রাগ দমন করুন পাছে আপনি বিঘ্ন পান
“শান্ত হও!” “দশ পর্যন্ত গোন!” “মাথা ঠান্ডা রাখো!” আপনি কী কখনও এই কথাগুলো শুনেছেন? রাগকে শান্ত করার জন্য আপনি নিজেও হয়তো কখনও মনে মনে এই কথাগুলো বলেছেন। কিছু লোকেরা রাগকে দমন করার জন্য হাঁটতে যান। এইরকম কিছু সাধারণ উপায় আছে যেগুলোকে লোকেরা তাদের রাগ সামলানোর জন্য এবং অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য করে থাকেন।
কিন্তু, রাগ সামলানো বা দমন করা উচিত কি না সেই বিষয়ে এখনকার পেশাদার পরামর্শদাতারা যে পরামর্শ দিয়েছেন তা একটার সঙ্গে আরেকটা মেলে না, যার ফলে অনেকে ধাঁধার মধ্যে পড়ে যান যে কোন্ পরামর্শটা সঠিক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন যে “রাগ করলে যদি আপনি স্বস্তি পান,” তাহলে রাগকে মনে পুষে না রেখে তা প্রকাশ করুন। আবার অন্যেরা বলেন, কথায় কথায় রাগ করলে তাতে “ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে কোলেস্টেরলের কারণে যতটা না মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে তার চেয়েও বেশি অকাল মৃত্যুর ভয় থাকে।” ঈশ্বরের বাক্য স্পষ্টভাবে বলে, “ক্রোধ হইতে নিবৃত্ত হও, কোপ ত্যাগ কর, রুষ্ট হইও না, হইলে কেবল দুষ্কার্য্য করিবে।” (গীতসংহিতা ৩৭:৮) বাইবেল কেন এতটা স্পষ্ট পরামর্শ দেয়?
অসংযত আবেগ আমাদের দিয়ে ধ্বংসাত্মক কাজ করায়। আর মানব ইতিহাসের একেবারে শুরুতেই এটাকে সত্যি হতে দেখা যায়। আমরা পড়ি “কয়িন অতিশয় ক্রুদ্ধ হইল, তাহার মুখ বিষণ্ণ হইল।” ফলে সে কী করেছিল? সে এতটাই রেগে গিয়েছিল যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল ও কোন কথা শুনতে রাজি ছিল না ফলে যিহোবা যখন তাকে ভাল কাজ করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন সে তাতে কান দেয়নি। আর এই রাগের কারণেই কয়িন গুরুতর পাপ করেছিল অর্থাৎ সে তার ভাইকে খুন করেছিল।—আদিপুস্তক ৪:৩-৮.
একইভাবে ইস্রায়েলের প্রথম রাজা শৌলও যখন দায়ূদের প্রশংসা শোনেন তখন তার রাগকে দমন করতে পারেননি। ‘স্ত্রীলোকেরা অভিনয়ক্রমে পরস্পর গান করিয়া বলিল, শৌল বধিলেন সহস্র সহস্র, আর দায়ূদ বধিলেন অযুত অযুত। তাহাতে শৌল অতিশয় ক্রুদ্ধ হইলেন, তিনি এই কথায় অসন্তুষ্ট হইলেন।’ শৌল এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে তিনি গোপনে অনেকবার দায়ূদকে মারার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি দায়ূদ যখন তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন তখনও শৌল শান্তি স্থাপন করতে এবং সন্ধি করতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি পুরোপুরিভাবে যিহোবার অনুগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।—১ শমূয়েল ১৮:৬-১১; ১৯:৯, ১০; ২৪:১-২১; হিতোপদেশ ৬:৩৪, ৩৫.
একইভাবে কেউ যখন অসংযত রাগ দেখায় তখন সে এমন কিছু বলে বা করে বসে যা শুধু অন্যদের কষ্টই দেয়। (হিতোপদেশ ২৯:২২) কয়িন এবং শৌল দুজনেরই রাগের কারণ ছিল ঈর্ষা এবং হিংসা। কিন্তু রাগ অন্যান্য কারণেও হতে পারে। যেমন ভিত্তিহীন পরচর্চা, অপমান, ভুলবোঝাবুঝি অথবা খারাপ ব্যবহারের কারণেও একজন রাগে ফেটে পড়তে পারেন।
কয়িন এবং শৌলের দুটো উদাহরণই দেখায় যে তাদের দুজনের একটা বিষয়ে দুর্বলতা ছিল। কয়িন উৎসর্গ করেছিল কিন্তু তাতে বিশ্বাসের অভাব ছিল। (ইব্রীয় ১১:৪) শৌল যিহোবার আদেশের প্রতি অবাধ্য হয়েছিলেন এবং পরে তার কাজের জন্য বিভিন্ন অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যে কারণে তিনি ঈশ্বরের অনুমোদন ও আত্মা দুটোই হারিয়েছিলেন। অতএব, এর থেকে এটা পরিষ্কার যে তারা দুজনেই যিহোবার সঙ্গে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরতে দিয়েছিল।
অন্যদিকে দায়ূদের মনোভাব একেবারেই অন্যরকম ছিল। শৌল তার সঙ্গে যেমন ব্যবহার করেছিলেন তাতে তার রাগ করার কথা ছিল কিন্তু দায়ূদ নিজেকে দমন করেছিলেন। কেন? তিনি বলেছিলেন: “আমার প্রভুর প্রতি, সদাপ্রভুর অভিষিক্ত ব্যক্তির প্রতি এমন কর্ম্ম করিতে, . . . আমাকে না দিউন।” ঈশ্বরের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টা দায়ূদের মনে ছিল এবং শৌলের সঙ্গে তার ব্যবহারে তা ফুটে উঠেছিল। তিনি নম্রভাবে বিষয়টা যিহোবার হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন।—১ শমূয়েল ২৪:৬, ১৫.
সত্যিই, অসংযত রাগের পরিণতি খুবই খারাপ হয়। পৌল সাবধান করে দিয়েছিলেন: “ক্রুদ্ধ হইলে পাপ করিও না।” (ইফিষীয় ৪:২৬) হতে পারে যে রাগ করার পিছনে যথার্থ কারণ আছে কিন্তু তা করার মধ্যে এক বিপদও রয়েছে আর তা হল রাগ করে আমরা নিজেরাই বিঘ্ন পেতে পারি। তাহলে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে রাগকে দমন করা সত্যিই খুব কঠিন ব্যাপার। কিন্তু কীভাবে আমরা তা করতে পারি?
সবচেয়ে প্রথম উপায় হল যিহোবার সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলা। তিনি আপনাকে তাঁর সঙ্গে মন খুলে কথা বলার আমন্ত্রণ জানান। আপনার চিন্তা এবং উদ্বেগের কথা তাকে বলুন এবং তাঁর কাছে বিনতি করুন যাতে তিনি আপনার মনকে শান্ত করেন। (হিতোপদেশ ১৪:৩০) মনে রাখবেন যে “ধার্মিকগণের প্রতি প্রভুর চক্ষু আছে; তাহাদের বিনতির প্রতি তাঁহার কর্ণ আছে।”—১ পিতর ৩:১২.
প্রার্থনা আপনার মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারে এবং আপনাকে সঠিক পথ দেখাতে পারে। কিন্তু কীভাবে? অন্যদের সঙ্গে আপনি কীভাবে ব্যবহার করেন তার ওপর এটা গভীর ছাপ ফেলতে পারে। মনে করে দেখুন যিহোবা আপনার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছিলেন। যেমন বাইবেল বলে যিহোবা “আমাদের প্রতি আমাদের পাপানুযায়ী ব্যবহার করেন নাই।” (গীতসংহিতা ১০৩:১০) ক্ষমা করার মনোভাব গড়ে তোলা জরুরি যেন আপনি ‘শয়তানকর্ত্তৃক প্রতারিত না হন।’ (২ করিন্থীয় ২:১০, ১১) এছাড়াও, প্রার্থনা পবিত্র আত্মার নির্দেশনা মেনে নিতে আপনার হৃদয়কে পরিচালিত করবে যা আপনার জীবনকে বদলে দিতে পারে। যিহোবা আনন্দের সঙ্গে আপনাকে ‘সমস্ত চিন্তার অতীত . . . শান্তি’ দেন যা আপনাকে খুব রেগে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে।—ফিলিপীয় ৪:৭.
এছাড়া ‘প্রভুর ইচ্ছা কি, তাহা বোঝার’ জন্য প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন শাস্ত্র পরীক্ষা করাও দরকার। (ইফিষীয় ৫:১৭; যাকোব ৩:১৭) রাগকে দমন করা যদি আপনার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে এই বিষয়ে যিহোবার মনোভাব জানার জন্য মনেপ্রাণে চেষ্টা করুন। আর এই বিষয়ে বাইবেলে যে পদগুলো রয়েছে তা বার বার পড়ুন।
প্রেরিত পৌল এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন “আইস, . . . সকলের প্রতি, বিশেষতঃ যাহারা বিশ্বাস-বাটীর পরিজন, তাহাদের প্রতি সৎকর্ম্ম করি।” (গালাতীয় ৬:১০) আপনার চিন্তা ও কাজের মাধ্যমে অন্যদের জন্য ভাল কিছু করার চেষ্টা করুন। এইরকম ভাল, উপকারজনক কাজ অন্যদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে ও তাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে সাহায্য করবে আর সেইসব ভুল বোঝাবুঝির শেষ নিয়ে আসবে যার কারণে আপনি সহজেই রেগে যান।
গীতরচক গেয়েছিলেন, “তোমার বচনে আমার পাদবিক্ষেপ স্থির রাখ, কোন অধর্ম্ম আমার উপরে কর্ত্তত্ব না করুক। যাহারা তোমার ব্যবস্থা ভালবাসে, তাহাদের পরম শান্তি, তাহাদের উছোট লাগে না।” (গীতসংহিতা ১১৯:১৩৩, ১৬৫) আপনার বেলায়ও এটা সত্যি হতে পারে।
[৯ পৃষ্ঠার বাক্স//চিত্র]
রাগ দমন করার পদক্ষেপগুলো
□ যিহোবার কাছে প্রার্থনা করুন।—গীতসংহিতা ১৪৫:১৮.
□ প্রতিদিন বাইবেল পড়ুন।—গীতসংহিতা ১১৯:১৩৩, ১৬৫.
□ ভাল কাজে ব্যস্ত থাকুন।—গালাতীয় ৬:৯, ১০.