কেন এত দুঃখকষ্ট?
কেন এত দুঃখকষ্ট রয়েছে আর এগুলো দূর করার জন্য মানুষের প্রচেষ্টা কেন ব্যর্থ হয়েছে, তা বোঝার জন্য আমাদের এগুলোর পিছনে প্রকৃত কারণগুলো শনাক্ত করা প্রয়োজন। যদিও এর কারণগুলো বিভিন্ন প্রকারের ও জটিল, তবুও আমরা কৃতজ্ঞ থাকতে পারি যে, বাইবেল আমাদের সেগুলো শনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে। কেন এত দুঃখকষ্ট রয়েছে, সেটার পাঁচটা মূল কারণ আমরা এই প্রবন্ধে পরীক্ষা করে দেখব। বাইবেল যা বলে, তা যত্নপূর্বক বিবেচনা করার ও গভীরে গিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রকৃত কারণ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে, ঈশ্বরের বাক্য যেভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে, তা দেখার জন্য আমরা আপনাকে আমন্ত্রণ জানাই।—২ তীমথিয় ৩:১৬.
◼ মন্দ সরকারের প্রভাব
বাইবেল বলে: “দুষ্ট লোক কর্ত্তৃত্ব পাইলে প্রজারা আর্ত্তস্বর করে।”—হিতোপদেশ ২৯:২.
ইতিহাসে এমন অনেক একনায়ক শাসকদের বিষয়ে লেখা আছে, যারা নিষ্ঠুরভাবে শাসন করত, তাদের প্রজাদের ওপর অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট নিয়ে আসত। এটা ঠিক যে, সমস্ত শাসকের ক্ষেত্রে তা সত্য নয়। কারো কারো হয়তো তাদের দেশের লোকেদের জন্য উত্তম উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু, একবার ক্ষমতা লাভ করার পর তারা দেখে যে, তাদের প্রচেষ্টাগুলো নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াইয়ের ফলে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। অথবা তারা হয়তো ব্যক্তিগত স্বার্থে এমনকী লোকেদের ক্ষতি করে হলেও তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন সচিব হেনরি কিসিংগার বলেন, “ইতিহাস হল ব্যর্থ প্রচেষ্টা আর অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার কাহিনি।”
এ ছাড়া, বাইবেল তুলে ধরে: “মনুষ্যের পথ তাহার বশে নয়, মনুষ্য চলিতে চলিতে আপন পাদবিক্ষেপ স্থির করিতে পারে না।” (যিরমিয় ১০:২৩) অসিদ্ধ মানুষদের তাদের নিজস্ব কাজকর্ম সফলভাবে সংগঠিত করার প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। লোকেরা যদি নিজেদের পাদবিক্ষেপ স্থির করতে না পারে, তাহলে তারা কীভাবে একটা দেশকে পরিচালনা করতে পারবে? আপনি কি বুঝতে পারছেন, কেন মানবশাসকদের পক্ষে দুঃখকষ্ট দূর করা অসম্ভব? আসলে, বেশিরভাগ সময়ই মন্দ সরকার কিংবা শাসনব্যবস্থা দুঃখকষ্টের জন্য দায়ী।
◼ মিথ্যা ধর্মের প্রভাব
যিশু বলেছিলেন: “তোমরা যদি আপনাদের মধ্যে পরস্পর প্রেম রাখ, তবে তাহাতেই সকলে জানিবে যে, তোমরা আমার শিষ্য।”—যোহন ১৩:৩৫.
প্রত্যেক ধর্ম ও সম্প্রদায়ের গুরুরা প্রেম ও একতার বিষয়ে প্রচার করে থাকে। প্রকৃত বিষয়টা হল, তারা তাদের অনুসারীদের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করার মতো প্রেম গেঁথে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রেম গড়ে তুলতে সাহায্য করার পরিবর্তে, ধর্ম প্রায়ই লোকেদের ও সাম্প্রদায়িক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ, গোঁড়ামি ও শত্রুতায় ইন্ধন জোগায়। ঈশ্বরতত্ত্ববিদ হ্যান্স কুং তার খ্রিশ্চিয়ানিটি অ্যান্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়ান্স বইয়ের উপসংহারে লিখেছেন: “সবচেয়ে বর্বর, নির্মম রাজনৈতিক লড়াই হল সেগুলো, যেগুলোকে ধর্ম প্রভাবিত করেছে, উসকে দিয়েছে ও সমর্থন জুগিয়েছে।”
এ ছাড়া, অনেক ধর্মের নেতারা বিবাহপূর্ব ও বিবাহবহির্ভূত যৌনতা আর সেইসঙ্গে সমকামিতাকে খোলাখুলিভাবে মেনে নেয়। এর ফল হল, রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়া, গর্ভপাত, অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ, বিবাহ ও পরিবারে ভাঙন, যেগুলো অবর্ণনীয় কষ্ট ও মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে আসে।
◼ মানুষের অসিদ্ধতা ও স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা
“প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কামনা দ্বারা আকর্ষিত ও প্ররোচিত হইয়া পরীক্ষিত হয়। পরে কামনা সগর্ভা হইয়া পাপ প্রসব করে।”—যাকোব ১:১৪, ১৫.
উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অসিদ্ধতার কারণে আমরা সবাই ভুল করি আর আমাদেরকে ‘মাংসের বিবিধ ইচ্ছা পূর্ণ করিবার’ আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। (ইফিষীয় ২:৩) কিন্তু, যখন মন্দ আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার সুযোগ চলে আসে, তখন সেটার বিরুদ্ধে লড়াই করা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা যদি ক্ষতিকর আকাঙ্ক্ষাগুলোর কাছে নতিস্বীকার করি, তাহলে ফলাফল খুবই বিপদজনক হতে পারে।
লেখক পি. ডি. মেহতা লিখেছেন: “অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুঃখকষ্টের কারণ হল, আমাদের নিজেদের লালসা, অনিয়ন্ত্রিত আমোদপ্রমোদ ও নিজের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার আকাঙ্ক্ষা, আমাদের লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা।” মদ, ড্রাগ, জুয়া, যৌনতা ও এইরকম অন্যান্য আকাঙ্ক্ষা ও আসক্তি অনেক “সম্মাননীয় নাগরিকের” জীবন নষ্ট করে দিয়েছে ও তাদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও অন্যদের জন্য দুঃখকষ্ট নিয়ে এসেছে। মানবজাতির অসিদ্ধ স্বভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাইবেলের এই কথার সঙ্গে আমাদের একমত হওয়া উচিত: “আমরা জানি, সমস্ত সৃষ্টি এখন পর্য্যন্ত একসঙ্গে আর্ত্তস্বর করিতেছে, ও একসঙ্গে ব্যথা খাইতেছে।”—রোমীয় ৮:২২.
◼ মন্দ আত্মাদের প্রভাব
বাইবেল জানায় যে, শয়তান হল “এই যুগের দেব” আর এটাও জানায় যে, তার সঙ্গে শক্তিশালী মন্দ আত্মারাও যোগ দিয়েছে, যারা হল মন্দদূত।—২ করিন্থীয় ৪:৪; প্রকাশিত বাক্য ১২:৯.
শয়তানের মতো এই মন্দদূতেরাও লোকেদের নিয়ন্ত্রণ ও বিভ্রান্ত করার কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছে। প্রেরিত পৌল এই বিষয় স্বীকার করেছিলেন, যখন তিনি বলেছিলেন: “রক্তমাংসের সহিত নয়, কিন্তু আধিপত্য সকলের সহিত, কর্ত্তৃত্ত্ব সকলের সহিত, এই অন্ধকারের জগৎপতিদের সহিত, স্বর্গীয় স্থানে দুষ্টতার আত্মাগণের [বা মন্দদূতদের] সহিত আমাদের মল্লযুদ্ধ হইতেছে।”—ইফিষীয় ৬:১২.
যদিও মন্দদূতেরা লোকেদের হয়রান করে আনন্দ পায়, কিন্তু এটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য নয়। তাদের ইচ্ছা হল, সর্বমহান ঈশ্বর যিহোবার কাছ থেকে লোকেদের দূরে সরিয়ে নেওয়া। (গীতসংহিতা ৮৩:১৮) জ্যোতিষীবিদ্যা, জাদুক্রিয়া, মায়াবিদ্যা ও ভবিষ্যৎ কথন হল কয়েকটা উপায়, যেগুলোর দ্বারা মন্দদূতেরা লোকেদের প্রতারিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। এই কারণেই যিহোবা সেই বিপদগুলো সম্বন্ধে আমাদের সাবধান করেন এবং যারা শয়তান ও মন্দদূতেদের প্রতিরোধ করে, তাদের সুরক্ষা প্রদান করেন।—যাকোব ৪:৭.
◼ আমরা “শেষ কালে” বাস করছি
প্রায় দু-হাজার বছর আগে বাইবেল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল: “ইহা জানিও, শেষ কালে বিষম সময় উপস্থিত হইবে।”
কোন বিষয়গুলো এই সময়কে আরও বিষম বা কঠিন করে তুলবে, তা নির্দেশ করতে গিয়ে এটি বলে চলে: “কেননা মনুষ্যেরা আত্মপ্রিয়, অর্থপ্রিয়, আত্মশ্লাঘী, অভিমানী, . . . স্নেহরহিত, ক্ষমাহীন, অপবাদক, অজিতেন্দ্রিয়, প্রচণ্ড, সদ্বিদ্বেষী, বিশ্বাসঘাতক, দুঃসাহসী, গর্ব্বান্ধ, ঈশ্বরপ্রিয় নয়, বরং বিলাসপ্রিয় হইবে।” নিশ্চিতভাবেই আজ আমরা যেসমস্ত দুঃখকষ্ট দেখি, সেগুলোর কারণ হল, আমরা “শেষ কালে” বাস করছি।—২ তীমথিয় ৩:১-৪.
আমরা যে-কারণগুলো বিবেচনা করলাম, সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এটা কি স্পষ্ট নয় যে, ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও কেন মানুষ দুঃখকষ্ট দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে? তাহলে, আমরা সাহায্যের জন্য কোথায় যেতে পারি? আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের সৃষ্টিকর্তার ওপর আশা রাখতে হবে, যিনি “দিয়াবলের” ও তার অনুসারীদের ‘কার্য্য সকল লোপ করিবার’ প্রতিজ্ঞা করেছেন। (১ যোহন ৩:৮) ঈশ্বর দুঃখকষ্টের সমস্ত কারণ দূর করার জন্য কী করবেন, তা পরবর্তী প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে। (w১৩-E ০৯/০১)
[৪ পৃষ্ঠার চিত্র]