আপনি কি বাইবেলে বিশ্বাস করতে পারেন?
এমনকি আজকের এই আধুনিক জগতেও প্রচুর লোক বাইবেলে বিশ্বাস করেন। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকাবাসীদের উপর অল্প কিছুদিন আগে নেওয়া এক সমীক্ষা দেখায় যে ৮০ শতাংশ লোক বিশ্বাস করেন যে বাইবেল ঈশ্বরের অনুপ্রাণিত বাক্য। আপনার এলাকার শতকরা হার এতটাই বেশি হোক বা না হোক, আপনি বুঝতে পারেন যে এই বিশ্বাসী লোকেরা আশা করেন যে গির্জা তাদের বাইবেল সম্বন্ধে শেখাবে। কিন্তু প্রায়ই তারা তা করে না। উদাহরণ হিসাবে মৃত্যুর পরে শাস্তি ভোগের মতবাদটির কথাই চিন্তা করুন।
বাইবেল কি কোথাও পুরগাতরি বা এক অগ্নিময় নরক সম্বন্ধে শিক্ষা দেয়? আজকে খ্রীষ্টীয়জগতের অনেক বিশেষজ্ঞ উত্তর দেবেন, না। নতুন ক্যাথলিক বিশ্বকোষ (ইংরাজি) বলে: “চূড়ান্ত বিশ্লেষণে জানা যায় যে পুরগাতরি সম্বন্ধে ক্যাথলিক মতবাদের ভিত্তি পবিত্র শাস্ত্র নয় কিন্তু পরম্পরাগত বিধি।” নরক সম্বন্ধে খ্রীষ্টীয় ঈশ্বরতত্ত্ব সম্বন্ধীয় শব্দকোষ (ইংরাজি) মন্তব্য করে: “প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের প্রচারের বিষয়বস্তু হিসাবে নরকাগ্নির কথা আমরা নতুন নিয়মে খুঁজে পাই না।”
বস্তুতপক্ষে, সম্প্রতি চার্চ অফ ইংল্যান্ডের মতবাদ সমিতি যখন নরকাগ্নির শিক্ষাকে বাতিল করেছিল, তারা এটিকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছিল। লিচফিল্ড গির্জার প্রধান যাজক ড. টম রাইট বলেন যে পূর্বের নরকের ধারণা “ঈশ্বরকে দানব হিসাবে তুলে ধরত আর অনেককে মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করত।” সমিতির বিবৃতি নরক সম্বন্ধে জানায় যে “এর একেবারেই অস্তিত্ব নেই।”a একইভাবে নতুন ক্যাথলিক বিশ্বকোষ ক্যাথলিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে এইভাবে বর্ণনা করে: “আজকে ধর্মতত্ত্ব নরককে এমন এক স্থান হিসাবে দেখে যেটি দৈহিক যন্ত্রণাভোগের জায়গা নয় কিন্তু ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন এক স্থান।”
প্রকৃতপক্ষে বাইবেল মৃতদের অবস্থা সম্বন্ধে যা শিক্ষা দেয় তা পুরগাতরি ও নরকাগ্নির শিক্ষার একেবারে বিপরীত। বাইবেল অনুসারে মৃতেরা অচেতন আর তাই তারা কোন যন্ত্রণা অনুভব করতে পারে না। “জীবিত লোকেরা জানে যে, তাহারা মরিবে; কিন্তু মৃতেরা কিছুই জানে না।” (উপদেশক ৯:৫) বাইবেল মৃতদের জন্য ভবিষ্যৎ পুনরুত্থানের আশা প্রদান করে। যখন যীশুর বন্ধু লাসার মারা গিয়েছিলেন যীশু মৃত্যুকে ঘুমের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। লাসারের বোন মার্থা বাইবেলের শিক্ষা অনুযায়ী আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন: “আমি জানি, শেষ দিনে পুনরুত্থানে সে উঠিবে।” লাসারকে মৃত্যু থেকে উঠিয়ে যীশু মানবজাতির জন্য সেই আশাকে দৃঢ় করেছিলেন।—যোহন ৫:২৮, ২৯; ১১:১১-১৪, ২৪, ৪৪.
ইতিহাসবেত্তারা বলেন যে মানুষের ভিতরে আলাদা কোন অমর বস্তু রয়েছে, এই শিক্ষার উৎপত্তি বাইবেল থেকে নয় কিন্তু গ্রীক দর্শন থেকে এসেছে। নতুন ক্যাথলিক বিশ্বকোষ জানায়, প্রাচীন ইব্রীয়রা মানুষকে একটি ভৌতিক দেহ ও অদৃশ্য কোন বস্তুর সংমিশ্রণ হিসাবে দেখতেন না।
একই বিশ্বকোষ বলে সম্প্রতি ক্যাথলিক পণ্ডিতেরা “সমর্থন করেছেন যে নতুন নিয়ম আত্মার অমরত্ব সম্বন্ধে শেখায় না যেমন [গ্রীক] দর্শন তা শিক্ষা দেয়।” উপসংহারে এটি বলে: “এই সমস্যাটির চূড়ান্ত সমাধান দার্শনিক অনুমানে নয় কিন্তু পুনরুত্থানের অলৌকিক দানের মধ্যে রয়েছে।”
বাইবেল না পরম্পরাগত বিধি?
তাহলে কিভাবে বাইবেলে নেই এমন বিষয়গুলি গির্জার শিক্ষার সঙ্গে জুড়ে গেছে? অনেক গির্জা স্বীকার করে যে বাইবেল তাদের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, অল্প কয়েকদিন আগে, জন পল দ্বিতীয় বলেছিলেন যে শাস্ত্রকে “ক্যাথলিকদের সম্পূর্ণ সত্য ও তাদের বিশ্বাসের চূড়ান্ত নিয়ামক হিসাবে গ্রহণ করা” প্রয়োজন। কিন্তু সাধারণত লোকেরা মেনে নেন যে আজকে খ্রীষ্টীয়জগতের শিক্ষা প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানদের শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। অনেক গির্জা এই পরিবর্তনকে গির্জার মতবাদের ক্রমশ বিকাশ, তাদের অগ্রগতির অংশ হিসাবে দেখে থাকে। এছাড়াও ক্যাথলিক গির্জা মনে করে যে গির্জার পরম্পরাগত বিধির শাস্ত্রের মতোই সমান কর্তৃত্ব বা গুরুত্ব রয়েছে। নতুন ক্যাথলিক বিশ্বকোষ বলে, গির্জা “মনে করে যে তাদের মতবাদের ভিত্তি, পরম্পরাগত শিক্ষাকে বাদ দিয়ে শুধু শাস্ত্র কিংবা শাস্ত্রকে বাদ দিয়ে শুধু পরম্পরাগত শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।”
ইতিহাস অনুযায়ী গির্জাগুলি শাস্ত্রীয় শিক্ষাকে বাতিল করে কেবল পরম্পরাগত বিধিকে গ্রহণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে এখন অনেক গির্জা বাইবেলের শিক্ষাকে ভুল বলে মনে করে। উদাহরণস্বরূপ নতুন ক্যাথলিক বিশ্বকোষ বলে, এটি “স্পষ্ট যে যখন আধুনিক বিজ্ঞান ও ইতিহাসের আলোকে বিচার করা হয় তখন বাইবেলের অনেক তথ্য সাধারণভাবে অসত্য বলে মনে হয়।” মৃতেরা অচেতন এই বিষয়ে বাইবেলের শিক্ষা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে এটি আরও বলে: “এমনকি ধর্মীয় বিষয়েও যেমন মৃত্যুর পরে জীবন সম্পর্কে পুরাতন নিয়ম এক অসম্পূর্ণ ধারণা দিয়ে থাকে।” বিশ্বকোষ এর একটি উদাহরণ হিসাবে গীতসংহিতা ৬:৫ (কোন কোন বাইবেলে ৬ পদ) পদটি উল্লেখ করে: “মৃত্যুতে তোমাকে স্মরণ করা যায় না, পাতালে কে তোমার স্তব করিবে?” কিছু প্রটেস্টান্ট শিক্ষাকেন্দ্র ও শিক্ষালয়গুলি শেখায় না যে বাইবেল নির্ভুল। অন্যদিকে ক্যাথলিক গির্জা মনে করে যে গির্জার শিক্ষা দেওয়ার অধিকার আছে আর এই অধিকারে তারা বাইবেলে যা শেখানো হয়েছে তার ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু, আপনি হয়ত ভাববেন ‘যদি এই ব্যাখ্যা শাস্ত্রসংগত না হয় তাহলে কী হবে?’
শাস্ত্রের গুরুত্ব
যীশু বার বার তাঁর কথার ভিত্তি হিসাবে শাস্ত্র উল্লেখ করেছিলেন আর প্রায়ই তিনি তাঁর বিষয়বস্তু শুরু করতেন এই কথা বলে: “লেখা আছে।” (মথি ৪:৪, ৭, ১০; লূক ১৯:৪৬) তাই প্রকৃতই যখন যীশু মানুষের বৈবাহিক সম্বন্ধের বিষয়ে কথা বলেছিলেন তিনি গ্রীক দার্শনিক ধারণাকে তুলে ধরেননি কিন্তু আদিপুস্তকের সৃষ্টির বিবরণ থেকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। (আদিপুস্তক ১:২৭; ২:২৪; মথি ১৯:৩-৯) স্পষ্টতই যীশু শাস্ত্রকে ঈশ্বর অনুপ্রাণিত ও সত্য বলে বিবেচনা করেছিলেন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনায় তিনি বলেছিলেন: “তোমার বাক্যই সত্যস্বরূপ।”—যোহন ১৭:১৭.b
যীশু তাঁর দিনের যিহূদী নেতাদের ভর্ৎসনা করেছিলেন আর বাইবেল এইভাবে সেটি বর্ণনা করে: “পরম্পরাগত বিধি পালনের নিমিত্ত তোমরা ঈশ্বরের আজ্ঞা বিলক্ষণ অমান্য করিতেছ। . . . এইরূপে তোমাদের সমর্পিত পরম্পরাগত বিধি দ্বারা তোমরা ঈশ্বরের বাক্য নিষ্ফল করিতেছ।” (মার্ক ৭:৬-১৩) একইভাবে প্রেরিত পৌল তার শিক্ষায় গ্রীক দর্শন অথবা ভুল পরম্পরাগত শিক্ষাকে গ্রহণ করার চাপকে প্রতিরোধ করেছিলেন। “দেখিও,” তিনি বলেছিলেন। “দর্শনবিদ্যা ও অনর্থক প্রতারণা দ্বারা কেহ যেন তোমাদিগকে বন্দি করিয়া লইয়া না যায়; তাহা মনুষ্যদের পরম্পরাগত শিক্ষার অনুরূপ।” (কলসীয় ২:৮; ১ করিন্থীয় ১:২২, ২৩; ২:১-১৩) কিন্তু শাস্ত্র ভিত্তিক বা শাস্ত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল আছে এমন কিছু পরম্পরাগতবিধি বা শিক্ষাকে মেনে চলার জন্য পৌল খ্রীষ্টানদের উৎসাহিত করেছিলেন। (২ থিষলনীকীয় ২:১৩-১৫) “ঈশ্বর-নিশ্বসিত প্রত্যেক শাস্ত্রলিপি . . . উপকারী,” পৌল লিখেছিলেন, “যেন ঈশ্বরের লোক পরিপক্ব, সমস্ত সৎকর্ম্মের জন্য সুসজ্জীভূত হয়।”—২ তীমথিয় ৩:১৬, ১৭.
পৌল শাস্ত্র থেকে দূরে সরে যাওয়ার বিষয়টি আগে থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি তীমথিয়কে সাবধান করেছিলেন: ‘এমন সময় আসিবে, যে সময় লোকেরা নিরাময় শিক্ষা সহ্য করিবে না, . . . সত্য হইতে কাণ ফিরাইবে।’ তিনি তীমথিয়কে উৎসাহিত করেছিলেন: “কিন্তু তুমি সর্ব্ববিষয়ে মিতাচারী হও।” (২ তীমথিয় ৪:৩-৫) কিন্তু কিভাবে? একটি উপায় হচ্ছে “ভদ্র” হয়ে। গ্রীক শব্দকোষ বাইবেলের এই শব্দটিকে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করে: “শিখতে ইচ্ছুক থাকা ও যুক্তিসংগতভাবে কোন কিছুর মূল্যায়ন করা।” লূক এই অভিব্যক্তিটি পৌলের প্রথম শতাব্দীর শ্রোতা বিরয়াবাসীদের উদ্দেশে ব্যবহার করেছিলেন। পৌলের শিক্ষা তাদের কাছে নতুন ছিল, ফলে তারা ভুল পথে পরিচালিত হতে চাননি। তাদের প্রশংসা করে লূক লিখেছিলেন: “থিষলনীকীর যিহূদীদের অপেক্ষা [বিরয়াবাসীরা] ভদ্র ছিল; কেননা ইহারা সম্পূর্ণ আগ্রহপূর্ব্বক বাক্য গ্রহণ করিল, আর এ সকল বাস্তবিকই এইরূপ কি না, তাহা জানিবার জন্য প্রতিদিন শাস্ত্র পরীক্ষা করিতে লাগিল।” ভদ্র হওয়ার কারণে তারা সন্দেহপ্রবণ ছিলেন না বা কোন কিছুই বিশ্বাস না করার মনোভাব গড়ে তোলেননি। বরং সততার সঙ্গে অনুসন্ধান করায় “তাহাদের মধ্যে অনেকে, . . . বিশ্বাস করিলেন।”—প্রেরিত ১৭:১১, ১২.
বাইবেলের মান অনুযায়ী জীবনযাপন করার উপকারগুলি
প্রাথমিক খ্রীষ্টানেরা বাইবেলের প্রতি তাদের একনিষ্ঠতা ও তাদের আত্মত্যাগমূলক প্রেম, এই দুটি বিষয়ের জন্যই উল্লেখযোগ্য ছিলেন। কিন্তু আজকে অনেকেই “ভক্তির অবয়বধারী, কিন্তু তাহার শক্তি অস্বীকারকারী।” (২ তীমথিয় ৩:৫) মূল খ্রীষ্টতত্ত্ব থেকে সরে আসা বর্তমানের যে কোন ধরনের খ্রীষ্টতত্ত্বের লোকেদের জীবনকে ভালর দিকে পরিবর্তিত করার জন্য কোন শক্তি নেই। এটি কি ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে কেন খ্রীষ্টীয়জগতের বেশিরভাগ অংশে আমরা দৌরাত্ম্য, অনৈতিকতা, পারিবারিক ভাঙন এবং বস্তুবাদ দেখতে পাই? কিছু “খ্রীষ্টান” দেশগুলিতে এমনকি একই ধর্মের সদস্যদের মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ জাতিগত যুদ্ধগুলি হয়ে থাকে।
বিরয়াবাসীদের ভদ্র মনোভাব কি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে? আজকেও কি কোন দল আছে যারা বাইবেলে বিশ্বাস করেন ও বাইবেলের মান অনুযায়ী জীবনযাপন করেন?
এনসাইক্লোপিডিয়া কানাডিয়ানা উল্লেখ করে: “যিহোবার সাক্ষীদের কাজ আমাদের কালের প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে যীশু ও তাঁর শিষ্যরা যে প্রাথমিক খ্রীষ্টতত্ত্ব মেনে চলতেন তার পুনঃপ্রবর্তন ও পুনর্প্রতিষ্ঠামূলক।” সাক্ষীদের কথা উল্লেখ করে নতুন ক্যাথলিক বিশ্বকোষ জানায়: “তারা বাইবেলকে তাদের বিশ্বাসের একমাত্র উৎস ও তাদের আচরণের একমাত্র বিধান হিসাবে গণ্য করেন।”
নিঃসন্দেহে, এটি একটি বড় কারণ যে জন্য পৃথিবী জুড়ে যিহোবার সাক্ষীরা তাদের আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি, শান্তি ও আনন্দের জন্য সুপরিচিত। তাই আমরা আমাদের পাঠকদের উৎসাহিত করি যে তারা যেন বাইবেলের আধ্যাত্মিক উপকারী শিক্ষাগুলি সম্বন্ধে আরও বেশি করে জানেন। গভীর জ্ঞান নিলে তা বাইবেলের উপর আরও বেশি আস্থা ও ঈশ্বরের প্রতি আরও শক্তিশালী বিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এই বিশ্বাসের অনন্তকালীন উপকারগুলি তাদের প্রচেষ্টার উপযুক্ত ফল।
[পাদটীকাগুলো]
a ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও—“প্রভাতি অনুষ্ঠান”
b বাইবেলের নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে আরও তথ্যের জন্য ওয়াচটাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত সমস্ত লোকের জন্য একটি পুস্তক (ইংরাজি) নামক ব্রোশারটি দেখুন।
[৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
প্রেরিত পৌল ও অন্যান্যেরা বাজারে শিক্ষা দিতেন
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
যিহোবার সাক্ষীরা “বাইবেলকে তাদের বিশ্বাসের একমাত্র উৎস ও তাদের আচরণের একমাত্র বিধান হিসাবে গণ্য করেন”