আনন্দের বিষয় যে যিহোবা আমাদেরকে তাঁর পথ দেখান
“তিনিই ঈশ্বর, তাঁহার পথ সিদ্ধ; সদাপ্রভুর বাক্য পরীক্ষাসিদ্ধ।”—২ শমূয়েল ২২:৩১.
১, ২. (ক) মানুষের কোন্ মৌলিক চাহিদা রয়েছে? (খ) কার মতো চলা আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ?
নির্দেশনা চাওয়া মানুষের এক মৌলিক চাহিদা। সত্যিই, জীবনের পথে চলার জন্য আমাদের কারও সাহায্যের দরকার। এটা ঠিক যে যিহোবা আমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় বিচার করার মতো বুদ্ধি ও বিবেক দিয়েছেন। কিন্তু, বিবেককে যদি এক নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হতে হয়, তাহলে একে ঠিক মতো প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। (ইব্রীয় ৫:১৪) আর ভেবেচিন্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের মনের নির্ভুল তথ্য ও সেই তথ্যকে পরীক্ষা করার জন্য ঠিক মতো প্রশিক্ষণের দরকার। (হিতোপদেশ ২:১-৫) কিন্তু, এত কিছু করার পরও এমন হয় যে আমাদের সিদ্ধান্ত সেই লক্ষ্যে পৌঁছায় না যা আমরা চেয়েছিলাম কারণ আমরা কেউই জানি না যে কাল আমাদের জীবনে কী ঘটতে চলেছে। (উপদেশক ৯:১১) তাই ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য কী নিয়ে আসবে তা জানার কোন পথ আমাদের নিজেদের কাছে নেই।
২ এর জন্য এবং অন্য আরও কারণে ভাববাদী যিরমিয় লিখেছিলেন: “হে সদাপ্রভু, আমি জানি, মনুষ্যের পথ তাহার বশে নয়, মনুষ্য চলিতে চলিতে আপন পাদবিক্ষেপ স্থির করিতে পারে না।” (যিরমিয় ১০:২৩) সর্বকালের সর্বমহান পুরুষ, যীশু খ্রীষ্ট নির্দেশনা মেনে কাজ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “পুত্ত্র আপনা হইতে কিছুই করিতে পারেন না, কেবল পিতাকে যাহা করিতে দেখেন, তাহাই করেন; কেননা তিনি যাহা যাহা করেন, পুত্ত্রও সেই সকল তদ্রূপ করেন।” (যোহন ৫:১৯) তাই, যীশুর মতোই আমাদের পদক্ষেপকে ঠিক পথে চালানোর জন্য যিহোবার দিকে তাকানো কতই না বুদ্ধিমানের কাজ! রাজা দায়ূদ গেয়েছিলেন: “তিনিই ঈশ্বর, তাঁহার পথ সিদ্ধ; সদাপ্রভুর বাক্য পরীক্ষাসিদ্ধ, তিনি নিজ শরণাগত সকলের ঢাল।” (২ শমূয়েল ২২:৩১) অতএব, আমাদের নিজেদের বুদ্ধিতে নয় কিন্তু আমরা যদি যিহোবার পথে চলার চেষ্টা করি, তাহলে আমরা নিখুঁত নির্দেশনা পাব। ঈশ্বরের পথকে ছেড়ে দেওয়া ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
যিহোবা পথ দেখান
৩. আদম ও হবাকে যিহোবা কীভাবে নির্দেশনা দিয়েছিলেন আর তাদের সামনে কোন্ ভবিষ্যৎ রেখেছিলেন?
৩ আদম ও হবার কথা চিন্তা করুন। তাদের মধ্যে পাপ ছিল না, তবুও তাদের নির্দেশনার দরকার ছিল। সেই সুন্দর এদন বাগানে কী কী করতে হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার ভার যিহোবা আদমের ওপর ছেড়ে দেননি। এর বদলে ঈশ্বর তাকে কাজ দিয়েছিলেন। প্রথমে, আদমকে সমস্ত পশুপাখির নাম রাখতে হয়েছিল। তারপর, যিহোবা আদম ও হবাকে ভবিষ্যতের জন্য বড় বড় কাজ দিয়েছিলেন। তাদের পৃথিবীকে বশীভূত করার, সন্তানসন্ততি দিয়ে পৃথিবী পূর্ণ করার আর পৃথিবীর পশুপাখিদের দেখাশোনা করার কথা ছিল। (আদিপুস্তক ১:২৮) এটা খুব বড় কাজ ছিল আর এক সময় সমস্ত পৃথিবী পরমদেশে পরিণত হতো, সিদ্ধ মানুষ দিয়ে পৃথিবী ভরে যেতো আর পশুপাখিরা তাদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করত। কী এক চমৎকার ভবিষ্যৎ! এছাড়া আদম ও হবা যদি বিশ্বস্তভাবে যিহোবার পথে চলত, তাহলে তারা ঈশ্বরের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারত। (আদিপুস্তক ৩:৮ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সবসময়ের জন্য এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক উপভোগ করার কতই না বড় এক সুযোগ!
৪. আদম ও হবা কীভাবে আস্থা ও নিষ্ঠার অভাব দেখিয়েছিল আর এর ফলে তাদের কোন্ বড় ক্ষতি হয়েছিল?
৪ যিহোবা প্রথম মানব দম্পতিকে এদনের সদসদ্জ্ঞানদায়ক গাছ থেকে ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন আর এটা তাদেরকে তখনই বাধ্যতা দেখানোর অর্থাৎ সত্যিই তারা যিহোবার পথে চলতে চায় কি না তা দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। (আদিপুস্তক ২:১৭) কিন্তু শীঘ্রই তাদের বাধ্যতার পরীক্ষা হয়েছিল। শয়তান যখন তার মনভুলানো কথা নিয়ে কাছে এসেছিল তখন আদম, হবা যদি বাধ্য থাকতে চাইত, তাহলে তাদের যিহোবার প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়ার আর তাঁর প্রতিজ্ঞাগুলোর ওপর আস্থা রাখার দরকার ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে তাদের নিষ্ঠা ও আস্থার অভাব ছিল। শয়তান যখন হবাকে স্বাধীন হওয়ার লোভ দেখিয়েছিল ও যিহোবাকে মিথ্যাবাদী বলে দোষ দিয়েছিল তখন হবা তার কথা শোনে আর ঈশ্বরের অবাধ্য হয়। হবার সঙ্গে আদমও পাপের পথে চলে যায়। (আদিপুস্তক ৩:১-৬; ১ তীমথিয় ২:১৪) এর ফলে তাদের যে ক্ষতি হয়েছিল তার কোন হিসাব নেই। যিহোবার পথে চলে তারা যদি তাঁর ইচ্ছা পালন করে চলত, তাহলে তারা দিনে দিনে আরও সুখী হতো। কিন্তু এর বদলে তাদের জীবনে শুধু হতাশা ও দুঃখই অবশিষ্ট ছিল, যতদিন না মৃত্যু তাদেরকে তার কবলে নিয়ে নেয়।—আদিপুস্তক ৩:১৬-১৯; ৫:১-৫.
৫. ভবিষ্যতের জন্য যিহোবার উদ্দেশ্য কী আর এই পূর্ণতা দেখার জন্য তিনি বিশ্বস্ত মানুষদের কীভাবে সাহায্য করেন?
৫ কিন্তু তাই বলে, ঈশ্বর তাঁর সেই উদ্দেশ্য পাল্টাননি যে একসময় এই পৃথিবী সুন্দর বাগান হয়ে উঠবে যেখানে সিদ্ধ, নিষ্পাপ মানুষেরা বাস করবে। (গীতসংহিতা ৩৭:১১, ২৯) আর যারা তাঁর পথে চলেন ও সেই প্রতিজ্ঞার পূর্ণতা দেখার আশা রাখেন তাদেরকে নিখুঁত নির্দেশনা দিতে যিহোবা কখনই ভুলে যান না। আমরা যারা যিহোবার কথায় কান দিই, আমরা পিছন থেকে যিহোবার এই বাণী শুনতে পাই: “এই পথ, তোমরা এই পথেই চল।”—যিশাইয় ৩০:২১.
যিহোবার পথে চলেছিলেন এমন কিছু ব্যক্তিরা
৬. প্রাচীনকালের কোন্ দুজন ব্যক্তি যিহোবার পথে চলেছিলেন এবং এর ফল কী হয়েছিল?
৬ বাইবেলে লেখা ইতিহাস দেখায় যে আদম ও হবার সন্তানদের মধ্যে খুব অল্প কিছুজনই যিহোবার পথে চলেছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি ছিলেন হেবল। তিনি যদিও অকালে মারা গিয়েছিলেন, তবুও যিহোবা তার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন আর তাই ঈশ্বরের নিরূপিত সময়ে যখন “ধার্ম্মিক . . . লোকের . . . পুনরুত্থান” হবে তখন তিনিও তাদের মধ্যে একজন হবেন। (প্রেরিত ২৪:১৫) পৃথিবী ও মানবজাতির জন্য যিহোবার যে মহান উদ্দেশ্য আছে তা তিনি পূর্ণ হতে দেখবেন। (ইব্রীয় ১১:৪) যিহোবার পথে চলেছিলেন এমন আরেকজন ব্যক্তি ছিলেন হনোক, এই বিধিব্যবস্থার শেষ সম্পর্কে তিনি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা বাইবেলের যিহূদার বইয়ে লেখা আছে। (যিহূদা ১৪, ১৫) হনোকেরও অকাল মৃত্যু হয়েছিল। (আদিপুস্তক ৫:২১-২৪) তবুও “তাঁহার পক্ষে এই সাক্ষ্য দেওয়া হইয়াছিল যে, তিনি ঈশ্বরের প্রীতির পাত্র ছিলেন।” (ইব্রীয় ১১:৫) পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও, হেবলের মতো তারও পুনরুত্থানের দৃঢ় আশা ছিল আর তাই যারা যিহোবার উদ্দেশ্যগুলোকে পূর্ণ হতে দেখবেন তিনিও তাদের মধ্যে থাকবেন।
৭. নোহ ও তার পরিবার কীভাবে ঈশ্বরের প্রতি তাদের নিষ্ঠা দেখিয়েছিলেন ও তাঁর ওপর আস্থা রেখেছিলেন?
৭ জলপ্লাবনের আগে জগৎ যখন দুষ্টতার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল তখন যিহোবার প্রতি বাধ্য ও নিষ্ঠাবান থাকা দিনে দিনে আরও কঠিন পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই জগৎ ধ্বংস হওয়ার আগে শুধু একটা ছোট দল যিহোবার পথে চলছিল। নোহ ও তার পরিবার ঈশ্বরের কথা মন দিয়ে শুনেছিলেন আর তিনি যা বলেছিলেন তাতে আস্থা রেখেছিলেন। তাদের যে কাজ দেওয়া হয়েছিল তারা বিশ্বস্ততার সঙ্গে তা পালন করেছিলেন আর তারা সেই সময়ের জগতের সমস্ত মন্দ অভ্যাস থেকে দূরে থেকেছিলেন। (আদিপুস্তক ৬:৫-৭, ১৩-১৬; ইব্রীয় ১১:৭; ২ পিতর ২:৫) তারা নিষ্ঠা ও আস্থা রেখে যিহোবার বাধ্য হওয়ায় আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ হতে পারি। এই কারণে, তারা জলপ্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন আর আমরা তাদের থেকেই এসেছি।—আদিপুস্তক ৬:২২; ১ পিতর ৩:২০.
৮. ইস্রায়েল জাতিকে ঈশ্বরের পথে চলার জন্য কী কী করতে হয়েছিল?
৮ পরে, যিহোবা বিশ্বস্ত যাকোবের বংশধরদের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিলেন আর তারা তাঁর বিশেষ জাতি হয়ে উঠেছিল। (যাত্রাপুস্তক ১৯:৫, ৬) যিহোবা তাঁর চুক্তির লোকেদের জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন আর সেই নির্দেশনা তিনি লিখিত ব্যবস্থা, যাজক শ্রেণী ও একের পর এক ভাববাদীদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা এই নির্দেশনা মেনে চলবে কি না তা ইস্রায়েলীয়দের নিজেদের ঠিক করতে হয়েছিল। যিহোবা তাঁর ভাববাদীকে দিয়ে ইস্রায়েলীয়দের বলেছিলেন: “দেখ, অদ্য আমি তোমাদের সম্মুখে আশীর্ব্বাদ ও অভিশাপ রাখিলাম। অদ্য আমি তোমাদিগকে যে সকল আজ্ঞা জানাইলাম, তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর সেই সকল আজ্ঞাতে যদি কর্ণপাত কর, তবে আশীর্ব্বাদ পাইবে। আর যদি তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর আজ্ঞাতে কর্ণপাত না কর, এবং আমি অদ্য তোমাদিগকে যে পথের বিষয়ে আজ্ঞা করিলাম, যদি সেই পথ ছাড়িয়া তোমাদের অজ্ঞাত অন্য দেবগণের পশ্চাতে গমন কর, তবে অভিশাপগ্রস্ত হইবে।”—দ্বিতীয় বিবরণ ১১:২৬-২৮.
কিছু লোকেরা যে কারণে যিহোবার পথ ছেড়ে দিয়েছিল
৯, ১০. কোন্ অবস্থার জন্য ইস্রায়েলীয়দের যিহোবার প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা ও আস্থা রাখার দরকার ছিল?
৯ আদম ও হবার বেলায় যেমন হয়েছিল, তেমনই ইস্রায়েলীয়রা যদি যিহোবার প্রতি বাধ্য থাকতে চাইত, তাহলে তাদেরও তাঁর প্রতি নিষ্ঠাবান হতে ও তাঁর ওপর আস্থা রাখতে হতো। ইস্রায়েল একটা ছোট্ট জাতি ছিল আর তার আশেপাশের জাতিগুলো তাদের শত্রু ছিল। দক্ষিণপশ্চিম দিকে ছিল মিশর ও ইথিওপিয়া। উত্তরপূর্ব দিকে ছিল সিরিয়া ও অশূর। একেবারে কাছেই ছিল ফিলিস্টিয়া, অম্মোন, মোয়াব এবং ইদোম। আগে বা পরে এই সব জাতিগুলোই ইস্রায়েলের শত্রু হয়েছিল। এছাড়াও, এরা সবাই মিথ্যা ধর্ম পালন করত, তারা মূর্তিপূজা করত, জ্যোতিষ মানত আর তাদের মধ্যে জঘন্য যৌন আচার-অনুষ্ঠান ছিল, তারা ধর্মের নামে সন্তান বলি দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর কাজও করত। ইস্রায়েলের প্রতিবেশীরা তাদের বড় পরিবার, প্রচুর শস্য আর যুদ্ধে জয়ের জন্য তাদের ওই দেবতাদের ওপর আস্থা রাখত।
১০ একমাত্র ইস্রায়েল জাতিই এক সত্য ঈশ্বর যিহোবার উপাসনা করত। যিহোবা তাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে যদি তারা তাঁর নিয়ম মেনে চলে, তাহলে তিনি তাদের অনেক সন্তান, প্রচুর শস্য দিয়ে আশীর্বাদ করবেন আর তাদের শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। (দ্বিতীয় বিবরণ ২৮:১-১৪) কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে ইস্রায়েলের অনেকেই তা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর যারা যিহোবার পথে চলেছিলেন তাদের অনেকেই নিষ্ঠা বজায় রাখার জন্য কষ্ট ভোগ করেছিলেন। কারও কারও ওপর অত্যাচার করা হয়েছিল, টিটকারি দেওয়া হয়েছিল, চাবুক মারা হয়েছিল, জেলে দেওয়া হয়েছিল, পাথর মারা হয়েছিল আর তাদের নিজের জাতির লোকেরাই তাদের হত্যা করেছিল। (প্রেরিত ৭:৫১, ৫২; ইব্রীয় ১১:৩৫-৩৮) বিশ্বস্ত লোকেদের জন্য কত বড় পরীক্ষাই না তা ছিল! তবুও কেন অনেকে যিহোবার পথ থেকে সরে গিয়েছিল? ইস্রায়েলের ইতিহাস থেকে দুটো উদাহরণ আমাদেরকে তাদের ভুল চিন্তাধারার বিষয়ে বুঝতে সাহায্য করে।
আহসের মন্দতা
১১, ১২. (ক) সিরিয়া আহসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এলে তিনি কী করতে অস্বীকার করেছিলেন? (খ) সুরক্ষার জন্য আহস দুবার কাদের দিকে তাকিয়েছিলেন?
১১ আহস সা.কা.পূ. অষ্টম শতাব্দীতে যিহূদার দক্ষিণ রাজ্যের রাজা ছিলেন। তার রাজ্যে শান্তি ছিল না। একবার সিরিয়া ও ইস্রায়েলের উত্তর রাজ্য মিলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আর তাই “তাঁহার হৃদয় ও তাঁহার প্রজাদের হৃদয় আলোড়িত হইল।” (যিশাইয় ৭:১, ২) কিন্তু, যিহোবা যখন আহসকে সাহায্য করতে চান এবং তাঁকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য বলেন, আহস খুব জোরের সঙ্গে তা করতে অস্বীকার করেছিলেন! (যিশাইয় ৭:১০-১২) ফলে, যিহূদা যুদ্ধে হেরে যায় আর অনেক লোক মারা যায়।—২ বংশাবলি ২৮:১-৮.
১২ আহস যিহোবার পরীক্ষা নিতে বা তাঁর সাহায্য নিতে অস্বীকার করলেও, তিনি অশূর রাজের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে পিছপা হননি। তবুও যিহূদা প্রতিবেশী রাজ্যের হাতে কষ্ট পেতেই থাকে। অশূরীয়রাও যখন আহসের বিরুদ্ধে গিয়ে “তাঁহাকে ক্লেশ দিলেন” তখন রাজা “দম্মেশকের যে দেবগণ তাঁহাকে আঘাত করিয়াছিল, তিনি তাহাদের উদ্দেশে বলিদান করিলেন; আর কহিলেন, অরামীয় রাজাদের দেবগণই তাঁহাদের সাহায্য করেন, অতএব আমি তাঁহাদেরই উদ্দেশে বলিদান করিব, তাহাতে তাঁহারা আমারও সাহায্য করিবেন।”—২ বংশাবলি ২৮:২০, ২৩.
১৩. সিরিয়ার দেবতাদের ওপর নির্ভর করে আহস কী দেখিয়েছিলেন?
১৩ পরে যিহোবা ইস্রায়েলকে বলেছিলেন: “আমি সদাপ্রভু তোমার ঈশ্বর, আমি তোমার উপকারজনক শিক্ষা দান করি, ও তোমার গন্তব্য পথে তোমাকে গমন করাই। আহা! তুমি কেন আমার আজ্ঞাতে অবধান কর নাই? করিলে তোমার শান্তি নদীর ন্যায়, তোমার ধার্ম্মিকতা সমুদ্র-তরঙ্গের ন্যায় হইত।” (যিশাইয় ৪৮:১৭, ১৮) সিরিয়ার দেবতাদের ওপর নির্ভর করে আহস দেখিয়েছিলেন যে তিনি ‘তার গন্তব্য পথে গমন করা’ থেকে কত দূরে চলে গিয়েছিলেন। আশেপাশের জাতিগুলোর চিন্তাধারা তাকে পুরোপুরি ভ্রান্ত করে দিয়েছিল। আর সুরক্ষার জন্য তিনি যিহোবার দিকে না তাকিয়ে সেই লোকেদের দিকে তাকিয়েছিলেন, যারা তাকে সত্যিকারের সুরক্ষা দিতে পারবে না।
১৪. মিথ্যা দেবতাদের ওপর নির্ভর করার মতো কোন অজুহাত কেন আহসের ছিল না?
১৪ সিরিয়ার দেবতা ও সেইসঙ্গে জাতিগুলোর দেবতারা, অনেক আগেই ‘[অকর্মণ্য] প্রতিমা’ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। (যিশাইয় ২:৮) আগে রাজা দায়ূদের শাসনের সময়, যখন সিরিয়াবাসীরা দায়ূদের দাসে পরিণত হয়েছিল তখনই প্রমাণ হয়েছিল যে যিহোবা সিরিয়ার দেবতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও অনেক বেশি শক্তিশালী। (১ বংশাবলি ১৮:৫, ৬) একমাত্র যিহোবাই “ঈশ্বরগণের ঈশ্বর ও প্রভুদের প্রভু, তিনিই মহান্, বীর্য্যবান্ ও ভয়ঙ্কর ঈশ্বর,” যিনি প্রকৃত সুরক্ষা যোগাতে পারেন। (দ্বিতীয় বিবরণ ১০:১৭) তারপরও আহস যিহোবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন আর সুরক্ষার জন্য আশেপাশের জাতিগুলোর দেবতাদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। ফলে তা যিহূদা রাজ্যের জন্য ধ্বংস নিয়ে এসেছিল।—২ বংশাবলি ২৮:২৪, ২৫.
মিশরে যিরমিয়ের সঙ্গে যিহূদীরা
১৫. যিরমিয়ের দিনে মিশরের যিহূদীরা কীভাবে পাপ করেছিল?
১৫ যিহোবার লোকেদের অবিশ্বস্ততা যখন চরম সীমায় পৌঁছেছিল তখন সা.কা.পূ. ৬০৭ সালে যিহোবা বাবিলনীয়দেরকে যিরূশালেম ও তার মন্দির ধ্বংস করতে দিয়েছিলেন। সেই জাতির বেশিরভাগ লোককেই বন্দি করে বাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউ কেউ যিরূশালেমেই রয়ে যান যাদের মধ্যে যিরমিয় ছিলেন। শাসনকর্তা গদলিয়কে হত্যা করার পর এই দলটা মিশরে যায় আর যিরমিয়কেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। (২ রাজাবলি ২৫:২২-২৬; যিরমিয় ৪৩:৫-৭) সেখানে তারা মিথ্যা দেবদেবীদের কাছে হোমবলি উৎসর্গ করতে শুরু করে। যিরমিয় এই অবিশ্বস্ত যিহূদীদের অনেক বুঝিয়েছিলেন কিন্তু তারা একগুঁয়ে ছিল। তারা যিহোবার উপাসনা করতে অস্বীকার করেছিল আর একগুঁয়েভাবে বলেছিল যে তারা “আকাশরাণীর” কাছেই ধূপ জ্বালিয়ে যাবে। কেন? কারণ তারা ও তাদের পিতৃপুরুষেরা ‘যিহূদার নগরে নগরে ও যিরূশালেমের পথে পথে তাহাই করিত, আর তৎকালে তাহারা ভক্ষ্যদ্রব্যে তৃপ্ত হইত, এবং সুখে ছিল, কোন অমঙ্গল দেখিত না।’ (যিরমিয় ৪৪:১৬, ১৭) যিহূদীরা আরও বলেছিল: “যে অবধি আমরা আকাশরাণীর উদ্দেশে ধূপ জ্বালান ও পেয় নৈবেদ্য ঢালা ছাড়িয়া দিয়াছি, সে অবধি আমাদের সমস্ত বস্তুর অভাব হইতেছে, এবং আমরা খড়্গ ও দুর্ভিক্ষ দ্বারা বিনষ্ট হইতেছি।”—যিরমিয় ৪৪:১৮.
১৬. মিশরের যিহূদীদের চিন্তাধারা কেন একেবারেই ভুল ছিল?
১৬ মানুষ শুধু নিজের স্বার্থই দেখে! কিন্তু, সত্য কী ছিল? যিহোবা তাদেরকে যে দেশ দিয়েছিলেন সেখানে যিহূদীরা মিথ্যা দেবতাদের উদ্দেশে হোমবলি উৎসর্গ করেছিল। কখনও কখনও যখন তারা সত্য উপাসনা ছেড়ে মিথ্যা দেবতাদের মানতে শুরু করে তারা দুঃখকষ্ট ভোগ করেছিল যেমন আহসের সময়ে হয়েছিল। কিন্তু, যিহোবা তাঁর নিজস্ব লোকেদের বেলায় “ক্রোধে ধীর” ছিলেন। (যাত্রাপুস্তক ৩৪:৬; গীতসংহিতা ৮৬:১৫) তিনি তাঁর ভাববাদীদের পাঠিয়ে তাদের অনুতপ্ত হওয়ার জন্য বলেছিলেন। যখন রাজা যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন, যিহোবা তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন আর প্রজারাও ওই আশীর্বাদের উপকার পেয়েছিল যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই অবিশ্বস্ত ছিল। (২ বংশাবলি ২০:২৯-৩৩; ২৭:১-৬) মিশরের যিহূদীদের এই দাবি কত ভুলই না ছিল যে তাদের দেশে তারা যে সমৃদ্ধি উপভোগ করত তা মিথ্যা দেবতারা তাদের দিত!
১৭. যিহূদা কেন তার দেশ ও মন্দির হারিয়েছিল?
১৭ সাধারণ কাল পূর্ব ৬০৭ সালের আগে যিহোবা যিহূদার লোকেদের বলেছিলেন: “তোমরা আমার রবে কর্ণপাত কর, তাহাতে আমি তোমাদের ঈশ্বর হইব, ও তোমরা আমার প্রজা হইবে; আর আমি তোমাদিগকে যে পথে চলিবার আজ্ঞা দিই, সেই পথেই চলিও, যেন তোমাদের মঙ্গল হয়।” (যিরমিয় ৭:২৩) যিহূদীরা তাদের মন্দির ও দেশ শুধু এই কারণেই হারিয়েছিল যে ‘যিহোবা তাহাদিগকে যে পথে চলিবার আজ্ঞা দিয়াছিলেন তাহারা সেই পথে’ চলেনি। আমরা যেন কখনও এইরকম গুরুতর ভুল না করি।
যারা তাঁর পথে চলেন যিহোবা তাদের আশীর্বাদ করেন
১৮. যারা যিহোবার পথে চলেন তাদের কী করা উচিত?
১৮ অতীতের মতো আজকেও, যিহোবার পথে চলতে গেলে নিষ্ঠার দরকার অর্থাৎ এই সংকল্প নেওয়া যে আমরা শুধু যিহোবারই সেবা করব। এইজন্য আস্থার দরকার যার মানে হল পুরোপুরি বিশ্বাস করা যে যিহোবার প্রতিজ্ঞা কখনই বিফল হবে না আর তা পূর্ণ হবেই। যিহোবার পথে চলতে হলে বাধ্যতার দরকার মানে তাঁর নিয়মগুলোকে পুরোপুরিভাবে মেনে চলা ও জীবনে তাঁর উচ্চ নৈতিক মান বজায় রাখা। “সদাপ্রভু ধর্ম্মময়, ধর্ম্মকর্ম্মই ভালবাসেন।”—গীতসংহিতা ১১:৭.
১৯. আজকে অনেকে কোন্ দেবতার উপাসনা করেন আর এর ফল কী হয়?
১৯ আহস সুরক্ষার জন্য সিরিয়ার দেবতাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। মিশরের ইস্রায়েলীয়রা আশা করেছিল যে ‘আকাশরাণী,’ প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের অনেক লোকেরা যার উপাসনা করত, সেই তাদেরকে ধনদৌলত দেবে। আজকে দেবতা বলতে শুধু পাথরের তৈরি মূর্তিই বোঝায় না। যীশু যিহোবাকে বাদ দিয়ে ‘ধনের’ সেবা করার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। (মথি ৬:২৪) প্রেরিত পৌল বলেছিলেন, “লোভ, এ ত প্রতিমাপূজা।” (কলসীয় ৩:৫) তিনি আরও বলেছিলেন, “উদর তাহাদের ঈশ্বর।” (ফিলিপীয় ৩:১৯) হ্যাঁ, টাকাপয়সা ও ধনদৌলতই প্রধান দেবতা, যাদের উপাসনা করা হয়ে থাকে। আসলে, বেশিরভাগ লোকেরাই এমনকি ধার্মিক মনোভাবাপন্ন হলেও তারা ‘ধনের অস্থিরতার উপরে প্রত্যাশা রাখেন।’ (১ তীমথিয় ৬:১৭) অনেক লোকেরা এই দেবতাদের সেবা করার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করেন আর তারা তার ফলও পান—তারা সুন্দর সুন্দর বাড়িতে থাকেন, দামি দামি জিনিসপত্র ব্যবহার করেন আর ভাল ভাল খাবার খান। কিন্তু, সবাই এইরকম ঐশ্বর্য ভোগ করতে পান না। আর এমনকি অনেকে যারা অনেক চেষ্টার পর যদিও বা এগুলো পান, তারা এগুলোতে সুখী বা সন্তুষ্ট হন না। কারণ সেগুলো অনিশ্চিত, চিরকালের জন্য থাকে না আর আধ্যাত্মিক চাহিদাকে মেটায় না।—মথি ৫:৩.
২০. আমাদের কোন্ ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে?
২০ এটা ঠিক যে আমরা যেহেতু এই বিধিব্যবস্থার শেষ কালে বাস করছি তাই আমাদের আরও বেশি বাস্তববাদী হওয়া দরকার। আমাদের পরিবারের ভরণপোষণ করার জন্য আমাদের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু আমরা যদি ঈশ্বরকে সেবা করার চেয়ে বিলাসী জীবনযাপন করতে, টাকাপয়সার পিছনে ছুটতে কিংবা ওইরকম অন্য কিছুতে সময় কাটাই, তাহলে আমরা একরকমের প্রতিমাপূজায় জড়িয়ে পড়েছি এবং আমরা আর যিহোবার পথে চলছি না। (১ তীমথিয় ৬:৯, ১০) কিন্তু, আমরা যখন কোন অসুখে পড়ি, টাকাপয়সার অভাব ভোগ করি বা এইরকম কোন সমস্যার মধ্যে পড়ি তখন কী হবে? আমরা যেন মিশরের সেই যিহূদীদের মতো না হই যারা বলেছিল যে ঈশ্বরকে সেবা করার জন্যই তাদের এই সমস্যাগুলো ভোগ করতে হচ্ছে। এর বদলে, আসুন আমরা যিহোবার পরীক্ষা করি, যা আহস করতে পারেননি। নির্দেশনার জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে যিহোবা ঈশ্বরের কাছে যাই। তাঁর ওপর আস্থা রেখে তাঁর নির্দেশনা কাজে লাগাই আর প্রতিটা পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য তাঁর কাছে শক্তি ও বুদ্ধি চেয়ে প্রার্থনা করি। এরপর, পুরো বিশ্বাস নিয়ে যিহোবার আশীর্বাদের জন্য অপেক্ষা করি।
২১. যারা যিহোবার পথে চলেন তাদের জন্য কোন্ কোন্ আশীর্বাদ আসে?
২১ ইস্রায়েলের ইতিহাসে, যিহোবা তাদেরকে অনেক আশীর্বাদ করেছিলেন যারা তাঁর পথে চলেছিলেন। রাজা দায়ূদ গেয়েছিলেন: “হে সদাপ্রভু, আমার গুপ্ত শত্রুগণ হেতু তুমি আপন ধর্ম্মশীলতায় আমাকে চালাও।” (গীতসংহিতা ৫:৮) তাকে যিহোবা প্রতিবেশী জাতিগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী করেছিলেন কিন্তু এই জাতিগুলোই পরে আহসের ওপর অত্যাচার করেছিল। শলোমনের রাজত্বকালে শান্তি ও সমৃদ্ধি দিয়ে ইস্রায়েলকে আশীর্বাদ করা হয়েছিল যা পাওয়ার জন্য পরে মিশরের যিহূদীরা হা-হুতাশ করেছিল। আহসের পুত্র হিষ্কীয়কে যিহোবা শক্তিশালী অশূরীয় জাতির ওপর জয়ী করেছিলেন। (যিশাইয় ৫৯:১) হ্যাঁ, যিহোবার হাত তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত লোকেদের জন্য খাট ছিল না, যারা “পাপীদের পথে” দাঁড়াননি কিন্তু ঈশ্বরের ব্যবস্থায় আমোদ করেছিলেন। (গীতসংহিতা ১:১, ২) আজকেও এই একই বিষয় সত্যি। কিন্তু, আজকে আমরা কী করে জানতে পারব যে আমরা যিহোবার পথে চলছি? পরের প্রবন্ধে তা আলোচনা করা হবে।
আপনি কি মনে করতে পারেন?
◻ আমরা যদি যিহোবার পথে চলতে চাই, তাহলে আমাদের কোন্ গুণগুলো থাকা জরুরি?
◻ আহসের চিন্তাধারা কেন ভুল ছিল?
◻ মিশরের যিহূদীদের চিন্তাভাবনায় কী ভুল ছিল?
◻ যিহোবার পথে চলার জন্য আমাদের সংকল্পকে আমরা কী করে শক্তিশালী করতে পারি?
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
আহস যিহোবাকে বাদ দিয়ে সিরিয়ার দেবতাদের দিকে তাকিয়েছিলেন