পাঠক-পাঠিকাদের থেকে প্রশ্নসকল
দিনের ঠিক যে-সময়ে যিশু খ্রিস্টকে বিদ্ধ করা হয়েছিল, তা কি নির্ণয় করা সম্ভব?
যিশুর মৃত্যু সম্বন্ধে মার্ক ও প্রেরিত যোহনের দ্বারা লিপিবদ্ধ অনুপ্রাণিত বিবরণে আপাতদৃষ্টিতে যে-অসামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়, সেটার কারণে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। মার্ক বলেন: “তৃতীয় ঘটিকার সময়ে তাহারা [সৈন্যরা] তাঁহাকে ক্রুশে দিল” বা বিদ্ধ করল। (মার্ক ১৫:২৫) যোহনের বিবরণ অনুযায়ী: পীলাত যখন যিশুকে বিদ্ধ করার জন্য যিহুদিদের হাতে সমর্পণ করেছিলেন, তখন “বেলা অনুমান ছয় ঘটিকা।” (যোহন ১৯:১৪-১৬) বাইবেল পণ্ডিতরা আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান এই বৈসাদৃশ্যকে সমাধান করার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিন্তু, এই দুটো বিবরণের মধ্যে অমিল ব্যাখ্যা করার মতো যথেষ্ট শাস্ত্রীয় তথ্য নেই। তা সত্ত্বেও, সেই সময়ে লোকেরা সময়কে যেভাবে দেখত, তা বিবেচনা করা সাহায্যকারী হতে পারে।
সাধারণ কাল প্রথম শতাব্দীতে, যিহুদিরা সূর্যোদয় থেকে গণনা শুরু করে দিনের সময়কে ১২ ঘন্টায় বিভক্ত করেছিল। (যোহন ১১:৯) তাই, ‘তৃতীয় ঘটিকা’ সকাল আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এবং “ছয় ঘটিকা” প্রায় মধ্যাহ্নে শেষ হতো। অবশ্য, বছরজুড়ে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হতো আর তাই ঋতুভেদে দিনের স্থায়িত্বে তারতম্য ঘটত। অধিকন্তু, সূর্যের অবস্থান লক্ষ করে দিনের সময় নির্ধারণ করা হতো। তাই, সময়ের যে-উল্লেখগুলো রয়েছে, সেগুলো অনুমানভিত্তিক ছিল। খ্রিস্টান গ্রিক শাস্ত্র সাধারণত এমন ঘটনাগুলো সম্বন্ধে উল্লেখ করে, যেগুলো তিন, ছয় অথবা নয় ঘটিকায়—বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটার অর্থ হল প্রায় সেই সময়ে—ঘটেছে। (লূক ২৩:৪৪; যোহন ১৯:১৪; প্রেরিত ১০:৩, ৯, ৩০) যখন বর্ণিত বিবরণের জন্য সময় প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, শুধুমাত্র সেই সময়েই আরও সুনির্দিষ্টভাবে সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে যেমন, ‘দশম ঘটিকায়’ অথবা ‘সপ্তম ঘটিকায়।’—যোহন ৪:৫২.
সুসমাচারের বিবরণগুলোতে পৃথিবীতে যিশুর জীবনের শেষ দিনে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার সময় সম্বন্ধে সামঞ্জস্য রয়েছে। চার জনের মধ্যে সকলেই এই ইঙ্গিত দেয় যে, যাজকরা ও প্রাচীনবর্গ ভোর হওয়ার পর একত্রে মিলিত হয়েছিল আর এরপর যিশুকে রোমীয় দেশাধ্যক্ষ পন্তীয় পীলাতের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। (মথি ২৭:১; মার্ক ১৫:১; লূক ২২:৬৬; যোহন ১৮:২৮) মথি, মার্ক ও লূক সকলেই তুলে ধরেছিল যে, ষষ্ঠ ঘটিকা অর্থাৎ যে-সময়ে যিশু ইতিমধ্যেই দণ্ডে বিদ্ধ ছিলেন, সেই সময় থেকে “নয় ঘটিকা পর্য্যন্ত” দেশ অন্ধকারময় হয়ে ছিল।—মথি ২৭:৪৫, ৪৬; মার্ক ১৫:৩৩, ৩৪; লূক ২৩:৪৪.
একটা যে-বিষয় হয়তো যিশুর বিদ্ধ হওয়ার সময়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তা হল: কোড়া বা চাবুক মারার বিষয়টাকে বিদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার একটা অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মাঝে মাঝে এই কোড়া মারার বিষয়টা এতই মারাত্মক ছিল যে, এর ফলে ব্যক্তি মারা যেত। যিশুর ক্ষেত্রেও, নিশ্চয়ই এই বিষয়টা ভীষণ কষ্টদায়ক ছিল, যে-কারণে সেই দণ্ডটা বহন করার জন্য আরেক জন ব্যক্তির প্রয়োজন হয়েছিল, যেটা যিশু প্রথমে একা বহন করতে শুরু করেছিলেন। (লূক ২৩:২৬; যোহন ১৯:১৭) যদি কোড়া মারার বিষয়টাকে বিদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার শুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে, তাহলে যে-সময়ে যিশুকে যাতনাদণ্ডে পেরেক দ্বারা বিদ্ধ করা হয়েছিল, তার আগে কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার কথা। এমনটা হতে পারে যে, কোনো লেখক সেই সময়ের প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন, যে-সময়ে কোড়া মারা শুরু হয়েছিল, আবার অন্য কেউ হয়তো সেই সময়ের প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলেন, যে-সময়ে সত্যিই বিদ্ধ করার ঘটনাটা ঘটেছিল। এই বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারে যে, কেন লেখকরা বিদ্ধকরণ সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন উল্লেখ করেছে।
প্রেরিত যোহন, অন্যান্য সুসমাচার লেখকদের কয়েক দশক পরে তার বিবরণ লিখেছিলেন। তাই, তিনি তাদের বিবরণগুলো দেখেছিলেন। এটা ঠিক যে, যোহন এমন একটা সময় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যেটা মার্কের দেওয়া সময়ের চেয়ে ভিন্ন বলে মনে হয়। কিন্তু, সেটা এই বিষয়ের স্পষ্ট প্রমাণ দেয় যে, মার্কের বিবরণকে যোহন নকল করেননি। যোহন ও মার্ক দুজনেই ঈশ্বরের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। যদিও সেই পার্থক্যটা ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট শাস্ত্রীয় তথ্য নেই কিন্তু আমরা সুসমাচারের বিবরণের ওপর আস্থা রাখতে পারি।