিজে নিজেই পরীক্ষা করতেন। উনবিংশ শতাব্দীর গির্জার ঐতিহাসিক জ্যাকোবাস সি. ভান স্লির মতে, সেই সময়ের অন্য ধর্মীয় দলগুলোর চেয়ে কলিজিয়ন্টদের বাইবেল সম্বন্ধে অনেক বেশি জ্ঞান ছিল। বাইবেল ব্যবহারে তারা এতই দক্ষ ছিলেন যে এমনকি বিরোধীরাও কলিজিয়ন্টদের প্রশংসা করতেন।
কিন্তু কলিজিয়ন্টরা যতই বাইবেল অধ্যয়ন করতে থাকেন, ততই তাদের মধ্যে এমন বিশ্বাস গড়ে উঠতে থাকে যা গির্জাগুলো থেকে আলাদা ছিল। সপ্তদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর কিছু কিছু গ্রন্থ ও লেখায় তাদের ধর্মমতকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে:
প্রাথমিক গির্জা। ১৬৪৪ সালে কলিজিয়ন্ট এবং ঈশ্বরতত্ত্ববিদ অ্যাডাম বরিল লিখেছিলেন যে সম্রাট কনস্টানটাইনের সময় যখন প্রাচীন গির্জা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল, তখন খ্রীষ্টের সঙ্গে করা তার চুক্তিকে গির্জা ভেঙে দিয়েছিল আর তাই পবিত্র আত্মার প্রেরণাও হারিয়ে ফেলেছিল। তিনি আরও বলেছিলেন, এর ফলে মিথ্যা শিক্ষা বেড়ে গিয়েছিল আর তা তার সময় পর্যন্ত চলে এসেছে।
ধর্ম-সংস্কার। লুথার, ক্যালভিন এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে করা ষোড়শ শতাব্দীর ধর্ম-সংস্কার গির্জায় বিশেষ কোন পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেনি। একজন কলিজিয়ন্ট নেতা ও চিকিৎসক গালেনাস অ্যাব্রাহামজনের মতে, এই ধর্ম-সংস্কার ধর্মীয় পরিবেশকে আরও খারাপ করে দিয়েছিল, এর ফলে ঝগড়া ও ঘৃণা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সত্যিকারের সংস্কারের হৃদয় বদলে দেওয়া উচিত কিন্তু এই ধর্ম-সংস্কার তা করতে পারেনি।
গির্জা ও পাদ্রি শ্রেণী। প্রতিষ্ঠিত গির্জাগুলো দুর্নীতিপরায়ণ ও জাগতিক ছিল আর ঈশ্বর সেগুলোকে নিযুক্ত করেননি। যারা সত্যিকরে ধর্ম পালন করতে চায় তাদের জন্য একটাই পথ থেকে যায় আর তা হল তাদের গির্জা ছেড়ে দেওয়া যেন তারা তার পাপের ভাগী না হয়। কলিজিয়ন্টরা বলেছিল যে পাদ্রি পদ বাইবেল বিরুদ্ধ আর তা “খ্রীষ্টান মণ্ডলীর আধ্যাত্মিক মঙ্গলের পক্ষে ক্ষতিকর।”
রাজ্য এবং পরমদেশ। আমস্টারডাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন দানিয়েল ডি ব্রিন (১৫৯৪-১৬৬৪) লিখেছিলেন যে খ্রীষ্টের রাজ্য একজনের হৃদয়ে থাকা কোন আত্মিক রাজ্য নয়। রটেরডামের কলিজিয়ন্ট ও শিক্ষক জ্যাকোব ওস্টেনস্ বলেছিলেন, “কূলপতিরা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আশা রাখতেন।” একইভাবে, কলিজিয়ন্টরাও সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করতেন যখন পৃথিবী পুরোপুরি বদলে যাবে আর পরমদেশ হয়ে যাবে।
ত্রিত্ব। সোশিনিয় দলের বিশ্বাসের প্রভাবে কিছু নেতৃস্থানীয় কলিজিয়ন্টরা ত্রিত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।c উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডেনিয়েল জুইকার (১৬২১-৭৮) লিখেছিলেন যে ত্রিত্বের মতো কোন মতবাদ যাকে যুক্তি দিয়ে বোঝা যায় না তা কখনই “সত্যি হতে পারে না আর তা একেবারেই মিথ্যা।” ১৬৯৪ সালে কলিজিয়ন্ট রেইনার রোলিওয়ের অনূদিত বাইবেল প্রকাশিত হয়েছিল। এতে যোহন ১:১ পদের শেষ অংশকে এইভাবে অনুবাদ করা হয়েছিল: “আর বাক্য একজন ঈশ্বর ছিলেন” যখন কিনা বাকি সমস্ত বাইবেল এই পদটাকে এইভাবে অনুবাদ করেছিল: “আর বাক্য ঈশ্বর ছিলেন।”d
সাপ্তাহিক সভাগুলো
যদিও কলিজিয়ন্টরা তাদের বিশ্বাসে এক ছিলেন না কিন্তু বিভিন্ন শহরে হওয়া তাদের কলেজগুলো প্রায় একইভাবে চালানো হতো। ঐতিহাসিক ভান স্লি বলেন যে কলিজিয়ন্ট বিপ্লবের শুরুর দিনগুলোতে সভাগুলোর জন্য আগে থেকে তৈরি করা হতো না। প্রেরিত পৌল “ভাববাণী” বলার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বলেছিলেন এইজন্য কলিজিয়ন্টরা মনে করতেন যে সব পুরুষ সদস্যের তৈরি না হয়ে এসেই সভায় বক্তৃতা দেওয়া উচিত। (১ করিন্থীয় ১৪:১, ৩, ২৬) এর ফলে প্রায়ই সভা অনেক রাত পর্যন্ত হতো আর কিছু শ্রোতারা “গভীর ঘুমে” ডুবে যেতেন।
পরে সভাগুলো আরও সংগঠিত হয়ে উঠেছিল। কলিজিয়ন্টরা শুধু রবিবারেই নয় কিন্তু সপ্তাহের অন্যান্য দিন সন্ধ্যাবেলাতেও একত্রিত হতেন। বক্তা আর মণ্ডলী যাতে সেই বছরের সব সভাগুলোর জন্য আগে থেকেই তৈরি হতে পারেন তাই একটা কার্যক্রম ছাপানো হতো যেখানে বাইবেলের যে পদগুলো আলোচনা করা হবে সেগুলো আর বক্তার নামের প্রথম অক্ষর দেওয়া থাকত। গান ও প্রার্থনা দিয়ে সভা শুরু করার পর একজন বক্তা বাইবেলের পদগুলো বুঝিয়ে দিতেন। তার বলা শেষ হলে তিনি অন্য পুরুষদের এই বিষয়ে তাদের নিজেদের মতামত সম্বন্ধে বলার জন্য বলতেন। পরে দ্বিতীয় বক্তা এই পদগুলোকে কিভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে তা দেখাতেন। প্রার্থনা ও গান করে সভা শেষ করা হতো।
ফ্রিসল্যান্ড প্রদেশের হারলিনজেন শহরে তাদের সভাগুলোকে ঠিক সময়ে শুরু ও শেষ করার জন্য কলিজিয়ন্টরা এক অভিনব পদ্ধতি খুঁজে বের করেছিল। যে বক্তা তার জন্য দেওয়া সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে কথা বলতেন তাকে সামান্য কিছু জরিমানা দিতে হতো।
জাতীয় সম্মেলনগুলো
কলিজিয়ন্টরা বড় করে সভা করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন। আর তাই ১৬৪০ সাল থেকে পুরো দেশের সব কলিজিয়ন্টরা বছরে দুবার (বসন্তকালে এবং গরমকালে) রিন্সবার্গে আসত। ঐতিহাসিক ফিক্স লেখেন, এই সমাবেশগুলো করে তারা “তাদের দূরদূরান্তের ভাইদের ধারণা, অনুভূতি, বিশ্বাস ও কাজ সম্বন্ধে জানতে” পারতেন।
কিছু কলিজিয়ন্টরা সেই গ্রামের লোকেদের কাছ থেকে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন আর অন্যান্যরা ক্রোটে হোস বা বড় বাড়িতে থাকতেন। এটা ৩০টা কামরাওয়ালা একটা বড় বাড়ি ছিল যার মালিক নিজে একজন কলিজিয়ন্ট ছিলেন। সেখানে ৬০ থেকে ৭০ জনকে একসঙ্গে খাওয়ানো যেত। রাতের খাবারের পর, অতিথিরা সেই বাড়ির বড় বাগানে ঘুরে বেড়াতে পারতেন যাতে তারা ‘ঈশ্বরের সৃষ্টিকে’ উপভোগ করতে পারেন আর ‘নিচু স্বরে কথাবার্তা বলতে কিংবা ঈশ্বরের বিষয়ে গভীর চিন্তা করতে পারেন।’
কলিজিয়ন্টদের কিছুজন ছাড়া বাকি সদস্যরা মনে করতেন যে বাপ্তিস্ম নেওয়া জরুরি। আর সেইজন্য বাপ্তিস্ম বড় বড় সম্মেলনগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। ঐতিহাসিক ভান স্লি বলেন যে এই অনুষ্ঠান সাধারণত শনিবার সকালে হতো। বাপ্তিস্ম নেওয়া কেন জরুরি এই বিষয়ের ওপর একটা বক্তৃতার পর গান ও প্রার্থনা করা হতো। এরপর বক্তা বাপ্তিস্ম নিতে চান এমন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের তাদের বিশ্বাসের অঙ্গীকার করার জন্য বলতেন অর্থাৎ এই কথা বলা যে, “আমি যীশু খ্রীষ্টকে জীবন্ত ঈশ্বরের পুত্র বলে বিশ্বাস করি।” প্রার্থনা করে বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর, উপস্থিত সকলে বাপ্তিস্মের জায়গায় যেতেন আর অঙ্গীকার করা পুরুষ ও মহিলারা হাঁটু গেড়ে জলের মধ্যে বসতেন যাতে জল তাদের কাঁধ পর্যন্ত আসে। যিনি বাপ্তিস্ম দিতেন তিনি আস্তে করে নতুন বিশ্বাসীর মাথা সামনের দিকে ঝোকাতেন যাতে তিনি পুরোপুরি জলের নিচে চলে যান। এই অনুষ্ঠানের পর, সকলে পরের বক্তৃতা শোনার জন্য তাদের নিজের নিজের জায়গায় গিয়ে বসতেন।
শনিবার বিকেল ৫টায় বাইবেলের কিছু অংশ পড়া, গান এবং প্রার্থনা করে আসল সভা শুরু করা হতো। সবসময় যেন কোন না কোন বক্তা পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করার জন্য রটেরডাম, লিডেন, আমস্টারডাম এবং উত্তর হল্যান্ডের কলেজগুলো থেকে পালা পালা করে প্রতিটা সম্মেলনের জন্য বক্তাদের ব্যবস্থা করত। রবিবার সকালটা প্রভুর ভোজ উদ্যাপন করার জন্য রাখা হতো। বক্তৃতা, প্রার্থনা ও গানের পরে প্রথমে পুরুষ ও পরে মহিলারা রুটি ও দ্রাক্ষারস খেতেন। রবিবার বিকেলে আরও বক্তৃতা হতো আর সোমবার সকালে সবাই শেষ বক্তৃতা শোনার জন্য একত্রিত হতেন। ভান স্লি বলেন, এই সম্মেলনগুলোতে বেশিরভাগই ব্যবহারিক বক্তৃতা দেওয়া হতো যেখানে অন্যদের দেখার চেয়ে নিজেদের জীবনে বিষয়গুলো কাজে লাগানোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হতো।
রিন্সবার্গ গ্রাম এই সম্মেলনের আয়োজন করতে পেরে খুশি হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন মন্তব্যকারী লিখেছিলেন যে বাইরে থেকে আসা এই লোকেরা খাবারের জন্য অনেক পয়সা খরচ করতেন যা ওই গ্রামের লোকেদের আয়ের ভাল পথ খুলে দিত। এছাড়াও, প্রত্যেক সম্মেলনের পর কলিজিয়ন্টরা রিন্সবার্গের গরিবদের কিছু টাকা দান করতেন। কোন সন্দেহ নেই যে ১৭৮৭ সালে যখন সম্মেলন বন্ধ হয়ে যায় তখন এই গ্রামের লোকসান হয়েছিল। এর পর থেকে কলিজিয়ন্টরা আস্তে আস্তে লোপ পেতে থাকে। কেন?
কেন তারা লোপ পায়
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষাশেষি ধর্মে নিজেরা যুক্তি দিয়ে বুঝে কাজ করার বিষয় নিয়ে এক বিবাদ শুরু হয়। কিছু কলিজিয়ন্ট মনে করতেন যে ঐশিক উপদেশের চেয়ে মানুষের যুক্তিকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত কিন্তু অন্যরা এর সঙ্গে একমত হননি। ফলে, এই বিবাদ পুরো কলিজিয়ন্ট দলকে বিভক্ত করে দিয়েছিল। একমাত্র যখন দুই দলের প্রধান বিবাদকারীরা মারা যান তখনই কলিজিয়ন্টরা আবার এক হতে পেরেছিলেন। কিন্তু তবুও এই বিবাদের পর তা “আর কখনই আগের মতো হয়ে ওঠেনি,” ঐতিহাসিক ফিক্স বলেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রটেস্টান্ট গির্জাগুলোর সহনশীলতা বেড়ে যাওয়ায় কলিজিয়ন্টদের পতন আরও তাড়াতাড়ি হয়েছিল। যুক্তি আর সহনশীলতা সম্বন্ধে কলিজিয়ন্টদের নীতিগুলো যখন সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, তখন “একসময়ের কলিজিয়ন্টবাদের নিঃসঙ্গ বাতি জ্ঞানালোকের উজ্জ্বল ভোরের আলোয় মিলিয়ে যায়।” অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে, বেশিরভাগ কলিজিয়ন্ট ম্যানোনাইট ও অন্যান্য ধর্মীয় দলে যোগ দেন।
যেহেতু কলিজিয়ন্টরা তাদের দলের মধ্যে চিন্তাধারায় একতা রাখার বিষয়ে জোর দেয়নি, তাই যতজন কলিজিয়ন্ট ছিল তাদের তত আলাদা আলাদা চিন্তাধারা ছিল। তারা নিজেরাও এটা জানতেন আর তাই তারা কখনও দাবি করেননি যে তারা “এক বিচারে পরিপক্ব” যেমন হওয়ার জন্য প্রেরিত পৌল খ্রীষ্টানদের বলেছিলেন। (১ করিন্থীয় ১:১০) কিন্তু তা সত্ত্বেও কলিজিয়ন্টরা সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন যখন মৌলিক খ্রীষ্টীয় বিশ্বাসগুলো, যেমন চিন্তাধারায় একতা তাদের মধ্যেও এসে যাবে।
যদিও এটা ঠিক যে কলিজিয়ন্টদের দিনে সত্য জ্ঞান বড় ছিল না তবুও তারা এক ভাল উদাহরণ রেখে গিয়েছেন যার থেকে আজকের অনেক ধর্ম কিছু শিখতে পারে। (দানিয়েল ১২:৪ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) তারা বাইবেল অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর যে জোর দিয়েছিলেন তা প্রেরিত পৌলের পরামর্শের সঙ্গে মিলে যায়: “সর্ব্ববিষয়ের পরীক্ষা কর।” (১ থিষলনীকীয় ৫:২১) ব্যক্তিগত বাইবেল অধ্যয়ন জ্যাকোবাস আর্মিনিয়াস আর অন্যানদের শিখিয়েছিল যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ধর্মীয় মতবাদ ও প্রথাগুলোর ভিত্তি একেবারেই বাইবেল নয়। তারা যখন এটা বুঝতে পেরেছিলেন, তখন প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলো থেকে আলাদা হয়ে আসার সাহস তাদের ছিল। আপনিও কি এইরকমই করতেন?
[পাদটীকাগুলো]
a ১৬১০ সালে এই বিরোধীরা হল্যান্ডের শাসকদের কাছে রেমোস্ট্রেন্স (একটা প্রমাণপত্র যাতে বিরোধের কারণ বলা হয়েছিল) লেখেন। এর পর থেকেই তাদেরকে রেমনস্ট্রান্ট বলে ডাকা শুরু হয়।
b এই জায়গার জন্য কলিজিয়ন্টদের রিন্সবার্জারও বলা হতো।
c ১৯৮৮ সালের নভেম্বর ২২ সংখ্যার সচেতন থাক! (ইংরাজি) পত্রিকার ১৯ পৃষ্ঠায় “সোশিনিয় দল—কেন ত্রিত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছিল?” প্রবন্ধটা দেখুন।
d হ্যাট নিওই টেস্টামেন্ট ভান ওনজ্ হির যিজাস ক্রাইস্টাস, উইট হ্যাট গ্রিকস্ক ভারটাল্ড ডোর রেইনার রোলিও, এম.ডি.। (আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের নতুন নিয়ম, রেইনার রোলিও এম.ডি. দ্বারা গ্রিক থেকে অনূদিত।)
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
রেমব্রান্ট ভান রিন
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
ওয়ারমন্ড গ্রাম যেখানে কলিজিয়ন্টদের শুরু হয়েছিল আর ডি ভ্লেট নদী যেখানে বাপ্তিস্ম হতো
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
পশ্চাৎপট: Courtesy of the American Bible Society Library, New York