গঠনমূলক কথাবার্তা—সুখী বিবাহের এক চাবি
১৭৭৮ সালে রবার্ট ব্যারন লিভার চালিত একটা তালা উদ্ভাবন করেন, যা একইসঙ্গে দুটো কাজ করে আর এর ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক দিনের তালা চাবি তৈরি করা হয়েছে। তিনি যেভাবে এই তালাটা তৈরি করেছিলেন তাতে একটা মাত্র চাবি দিয়ে তালার দুটো অংশই একসঙ্গে খোলা যেত।
একইভাবে, সফল বিবাহ স্বামী স্ত্রীর একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার ওপর নির্ভর করে। সুখী বিবাহের মহামূল্যবান আনন্দের ডালা খোলার ও তা পাওয়ার এক অতি দরকারি বিষয় হল গঠনমূলক কথাবার্তা বলা।
গঠনমূলক কথাবার্তা বলার মানে কী
গঠনমূলক কথাবার্তা বলার মানে কী? একটা অভিধান কথাবার্তা বলাকে এভাবে বর্ণনা করে, “চিন্তাভাবনা, মতামত বা তথ্য বলা, লেখা বা সংকেতের মাধ্যমে প্রকাশ বা আদানপ্রদান করা।” সুতরাং, কথাবার্তা বলার মানে আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তাভাবনা একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। তাছাড়া গঠনমূলক কথাবার্তা বলতে আমরা বুঝি যা কিছু গড়ে তোলে, সতেজ করে, যা ভদ্রসভ্য, প্রশংসাজনক এবং যা সান্ত্বনা দেয়।—ইফিষীয় ৪:২৯-৩২; ফিলিপীয় ৪:৮.
আস্থা, বিশ্বাস ও একে অন্যকে বোঝার মাধ্যমে গঠনমূলক কথাবার্তা বলা যায়। এই গুণগুলো তখনই দেখানো যায় যখন বিবাহকে সারা জীবনের সম্পর্ক বলে দেখা হয় আর এটাকে সফল করার জন্য অন্তর থেকে প্রতিজ্ঞা করা হয়। এই সম্পর্কের বিষয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন প্রবন্ধকার যোসেফ এডিসন লিখেছিলেন: “দুজন ব্যক্তি পরস্পরকে সান্ত্বনা ও আনন্দ দেওয়ার জন্য অন্য সব মানুষের মধ্যে থেকে একে অন্যকে বেছে নিয়েছেন আর তারা যেন এই প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়েছেন যে তারা আজীবন একে অন্যের ভালমন্দ নিয়ে হাশিখুশিতে ভরা জীবন কাটাবেন, সদয় হবেন, একে অন্যকে বুঝবেন, ক্ষমা করে দেবেন, ধৈর্য ধরবেন ও আনন্দে থাকবেন।” এইরকম পরিণয় কতই না সুখের! আর এই রত্নের মতো গুণগুলো আপনার বিবাহকে সাজিয়ে দিতে পারে কারণ এগুলো গঠনমূলক কথাবার্তা বলার মাধ্যমে আপনার নিজের হতে পারে।
গঠনমূলক কথাবার্তা বলার পথে বাধাগুলো
বেশিরভাগ দম্পতি এই আশা নিয়ে বিয়ে করেন যে তাদের জীবনে শুধুই আনন্দ আর সুখ থাকবে। কিন্তু অনেকের জীবন থেকেই সুখ খুব তাড়াতাড়ি বিদায় নেয় ও আশা হারিয়ে যায়। নিশ্চয়তার বদলে তাদের মধ্যে তিক্ত হতাশা, রাগ এসে বাসা বাঁধে, তারা একে অন্যকে সহ্য করতে পারেন না, এমনকি ঘৃণা পর্যন্ত করতে শুরু করেন। তখন বিয়ের হাল এমন হয়ে দাঁড়ায় যে “যতক্ষণ পর্যন্ত না মরণ আমাদের বিচ্ছিন্ন করে” ততক্ষণ পর্যন্ত কোনরকমে সয়ে যাওয়া। তাই সুখী বিবাহের জন্য অতি দরকারি জিনিস গঠনমূলক কথাবার্তা বলা যদি বাড়াতে হয় বা চালিয়ে যেতে হয়, তবে কিছু বাধা অবশ্যই পেরোতে হবে।
গঠনমূলক কথাবার্তা বলার পথে ভয় হল একটা বিরাট বাধা কারণ একজন হয়তো ভাবতে পারেন যে না জানি আমার এ কথাকে আমার সাথি কীভাবে নেবেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোন সাথি জানতে পারেন যে তার শরীরে এক মারাত্মক রোগ বাসা বাঁধছে তখন অন্যজন হয়তো তাকে দূরে ঠেলে দিতে পারে সেই ভয় মনে আসতে পারে। কিন্তু কীভাবে একজন তার সাথিকে বোঝাবেন যে রোগের কারণে তার চেহারা খারাপ হয়ে যাবে বা কাজ করার শক্তি কমে যাবে? এইসব ক্ষেত্রে, সৎভাবে বলা এবং আগামী দিনের জন্য ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা করা বিশেষভাবে জরুরি। কথায় ভালবাসা প্রকাশ করা আর সেইসঙ্গে কোমল ব্যবহার দেখায় যে স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের প্রতি আগ্রহ রয়েছে, যা সত্যিকারের সুখী বিবাহ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। বিবাহের জন্য এই নীতিবাক্যটা একেবারে ঠিক: “বন্ধু সর্ব্বসময়ে প্রেম করে, ভ্রাতা দুর্দ্দশার জন্য জন্মে।”—হিতোপদেশ ১৭:১৭.
বিরক্তি হল গঠনমূলক কথাবার্তা বলার পথে আরেকটা বাধা। এটা একেবারে ঠিক যে সুখী বিবাহ হল মন থেকে ক্ষমা করে দিতে পারেন এমন দুজন নরনারীর মিলন। এইরকম হওয়ার জন্য স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই পৌলের উপকারী পরামর্শ মেনে চলতে প্রাণপণ করা উচিত: “সূর্য্য অস্ত না যাইতে যাইতে তোমাদের কোপাবেশ শান্ত হউক।” (ইফিষীয় ৪:২৬) রাগ বা বিরক্তি মনে পুষে না রেখে বরং এই পরামর্শ কাজে লাগানোর জন্য নম্রভাবে কথাবার্তা বলা একান্ত দরকার। সুখী বিবাহে স্বামী স্ত্রী রাগ পুষে রাখেন না, সবসময় ঝগড়াঝাটি করেন না বা তারা প্রতিহিংসা পরায়ণ হন না। (হিতোপদেশ ৩০:৩৩) তারা ঈশ্বরকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেন, যিনি বিরক্তি পুষে রাখেন না। (যিরমিয় ৩:১২) তারা একে অন্যকে মন থেকে ক্ষমা করে দেন।—মথি ১৮:৩৫.
কথাবার্তা বলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল নীরব থাকা। এর মানে মনমরা হয়ে থাকা, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা, যন্ত্রের মতো কাজ করা এবং কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া। স্বামী বা স্ত্রী যখন এইরকম ব্যবহার করেন, তখন তারা তাদের অসন্তোষকেই প্রকাশ করেন। কিন্তু নিজের অনুভূতিকে খোলাখুলি ও মন জয় করার মতো করে বললে তা বিবাহে সুখ বাড়িয়ে তোলে, যা নীরব ও মনমরা থাকলে কখনই হয় না।
স্বামী বা স্ত্রী যখন কথা বলেন তখন মনোযোগ না দেওয়া বা একেবারেই না শোনা হল আরেকটা অন্তরায় যা ভালভাবে কথাবার্তা বলার জন্য পেরিয়ে আসতেই হবে। আমরা হয়তো এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ি বা ব্যস্ত থাকি যে দুদণ্ড বসে মন দিয়ে সাথির কথা শোনার ইচ্ছা বা শক্তি আমাদের একেবারেই থাকে না। আর এইজন্য কখনও কখনও ভুল বোঝাবুঝির কারণে ঝগড়া শুরু হয়ে যেতে পারে। একজন সাথি হয়তো ভাবতে পারেন যে তিনি কোন একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন কিন্তু অন্যজন হয়তো বলেন যে তিনি এ কথা এইমাত্রই শুনছেন। তাহলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে কম কথাবার্তা বলাই এইরকম সমস্যার জন্য দায়ী।
কীভাবে গঠনমূলক কথাবার্তা বলা বাড়ানো যায়
মধুর ও গঠনমূলক কথাবার্তা বলার জন্য সময় করে নেওয়া কতই না গুরুত্বপূর্ণ! কেউ কেউ টেলিভিশনে অন্যের জীবনযাত্রা দেখে এত বেশি সময় কাটান যে তাদের নিজেদের জীবনের জন্য খুব কম সময়ই তাদের হাতে থাকে। তাই গঠনমূলক কথাবার্তা শুরু করার জন্য টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়া একটা জরুরি পদক্ষেপ।
কথা বলার জন্য যেমন উপযুক্ত সময় আছে, তেমনই চুপ থাকারও নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছিলেন: “সকল বিষয়েরই সময় আছে, . . . নীরব থাকিবার কাল ও কথা কহিবার কাল।” সত্যি, বলার জন্য সুন্দর সুন্দর কথাও রয়েছে। তাই একটা প্রবাদ বলে, “যথাকালে কথিত বাক্য কেমন উত্তম।” (উপদেশক ৩:১, ৭; হিতোপদেশ ১৫:২৩) এইজন্য ঠিক করুন যে কখন আপনার দরকারি কথা বলার বা আপনার অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য সবচেয়ে ভাল সময়। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন: ‘আমার সাথি কি ক্লান্ত বা এখন কি সে হাশিখুশি আছে বা তার মেজাজ কি ভাল? যে বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই তা শুনলে কি সে রেগে যেতে পারে? আমি গতবার যখন এই বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম তখন সে আমার কোন্ কথায় আপত্তি করেছিল?’
এটা মনে রাখা ভাল যে লোকেরা তখনই সবচেয়ে বেশি সাড়া দেন যখন তারা বুঝতে পারেন যে কারও কথা শুনলে বা মেনে নিলে তা কীভাবে তাদের উপকারে আসবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি কোনরকম মনোমালিন্য হয়, তাহলে তাদের মধ্যে একজন হয়তো বলতে পারেন, “একটা বিষয় আমাকে খুবই কষ্ট দিচ্ছে, তাই আমরা এখনই সেটা মিটমাট করব!” কথা অবশ্যই পরিস্থিতি বুঝে বলতে হবে, তবে এভাবে বললে আরও ভাল হয়, যেমন “শোনো আমরা আগে যে বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছিলাম সেটা কীভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি।” কীভাবে বলাটা আপনার সাথি বেশি পছন্দ করবেন?
হ্যাঁ, একজন যেভাবে কথা বলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন: “তোমাদের বাক্য সর্ব্বদা অনুগ্রহ সহযুক্ত হউক, লবণে আস্বাদযুক্ত হউক।” (কলসীয় ৪:৬) মিষ্টিস্বরে এবং ঠিক শব্দ বেছে নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন যে “মনোহর বাক্য মৌচাকের ন্যায়; তাহা প্রাণের পক্ষে মধুর, অস্থির পক্ষে স্বাস্থ্যকর।”—হিতোপদেশ ১৬:২৪.
ঘরের কাজ একসঙ্গে করলে তা কিছু দম্পতিকে কথাবার্তা বলার এক সুন্দর সুযোগ করে দেয়। এইরকম সহযোগিতা মিলেমিশে কাজ করার মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে আর সেইসঙ্গে গঠনমূলক কথাবার্তা বলার সময়ও করে দিতে পারে। আবার কিছু দম্পতির জন্য কোন কাজ না করে চুপচাপ কিছুটা সময় একান্তে কাটালে ভাল হয় আর তা তাদেরকে প্রাণ খুলে গঠনমূলক কথাবার্তা বলতে সাহায্য করে।
সফল দম্পতিরা কীভাবে একে অন্যের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন তা দেখেও অনেক কিছু শেখা যায়। কীভাবে তারা এতখানি সফল হয়েছেন? খুব সম্ভবত তাদের মধ্যে মনের মিল ও খোলামেলা ভাব থাকায় তারা সহজে কথাবার্তা বলতে পারেন আর এর জন্য তাদের অনেক চেষ্টা করতে, ধৈর্য ধরতে এবং একে অন্যের প্রতি ভালবাসা ও বিবেচনা দেখাতে হয়েছে। স্পষ্টতই তাদের অনেক কিছু শিখতে হয়েছে কারণ সুখী বিবাহ আপনাআপনি গড়ে ওঠে না। অতএব আপনার সাথির চিন্তাধারা বোঝা, তার চাহিদাগুলোর দিকে নজর রাখা এবং উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিকে শান্ত করার জন্য বুদ্ধিপূর্বক কথা বলা কতটাই না জরুরি। (হিতোপদেশ ১৬:২৩) তাই আপনি যদি বিবাহিত হন, তাহলে হাশিখুশি থাকার ও সহজে ভুল স্বীকার করার চেষ্টা করুন। বিবাহিত জীবনে সুখী হওয়ার জন্য এটা আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করবে।
যিহোবা ঈশ্বর চান যে মানুষ সুখী ও দীর্ঘস্থায়ী বিবাহ উপভোগ করুক। (আদিপুস্তক ২:১৮, ২১) কিন্তু এর চাবি তাদের হাতে থাকে যারা এই বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। বিবাহ দুজন অনুরাগী নরনারীকে একত্র করে যারা গঠনমূলক কথাবার্তা বলতে শিখে এক সুখী বিবাহের দরজার তালা খোলার জন্য মিলেমিশে কাজ করেন।
[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]
টিভি বন্ধ করে দেওয়া কথাবার্তা বলার জন্য আরও সুযোগ করে দেয়
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
গঠনমূলক কথাবার্তা বলা অনন্ত প্রেমে দুটো মনকে বেঁধে রাখতে সাহায্য করে