জীবনকাহিনি
“যেখানে আমাদের পাঠানো হয়েছে, সেখানে মানিয়ে নিতে যিহোবা আমাদের সাহায্য করেছেন”
“তোমাকে যেখানে পাঠানো হবে, সেখানে নিজেকে মানিয়ে নাও” এই পরামর্শ খুব একটা কার্যকারী মনে না-ও হতে পারে। তবে, এই সুইডিশ দম্পতি, ম্যাটস ও অ্যান ক্যাটরিনকে বহুবার বহু জায়গায় “পাঠানো হয়।” কিন্তু, কেন এবং এই পরামর্শটা কীভাবে তাদের সাহায্য করেছিল?
ভাই ও বোন ক্যাসহমস্ ১৯৭৯ সালে গিলিয়েড স্কুলে যোগ দেয় আর এরপর তাদের বহুবছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় “পাঠানো হয়।” যেমন, ইরান, মরিশাস, মিয়ানমার, তানজানিয়া, উগান্ডা এবং জাইর। এই গিলিয়েড স্কুলে যোগ দেওয়ার সময় জ্যাক রেডফোর্ড নামে একজন ইন্সট্রাক্টর তাদের সব জায়গায় মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন, যেটা তাদের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। আসুন, তারা এই বিষয়ে কী বলছেন, তা দেখি।
ম্যাটস্, দয়া করে বলবেন, কীভাবে আপনি সত্য খুঁজে পেয়েছেন?
ম্যাটস্: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডে থাকাকালীন আমার বাবা ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে অনেক ভণ্ডামি লক্ষ করেন। কিন্তু, তা সত্ত্বেও, তিনি প্রায়ই বলতেন, “সত্য, কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে!” এমন একটা সময় আসে যখন আমি নিজেই বুঝতে পারি যে, এটা ঠিক। আমি অনেক পুরোনো বই কিনি। এর মধ্যে একটা নীল রঙের বই ছিল, যেটার নাম, “যে সত্য অনন্ত জীবনে লইয়া যায়।” এই নামটাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এক রাতের মধ্যেই আমি পুরো বইটা পড়ে ফেলি। আর বইটা পড়ার পর আমি বুঝতে পারি যে, আমি সত্য খুঁজে পেয়েছি!
১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের পর থেকে আমি যিহোবার সাক্ষিদের অনেক প্রকাশনা পড়ি এবং বাইবেল সম্বন্ধে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাই। আমার মনে হয়েছিল, আমি যেন যিশুর দৃষ্টান্তে দেওয়া সেই বণিক, যে একটা মহামূল্য মুক্তো কেনার জন্য তার সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা এবং ডাক্তার হওয়ার জন্য আমার যে-পরিকল্পনাগুলো ছিল, সেগুলো আমি এক অর্থে “বিক্রি” করে দিই, শুধুমাত্র সত্যের এই “মুক্তো” কেনার জন্য, যা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। (মথি ১৩:৪৫, ৪৬) আমি ১৯৭২ সালের ১০ই ডিসেম্বর বাপ্তিস্ম নিই।
এক বছরের মধ্যে আমার বাবা-মা এবং আমার ছোটো ভাইও সত্য গ্রহণ করে এবং বাপ্তিস্ম নেয়। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে, আমি পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করি। আমাদের মণ্ডলীতে উদ্যোগী অগ্রগামীদের মধ্যে অ্যান-ক্যাটরিন নামে একজন সুন্দরী বোন ছিল, যে যিহোবাকে খুব ভালোবাসত। আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ি এবং ১৯৭৫ সালে আমরা বিয়ে করি। আর এরপর চার বছর আমরা সুইডেনের একটা সুন্দর শহর স্ট্রমসুন্ডে সেবা করি, যেখানে অনেক লোক বাইবেলের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিল।
অ্যান-ক্যাটরিন: আমার বাবা যখন স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন, তখন তিনি সত্য সম্বন্ধে জানতে পারেন। আমার বয়স তখন মাত্র তিন মাস, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার বাবা আমাকে সভাতে এবং প্রচারে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। এটা আমার মা একেবারেই পছন্দ করতেন না আর তিনি সাক্ষিদের ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু, তিনি তা করে উঠতে পারেননি, শেষ পর্যন্ত তিনিও বাপ্তিস্ম নেন। ১৩ বছর বয়সে আমি বাপ্তিস্ম নিই এবং ১৬ বছর বয়সে আমি অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করি। উমিয়া শহর, যেখানে রাজ্যের প্রকাশকদের অনেক প্রয়োজন ছিল, সেখানে সেবা করার পর আমি একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে নিযুক্ত হই।
ম্যাটসের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার পর আমরা অনেক ব্যক্তিকে সত্যে আসতে সাহায্য করতে পেরে খুব খুশি হয়েছিলাম। এদের মধ্যে একজন হল মিভর নামে একটি অল্পবয়সি মেয়ে, যে তার খেলার কেরিয়ার ছেড়ে দিয়ে আমার ছোটো বোনের সঙ্গে অগ্রগামী সেবা শুরু করে। তারা দু-জনেই ১৯৮৪ সালে গিলিয়েড স্কুলে যোগ দেয় আর এখন মিশনারি হিসেবে ইকুয়েডরে সেবা করছে।
বিভিন্ন জায়গায় মিশনারি হিসেবে সেবা করার সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে “মানিয়ে নেওয়ার” যে-পরামর্শ আপনি পেয়েছিলেন, তা কীভাবে কাজে লাগিয়েছেন?
ম্যাটস্: প্রায়ই আমাদের নতুন নতুন জায়গায় সেবা করার জন্য “পাঠানো” হত। আমরা সাধ্যমতো যিশুর উদাহরণ, বিশেষভাবে তাঁর নম্রতা অনুকরণ করার দ্বারা আমাদের বিশ্বাসের ‘মূলকে’ ধরে রাখতে চেষ্টা করেছি। (কল. ২:৬, ৭) যেমন, আমরা কখনোই আশা করিনি যে, স্থানীয় ভাই-বোনেরা আমাদের সঙ্গে মানিয়ে নেবে বরং আমরা সবসময় তাদের সংস্কৃতি ও চিন্তাধারাকে জানার এবং বোঝার চেষ্টা করেছি। যতই আমরা যিশুকে অনুকরণ করেছি, ততই আমরা অনুভব করেছি যে, আমরা যেন “জলের স্রোতের ধারে লাগানো গাছের মতো,” আমাদের যেখানেই পাঠানো হোক না কেন, আমরা নিজেদের ঠিক মানিয়ে নিতে পারব।—গীত. ১:২, ৩.
বিভিন্ন মণ্ডলী পরিদর্শন করা আমাদের জীবনের একটা অংশ হয়ে গিয়েছিল
অ্যান-ক্যাটরিন: একটা চারাগাছ বেড়ে ওঠার জন্য সূর্যের আলো প্রয়োজন। যিহোবা আমাদের জন্য ঠিক ‘সূর্যের’ মতোই ছিলেন। (গীত. ৮৪:১১) তিনি আমাদের অনেক ভাই-বোন দিয়েছিলেন, যারা আমাদের খুব ভালোবাসত। যেমন, ইরানের রাজধানী তেহরানের একটা ছোটো মণ্ডলীতে সবসময় ভাই-বোনেরা আমাদের আতিথেয়তা দেখাত, যেটা বাইবেলের সময়ে খুব প্রচলিত ছিল। আমরা খুব খুশি হতাম, যদি আমরা ইরানেই থেকে যেতে পারতাম। কিন্তু, ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে যিহোবার সাক্ষিদের উপর সেখানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় আর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের সেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়। এরপর, আমাদের আবার আফ্রিকার জাইর শহরে (যেটা বর্তমানে কঙ্গো নামে পরিচিত) পাঠানো হয়।
১৯৮২ সালে জাইরে আমাদের কার্যভারের কিছু আনন্দপূর্ণ স্মৃতি
আমি যখন প্রথম জানতে পারি যে, আমাদের আফ্রিকায় আবার পাঠানো হয়েছে, তখন আমি খুব কেঁদেছিলাম। আমি শুনেছিলাম, আফ্রিকায় অনেক সাপ রয়েছে এবং লোকেরা বিভিন্ন রকমের রোগে ভোগে, আর সেটা আমাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু, আমাদের খুব কাছের দু-জন বন্ধু, যারা অনেক দিন ধরে সেখানে সেবা করছিল, তারা আমাদের বলে: “তোমরা তো আগে কখনো এখানে আসোনি! একবার এসে দেখ, দেখবে আফ্রিকাকে তোমাদের খুব ভালো লাগবে।” আর সত্যি, সেটাই হয়েছিল। সেখানকার ভাই-বোনেরা খুবই আন্তরিক ছিল আর আমাদের খুব ভালোবাসত। কিন্তু, ছয় বছর পর নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের যখন জাইর ছেড়ে চলে যেতে হয়, তখন আমি মনে মনে হাসি কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এখন আমি যিহোবার কাছে প্রার্থনা করে বলতে চাই, “দয়া করে, আমাদের আফ্রিকাতেই রেখে দাও।”
এত বছর ধরে সেবা করার পর আপনি কোন কোন আশীর্বাদ পেয়েছেন?
১৯৮৮ সালে তানজানিয়ায় আমাদের “শোয়ার ঘর”
ম্যাটস্:আমাকে এটা বলতেই হবে যে, বিভিন্ন জাতি ও পটভূমি থেকে আসা অনেক মিশনারিকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আবার কোনো কোনো জায়গায়, আমরা দু-জনে মিলে এক এক সময়ে প্রায় ২০টা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছি, আর সেটা আমাদের প্রচুর আনন্দ দিয়েছিল! আফ্রিকার ভাই-বোনদের প্রেম ও আতিথেয়তার কথা আমরা কখনো ভুলব না। তানজানিয়া শহরের মণ্ডলীগুলো পরিদর্শনের সময়, অনেক ভাই-বোন তাদের “সাধ্যের অতিরিক্ত” আমাদের প্রতি আতিথেয়তা দেখিয়েছিল, বিশেষ করে যখন আমরা আমাদের গাড়ি, যেটা আমাদের জন্য “শোয়ার ঘর” ছিল, সেটা তাদের বাড়ির পাশে রাখতাম। (২ করি. ৮:৩) নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য আমরা একটা সময় করে নিতাম, যেটা আমাদের কাছে খুব প্রিয় ছিল। অ্যান-ক্যাটরিন আর আমি দিনের শেষে একসঙ্গে বসে যিহোবাকে ধন্যবাদ দিতাম যে, তিনি আমাদের পাশে ছিলেন এবং সেই দিনটা কেমন কাটল, সেটা নিয়ে আমরা কথা বলতাম।
অ্যান-ক্যাটরিন: আমার জন্য আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃসমাজের মাঝে থাকাটাই ছিল, সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার সময় আমরা অনেকগুলো ভাষাও শিখেছিলাম, যেমন ফার্সি, ফ্রেঞ্চ, লুগান্ডা ও সোয়াহিলি। আমরা বহু নতুন ভাই-বোনকে প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছিলাম, নতুন নতুন বন্ধু বানিয়েছিলাম আর আমরা সবাই “একযোগে” যিহোবার সেবা করেছিলাম।—সফ. ৩:৯.
এ ছাড়া, আমরা যিহোবার অপূর্ব সৃষ্টির মধ্যে অনেক বৈচিত্র্য দেখেছিলাম। যত বার আমরা যিহোবার সেবায়, নতুন কার্যভার গ্রহণ করেছি, তত বার আমাদের মনে হয়েছে যে, যিহোবাই যেন আমাদের সেই যাত্রার পথ প্রদর্শক। যিহোবা আমাদের এমন অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন, যেটা হয়তো আমরা কখনো নিজে থেকে শিখতে পারতাম না।
তানজানিয়ার বিভিন্ন ধরনের এলাকায় প্রচার করা
কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর সম্মুখীন আপনি হয়েছিলেন এবং সেগুলো আপনি কীভাবে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন?
ম্যাটস্: বিভিন্ন সময়ে আমরা অনেক রকমের ট্রপিক্যাল ডিজিস-এর (গ্রীষ্মপ্রধান দেশে দেখা যায় এমন কিছু রোগ) দ্বারা আক্রান্ত হই, যেমন ম্যালেরিয়া। অ্যান-ক্যাটরিনেরও হঠাৎই কয়েক বার অপারেশন করানোর প্রয়োজন হয়। তা ছাড়াও, আমাদের বয়স্ক বাবা-মা ছিল, যাদের জন্য আমরা খুবই চিন্তায় থাকতাম। তাই, আমরা আমাদের আপন ভাই-বোনদের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ ছিলাম কারণ তারাই বিশেষভাবে বাবা-মায়ের যত্ন নিয়েছিল। তারা বিশ্বস্তভাবে ধৈর্য, আনন্দ ও প্রেমের সঙ্গে এই কর্তব্য পালন করেছিল। (১ তীম. ৫:৪) তবুও, এক এক সময় আমাদের খুব মন খারাপ হত। যদিও, আমরা দূরে থেকে আমাদের সাধ্যমতো তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি, তবুও মনে হত, বাবা-মায়ের জন্য যদি আরও কিছু করতে পারতাম, তা হলে খুব ভালো হত।
অ্যান-ক্যাটরিন: ১৯৮৩ সালে, জাইরে সেবা করার সময় আমি মারাত্মকভাবে কলেরা রোগে আক্রান্ত হই। ডাক্তার ম্যাটসকে বলে, “আপনি আজই আপনার স্ত্রীকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যান!” কিন্তু, পরের দিন সুইডেনে ফিরে যাওয়ার জন্য শুধুমাত্র একটাই মালবাহী বিমান ছিল, আর আমরা সেটা করেই সুইডেনের দিকে রওনা দিই।
ম্যাটস্: আমরা ভেবেছিলাম যে, এখানেই আমাদের মিশনারি সেবা শেষ, আর তাই আমরা খুব কেঁদেছিলাম। যদিও, ডাক্তার বলেছিলেন, অ্যান-ক্যাটরিনের পক্ষে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব নয়, তবে শেষ পর্যন্ত সে সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আর এক বছর পর, আমরা আবার জাইরে ফিরে যাই। আর এই বার আমরা লুবুমবাসি এলাকার একটা ছোটো সোয়াহিলি মণ্ডলীতে সেবা করতে শুরু করি।
অ্যান-ক্যাটরিন: লুবুমবাসিতে সেবা করার সময়, আমার গর্ভপাত হয়ে যায়। যদিও, আমরা কখনো পরিবার শুরু করার পরিকল্পনা করিনি, তবুও গর্ভের সন্তান হারানোর কষ্ট সহ্য করা আমার পক্ষে খুবই কঠিন ছিল। তবে, ওই দুঃখের সময় আমরা যিহোবার কাছ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে একটা উপহার লাভ করি। আমরা আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করতে শুরু করি। এক বছরের মধ্যে মণ্ডলীর প্রকাশকের সংখ্যা ৩৫ থেকে বেড়ে ৭০ পৌঁছায় এবং মণ্ডলীর উপস্থিতির সংখ্যাও ৪০ থেকে ২২০ তে দাঁড়ায়। আমরা সম্পূর্ণভাবে প্রচার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আর যিহোবার আশীর্বাদ আমাকে প্রচুর সান্ত্বনা দেয়। আমরা প্রায়ই, আমাদের সেই ছোট্টো শিশুটির কথা ভাবি, তবে আমরা এটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রয়েছি যে, যিহোবা কীভাবে পরমদেশে আমাদের আবেগগত কষ্ট সম্পূর্ণভাবে দূর করবেন।
ম্যাটস্: একটা সময়ে অ্যান-ক্যাটরিন শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। আর একই সময়ে আমার কোলোন ক্যান্সার ধরা পড়ে, যার জন্য একটা বড়ো অপারেশনের প্রয়োজন ছিল। আজকে অবশ্য, আমি ভালোই আছি আর অ্যান-ক্যাটরিনও তার সাধ্যমতো যিহোবার সেবা করে যাচ্ছে।
আমরা এটা বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের মতো আরও অনেকে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে, রুয়ান্ডায় গণহত্যার পর, আমরা আমাদের অনেক ভাই-বোনের সঙ্গে শরণার্থী শিবিরে দেখা করি। তাদের বিশ্বাস, সহ্যশক্তি ও আতিথেয়তা দেখে, আমরা এটা শিখেছিলাম যে, তাড়নার মধ্যেও যিহোবা তাঁর লোকদের যত্ন নেন।—গীত. ৫৫:২২.
অ্যান-ক্যাটরিন: ২০০৭ সালে উগান্ডা শাখার উৎসর্গীকরণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সময় আমরা আরেকটা পরীক্ষার সম্মুখীন হই। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা প্রায় ২৫ জন মিশনারি ও বেথেলাইটদের সঙ্গে কেনিয়ার নাইরোবি শহরে যাই। কেনিয়ার বর্ডারে যখন আমরা পৌঁছাই, তখন হঠাৎ করে একটা চলন্ত লরি সোজা এসে আমাদের গাড়িতে ধাক্কা মারে। এর ফলে, ড্রাইভার আর আমাদের পাঁচ জন বন্ধু সেখানেই মারা যায়। পরে একজন বোন হাসপাতালে মারা যান। আমরা কতই-না অধীর আগ্রহে আমাদের বন্ধুদের আবারও দেখার জন্য, অপেক্ষা করে রয়েছি!—ইয়োব ১৪:১৩-১৫.
শেষ পর্যন্ত যদিও আমি আমার শারীরিক জখম থেকে সুস্থ হয়ে উঠি। কিন্তু, ম্যাটস্ ও আমি এবং আমাদের সঙ্গে আরও অনেক সহযাত্রী, অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পরেও আতঙ্কে ভুগছিলাম। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল, আমি এতটাই আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, মাঝরাতে আমি জেগে উঠতাম আর মনে হত আমার যেন হার্ট-অ্যাটাক হবে। সেটা সত্যিই খুবই ভয়াবহ ছিল। কিন্তু, অবিরত যিহোবার কাছে প্রার্থনা করা আর আমাদের পছন্দের কিছু প্রিয় শাস্ত্রপদ এই সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করেছিল। এ ছাড়া, আমরা ডাক্তারদের পরামর্শও নিয়েছিলাম, যেটা আমাদের খুব কাজে লেগেছিল। আগের থেকে যদিও এখন আমাদের পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছে, তাই আমরা যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি, যাতে তিনি সেই সমস্ত ভাই-বোন, যারা একইরকম পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করছে, তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আমাদের সাহায্য করেন।
আপনি যখন আমাদের বলছিলেন যে, কীভাবে আপনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তখন আপনি এও বলেছিলেন যে, যিহোবা আপনাকে ঠিক একটা “কাঁচা ডিমের” মতো আগলে রেখেছিলেন। এর মানে কী?
ম্যাটস্: এই কথাটা আসলে সোয়াহিলি ভাষা থেকে এসেছে, যেখানে বলা হয়, “টুমেবেবওয়া কামা মায়াই মাবিচি,” যেটার মানে হল, “আমাদের কাঁচা ডিমের মতো আগলে রাখা হয়েছে।” ঠিক যেমন, একজন ব্যক্তি খুব সাবধানে কাঁচা ডিম ধরে রাখে, যাতে সেটা ভেঙে না যায়, একইভাবে যিহোবাও প্রত্যেকটা কার্যভারে আমাদের এমন কোমলভাবে যত্ন নিয়েছেন, যাতে আমরা কোনোভাবেই ভেঙে না পড়ি। আমাদের যা-কিছু প্রয়োজন ছিল, সেটার চেয়েও অনেক বেশি আমরা পেয়েছি। একটা যে-উপায়ে, আমরা যিহোবার ভালোবাসা এবং সমর্থন অনুভব করেছি, সেটা হল আমাদের প্রতি পরিচালকগোষ্ঠীর সমবেদনা।
অ্যান-ক্যাটরিন: যিহোবার একটা কোমল যত্নের কথা আমি বলতে চাই। একদিন হঠাৎ করে, আমি একটা ফোন পাই, আর আমি জানতে পারি যে, সুইডেনে আমার বাবা খুবই অসুস্থ এবং তাকে হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারে (রোগির অবস্থার উপর ২৪ ঘণ্টা নজর রেখে চিকিৎসা) রাখা হয়েছে। সেইসময় ম্যাটস্ সবেমাত্র ম্যালেরিয়া থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে। আর বাড়ি যাওয়ার জন্য টিকিট কেনার মতো টাকা আমাদের কাছে ছিল না, তাই আমরা ভেবেছিলাম যে, আমরা আমাদের গাড়ি বিক্রি করে দেব। এরপর, আমাদের কাছে আরও দুটো ফোন কল আসে। একজন দম্পতি আমাদের অবস্থার কথা শুনে, আমাদের ফোন করে এবং বলে যে, তারা আমাদের একটা টিকিটের ভাড়া দিতে চায়। অন্যদিকে আরেক জন বয়স্ক বোনের কল আসে, যিনি একটা বাক্সের মধ্যে কিছু টাকা জমাতেন আর সেই বাক্সের উপরে লেখা ছিল, “প্রয়োজন রয়েছে, এমন ব্যক্তির জন্য।” তিনি আমাদের প্রতি তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মুহূর্তের মধ্যে আমরা উপলব্ধি করেছিলাম যিহোবা আমাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন!—ইব্রীয় ১৩:৬.
আপনি যখন আপনার ৫০ বছর পূর্ণসময়ের সেবা করার দিকে ফিরে তাকান, তখন সেই অভিজ্ঞতা থেকে আপনি কী শিখেছেন
মিয়ানমারে আমাদের নতুন কার্যভার
অ্যান-ক্যাটরিন: আমি এটা উপলব্ধি করেছি যে, “শান্ত থাকলে এবং আস্থা রাখলে” আমরা শক্তি পাব। আমরা যদি যিহোবার উপর আস্থা রাখি, তা হলে তিনি আমাদের হয়ে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। (যিশা. ৩০:১৫; ২ বংশা. ২০:১৫, ১৭) যিহোবার সেবায় সর্বোত্তমটা দেওয়ার ফলে, আমরা এতটা আশীর্বাদ পেয়েছিলাম, যেটা হয়তো আমরা অন্য কোনো কাজ করে পেতাম না।
ম্যাটস্: আমি যে-প্রধান শিক্ষাটা পেয়েছিলাম, সেটা হল যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি যদি যিহোবার উপর নির্ভর করি, তা হলে তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। (গীত. ৩৭:৫) তিনি কখনো এই বিষয়ে তাঁর প্রতিজ্ঞা ভুলে যাবেন না। বর্তমানে আমরা মিয়ানমার বেথেলে সেবা করছি আর আমরা এখনও তাঁর সেই প্রতিজ্ঞার সত্যতা উপলব্ধি করছি।
আমরা আশা করছি, যে-অল্পবয়সিরা আরও বেশি করে যিহোবার সেবা করতে চায়, তারাও যিহোবার অটল প্রেম উপভোগ করবে, যা তিনি আমাদের প্রতি দেখিয়ে এসেছেন। আমরা নিশ্চিত যে, যেখানেই তাদের পাঠানো হোক না কেন, তারা যদি নিজেদের সেখানে মানিয়ে নিতে প্রস্তুত থাকে, তা হলে যিহোবা তাদের সফল হতে সাহায্য করবেন।