আমাদের এক দুর্লভ বায়ুমণ্ডল
৪ঠা মে, ১৯৬১ সালে, ম্যালকম রস্ ও ভিক্ প্রাথারকে পৃথিবীর মাটি থেকে প্রায় ৩৪.৬ কিলোমিটার উচ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সময় নতুন রেকর্ড স্থাপন, রসের কাছে যতটা না অর্থ রেখেছিল, তার চাইতে বেশি তিনি বিস্মিত হয়ে পড়েছিলেন যখন প্রথমবার তিনি অতি সন্তর্পণে বেলুনের খিড়কিটি খুলে বাইরের দৃশ্যটি লক্ষ্য করেন।
“আমরা যখন ৩০,৫০০ মিটার উঁচুতে পৌঁছাই, তখন সেখানকার দৃশ্যটি,” তিনি বলেন, “ছিল একদম অভূতপূর্ব।” বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলি নানা ধরনের রঙের দ্বারা চিহ্নিত দেখে রস্, একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমে “উজ্জ্বল ও সাদাটে নীল রঙ” দেখা যায় ট্রপোসফিয়ারের মধ্যে যা পৃথিবীর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার উপরে আচ্ছাদিত ছিল। এরপর থেকে গাঢ় নীল রঙের আন্তর আকাশ (stratosphere) ক্রমশই গভীরতর হতে থাকে যতক্ষণ না শূন্যের এক ঘোর অন্ধকার চোখে পড়ে। “এক নিঃস্তব্ধ বিস্ময়ে আমরা এই অপূর্ব বায়ুমণ্ডলের কথা চিন্তা করতে থাকি,” ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, নামক পত্রিকাটিতে রস্ এই কথাগুলি লেখেন।
অবশ্যই, আমাদের এই অপূর্ব বায়ুমণ্ডল বিবেচনার যোগ্য।
জীবন সংরক্ষণকারী
আমাদের এই বায়ুমণ্ডল বস্তুতপক্ষে একটি হাওয়ার সমুদ্র, যা পৃথিবীকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার উঁচু থেকে ঘিরে রেখেছে। এর ওজন প্রায় ৫০,০০০ কোটি কোটি টনেরও বেশি এবং এটি আমাদের মাথার উপরে, সমুদ্রপৃষ্ঠের ১.০৩ কিলোগ্রাম প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারের গতিতে চাপের সৃষ্টি করে। এই বায়ুর চাপ ব্যতিরেকে আমরা বাঁচতে পারতাম না, কারণ এটি আমাদের দেহের তরল পদার্থকে বাষ্পাইত হওয়ার থেকে রক্ষা করে। বায়ুমণ্ডলের উপরিস্থ অংশে যথেষ্ট পরিমাণে বাতাসের চাপ থাকে না বলে সেখানে মানবজীবন সংরক্ষিত হতে পারে না। এই কারণেই রস্ ও প্রাথারকে এক বিশেষ চাপ বিশিষ্ট মহাকাশের পোশাক পরতে হয়। “এই কৃত্রিম চাপ ছাড়া,” রস্ ব্যাখ্যা করেন, “আমাদের রক্ত ফুটতে থাকবে, আমাদের রক্তধমনী ও অঙ্গগুলির মধ্যে ফাটল দেখা দেবে।”
এছাড়াও, আমাদের অবশ্যই ক্রমাগতভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য এই বায়ু সমুদ্রের প্রয়োজন আছে। কিন্তু, আমাদের মধ্যে অধিকাংশই, এটিকে হাল্কাভাবে নিয়ে থাকে যেহেতু আমরা এটিকে দেখতে পাই না। প্রাচীন কালের এক ধার্মিক ব্যক্তি উপলব্ধিসহকারে বলেছিলেন: “[ঈশ্বর] সকলকে জীবন ও শ্বাস ও সমস্তই দিতেছেন।”—প্রেরিত ১৭:২৪, ২৫.
আমাদের এই বায়ুমণ্ডল যদি না থাকত, তাহলে ধূলিকণাকে ধরে রাখার মতো কোন মাধ্যমও থাকত না, যার চারপাশে জলবিন্দুর সৃষ্টি হয়। অতএব কোন বৃষ্টিরও সম্ভাবনা থাকত না। যদি এই বায়ুমণ্ডল না হত, তাহলে আমরা সরাসরি সূর্যের রশ্মিতে দগ্ধ হয়ে যেতাম এবং রাত্রে বরফের মতো জমে যেতাম। কিন্তু আনন্দের বিষয় হল যে আমাদের এই বায়ুমণ্ডল ঠিক একটা কম্বলের মতো কাজ করে, সূর্যের কিছুটা তাপ এটি সংরক্ষণ করে রাখে যাতে করে রাত্রিগুলি অতি ঠাণ্ডায় পরিণত না হয়।
এছাড়াও, বায়ুমণ্ডল আমাদের প্রবেশোদ্যত উল্কাগুলির হাত থেকে রক্ষা করে যা পৃথিবী নিবাসীদের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। “মহাকাশের এই শক্ত পদার্থগুলি,” হারর্বাট রেল্ বায়ুমণ্ডলের ভূমিকা (ইংরাজি), নামক তার নিজস্ব বইয়ে ব্যাখ্যা করেন “প্রতিদিন আনুমানিক সহস্র সহস্র টন বায়ুমণ্ডলের বহির্ভাগ থেকে এসে পৌঁছায়।” কিন্তু, অধিকাংশ উল্কাগুলি পৃথিবীতে পৌঁছানোর আগেই বায়ুমণ্ডলের মধ্যেই খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়।
বায়ুমণ্ডল আমাদের জীবনের আনন্দকে বাড়িয়ে তোলে। এটি আমাদের দেয় অপূর্ব নীল আকাশ, ধূম্রাকৃত শুভ্র মেঘ, সতেজপূর্ণ বৃষ্টি, আর চমৎকার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। এছাড়াও, এই বায়ুমণ্ডল ব্যতিরেকে, আমরা কখনও আমাদের প্রিয়জনদের কণ্ঠস্বর অথবা আমাদের প্রিয় সঙ্গীতের সুর শুনতে পেতাম না। কেন? কারণ শব্দতরঙ্গের গতিকে বজায় রাখবার জন্য এক ধরনের পদার্থের প্রয়োজন হয়। আর এই শব্দকে প্রকাশ করার জন্য যেহেতু বাতাসই হল সবচাইতে উত্তম মাধ্যম, তাই মহাশূন্যে কোন রকম শব্দ শোনা যায় না।
এক অপূর্ব সংমিশ্রন
প্রাচীনকালে লোকেরা এই বায়ুমণ্ডলকে একটি স্বতন্ত্র পদার্থ বলে মনে করত। এরপর, বিগত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে, বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে এটি মূলত প্রধান দুটি পরস্পর পরিপূরক গ্যাস, অর্থাৎ নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের সংমিশ্রনে তৈরি হয়েছে। বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৭৮ ভাগ হল নাইট্রোজেন এবং ২১ ভাগ হল অক্সিজেন; আর বাকি ১ ভাগের মধ্যে পড়ে কিছু গ্যাস যেমন আরগন, জলীয়বাষ্প, কার্বনডাই অক্সাইড, নিয়োন, হিলিয়াম, ক্রিপটন, হাইড্রোজেন, জেনন এবং ওজোন।
অক্সিজেন, অবশ্যই এক জীবন-দায়ী গ্যাস যা আমাদের দেহ নিশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকে। পৃথিবীর প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য বায়ুমণ্ডলে যে অক্সিজেনের পরিমাণ রয়েছে তা একেবারে সঠিক। এর পরিমাণ যদি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়, তাহলে আমরা তন্দ্রালু এবং অবশেষে অজ্ঞান হয়ে যাবো। অন্যদিকে আবার এটি যদি অতিরিক্ত ঘনীভূত হয়ে পড়ে, তাহলে অনেকে বলে থাকে যে এমনকি সিক্ত পল্লব এবং জঙ্গলের ঘাসগুলি পর্যন্ত জ্বলে উঠবে।
যদিও নাইট্রোজেন হল অক্সিজেনের সঠিক মিশ্রন, তবুও এটি জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এক পরোক্ষ ভূমিকা নেওয়ার চাইতে আরও বেশি কিছু করে। বেঁচে থাকার জন্য সমস্ত প্রাণীর এটিকে প্রয়োজন। উদ্ভিদ জগৎ, প্রধানত বিদযুৎ ও এক বিশেষ ধরনের জীবাণুর মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল থেকে এই নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে থাকে। আর আমরা যে খাদ্য খাই তার মাধ্যমে নাইট্রোজেন পেয়ে থাকি।
আমাদের এই বায়ুমণ্ডল যে সঠিক পরিমাণে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন বজায় রাখে তা অবশ্যই এক আশ্চর্যের ব্যাপার। নাইট্রোজেন পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায় এবং এর জন্য অতি ক্ষুদ্র প্রাণীগুলির দ্বারা কৃত মূল্যবান কাজগুলিকে ধন্যবাদ দিতে হয়। অক্সিজেন সম্বন্ধে কী বলা যায়? এর অধিকাংশ ভাগই আগুন, মানুষ ও পশুর নিশ্বাসের দ্বারা নিঃশেষ হয়ে যায়। তবুও বায়ুমণ্ডল তার মধ্যে ২১ শতাংশ অক্সিজেনের পরিমাণ বজায় রেখে চলে। কী করে? সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে—এক ধরনের রাসায়নিক প্রক্রিয়া যা সবুজ পাতা ও শৈবালের মধ্যে প্রকাশ পায়—যেগুলি প্রতিদিন বায়ুমণ্ডলে এক বিলিয়ন টনেরও বেশি অক্সিজেন নির্গত করে।
এই সালোকসংশ্লেষ কার্বনডাই অক্সাইড ছাড়া হতে পারে না—এটি একটি নগণ্য পরিমাণের গ্যাস যা মাত্র ০.০৩ শতাংশ বায়ুমণ্ডলের মধ্যে থাকে। আলোর সাহায্যে, উদ্ভিদ জগৎ কার্বনডাই অক্সাইডের উপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠার এবং নানা ধরনের ফল, বাদাম, শস্য, ও শাকসবজি উৎপাদন করার জন্য। এছাড়াও কার্বনডাই অক্সাইড পৃথিবীর দিকে কিছুটা তাপ ফিরিয়ে দেয়, যাতে করে আমাদের এই গ্রহটিকে উষ্ম রাখা যায়। কিন্তু যদি অতিরিক্ত পরিমাণে কাঠ, কয়লা, সাধারণ গ্যাস এবং তেল জ্বালানোর ফলে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমাপ বৃদ্ধি পেত, তাহলে এই পৃথিবীর আবহাওয়া এতই তপ্ত হয়ে উঠত যে সমস্ত প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। আবার অন্যদিকে, যদি কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমাণ অতিরিক্তভাবে কমে যেত, তাহলে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া ঘটতে পারত না এবং আমাদের সকলকে অনাহারে থাকতে হত।
ওজোন হচ্ছে আর একটি স্বল্প পরিমাণের গ্যাস যার উপর পৃথিবীস্থ জীবন নির্ভর করে। এই ওজোন গ্যাসটি বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগ, যাকে স্ট্র্যাটোসফিয়ার বলা হয়, সেখান থেকে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মিকে টেনে নেয়। এর ফলে আমরা যারা পৃথিবীতে আছি তারা এই ক্ষতিকারক বেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা পাই।
এবিষয় সন্দেহ নেই যে যত আমরা আমাদের এই বায়ুমণ্ডল সম্বন্ধে জানতে পারি ততোই এটা একটা আশ্চর্যের বিষয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে যে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং অন্যান্য স্বল্প পরিমাণ গ্যাসের যে সংমিশ্রন আছে তা একেবারে সঠিক। প্রয়োজনীয় ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পৃথিবীর যে আয়তন তা সম্পূর্ণরূপে সঠিক। যদি পৃথিবীর আয়তন একটু ছোট বা তার ওজন একটু কম হত, তাহলে তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ত এবং আমাদের এই দুর্লভ বায়ুমণ্ডলের বেশির ভাগ অংশই মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যেত।
“অপরদিকে আবার,” বিজ্ঞানের পাঠ্যবই জীবনের আবহাওয়া (ইংরাজি) জানায়, “যদি পৃথিবীর আয়তন বর্তমানের তুলনায় একটু বড় হত, তাহলে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিপুল পরিমাণে গ্যাসগুলিকে সংরক্ষিত রাখত . . . তাতে করে বায়ুমণ্ডলের মধ্যে বিভিন্ন গ্যাসের যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য তা নষ্ট হয়ে যেত।”
কিন্তু, দুঃখের বিষয় হল যে মানুষের আধুনিক জীবন-ধারার মাধ্যমে এই “সূক্ষ্ম ভারসাম্যটি” নষ্ট হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতি কতটা গম্ভীর এবং কী আশা রয়েছে যে আমাদের এই দুর্লভ বায়ুমণ্ডল ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে?(g94 12/22)
[৫ পৃষ্ঠার বাক্স]
যখন সূর্যাস্তগুলিকে অপেক্ষাকৃতভাবে সুন্দর দেখায়
বায়ুমণ্ডল সূর্যের রশ্মিরেখাকে এমনভাবে প্রতিফলিত করে যে আকাশের মধ্যে একটি মনোরম নীল আভা ছড়িয়ে দেয়। যখন সূর্য দিগন্তের সীমায় ডুবতে শুরু করে, তখন তার রশ্মিরেখাকে আরও অনেক গভীরে বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এর ফলে বিচিত্র রঙের সৃষ্টি হয় যা শহরের লোকেরা হয়ত কখনও দেখতে পাবে না।
শিল্পপ্রধান শহরগুলিতে সূর্যাস্ত সাধারণত নিষ্প্রভ ও বর্ণহীন হয়ে থাকে শুধুমাত্র আংশিক লাল আভা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই দেখা যায় না। যদি সেই অঞ্চল অতিরিক্ত দূষিত হয়ে থাকে, নব বিজ্ঞানী (ইংরাজি) নামক পত্রিকাটি জানায় যে, “সূর্যকে একটা বিবর্ণ লাল চাকতির মতো দেখাবে যা হয়তো দিগন্তে পৌঁছানোর আগেই বিলীন হয়ে যাবে।”
“এক অস্বাভাবিক পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত বায়ুমণ্ডলে,” উপরোক্ত পত্রিকাটি ব্যাখ্যা করে যে, “সূর্যাস্তের রঙগুলি বিশেষভাবে বৈচিত্র্যময় দেখায়। সূর্যের রঙ হয়ে ওঠে উজ্জ্বল হলদে এবং তার পার্শ্ববর্তী আকাশের রঙ হয়ে দাঁড়ায় আংশিক কমলা ও আংশিক হলুদ। যখন সূর্য দিগন্তের নিচে অদৃশ্য হতে থাকে তখন রঙও বদলে গিয়ে কমলার থেকে নীল হয়ে যায়। নিম্নস্থ মেঘগুলি, সূর্য অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরও তার আলোকে প্রতিফলিত করে চলে।”
একবার চিন্তা করে দেখুন বিভিন্ন ধরনের মনোরম সূর্যাস্তগুলির কথা যা দূষণমুক্ত জগতে উপভোগ করা সম্ভবপর হবে!—প্রকাশিত বাক্য ২১:৩-৫. (g94 12/22)