জীবনকাহিনি
আমি যিহোবার উপর আস্থা রেখেছিলাম এবং তিনি আমাকে সুরক্ষা জুগিয়েছিলেন
আমি প্রায়ই লোকদের বলি, “আমি যিহোবার হাতের একটা সুটকেসের মতো!” আমি যাত্রা করার সময়ে আমার সুটকেস নিয়ে যাই। আমি যেখানেই যাই, আমার সুটকেসও সেখানে যায়। ঠিক একইভাবে, যিহোবা এবং তাঁর সংগঠন আমাকে যেখানে যেতে বলে, সেখানে যাওয়ার জন্য আমি সবসময় প্রস্তুত থাকি। অনেক বার আমাকে এমন জায়গায় যেতে হয়েছিল, যেখানে অনেক সমস্যা ও বিপদ ছিল। কিন্তু আমি দেখেছি যে, আমি যদি যিহোবার উপর আস্থা রাখি, তা হলে তিনি আমাকে সুরক্ষা জোগাবেন।
আমি যিহোবাকে জেনেছি এবং তাঁর উপর আস্থা রাখতে শিখেছি
আমি ১৯৪৮ সালে নাইজিরিয়ার একটা ছোটো গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। আমাদের গ্রামটা নাইজিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল। ঠিক সেইসময়ই আমার কাকা মুস্তাফা এবং পরে দাদা বহাবি বাপ্তিস্ম নিয়ে যিহোবার সাক্ষি হয়েছিল। আমার বয়স যখন নয় বছর ছিল, তখন আমার বাবা মারা যায়। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি একেবারে ভেঙে পড়ি। কিন্তু বহাবি আমাকে বলে যে, আমরা আবারও বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারব। তাই, আমি বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করি এবং ১৯৬৩ সালে বাপ্তিস্ম নিই। কিছুসময় পর আমার আরও তিন জন ভাই বাপ্তিস্ম নিয়েছিল।
১৯৬৫ সালে আমি আমার বড়দা উইল্সনের কাছে চলে যাই, যে লাগোসে থাকত। সেখানে আমি ইগবোবি মণ্ডলীর অগ্রগামীদের সঙ্গে অনেক ভালো সময় কাটাই। আমি দেখেছিলাম, তারা কত উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করে এবং কত খুশিতে থাকে। তাদের দেখে ১৯৬৮ সালে জানুয়ারি মাসে আমিও অগ্রগামী সেবা শুরু করি।
কিছুসময় পর ভাই অ্যালবার্ট অলুগবেবি, যিনি বেথেলে সেবা করতেন, তিনি আমাদের মতো যুবকদের জন্য এক বিশেষ সভা রেখেছিলেন। সেই সভাতে তিনি বলেছিলেন, উত্তর নাইজিরিয়াতে বিশেষ অগ্রগামীদের অনেক প্রয়োজন রয়েছে। আমার এখনও মনে আছে, সেই সভায় তিনি আমাদের কতটা উৎসাহিত করেছিলেন! তিনি বলেছিলেন, “কাজ অনেক রয়েছে, শস্য পেকে গিয়েছে।” তিনি আরও বলেছিলেন, “তোমরা এখন যুবক, তাই তোমরা তোমাদের সময় ও শক্তি যিহোবার সেবায় ব্যবহার করতে পারো।” আমি যিশাইয়ের মতো উদ্যোগ দেখাতে চেয়েছিলাম, তাই আমি বিশেষ অগ্রগামীর জন্য আবেদন জানিয়েছিলাম।—যিশা. ৬:৮.
১৯৬৮ সালে মে মাসে কানো শহরে আমাকে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে বলা হয়। এই শহরটা উত্তর নাইজিরিয়াতে ছিল। সেই সময়ে নাইজিরিয়াতে যুদ্ধ চলছিল এবং কানো শহরের আশেপাশের এলাকাতেও সেটার প্রভাব পড়েছিল (এই যুদ্ধ ১৯৬৭-১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলেছিল)। সেখানকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। একজন ভাই আমার জন্য অনেক চিন্তা করতেন। তাই, তিনি সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাকে আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমি তাকে বলি, “ধন্যবাদ ভাই, আপনি আমার জন্য অনেক চিন্তা করেন। কিন্তু যিহোবা যদি চান, আমি সেখানে গিয়ে সেবা করি, তা হলে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে, যিহোবা আমাকে সুরক্ষা জোগাবেন।”
যুদ্ধে বিদ্ধস্ত এলাকাতে যিহোবার উপর আস্থা
আমরা যখন কানোতে পৌঁছাই, তখন সেখানকার পরিস্থিতি দেখে ভয়ে আমাদের গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। শহরের অনেক এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। আমরা যখন সেখানে প্রচার করতাম, তখন প্রায়ই যুদ্ধে মারা গিয়েছে এমন লোকদের মৃতদেহ দেখতে পেতাম। কানো শহরে অনেক মণ্ডলী ছিল। কিন্তু, যুদ্ধের কারণে অনেক ভাই-বোন সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র ১৫ জন প্রকাশকই সেখানে রয়ে গিয়েছিল এবং তারাও ভয়ে আতঙ্কিত ছিল। যখন আমরা ছয় জন বিশেষ অগ্রগামী সেখানে পৌঁছাই, তখন সেখানকার ভাই-বোনেরা কতটা খুশি হয়েছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমরা সেই প্রকাশকদের অনেক উৎসাহিত করি আর সেটা তাদের খুব ভালো লাগে। আমরা পুনরায় সভা ও প্রচার কাজ শুরু করার জন্য তাদের সাহায্য করি। বেশ কিছু সময় ধরে প্রচারের রিপোর্ট শাখা অফিসে পাঠানো হচ্ছিল না। আমরা আবারও রিপোর্ট পাঠানোর ব্যবস্থা করি এবং প্রকাশনাও অর্ডার করি।
আমরা যারা বিশেষ অগ্রগামী ছিলাম, তারা সবাই কোসা ভাষা শিখতে শুরু করি। সেই এলাকার লোকেরা যখন নিজের ভাষায় সুসমাচার শুনেছিল, তখন তারা আরও বেশি করে এর প্রতি মনোযোগ দিয়েছিল। কানো শহরে যে-ধর্মের প্রভাব ছিল, সেটার লোকেরা আমাদের কাজকে পছন্দ করত না। তাই, আমরা সতর্কতার সঙ্গে প্রচার করতাম। একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। যখন আমি একজন ভাইয়ের সঙ্গে প্রচার করছিলাম, তখন এক ব্যক্তি ছুরি নিয়ে আমাদের তাড়া করতে শুরু করে। আমরা দৌড়ে পালাই। এটা ভালো যে, সে আমাদের ধরতে পারেনি আর আমরা বেঁচে যাই। বিপদ তো অনেক ছিল, কিন্তু যিহোবা আমাদের সুরক্ষিত রেখেছিলেন। আর প্রকাশকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। (গীত. ৪:৮) বর্তমানে, কানো শহরে ১১টা মণ্ডলীতে ৫০০রও বেশি প্রকাশক রয়েছে।
নাইজরে বিরোধিতা
নাইজরের নিয়ামে শহরে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে কাজ
কানোতে থাকতে শুরু করার কিছু মাস পর, ১৯৬৮ সালে আগস্ট মাসেই আমাকে এবং দু-জন বিশেষ অগ্রগামীকে নাইজর দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নাইজর দেশটা আফ্রিকাতেই অবস্থিত। আমাদের নাইজরের রাজধানী নিয়ামেতে সেবা করতে বলা হয়। এখানে অনেক গরম পড়ে এবং এটা পৃথিবীর সবচেয়ে গরম এলাকাগুলোর মধ্যে একটা। সেখানকার লোকেরা ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে, যেটা আমরা সবে শিখছিলাম। এক তো সেখানে অনেক গরম পড়ে, তার উপর আমরা সেখানকার ভাষাও জানতাম না। এই সমস্যাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করা অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু, আমরা যিহোবার উপর আস্থা রেখেছিলাম এবং নিয়ামেতে যে-অল্প কয়েক জন প্রকাশক ছিল, তাদের সঙ্গে প্রচার করতে শুরু করেছিলাম। সেইসময় আমরা বাইবেল অধ্যয়নের জন্য যে সত্য অনন্ত জীবনে লইয়া যায় বই ব্যবহার করতাম। ভাই-বোনেরা এত উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করেছিল যে, দেখতে দেখতে নিয়ামেতে পড়াশোনা জানে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে এই বই পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকী এই বই নেওয়ার জন্য অনেক দূর দূর থেকে লোকেরা আমাদের কাছে আসত!
১৯৬৯ সালে জুলাই মাসে নাইজরে প্রথম বার সীমা সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রায় ২০ জন লোক সেখানে এসেছিল এবং আমরা খুব খুশি ছিলাম কারণ দু-জন প্রকাশক বাপ্তিস্ম নিতে চলেছিল। কিন্তু, দ্রুত আমরা বুঝতে পারি যে, সরকার আমাদের কাজের প্রতি খুশি নয়। সম্মেলনের প্রথম দিনই পুলিশ চলে আসে। তারপর পুলিশ বিশেষ অগ্রগামীদের এবং সীমা অধ্যক্ষকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। তারা আমাদের অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে এবং পরের দিন আবার থানায় আসতে বলে। আমরা আর বিপদ বাড়াতে চাইনি। তাই, বাপ্তিস্মের বক্তৃতা একজন ভাইয়ের বাড়িতে দেওয়া হয়েছিল এবং সেই প্রকাশকদের একটা নদীতে লুকিয়ে লুকিয়ে বাপ্তিস্ম দেওয়া হয়েছিল।
কিছু সপ্তাহ পর, সরকার আমাকে এবং পাঁচ জন বিশেষ অগ্রগামীকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেয়। তারা আমাদের বলে, আমাদের কাছে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময় রয়েছে, তার মধ্যেই দেশ ছাড়তে হবে আর সমস্ত ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। সেখান থেকে আমরা সোজা নাইজিরিয়ার শাখা অফিসে যাই এবং তারা আমাদের বলে, এখন আমাদের কোথায় যেতে হবে।
তারা আমাকে নাইজিরিয়ার একটা ছোটো গ্রাম ওরিসিনবারিতে গিয়ে সেবা করতে বলে। সেখানে অনেক কম ভাই-বোন ছিল। কিন্তু, তাদের সঙ্গে প্রচার করে এবং বাইবেল অধ্যয়ন করিয়ে আমি খুব আনন্দিত হই। কিন্তু, মাত্র ছ-মাস পরেই শাখা অফিস আমাকে আবার নাইজর যেতে বলে। এটা শুনে আমি ঘাবড়ে যাই এবং কিছুটা ভয়ও পাই। কিন্তু আমি খুশিও ছিলাম যে, আবারও নাইজরের ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করতে পারব!
আমি আবারও নাইজরের নিয়ামে শহরে চলে আসি। নাইজরে পৌঁছানোর এক দিন পর আমার নাইজিরিয়ার একজন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়, যার নিজের ব্যাবসা ছিল। তিনি আমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন, আমি যিহোবার সাক্ষি। তিনি বাইবেল সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। আমি তাকে বাইবেল অধ্যয়ন করাতে শুরু করি এবং তিনি নিজের জীবনে অনেক পরিবর্তন করেন। তিনি সিগারেট খাওয়া এবং অতিরিক্ত মদ খাওয়া ছেড়ে দেন এবং কিছুসময় পর তিনি বাপ্তিস্ম নেন। আমি নাইজরের বিভিন্ন এলাকাতে অনেক ভাই-বোনের সঙ্গে প্রচার করেছিলাম। আমি দেখতে পেরেছিলাম, সেখানকার ভাই-বোনদের সংখ্যা কীভাবে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথম বার আমি যখন নাইজরে এসেছিলাম, তখন এখানে মাত্র ৩১ জন যিহোবার সাক্ষি ছিল। কিন্তু, আমাকে যখন সেখান থেকে চলে যেতে বলা হয়, তখন পর্যন্ত ভাই-বোনদের সংখ্যা বেড়ে ৬৯ হয়ে গিয়েছিল।
“গিনিতে হওয়া কাজ সম্বন্ধে আমি বেশি কিছু জানি না”
১৯৭৭ সালে ডিসেম্বর মাসে একটা ট্রেনিং-এর জন্য আমাকে আবারও নাইজিরিয়াতে ডাকা হয়। এই ট্রেনিং প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলেছিল। এরপর শাখা অফিসের কোঅর্ডিনেটর মেলকম ভিগো আমাকে একটা চিঠি দেন আর আমাকে সেটা পড়তে বলেন। এই চিঠিটা সিয়েরা লিয়োন শাখা অফিস থেকে এসেছিল। এই চিঠিতে লেখা ছিল, গিনি দেশে একজন সীমা অধ্যক্ষের প্রয়োজন রয়েছে। তাদের এমন একজন ভাইয়ের প্রয়োজন ছিল, যিনি অবিবাহিত হবেন এবং যিনি ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষা জানবেন। ভাই মেলকম আমাকে বলেন যে, আমাকে এই কার্যভারের জন্যই ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। তিনি আমাকে বলেন, “এটা অনেক বড়ো দায়িত্ব, তাই আমি যেন চিন্তাভাবনা করে উত্তর দিই।” কিন্তু আমি সঙ্গেসঙ্গে তাকে বলি, “যিহোবাই আমাকে পাঠাচ্ছেন, তাই আমি যাবই।”
আমি প্লেনে করে সিয়েরা লিয়োনে পৌঁছাই এবং সেখানে শাখা অফিসের ভাইদের সঙ্গে দেখা করি। গিনিতে যে-প্রচার কাজ হচ্ছিল, সেটা সিয়েরা লিয়োন শাখা অফিস দেখাশোনা করছিল। কিন্তু, শাখা অফিসের একজন ভাই আমাকে বলেন, আমরা গিনিতে হওয়া প্রচার কাজ সম্বন্ধে বেশি কিছু জানি না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ভাইয়েরা সেখানকার প্রকাশকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না। শাখা অফিস সেখানে কাউকে পাঠানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি। তাই ভাইয়েরা আমাকে বলে, আমি যেন গিনির রাজধানী কোনাক্রি যাই এবং চেষ্টা করি যেন সরকার আমাকে সেখানে থাকার অনুমতি দেয়।
“যিহোবাই আমাকে পাঠাচ্ছেন, তাই আমি যাবই।”
আমি যখন কোনাক্রিতে পৌঁছাই, আমি সেখানকার নাইজিরিয়া দূতাবাসে (এম্ব্যাসি) যাই এবং সেখানকার এক বড়ো অফিসারের সঙ্গে দেখা করি। আমি তাকে বলি, আমি গিনিতে প্রচার কাজ করতে চাই। তখন তিনি আমাকে বলেন, “নাইজিরিয়া ফিরে যাও এবং সেখানে গিয়ে প্রচার করো।” তিনি এও বলেন, আমি যদি এরকম না করি, তা হলে আমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে অথবা তার চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারে। কিন্তু আমি তাকে বলি, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমি গিনিতেই প্রচার করতে চাই। তাই, তিনি গিনির একজন মন্ত্রীকে চিঠি পাঠান এবং তাকে বলেন তিনি যেন আমাকে সাহায্য করে। যখন আমি সেই মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি তখন তিনি আমার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলেন এবং আমাকে সাহায্য করেন।
যিহোবার আশীর্বাদে সমস্ত কিছু ভালোভাবে হয়। আমি গিননিতে থাকার অনুমতি পেয়ে যাই। আমি সিয়েরা লিয়োনের শাখা অফিসে ফিরে আসি এবং ভাইদের এই বিষয়টা জানাই। যখন তারা এটা শুনেছিল, তখন তাদের খুশি দেখার মতো ছিল।
সিয়েরা লিয়োনে সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ
১৯৭৮ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আমি গিনি এবং সিয়েরা লিয়োনে সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করি আর সেই সঙ্গে লাইবেরিয়াতে বিকল্প সীমা অধ্যক্ষ হিসেবেও কাজ করি। প্রথম প্রথম আমি বেশ কয়েক বার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কখনো কখনো আমি এমন এলাকাতে থাকতাম, যেখানে কোন হাসপাতালে ছিল না। তা সত্ত্বেও, ভাই-বোনেরা প্রচেষ্টা করত যেন আমার চিকিৎসা হয়।
একবার, আমি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার ম্যালেরিয়া হয় এবং আমার পেটে কৃমি ভরে যায়। যখন আমি সুস্থ হয়ে যাই, তখন আমি জানতে পারি, ভাই-বোনেরা মনে করেছিল যে, আমি আর বাঁচব না। আর তাই তারা এমনকী এটাও চিন্তা করছিল, আমাকে কোথায় কবর দেওয়া হবে। আমার জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট এসেছে কিন্তু কখনো একরকম মনে হয়নি যে, আমি সব কিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাই। আমার পুরোপুরি আস্থা আছে যে, যিহোবা আমাকে সুরক্ষিত রাখবেন। আর যদি আমার কিছু হয়েও যায়, যিহোবা আমাকে পুনরুত্থিত করবেন।
বিয়ের পরও যিহোবার উপর আস্থা
১৯৮৮ সালে আমাদের বিয়ের দিন
১৯৮৮ সালে দরকাসের সঙ্গে আমার দেখা হয়। ও একজন অগ্রগামী ছিল এবং যিহোবাকে খুবই ভালোবাসতেন। ও অনেক নম্রও ছিল। কিছুদিন পর আমরা বিয়ে করি এবং দু-জনে একসঙ্গে সীমার কাজ শুরু করি। অনেক বার এক মণ্ডলী থেকে অন্য মণ্ডলী আমাদের পায়ে হেঁটে যাত্রা করতে হত। রাস্তায় কাদা থাকত এবং বড়ো বড়ো গর্ত থাকত। আমরা প্রায় ২৫ কিলোমিটার নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে পায়ে হেঁটে যাত্রা করতাম। কিছু মণ্ডলী অনেক দূরে ছিল। সেখানে যাওয়ার জন্য আমাদের ধীরে ধীরে যায় এমন পরিবহন ব্যবহার করতে হত। এই সময়ে দরকাস আমাকে অনেক সমর্থন জুগিয়েছিল। সে অনেক পরিশ্রম করেছিল এবং যিহোবার সেবার জন্য যেকোনো ত্যাগস্বীকার করতে রাজি ছিল।
ও অনেক সাহসীও ছিল। অনেকসময় আমাদের এমন নদীগুলো পার হতে হত, যেগুলোতে কুমির ছিল। একটা ঘটনা সম্বন্ধে বলি। একবার আমরা এক জায়গায় যাচ্ছিলাম, যেখানে যেতে আমাদের প্রায় পাঁচ দিন সময় লাগত। রাস্তায় আমাদের একটা নদীও পার করতে হত। সেই নদীটা পার করার জন্য যে-ব্রিজ ছিল, সেটা ভাঙা ছিল আর তাই ছোটো ছোটো নৌকা করে আমাদের নদী পার হতে হয়েছিল। কিন্তু নৌকা থেকে নামার সময় দরকাস নদীতে পড়ে যায়। সেখানে জল অনেক গভীর ছিল আর আমরা দু-জনেই সাঁতার জানতাম না। তার উপর সেই নদীতে কুমির ছিল। কিন্তু ভালো যে, সেখানে আশেপাশেই কয়েকজন ছেলে ছিল। তারা সঙ্গেসঙ্গে সেই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওকে উদ্ধার করে। অনেক দিন পর্যন্ত আমরা এই ভয়ানক ঘটনার স্বপ্ন দেখতে থাকি। কিন্তু, এই সমস্যা আমাদের আটকাতে পারেনি।
যাগিফ্ট ও এরিক আমাদের দু-জন সন্তান যিহোবার কাছ থেকে এক উপহার
১৯৯২ সালে আমি জানতে পারি দরকাস মা হতে চলেছে। আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আমরা চিন্তা করতে থাকি, এখন আমাদের পূর্ণ সময়ের সেবার কী হবে। কিন্তু পরে আমরা চিন্তা করি, এটা যিহোবার তরফ থেকে পাওয়া একটা উপহার। তাই, আমরা আমাদের মেয়ের নাম রাখি যাগিফ্ট। ইংরেজিতে যাগিফ্ট নামের অর্থ হল যিহোবার কাছ থেকে পাওয়া উপহার। তার চার বছর পর আমাদের একটা ছেলেও হয় আর আমরা তার নাম রাখি এরিক। যাগিফ্ট কিছুসময় ধরে কোনাক্রি রিমোট ট্রানস্লেশন অফিসে কাজ করেছিল আর এরিক এখন একজন পরিচারক দাস।
সত্যিই, আমাদের সন্তানেরা আমাদের কাছে অনেক বড়ো উপহার ছিল। দরকাসকে কিছুসময়ের জন্য বিশেষ অগ্রগামী সেবা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। কিন্তু, বাচ্চাদের মানুষ করে তোলার সময়েও ও অগ্রগামীর সেবা চালিয়ে গিয়েছিল। যিহোবার সাহায্যে আমি বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম। আর যখন বাচ্চারা বড়ো হয়ে গিয়েছিল, দরকাস আবারও বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করেছিল। বর্তমানে আমরা কোনাক্রি মিশনারি হিসেবে সেবা করছি।
সুরক্ষা একমাত্র যিহোবারই হাতে
যিহোবা আমাকে যেখানেই নিয়ে গিয়েছেন, আমি সবসময় তার সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছি। আমি এবং দরকাস এইরকমটা অনুভব করেছিলাম যে, যিহোবা আমাদের সুরক্ষা জোগাচ্ছেন। আর তিনি আমাদের আশীর্বাদ করা কখনো বন্ধ করেননি। জগতের লোকেরা শুধুমাত্র টাকাপয়সা উপর নির্ভর করে, কিন্তু তারপরও তাদের জীবনে বিভিন্ন চিন্তা এবং সমস্যা রয়েছে। কিন্তু, আমি আর দরকাস আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একমাত্র আমাদের “রক্ষাকারী ঈশ্বর” যিহোবাই আমাদের সুরক্ষা জোগাতে পারেন। (১ বংশা. ১৬:৩৫, NW) আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত যে, যারা যিহোবার ওপর আস্থা রাখে, তিনি তাদের “ঠিক সেভাবেই সুরক্ষিত রাখবেন, যেভাবে কেউ তার মূল্যবান জিনিস থলির মধ্যে বেঁধে সেটাকে সুরক্ষিত রাখে।”—১ শমূ. ২৫:২৯, NW.