জীবনকাহিনি
মহান নির্দেশকের কাছ থেকে আমরা অনেক মূল্যবান শিক্ষা পেয়েছি
জায়গায় জায়গায় অবরোধ, সৈন্যদের হাতে হাতিয়ার, জ্বলন্ত ব্যারিকেড, ঘূর্ণিঝড়, গৃহযুদ্ধ এবং বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া। আমি ও আমার স্ত্রী অগ্রগামী সেবা এবং মিশনারি সেবা করার সময় এমনই কিছু ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। এরপরও আমরা যে-জীবন কাটিয়েছি, তাতে আমাদের কোনো আপশোস নেই। এমন পরিস্থিতির মধ্যে যিহোবা আমাদের ধরে রেখেছিলেন এবং আমাদের প্রচুর আশীর্বাদ করেছিলেন। তিনি হলেন আমাদের মহান নির্দেশক, তাই তিনি আমাদের অনেক চমৎকার বিষয়ও শিখিয়েছেন।—ইয়োব ৩৬:২২; যিশা. ৩০:২০.
বাবা-মায়ের উত্তম উদাহরণ
১৯৫৭ সালে বাবা-মা ইতালি থেকে কানাডায় চলে যান এবং সেখানে সাসকেচুয়ান প্রদেশের কিন্ডারলি শহরে গিয়ে থাকতে শুরু করেন। কিছু সময় পর, তারা বাইবেল থেকে সত্য শেখেন এবং তারা এই সত্যকে তাদের জীবনে প্রথম স্থান দিতে শুরু করেন। আমার মনে আছে, ছোটোবেলায় আমি আমার পরিবারের সঙ্গে সারাদিন ধরে প্রচার করতাম। তাই, অনেকবার আমি মজা করে বলতাম, আমি তো আট বছর বয়সেই “সহায়ক অগ্রগামী” হিসেবে সেবা করতে শুরু করেছি!
প্রায় ১৯৬৬ সালে নিজের পরিবারের সঙ্গে
আমার বাবা-মায়ের কাছে বেশি টাকাপয়সা ছিল না। তা সত্ত্বেও, তারা যিহোবার জন্য বিভিন্ন ত্যাগস্বীকার করেছিলেন এবং আমাদের জন্য এক উত্তম উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। যেমন, ১৯৬৩ সালে তারা নিজেদের অনেক জিনিসপত্র বিক্রি করে দিয়েছিলেন যেন তারা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাওয়ার জন্য টাকা জোগাড় করতে পারেন। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনা শহরে এই সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে আমরা প্রায় ১০০০ কিলোমিটার দূরে ট্রেল শহরে চলে যাই যেন সেখানে ইতালিভাষী লোকদের সুসমাচার জানাতে পারি। এই শহরটা কানাডার অন্য এক প্রান্তের ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে রয়েছে। আমার বাবা একটা বড়ো দোকানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতেন। তিনি যখন আরও বেশি টাকা উপার্জন করার সুযোগ পেয়েছিলেন, তখন তিনি সেটা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যেন তিনি যিহোবার সেবার উপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন।
বাবা-মা আমার জন্য এবং আমার তিন ভাই-বোনের জন্য খুবই ভালো উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। এর জন্য আমি তাদের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। যিহোবার সেবা করার বিষয়ে আমি সবচেয়ে প্রথমে তাদের কাছ থেকেই শিখেছি। আমি তাদের কাছ থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও শিখেছি, যেটা আমার আজও মনে আছে: আমি যদি ঈশ্বরের রাজ্যকে প্রথম স্থান দিই, তা হলে যিহোবা আমাকে ধরে রাখবেন।—মথি ৬:৩৩.
পূর্ণসময়ের সেবায় প্রথম পদক্ষেপ
১৯৮০ সালে আমি এক সুন্দরী বোন ডেবিকে বিয়ে করি, যে সম্পূর্ণ হৃদয় দিয়ে যিহোবার সেবা করছিল। আমরা দু-জনেই পূর্ণসময়ের সেবা করতে চেয়েছিলাম। তাই, বিয়ের তিন মাস পরই ডেবি অগ্রগামী সেবা করতে শুরু করে। বিয়ের এক বছর পর আমরা একটা ছোটো মণ্ডলীতে গিয়ে সেবা করতে শুরু করি, যেখানে বেশি প্রয়োজন ছিল আর আমিও অগ্রগামী সেবা শুরু করি।
১৯৮০ সালে আমাদের বিয়ের দিনে
কিন্তু, কিছুসময় পর আমরা খুবই নিরুৎসাহিত হয়ে যাই এবং ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করি। কিন্তু, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমরা আমাদের সীমা অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলি। তিনি সরাসরি কিন্তু প্রেমের সঙ্গে আমাদের বুঝিয়েছিলেন যে, “তোমরা শুধুমাত্র নিজেদের সমস্যাগুলোর উপর মনোযোগ দিয়ে নিজেদের পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলছ। তোমরা যদি একটু থেমে চিন্তা কর, তা হলে তোমরা অনেক ভালো বিষয় খুঁজে পাবে।” সেইসময়ে আমাদের এই পরামর্শের প্রয়োজন ছিল। (গীত. ১৪১:৫) আমরা দ্রুত এই পরামর্শ কাজে লাগাই এবং দেখতে পাই যে, এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলোর উপরে মনোযোগ দিলে আমরা আনন্দে থাকতে পারি। যেমন, সেই ছোটো মণ্ডলীতে অনেক অল্পবয়সি এবং এমন কিছু বোন ছিল, যারা উদ্যোগের সঙ্গে যিহোবার উপাসনা করতে চেয়েছিল, যদিও তাদের স্বামীরা যিহোবার সেবা করত না। সীমা অধ্যক্ষের সেই পরামর্শ থেকে আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখি: আমাদের ভালো বিষয়গুলোর উপর মনোযোগ দেওয়া উচিত এবং যিহোবার উপর আস্থা রাখা উচিত যে, তিনি সঠিক সময়ে সমস্ত কিছু ঠিক করে দেবেন। (মীখা ৭:৭) এরপর আমরা আবার আনন্দের সঙ্গে যিহোবার সেবা করতে থাকি।
আমাদের প্রথম অগ্রগামী স্কুলের শিক্ষকেরা অন্যান্য দেশে গিয়ে সেবা করেছিল। তারা আমাদের সেখানকার ছবি দেখিয়েছিল এবং সেবা করার সময় তারা কোন সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিল আর কোন আশীর্বাদগুলো পেয়েছিল, সেই বিষয়ে আমাদের বলেছিল। এগুলো শুনে আমাদেরও মিশনারি সেবা করার ইচ্ছা হয়েছিল। তাই, আমরা চিন্তা করেছিলাম যে, আমরা মিশনারি সেবা করবই।
১৯৮৩ সালে ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে একটা কিংডম হলের বাইরে
আমাদের এই লক্ষ্য অর্জন করার জন্য আমরা ১৯৮৪ সালে প্রথম পদক্ষেপ নিই। আমরা ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার দূরে কুইবেকে চলে যাই, যেখানে ফ্রেঞ্চ ভাষা বলা হয়। সেখানকার ভাষা শেখা এবং সেখানকার জীবনধারার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়া আমাদের পক্ষে সহজ ছিল না। তার উপরে আমাদের কাছে তেমন টাকাপয়সাও ছিল না। একবার তো এমন হয়েছিল যে, একজন কৃষকের খেতে পড়ে থাকা আলু তুলে আমাদের জীবন চালাতে হয়েছিল। ডেবি আলুর বিভিন্ন খাবার তৈরি করতে শিখেছিল। এইসব সমস্যা সত্ত্বেও, আমরা আনন্দের সঙ্গে যিহোবাকে সেবা করে চলেছিলাম। আর আমরা দেখেছিলাম যে, যিহোবা আমাদের যত্ন নিচ্ছেন।—গীত. ৬৪:১০.
একদিন আমাদের কাছে একটা ফোন আসে এবং আমাদের কানাডা বেথেলে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমরা এমনটা আশাও করিনি, কারণ আমরা তো গিলিয়েড স্কুলের জন্য আবেদন পূরণ করেছিলাম। তাই যদিও আমরা বেথেলে যাওয়ার জন্য খুশি ছিলাম, কিন্তু গিলিয়েডে যেতে না পারার জন্য দুঃখিতও ছিলাম। আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছিলাম, তখন আমরা ভাই কেনেথ লিটলের সঙ্গে দেখা করি, যিনি শাখা কমিটির সদস্য ছিলেন। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি, “ভাই, এখন আমাদের গিলিয়েডের আবেদনের কী হবে?” তিনি বলেন, “সময় হলে দেখা যাবে।”
এক সপ্তাহ পরেই সেই সময় চলে আসে! আমাকে আর ডেবিকে গিলিয়েড স্কুলের জন্য ডাকা হয়। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হত যে, আমরা কী করব। ভাই লিটল আমাদের বলেন: “তুমি যে-পথই বেছে নাও না কেন, এক সময় গিয়ে তোমার মনে হবে, ইস আমি যদি অন্য পথ বেছে নিতাম, তা হলে ভালো হত। কোনো পথই অন্য পথের চেয়ে ভালো নয়। যিহোবা যেকোনো পথকেই আশীর্বাদ দিতে পারেন।” আমরা গিলিয়েডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। অনেক বছর পর আমরা বুঝতে পারি, ভাই লিটল ঠিক কথাই বলেছিলেন। আমরা ভাইয়ের এই পরামর্শ অন্যদেরও বলি, যাদের আমাদের মতোই এটা বেছে নিতে হত যে, তারা যিহোবার সেবায় কী করবে।
মিশনারি সেবা
(বাঁ-দিকে) ইউলিসিস গ্লাস
(ডান দিকে) জ্যাক রেডফোর্ড
১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে, আমরা গিলিয়েডের ৮৩তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। আমরা খুব খুশি ছিলাম। ক্লাসে আমরা মোট ২৪ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম। এই স্কুলটা নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন শহরে হয়েছিল। আমাদের বেশিরভাগ ক্লাস ভাই ইউলিসিস গ্লাস এবং ভাই জ্যাক রেডফোর্ড পরিচালনা করেছিলেন। কীভাবে পাঁচ মাস কেটে গেল, আমরা বুঝতেও পারিনি। ১৯৮৭ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর আমরা গ্র্যাজুয়েট হই। আমাদের জন ও মেরি গুডের সঙ্গে হাইতিতে সেবা করার জন্য পাঠানো হয়।
১৯৮৮ সালে হাইতিতে
হাইতিতে যে-মিশনারিরা সেবা করছিল, তাদের সবাইকে ১৯৬২ সালে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। তার পর আমরাই সেখানে মিশনারি হিসেবে যাচ্ছিলাম। আমরা গ্র্যাজুয়েশনের তিন সপ্তাহ পর সেখানে পৌঁছাই এবং একটা ছোটো মণ্ডলীতে সেবা করতে শুরু করি। এই মণ্ডলী পাহাড়ের মাঝখানে একটা প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত ছিল এবং এখানে ৩৫ জন প্রকাশক ছিল। আমাদের বয়স কম ছিল আর আমাদের এভাবে সেবা করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আর মিশনারি হোমে আমরা দু-জন ছাড়া আর কেউ ছিল না। সেখানকার লোকেরা খুবই গরিব ছিল এবং বেশিরভাগ লোকই পড়াশোনা জানত না। সেইসময় আমরা যেখানে থাকতাম, সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দাঙ্গা শুরু হয়, লোকেরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে শুরু করে, আগুন জ্বালানো, ব্যারিকেড পোড়ানো, এই সমস্ত কিছু শুরু করে। এ ছাড়া, সেখানে একটা ঘুর্ণিঝড়ও আসতে যাচ্ছিল।
আমরা হাইতির ভাই-বোনদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তারা এই কঠিন পরিস্থিতিও স্থির ছিল এবং আনন্দে ছিল। অনেক ভাই-বোনের জীবনে বিভিন্ন সমস্যা ছিল, কিন্তু তারা যিহোবাকে খুব ভালোবাসত এবং উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করছিল। যেমন, একজন বয়স্ক বোন পড়াশোনা জানতেন না, কিন্তু তার প্রায় ১৫০টা শাস্ত্রপদ মুখস্থ ছিল। আমরা প্রতিদিন যে-সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছিলাম, সেই কারণে আমাদের এই সংকল্প আরও দৃঢ় হয়েছিল যে, আমাদের রাজ্যের বার্তা প্রচার করা চালিয়ে যেতে হবে কারণ এটাই মানবজাতির সমস্যার একমাত্র সমাধান। আমরা এটা দেখে খুবই আনন্দিত যে, আমরা প্রথমে যাদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করেছিলাম, তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিয়মিত অগ্রগামী, কেউ কেউ বিশেষ অগ্রগামী এবং কেউ কেউ প্রাচীন হিসেবে সেবা করতে শুরু করে।
হাইতিতে থাকার সময় আমার ট্রেভর নামে একজন ছেলের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি একটি গির্জার হয়ে মিশনারি সেবা করছিলেন। আমরা তার সঙ্গে অনেক বার বাইবেল নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। অনেক বছর পর, তার কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়ে আমরা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “আমি পরের সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিতে চলেছি। আর আমি হাইতিতে গিয়ে সেই এলাকাতেই মিশনারি হিসেবে সেবা করতে চাই, যেখানে আমি আগে গির্জার হয়ে মিশনারি সেবা করতাম।” আর তিনি এবং তার স্ত্রী অনেক বছর ধরে এটাই করেন!
ইউরোপ থেকে আফ্রিকা
১৯৯৪ সালে স্লোভেনিয়াতে কাজ করার সময়
আমাদের ইউরোপের এমন একটা এলাকায় সেবা করার জন্য পাঠানো হয়, যেখানে প্রথমে আমাদের কাজের উপর কিছু বিধি-নিষেধ ছিল। কিন্তু, ধীরে ধীরে পরিস্থিতি ভালো হতে শুরু করে। ১৯৯২ সালে আমরা স্লোভেনিয়ার লুব্লিয়ানা শহরে পৌঁছাই। আসলে আমার বাবা-মা ছোটোবেলায় এই শহরের কাছেই বড়ো হয়ে উঠেছেন। আমরা যখন লুব্লিয়ানা পৌঁছাই, তখন ইউগোস্লাভিয়ার কিছু এলাকায় যুদ্ধ চলছিল। আর সেই পুরো এলাকায় যে-প্রচার কাজ চলছিল, সেটা ভিয়েনা শাখা অফিস দেখাশোনা করছিল, যেটা অস্ট্রিয়াতে রয়েছে। এর পাশাপাশি, ক্রোয়েশিয়ার জাগরেব এবং সার্বিয়ার বেলগ্রেডে যে-অফিস ছিল, সেটাও প্রচার কাজ দেখাশোনা করতে সাহায্য করছিল। কারণ এই সমগ্র এলাকা আলাদা আলাদা দেশে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই প্রতিটা দেশে বেথেলের ব্যবস্থা করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এখন আমাদের আরও একবার নতুন ভাষা শিখতে হত এবং নতুন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে হত। সেখানকার লোকেরা বলত, “ইয়েজেক ইয়ে তেজেক” যেটার মানে হল, “এই ভাষা খুবই কঠিন।” আর সত্যিই এই ভাষা শেখা কঠিন ছিল! আমাদের এটা দেখে খুবই ভালো লেগেছিল যে, সেইসময়ে সংগঠন যে-রদবদলগুলো করত, ভাই-বোনেরা তা সমর্থন করত আর তাই যিহোবা তাদের আশীর্বাদও করেছিলেন। আমরা আরও একবার দেখতে পেয়েছিলাম, যিহোবা প্রেমের সঙ্গে এবং সঠিক সময়ে বিষয়গুলো সমাধান করেন। আমরা আগে যে-বিষয়গুলো শিখেছিলাম, সেগুলো স্লোভেনিয়াতে সেবা করার সময় আমাদের সমস্যাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করতে অনেক সাহায্য করেছিল। আর এখানে সেবা করার সময়ও আমরা অনেক নতুন বিষয় শিখি।
আমাদের জীবনে আরও পরিবর্তন ঘটেছিল। ২০০০ সালে আমাদের পশ্চিম আফ্রিকার কোট ডিভোরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু, গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে ২০০২ সালের নভেম্বর মাসে আমাদের সেখান থেকে পালাতে হয়েছিল। আমরা সিয়েরা লিয়োন গিয়েছিলাম, যেখানে ১১ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলার পর সেটা সবেমাত্র শেষ হয়েছিল। হঠাৎ সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে আসা আমাদের জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু, আমরা যে-বিষয়গুলো শিখেছিলাম, সেগুলোর কারণে আমরা আমাদের আনন্দ বজায় রাখতে পেরেছিলাম।
সিয়েরা লিয়োনে অনেক লোক সত্য শিখতে চেয়েছিল। আমরা তাদের উপর এবং এর পাশাপাশি সেই ভাই-বোনদের উপরও মনোযোগ দিয়েছিলাম, যারা বহু বছর ধরে যুদ্ধের কারণে সমস্যা সহ্য করছিল। তাদের কাছে বেশি কিছু ছিল না, কিন্তু যা-কিছু ছিল, সেগুলো তারা আনন্দের সহকারে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে প্রস্তুত ছিল। একবার এক বোন ডেবিকে কিছু কাপড় দিয়েছিল। ডেবি যখন সেই কাপড় নিতে ইতস্তত বোধ করছিল, তখন বোন বলেছিলেন, “যুদ্ধ চলাকালীন অন্য দেশের ভাই-বোনেরা আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল। এখন আমাদের কাছে এই সুযোগ রয়েছে।” আমরা চিন্তা করেছিলাম, আমরাও সেই ভাই-বোনদের মতো হব এবং অন্যদের সাহায্য করব।
কিছু সময় পর, আমরা কোট ডিভোরে ফিরে যাই। কিন্তু, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেখানে আবার দাঙ্গা শুরু হয়। তাই, ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে আমাদের সেখান থেকে সুরক্ষিতভাবে বের করা হয়। আমাদের একটা হেলিকপ্টারে করে ফ্রেঞ্চ সৈন্য ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা নিজেদের সঙ্গে মাত্র ১০ কেজির একটা ব্যাগ নিয়ে যেতে পারতাম। সেখানে আমরা রাতে মেঝেতে শুয়েছিলাম। পরের দিন আমাদের প্লেনে করে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় মাঝরাতে আমরা শাখা অফিসে পৌঁছাই। সেখানে শাখা কমিটির ভাইয়েরা এবং মিনিস্টিরিয়াল ট্রেনিং স্কুলের শিক্ষকেরা এবং তাদের স্ত্রীরা আমাদের প্রেমের সঙ্গে স্বাগত জানায়। তারা অনেক বার আমাদের জড়িয়ে ধরে, গরম গরম খাবার দেয় এবং সেখানকার অনেক চকলেট দেয়। তাদের এই ভালোবাসা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল।
২০০৫ সালে কোট ডিভোরে শরণার্থীদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময়
আমাদের কিছু সময়ের জন্য ঘানাতে সেবা করার জন্য বলা হয়। কিন্তু, যখন কোট ডিভোরের পরিস্থিতি কিছুটা ঠিক হয়, তখন আমাদের আবার সেখানে পাঠানো হয়। হঠাৎ নিজের বাড়ি ছেড়ে কখনো এক জায়গায়, আবার কখনো অন্য জায়গায় সেবা করা আমাদের জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু, ভাই-বোনেরা যেভাবে প্রেমের সঙ্গে আমাদের সাহায্য করেছিল, সেটার কারণে আমরা আমাদের আনন্দ বজায় রাখতে পেরেছিলাম। আমি ও ডেবি প্রায়ই এই বিষয়ে কথা বলতাম যে, যিহোবার সংগঠনে ভাই-বোনদের মধ্যে ভালোবাসা তো থাকেই, কিন্তু আমাদের যেন কখনোই সেই ভালোবাসার প্রতি উপলব্ধিবোধ কমে না যায়। যদিও এটা খুবই কঠিন সময় ছিল, কিন্তু সেইসময় আমরা অনেক মূল্যবান বিষয় শিখি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সেবা
২০০৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে
২০০৬ সালে আমরা বিশ্বপ্রধান কার্যালয় থেকে একটা চিঠি পাই আর আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের একটা দেশে সেবা করার জন্য বলা হয়। আরও একবার আমাদের জীবন পরিবর্তিত হতে যাচ্ছিল। আমাদের সামনে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, নতুন সংস্কৃতি ও নতুন ভাষা শিখতে হত। আমাদের এখানে অনেক কিছু শিখতে হত কারণ এখানকার লোকদের মধ্যে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে খুবই আগ্রহ ছিল। কিন্তু, আমরা যখন দেখতাম যে, মণ্ডলীগুলোতে আলাদা আলাদা ভাষার ভাই-বোনেরা থাকা সত্ত্বেও সংগঠনের কাছ থেকে পাওয়া নির্দেশনা মেনে চলার কারণে তাদের মধ্যে চমৎকার একতা রয়েছে, তখন আমাদের খুব ভালো লাগত। সেখানকার বেশিরভাগ ভাই-বোন তাদের পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, সহপাঠী ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু, তারা সাহসের সঙ্গে এই সমস্ত কিছু মোকাবিলা করেছিল। তাই, আমরা তাদের অনেক সম্মান করতাম।
২০১২ সালে ইজরায়েলের তেল আবীব শহরে একটা বিশেষ সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয় এবং আমরা সেখানে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। ৩৩ খ্রিস্টাব্দের পঞ্চাশত্তমীর দিনের পর প্রথম বার সেই এলাকায় যিহোবার লোকেরা এত বিরাট আকারে একত্রিত হয়েছিল। এটা সত্যিই খুবই স্মরণীয় ছিল!
সেই বছরগুলোতে আমাদের এমন একটা দেশে পরিদর্শন করার জন্য পাঠানো হয়, যেখানে আমাদের কাজের উপর বিধি-নিষেধ ছিল। আমরা সেখানে নিজেদের সঙ্গে কিছু প্রকাশনা নিয়ে যাই। আমরা সেখানে প্রচার করেছিলাম এবং কিছু ছোটো ছোটো সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলাম। আমরা খুবই সতর্কতার সঙ্গে ছোটো ছোটো দলে অন্য প্রকাশকদের সঙ্গে যাতায়াত করতাম। সব জায়গায় সৈনিকেরা হাতিয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়াত এবং জায়গায় জায়গায় অবরোধ ছিল, কিন্তু আমরা ভয় পাইনি।
আফ্রিকাতে ফিরে যাওয়া
২০১৪ সালে কঙ্গোতে বক্তৃতা প্রস্তুত করার সময়
২০১৩ সালে আমরা এক নতুন কার্যভার পাই। এটা একেবারে আলাদা ছিল। আমাদের বলা হয়েছিল, আমরা যেন কঙ্গোর কিনশাসা শাখা অফিসে সেবা করি। এটা অনেক বড়ো ও সুন্দর একটা দেশ। কিন্তু, সেখানকার লোকেরা প্রচণ্ড দরিদ্রতা ও অনেক যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছে। প্রথম প্রথম আমাদের মনে হয়েছিল, “আফ্রিকাতে আমরা তো একসময় ছিলামই, তাই যা-ই হবে, আমরা সামলে নেব।” কিন্তু, আমাদের এখনও অনেক কিছু শিখতে হত। বিশেষ করে সেই এলাকাগুলোতে যাত্রা করার সময় যেখানে না ছিল কোনো রাস্তা, না ছিল কোনো ব্রিজ। কিন্তু, অনেক ভালো বিষয়ও ছিল, আমরা সেগুলোর উপর মনোযোগ দিয়েছিলাম। যেমন, আর্থিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ভাই-বোনেরা আনন্দের সঙ্গে যিহোবার সেবা করে চলছিল। তারা উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করত এবং সভা ও সম্মেলনগুলোতে যোগ দেওয়ার জন্য অনেক পরিশ্রম করত। আমরা নিজেদের চোখে দেখতে পেয়েছি, যিহোবার আশীর্বাদে রাজ্যের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। কঙ্গোতে সেবা করার সময় অনেক ভালো বিষয় শিখেছি এবং আমরা অনেক ভালো বন্ধু পেয়েছি, যারা আমাদের পরিবার হয়ে উঠেছিল।
২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রচারে যাওয়ার সময়
২০১৭ সালের শেষের দিকে আমাদের দক্ষিণ আফ্রিকার শাখা অফিসে সেবা করার জন্য পাঠানো হয়। এখনো পর্যন্ত আমরা যেখানে যেখানে সেবা করেছি, সেগুলোর মধ্যে এটা ছিল সবচেয়ে বড়ো শাখা অফিস। বেথেলে আমাদের যে-কার্যভার দেওয়া হয়েছিল, সেটা আমাদের কাছে একেবারে নতুন ছিল। আমাদের আবারও অনেক কিছু শিখতে হত। কিন্তু, এই পর্যন্ত যে-বিষয়গুলো শিখেছিলাম, সেগুলো থেকে আমরা অনেক সাহায্য পেয়েছিলাম। সেখানে অনেক ভাই-বোন বহু বছর ধরে বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করছিল। আমরা তাদের অনেক ভালোবাসি। এটা সত্যিই একটা দারুণ বিষয় যে, বেথেল পরিবারে আলাদা আলাদা জাতি, বর্ণ ও সংস্কৃতির ভাই-বোনেরা রয়েছে, তারপরও তারা একতাবদ্ধভাবে যিহোবার সেবা করছে। যিহোবার লোকেরা নতুন ব্যক্তিত্বকে কাপড়ের মতো পরার এবং বাইবেলের নীতি অনুযায়ী চলার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা করছে এবং যিহোবা তাদের প্রচেষ্টায় আশীর্বাদ করছেন। তাই তাদের মধ্যে শান্তি এবং এক উত্তম সম্পর্ক রয়েছে।
বিগত বছরগুলোতে আমি ও ডেবি বিভিন্ন জায়গায় সেবা করেছি। আমরা আলাদা আলাদা পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছি এবং নতুন নতুন ভাষা শিখেছি। এই সমস্ত কিছু করা সবসময় সহজ ছিল না। কিন্তু, আমরা কখনো নিজেদের একা বলে মনে করিনি। যিহোবা সবসময় আমাদের তাঁর সংগঠন এবং ভাই-বোনদের মাধ্যমে ধরে রেখেছিলেন এবং তিনি যে আমাদের কতটা ভালোবাসেন, তা বুঝতে সাহায্য করেছিলেন। (গীত. ১৪৪:২) পূর্ণসময়ের সেবা করার সময় যে-প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম এবং যে-বিষয়গুলো শিখেছিলাম, তা থেকে আমরা যিহোবার আরও ভালো সেবক হতে পেরেছি।
আমি খুবই কৃতজ্ঞ যে, বাবা-মা আমাকে এত ভালোভাবে বড়ো করে তুলেছেন। আমার প্রিয় স্ত্রী ডেবি সবসময় আমার পাশে ছিল এবং আলাদা আলাদা জায়গায় ভাই-বোনেরা আমাদের জন্য এক উত্তম উদাহরণ স্থাপন করেছিল। আমি ও ডেবি স্থির করেছি যে, আগামী দিনে যা-কিছুই হোক না কেন, আমরা আমাদের মহান নির্দেশক যিহোবার কাছ থেকে ক্রমাগত শিখব।