সত্যিই কি এটি চুরি?
নাইজিরিয়ার একটি বড় হোটেলের প্রধান পরিচারক ছিল আবিওদুন। একদিন সন্ধ্যাবেলা ডাইনিং হল বন্ধ করার সময়ে, সে একটি ব্যাগ খুঁজে পায় যাতে ১,৮২৭ যুক্তরাষ্ট্র ডলারের সমমূল্যের টাকা ছিল। দেরি না করে সে টাকাটি জমা দিয়ে, পরে সেই হোটেলেরই একজন অতিথি, ব্যাগটির মালিককে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। দুই ধাপ পদোন্নতি এবং সেই “বছরের শ্রেষ্ঠ কর্মী” খেতাব দিয়ে, হোটেলের কর্তৃপক্ষ আবিওদুনকে পুরস্কৃত করেছিল। ব্যাগটির কর্ত্রীও তাকে কিছু পুরস্কার দিয়েছিলেন।
কোয়ালিটি নামে একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে এই খবরটি প্রকাশিত হয় এবং সেখানে আবিওদুন “গুড সামারিটান” বলা হয়। কোয়ালিটি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করে যে টাকাটি নিতে সে প্রলোভিত হয়েছিল কিনা, আবিওদুন বলেছিল: ‘আমি একজন যিহোবার সাক্ষী। তাই আমার নয়, এমন কিছু যদি আমি খুঁজে পাই, তাহলে আমি তা তার মালিককে ফিরিয়ে দিই।’
আবিওদুনের সততায় সেই এলাকার অনেকে আশ্চর্য হয়েছিল। আবিওদুনের সহ-সাক্ষীরা এই ঘটনায় খুশি হয়েছিল, কিন্তু আশ্চর্য হয়নি। সারা পৃথিবীতে, যিহোবার সাক্ষীরা তাদের মধ্যে সততা কোন ব্যতিক্রম নয়? সেটি হল একটি নিয়ম, সত্য খ্রীষ্টতত্ত্বের একটি প্রয়োজনীয় অংশ।
অবশ্য কখনও কখনও, পরিস্থিতির চাপে কোন্টি সৎ এবং কোন্টি অসৎ, তার মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিটি বিবেচনা করুন। ফেস্টাস, যিনি পশ্চিম আফ্রিকায় যিহোবার সাক্ষীদের একটি মণ্ডলীতে দান ও হিসাবের দেখাশোনা করতেন, তার কিছু টাকার অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।a তার স্ত্রীর একটি গুরুতর অপারেশনের প্রয়োজন ছিল এবং ডাক্তারেরা বলেছিলেন দেরি করা উচিত হবে না। হাসপাতাল অর্ধেক টাকা অগ্রীম চেয়েছিল।
ফেস্টাসের কাছে টাকা ছিল না। অনেকের কাছে ধার চাইলেও তারা দিতে অস্বীকার করে। তখন তার তত্ত্বাবধানে যে টাকা ছিল সেই সম্বন্ধে চিন্তা করে সে নিজেকে যুক্তি দেখিয়েছিল, ‘আমার স্ত্রীর মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হবে, যখন তা রোধ করতে আমি কিছু করতে পারি? মণ্ডলীর টাকা থেকে “ধার” নেওয়া যায় না কি? আমার কাছে যাদের ঋণ আছে, তারা টাকা ফেরত দিলেই আমিও ফিরিয়ে দেব।’
যে টাকা তার নয়, সেই টাকা ফেস্টাস হাসপাতালের খরচের জন্য ব্যবহার করেছিল। তার যুক্তি কি সঠিক ছিল? তারা জরুরী অবস্থার জন্য, তার কাজ কি ন্যায্য ছিল?
এটি কার টাকা?
এই প্রশ্নগুলি বিবেচনা করার সময়ে, ফেস্টাস যে টাকা নিয়েছিল তার উৎস এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আসুন আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করি। মণ্ডলীর সদস্যরা যারা যিহোবার সত্য উপাসনা আরও বাড়িয়ে তুলতে চায়, তাদের স্বেচ্ছাকৃত দানের মাধ্যমে সেই টাকা আসে। (২ করিন্থীয় ৯:৭) বেতন হিসাবে সেই টাকা ব্যবহার করা হয় না, কারণ মণ্ডলীতে কাজ করার জন্য কাউকে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। বরং, দান করা টাকা প্রধানত একটি সভাস্থল, যেমন কিংডম হল গ্রহণ করতে ও তার দেখাশোনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর মাধ্যমে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র—সকলে বাইবেল থেকে নির্দেশ পাওয়ার জন্য একটি উপযুক্ত ও সুবিধাজনক স্থানে আসতে পারে।
এটি কার টাকা? দলগতভাবে এটি মণ্ডলীর সম্পত্তি। টাকাটি কিভাবে ব্যয় করা হবে, সেই বিষয়ে কোন একজন ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নেয় না। মণ্ডলীর নিয়মিত খরচ প্রাচীনগোষ্ঠী দেখাশোনা করলেও, যখন কোন বিশেষ ব্যয়ের প্রয়োজন হয়, তখন প্রাচীনেরা সমস্ত মণ্ডলীর সামনে বিষয়টি তুলে ধরেন।
ধার অথবা চুরি?
টাকাটি যত শীঘ্র সম্ভব ফিরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার জন্য, ফেস্টাস তার কাজকে ধার করা হিসাবে দেখেছিল। কিন্তু, “না বলে অথবা মালিকের অনুমতি ছাড়া অন্যের সম্পত্তি নেওয়া অথবা সরানোকে” ওয়েবস্টার্স নিউ ডিক্শনারী অফ সিননিমস্ অন্য কিছু বলে। তাকে বলা হয় “চুরি” এবং “চোর” অনুমতি অথবা অধিকার ছাড়াই, ফেস্টাস মণ্ডলীর টাকা নিয়েছিল। সুতরাং, সে চুরিই করেছিল। সে চোর ছিল।
অবশ্যই, চুরির পিছনে উদ্দেশ্য অনুযায়ী দোষের মান নির্ধারণ করা হয়। আমরা তা দেখতে পাই ঈষ্করিয়তীয় যিহূদার উদাহরণ থেকে, যাকে যীশু এবং তাঁর বিশ্বস্ত প্রেরিতদের টাকার ভার দেওয়া হয়েছিল। বাইবেল বলে: “[যিহূদা] চোর, আর তাহার নিকটে টাকার থলী থাকতে তাহার মধ্যে যাহা রাখা যাইত, তাহা হরণ করিত।” (যোহন ১২:৬) মন্দ হৃদয় এবং লোভের দ্বারা পরিচালিত হয়ে, যিহূদা মন্দ থেকে অতি মন্দে পরিণত হয়েছিল। অবশেষে যে ঈশ্বরের পুত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল—৩০টি রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে।—মথি ২৬:১৪-১৬.
কিন্তু, ফেস্টাস তার অসুস্থ স্ত্রীর জন্য উদ্বেগের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। এর অর্থ কি যে তার কোন দোষ ছিল না? অবশ্যই ছিল। আপাতদৃষ্টিতে আরেকটি জরুরী অবস্থায় চুরি সম্বন্ধে ছিল। আপাতদৃষ্টিতে আরেকটি জরুরী অবস্থায় চুরি সম্বন্ধে বাইবেলে কী বলা হয়েছে তা বিবেচনা করুন: “যে ক্ষুধিত হইয়া প্রাণের তৃপ্তির জন্য চুরি করে, লোকে সেই চোরকে উপেক্ষা করে না; কিন্তু ধরা পড়িলে তাহাকে সপ্তগুণ ফিরাইয়া দিতে হইবে, তাহার গৃহের সর্ব্বস্বও সমর্পণ করিতে হইবে।” (হিতোপদেশ ৬:৩০, ৩১) আর এক কথায়, ধরা পড়লে, সেই চোরকে আইন অনুসারে সম্পূর্ণ শাস্তি পেতে হবে। মোশির নিয়ম অনুযায়ী, চোরকে তার অপরাধের মূল্য দিতে হত। সুতরাং চুরিকে উৎসাহ দেওয়া বা যুক্তি দেখানোর বদলে, বাইবেল সাবধান করে দেয় যে জরুরী অবস্থাতেও, চুরির ফল হতে পারে আর্থিক ক্ষতি, মর্যাদাহানি ও তার থেকেও গুরুতর, ঈশ্বরের অনুগ্রহ হারোনো।
যিহোবার সাক্ষী হিসাবে, সমস্ত সত্য খ্রীষ্টানদের বিশেষত যাদের মণ্ডলীতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের অনুকরণযোগ্য, “অনিন্দীয়” হতে হবে। (১ তীমথিয় ৩:১০) যে টাকা পাওয়ার আশা ফেস্টাস করছিল, তা সে পায়নি, যার ফলে যে টাকা সে নিয়েছিল তা ফিরিয়ে দিতে পারেনি। সে যা করেছিল, তা জানাজানি হয়ে পড়ে। তার কী হয়েছিল, সে যদি একজন অনুতাপহীন চোর হত, তাহলে তাকে বিশুদ্ধ খ্রীষ্টীয় মণ্ডলী থেকে বহিষ্কার করতে হত। (১ পিতর ৪:১৫) কিন্তু সে অত্যন্ত লজ্জিত এবং অনুতপ্ত হয়েছিল। সুতরাং, তাকে মণ্ডলীতে থাকতে দেওয়া হয়েছিল, অবশ্য পরিচর্যা করার বিভিন্ন সুযোগ সে হারিয়েছিল।
ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখা
প্রেরিত পৌল সাবধান করেছিলেন, যে ব্যক্তি দাবি করে যে সে যিহোবার পরিচর্যা করে, সে যদি চুরি করে তাহলে ঈশ্বরের নাম ও তাঁর নামধারী লোকেদের প্রতি অসম্মান নিয়ে আসে। পৌল লিখেছিলেন: “তুমি যে পরকে শিক্ষা দিতেছ, তুমি কি আপনাকে শিক্ষা দেও না? তুমি যে চুরি করিতে নাই বলিয়া প্রচার করিতেছ, তুমি কি চুরি করিতেছ? কেননা যেমন লিখিত আছে, সেইরূপ ‘তোমাদের হইতে জাতিগণের মধ্যে ঈশ্বরের নাম নিন্দিত হইতেছে’।”—রোমীয় ২:২১, ২৪.
প্রাচীনকালের একজন জ্ঞানী ব্যক্তি, আগূরও একই কথা বলেছিলেন। তার প্রার্থনায় তিনি চেয়েছিলেন যে তিনি যেন ‘দরিদ্র হয়ে চুরি না করেন ও [তার] ঈশ্বরের নাম অপব্যবহার না করেন।’ (হিতোপদেশ ৩০:৯) কিন্তু লক্ষ্য করুন যে সেই জ্ঞানী ব্যক্তি স্বীকার করেছিলেন যে দারিদ্র্য এমন পরিস্থিতি নিয়ে আসতে পারে যার জন্য এমনকি ধার্মিক ব্যক্তিও চুরি করার প্রলোভনে পড়তে পারে। হ্যাঁ, যিহোবার লোকেদের প্রয়োজনগুলির যত্ন নেওয়ার তাঁর ক্ষমতার উপরে একজন খ্রীষ্টানের বিশ্বাস, কষ্টকর সময়ের দ্বারা পরীক্ষিত হতে পারে।
তবুও, যিহোবার বিশ্বস্ত সাক্ষীদের, যাদের মধ্যে দরিদ্ররাও অন্তর্ভুক্ত, তাদের বিশ্বাস আছে যে “যাহারা [ঈশ্বরের] অন্বেষণ করে, তিনি তাহাদের পুরস্কারদাতা।” (ইব্রীয় ১১:৬) তারা জানে যে যিহোবা তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করেন, তাদের প্রয়োজনগুলির যত্ন নিতে সাহায্য করে। পর্বতে দত্ত উপদেশে যীশু তা স্পষ্ট করে দেন এই বলে: “ইহা বলিয়া ভাবিত হইও না যে, ‘কি ভোজন করিব?’ বা ‘বা কি পান করিব?’ বা ‘কি পরিব?’ . . . তোমাদের স্বর্গীয় পিতা ত জানেন যে এই সকল দ্রব্যে তোমাদের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তোমরা প্রথমে তাঁহার রাজ্য ও তাঁহার ধার্ম্মিকতার বিষয়ে চেষ্টা কর, তাহা হইলে ঐ সকল দ্রব্যও তোমাদিগকে দেওয়া হইবে।”—মথি ৬:৩১-৩৩.
খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীতে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের কিভাবে ঈশ্বর যত্ন করেন? বহু উপায়ে। একটি উপায় হল সহবিশ্বাসীদের মাধ্যমে। ঈশ্বরের লোকেরা একে অপরের প্রতি প্রকৃত প্রেম দেখায়। তারা বাইবেলের আদেশকে গুরুত্ব দেয়: “যাহার সাংসারিক জীবনোপায় আছে, সে আপন ভ্রাতাকে দীনহীন দেখিলে যদি তাহার প্রতি আপন করুণা রোধ করে, তবে ঈশ্বরের প্রেম কেমন করিয়া তাহার অন্তরে থাকে? বৎসেরা, আইস, আমরা বাক্যে কিম্বা জিহ্বাতে নয়, কিন্তু কার্য্যে ও সত্যে প্রেম করি।”—১ যোহন ৩:১৭, ১৮.
সারা পৃথিবীতে, ৭৩,০০০ মণ্ডলীতে সাড়ে চার লক্ষেরও বেশি যিহোবার সাক্ষী, ঈশ্বরের ধার্মিক নীতি অনুযায়ী তাঁর পরিচর্যা করতে কঠোর চেষ্টা করে। তারা জানে যে ঈশ্বর কখনও তাঁর বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের পরিত্যাগ করবেন না। যারা বহু বছর ধরে যিহোবার পরিচর্যা করেছেন তারা রাজা দায়ূদকে একবাক্যে সমর্থন করতে পারেন, যিনি লিখেছিলেন: “আমি যুবক ছিলাম, এখন বৃদ্ধ হইয়াছি, কিন্তু ধার্ম্মিককে পরিত্যক্ত দেখি নাই, তাহার বংশকে খাদ্য ভিক্ষা করিতে দেখি নাই।”—গীতসংহিতা ৩৭:২৫.
চুরি করার প্রলোভনে পড়ে হয়ত চিরকালের জন্য ঈশ্বরের অনুগ্রহ হারানোর তুলনায়, যিনি দায়ূদকে এই কথাগুলি বলতে প্রেরণা দিয়েছিলেন, তাঁর উপরে বিশ্বাস রাখা আরও কতই না বেশি ভাল!—১ করিন্থীয় ৬:৯, ১০.
[পাদটীকাগুলো]
a নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।