ডাকটিকিট সংগ্রহ—এক ঐকান্তিক শখ এবং লাভজনক ব্যবসা
ব্রিটেনের সচেতন থাক! প্রতিনিধি কর্তৃক
ফিল্যাটেলি, বা ডাকটিকিট সংগ্রহকে “জগতের বৃহত্তম শখ” বলা হয়। ব্রিটিশ ডাক সংস্কারক সার রোল্যান্ড হিলের (১৭৯৫-১৮৭৯) বক্তব্য অনুযায়ী, সর্বপ্রথমে ডাকটিকিটগুলো ছিল ‘ছোট ছোট ছাপানো কাগজ, পিছনদিকগুলো আঠাল, যাতে ব্যবহারকারীরা ঈষৎ তরল পদার্থ ব্যবহার করে তা চিঠিতে লাগাতে পারত।’ ‘ছোট ছোট ছাপানো কাগজগুলি’ এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে বর্তমানে ডাকটিকিটকে লোকে নতুন কিছু আবিষ্কারের সমপর্যায়ে প্রশংসা করে, যা পৃথিবীব্যাপী যোগাযোগের গতিবিধিকে বদলে দিয়েছে।
যারা ডাকটিকিট সংগ্রহ করে ও যারা এর ব্যবসা করে, তাদের কাছে ডাকঢিকিটের মূল্য কিছুই নয়, কিন্তু অন্যজনের কাছে এর মূল্য হল লক্ষ লক্ষ ডলার। এটা কিভাবে হতে পারে যেখানে ডাকটিকিট একটি অতি সাধারণ জিনিসের পর্যায়ে পড়ে? আর এই ডাকটিকিটকে কী আকর্ষণীয় ও মূল্যবান করে তোলে?
অদ্বিতীয় পেনী ব্ল্যাক
প্রথম হাতে ছাপানো স্ট্যাম্পগুলি যা ডাকমাশুল দেওয়াকে চিত্রিত করে, তা বণিক উইলিয়াম ডক্রের আবিষ্কার, যিনি ১৬৮০ সালে লন্ডন পেনী পোস্ট চালু করেছিলেন। সেখানে যেসব চিঠি জমা পড়তো, সেগুলির উপর দুলাইনের ত্রিকোণ স্ট্যাম্প লাগানো হত যাতে লেখা থাকত পেনী ডাকমাশুল দেওয়া হয়ে গেছে এবং তারপরে ডক্রের বাহকের জন্য তা প্রস্তুত করা হত। কিন্তু অন্যান্য ডাককর্মীরা ও শ্রমিকেরা এই ব্যবস্থার প্রতি তীব্র প্রতিবাদ জানায়, কারণ তারা মনে করেছিল যে তাদের জীবিকা বিপদাপন্ন হবে। সরকারী ডাক বিভাগও ডক্রের এই ডাকব্যবস্থাকে তাদের একচেটিয়া অধিকারের প্রতিবন্ধক বলে মনে করেছিল।
উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের বছরগুলিতে আগে সমস্ত দেশে কোনভাবেই ডাক সংস্কার পেনী ডাকটিকিটকে সহজলভ্য করাতে পারেনি। ১৮৪০ সালের মে মাসে প্রথম, আঠালাগানো ডাকটিকিট ব্রিটেনে বিক্রি করা হয় ও খুব শীঘ্রই পেনী ব্লাক নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। (ছবিতে দেখুন।) এগুলিতে কোন ফুটো ছিল না এবং প্রতিটি স্ট্যাম্পকেই বড় একটা কাগজ থেকে ছিড়ে নিতে হত।
১৮৪৩ সালে ব্রিটেনের পরে ব্রাজিল হল দ্বিতীয় দেশ যে সমস্ত দেশে ব্যবহারের জন্য বৈধ আঠালাগানো ডাকটিকিট চালু করে। আস্তে আস্তে অন্যান্য দেশগুলিও আভ্যন্তরীণ ডাকের ক্ষেত্রে তা চালু করে। পরবর্তীকালে সমুদ্র পারাপারের দেশগুলিতেও একটি জগদ্ব্যাপী ডাক সংস্থা গড়ে ওঠে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ডাক সংস্থা, যার প্রধান কার্যালয় হল সুইজারল্যান্ডের বার্ন নামক স্থানে, যা হল রাষ্ট্রসংঘের একটি বিশিষ্ট প্রতিনিধি।
ডাকটিকিট সংগ্রহ একটি গল্পের কথা বলে
আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা যতই বাড়তে থাকে, প্রতিটি দেশ তাদের স্বতন্ত্র ডাকটিকিটের রূপ দিতে ও ছাপাতে থাকে। এদের কতকগুলি স্মরণার্থক, যা বিশেষ বিশেষ ঘটনা ও ব্যক্তির বর্ণনা দেয়; অন্যগুলিকে বলা হয় নির্দিষ্টসূচক, যা নিয়মিত ব্যবহারের জন্য ডাকের বিভিন্ন প্রয়োজনাদির জন্য নানাপ্রকার মূল্যে পাওয়া যায়। বিগত বছরগুলিতে প্রায় ৬০০ ডাক সংস্থা বাৎসরিক প্রায় ১০,০০০টি নতুন ডাকটিকিট ছাপিয়েছে। ডাকটিকিটের মনোযোগী ছাত্রেরা (ডাকটিকিট সংগ্রহকারী) এবং যারা ডাকটিকিট জমানোতে আনন্দ পায়, উভয়েই সময় কাটানোর জন্য ও তাদের মানানসই শখের জন্য প্রায় আড়াই লক্ষ বিভিন্ন ধরনের ডাকটিকিটের উপযোগ করতে পারে!
এত বিপুল সংখ্যা ও বিবিধ রকমের ডাকটিকিট থাকার জন্য এককভাবে কারও পক্ষেই সমস্ত ডাকটিকিটের একটা করে কপি থাকা আশা করা উচিত নয়। যেজন্য অনেকেই নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে ডাকটিকিট জমাতে পছন্দ করে। সংগ্রহ করার কতকগুলি বিষয়বস্তু হল কৃষিকার্য, জন্তু, দক্ষিণ মেরুদেশীয়, মৌমাছি, বাইবেল, পাখি, সেতু, গুহা, চলচিত্র, কয়লা, দেশ, শক্তি, এসপেরান্ত, ইউরোপ, অগিন, আকাশযান, ফুল, ছত্রক, ভূবিদ্যা, শিল্প, চিকিৎসা বিদ্যা, সংগীত, অলিম্পিক খেলা, আলোকচিত্রবিদ্যা, ডাক সংক্রান্ত কাজ, রেড ক্রস, ধর্ম, গতিবিদ্যা, খেলাধূলা, যানবাহন, রাষ্ট্রসংঘ এবং এমনকি আবহাওয়াও। আপনি যে বিষয়ের উপরই চিন্তা করুন না কেন, ডাকটিকিট পাবেন।
অন্যান্য সংগ্রহকারীরা ডাকটিকিটের বিভিন্নতার উপরে মনোনিবেশ করে। তার মধ্যে কী বিষয় জড়িত? আর একবার পেনী ব্ল্যাকটার দিকে তাকিয়ে দেখুন। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন ডাকটিকিটের নিচের কোনাগুলিতে ছাপানো হরফে লেখা অক্ষরগুলি? প্রথমে এই ডাকটিকিটগুলিকে একটা কাগজের উপরে ছাপানো হত যাতে থাকতো ২৪০টি স্বতন্ত্র ডাকটিকিট আড়াআড়িভাবে ১২টি সারিতে সাজানো। উপরের সারির প্রথম ডাকটিকিটে AA লেখা থাকতো; ও শেষটিতে, AL এবং এইভাবে পৃষ্ঠার ২০ সারির শেষটিতে, অক্ষর অনুসারে প্রথমটিতে TA ও শেষটিতে TL. ডাকটিকিটের প্লেটের নকশা তৈরি করার সময়ে হাতে করে এই অক্ষরটিকে ছাপাতে হত। ডাকবিভাগের এক কর্মী যদি অনেক টিকিটের ওপরে একই রকম ছাপানো অক্ষর দেখতে পেত, তাহলে সেটাকে সে জালিয়াতি বলে সন্দেহ করত।
যদিও আজ প্রায় ৬৮০ লক্ষের মত পেনী ব্ল্যাক ডাকটিকিট বাজারে প্রচলিত, কিন্তু সংগ্রহকারীর কাছে যদি তার মধ্যে অব্যবহৃত দুএকটা টিকিট থাকে, তাহলে বলা যায় বিরল ও মূল্যবান,—যার মূল্য হয়তো ৪,২০০ ডলার থেকে ৬,৮০০ ডলারের মধ্যে।
ডাকটিকিট জমানোর জন্য যারা খুবই বিশেষজ্ঞ, তাদের কাছে নকশার অল্প তারতম্য, ছাঁচের পার্থক্য, ডাকটিকিটের বিভিন্ন প্রকার ওয়াটার মার্ক পার্থক্য (আলোর সামনে ধরলে কাগজে অস্পষ্ট নকশা লক্ষ্য করা যায়) ও সেইসঙ্গে টিকিটের (ধারে যে ফুটো থাকে) তার বিভিন্নতাও তাদের কাছে আগ্রহজনক। এইধরনের বিশেষজ্ঞদের সফলতা লাভ করার জন্য সন্না (কখনও আঙ্গুল ব্যবহার করবেন না) ও বিবর্ধিত কাচের চেয়ে অধিক কিছু প্রয়োজন। মাপিবার যন্ত্র ফুটোর পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে; অতি বেগুনি রশ্মি কোন কাটাছেড়া, গুপ্ত অনুপ্রভা ও অন্যান্য পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়ের সন্ধান দিতে পারে।
কিছু সংগ্রহকারী ডাকটিকিটের নকশা ও ছাপার ত্রুটিসকলের প্রতি বিশেষ নজর দেয়। তাদের কাছে এমন ডাকটিকিট সংগ্রহ করা যা অন্যেরা পারেনি, তা হল খুব বড় ব্যাপার। দামের পার্থক্যের কথা চিন্তা করুন। ১৯৯০ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৮৪১ পেনী রেড টিকিটটিতে A অক্ষরটি নেই, অর্থাৎ দ্বিতীয় সারির প্রথম ডাকটিকিটে ভুলবশত সংখ্যাটি আসেনি, কিন্তু ওই টিকিটটির ত্রুটিহীন একটার মূল্য হল আসল দামের থেকে ১,৩০০ গুণ অধিক!
ডাকটিকিট এক লাভজনক ব্যবসা
আজকালকার দিনে ডাকটিকিটের শখ বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগকারীকে আকর্ষণ করে। প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান ডাকটিকিটের সেট কিনে নেয়, কারণ ব্যবসায়ীরা মনে করে এক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার মূল্য বৃদ্ধি পাবে। যখন বিনিয়োগের কাল পূর্ণ হয়, তখন ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ মূল্যে তাদের মক্কেলের ডাকটিকিট বিক্রয় করার পরিকল্পনা নেয়। “ডাকবিভাগের দ্বারা ব্যবহৃত ডাকটিকিটগুলি হওয়া চাই হালকা ও স্পষ্টভাবে ছাপলাগানো—প্রায়ই অতি সাধারণ টিকিটও সঠিক ছাপ না থাকার জন্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়, ফলে যার মূল্য হয়ে যায় অত্যধিক। ডাকটিকিটের পরিচ্ছন্নতার উপর তার দাম নির্ভর করে,” ডাকটিকিট কর্তৃপক্ষ জেমস্ ওয়াটসন একথা লেখেন।
১৯৭৯ সালে লন্ডনের ডেলী মেল রিপোর্টে জানায় যে “বিগত পাঁচ বছরে অতি উচ্চমূল্যের ডাকটিকিটগুলির (যেগুলি ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ সময়ের মধ্যে) মূল্য শেয়ার ও অন্যান্য বিনিয়োগের থেকে আরও বেশি হারে বেড়ে চলেছে আর এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ঘরবাড়ির দামের থেকেও।” সাতটি দুষ্প্রাপ্য ডাকটিকিটের একটি সেট, যার ১৯৭৪ সালের মূল্য ছিল ৮৪,৭০০ ডলার, এখন তার দাম হয়েছে ৩০৬,০০০ ডলার।
১৯৯০ সালে, একটি টাইম ইনটারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্টে বলে: “বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ডাকটিকিটের মূল্য উঠানামা করেছে। ফাটকাবাজরা দুষ্প্রাপ্য ডাকটিকিট থেকে মুনাফা করার জন্য ইনভেস্টমেন্ট পোর্টফোলিও (investment portfolio) গড়ে তোলে ফলত ১৯৯০ এর দশকে এর দাম অত্যাধিক হারে বেড়ে যায়। কিন্তু যখন ১৯৮০ সালে লন্ডনে আন্তর্জাতিক ডাকটিকিট প্রদর্শনী হয়, তখন তাদের সেই আশা সুপ্ত হয়ে যায় ও ফাটকাবাজরা দেখে যে বাজার ভাল করতে পারত ডাকটিকিট সংগ্রহকারীরা কিন্তু তারা বিজ্ঞতার সাথে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ‘যখন বিনিয়োগকারীরা তাদের ডাকটিকিট বিক্রি করার চেষ্টা করে, তখন তারা দেখে যেগুলিকে তারা দুষ্প্রাপ্য ভেবেছিল, এখন আর সেগুলি দুষ্প্রাপ্য নয়,’” এবং তারা তাদের আশা মত মুনাফা করতে ব্যর্থ হয়। যারা ডাকটিকিটের জন্য বিনিয়োগ করে থাকে, তাদের জন্য কী সতর্কবার্তাই না বটে!
সুতরাং, সংগ্রহকারী হিসাবে অথবা এমনকি একজন ডাকটিকিট সংগ্রহকারী হিসাবে ভারসাম্যতার প্রতি নজর দিন। আপনার ডাকটিকিটগুলি উপভোগ করুন। সেগুলি থেকে শিখুন—জগৎ, তার ভৌগলিক বিষয়গুলি, সেখানকার মানুষ ও তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে। ডাকটিকিট সংগ্রহ করাকে এক বদ্ধ আবেশে পরিণত করবেন না। যত্নসহকারে ডাকটিকিটের মূল্যায়ণ করুন ও জীবনের আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে তার সঠিক স্থান নির্ণয় করুন। (g95 1/8)
[১৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
পেনী ব্ল্যাক
[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]
অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন এবং স্পেনের ডাকটিকিট