পার্বত্য গোরিলাদের পরিদর্শন
তাঞ্জানিয়ার সচেতন থাক! সংবাদদাতা কর্তৃক
রুয়াণ্ডা ও গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো সীমান্তের আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে, এদের কেবল ৩২০টি বাস করে। আরও ৩০০টি উগাণ্ডার অভেদ্য অরণ্যে থাকে। এরা হল পার্বত্য গোরিলা—বিশ্বে চরমভাবে বিপদাপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে একটি!
এই প্রাণীদের পরিণতির প্রতি জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য আমেরিকার প্রাণীবিজ্ঞানী, ডায়েন ফোসি প্রচুর অবদান রেখেছেন। ১৯৬০ দশকের শেষের দিকে, পার্বত্য গোরিলাদের পর্যবেক্ষণ করার জন্য, ফোসি আফ্রিকায় এসেছিলেন। সেই সময়ে, অবৈধ শিকারের কারণে এরা দ্রুত লোপ পাচ্ছিল। এই সাহসী বিজ্ঞানী, ভিরাঙ্গা পর্বতে এক নির্জনবাসীর মত থেকেছিলেন আর শীঘ্রই সেখানে বসবাসরত গোরিলাদের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। ফোসি তার উদ্ভাবনগুলি পত্রিকার প্রবন্ধে এবং কুয়াশাচ্ছন্ন গোরিলাদের (ইংরাজি) নামক বইয়ে প্রকাশ করেছিলেন। যতই সময় গড়াতে থাকে তিনি তার লোমশ বন্ধুদের রক্ষা করার জন্য ক্রমশ দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন, অবৈধ শিকারীদের বিরুদ্ধে এক কার্যকারী যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। কিন্তু, তিনি তার নিজের যুদ্ধেই এক আহত ব্যক্তিতে পরিণত হন এবং ১৯৮৫ সালে এক অজ্ঞাত আক্রমণকারীর হাতে নিহত হয়েছিলেন।
এই শান্তিপ্রিয় প্রাণীদের দেখার আশা দ্বারা উদ্দীপিত হয়ে, আমার স্ত্রী ও আমি ১৯৯৩ সালে গোরিলাদের আবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দয়া করে, আমাদের অভিযানটির বর্ণনা দিতে দিন।
এই অভিযান শুরু হয়, যখন আমাদের পথপ্রদর্শকেরা ৩,৭০০ মিটার উঁচু ভিসক আগ্নেয়গিরির পাদদেশ থেকে, রুয়াণ্ডার ভলকেনোস ন্যাশনাল পার্কের চূড়ায় নিয়ে যান, যেখানে উঠতে এক ঘন্টা সময় লেগেছিল। বিশ্রাম নেওয়ার সময় আমাদের পথপ্রদর্শকেরা আমাদের গোরিলাদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সেই সম্বন্ধে বলেন। আমাদের জানানো হয় যে এই বিশেষ গোত্রের প্রাণীদের পরিদর্শনের জন্য দিনে কেবল আটজন পর্যটককে অনুমতি দেওয়া হয়। এটি এদের রোগ হওয়ার ঝুঁকিকে কমায় আর সেই সাথে এদের স্বভাবগত বিরক্তিকেও রোধ করে।
“অরণ্যে ঢোকার পর,” একজন পথপ্রদর্শক আমাদের মনে করিয়ে দেন যে “আমাদের কণ্ঠস্বর নিচু রাখতে হবে। এটি আমাদের অরণ্যের অন্যান্য পশু-পাখিদের দেখতে সাহায্য করবে, কেননা পার্বত্য গোরিলা ছাড়াও সেখানে সোনালী বানর, হরিণ, বুনো হরিণ, হাতি এবং মহিষও রয়েছে।”
এছাড়াও আমাদের সতর্ক করা হয়েছিল যে পার্কে বিষাক্ত বিছুটি ও ব্ধপপড়ে রয়েছে এবং আমাদের হয়ত কুয়াশাচ্ছন্ন ও কর্দমাক্ত ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হবে। আমার স্ত্রী ও আমি একে অপরের দিকে তাকালাম। আমরা যে এর জন্য প্রস্তুত নই! কিন্তু বন্ধুত্বপরায়ণ পথপ্রদর্শকেরা, বৃষ্টির পোশাক-পরিচ্ছদ ও বুট জুতো ধার দিয়ে সাহায্য করেন।
আমাদের পথপ্রদর্শক এরপর ব্যাখ্যা করেন যে গোরিলারা মানুষের রোগব্যাধির প্রতি চরমভাবে সংবেদনশীল আর তাই এদের নিরাপত্তার জন্য, যিনি অসুস্থ অথবা জানেন যে তিনি হয়ত সংক্রামক রোগে আক্রান্ত আছেন, তাহলে তার অবশ্যই সেখানে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। “গোরিলাদের সাথে থাকার সময়ে যদি আপনার কাশি বা হাঁচি আসে, দয়া করে পশুদের কাছ থেকে দূরে সরে আসবেন এবং আপনার নাক ও মুখ ঢেকে রাখবেন,” পথপ্রদর্শকদের একজন বলেন। “মনে রাখবেন! ওদের কুয়াশাচ্ছন্ন আবাসে আমরা অতিথি।”
এদের স্পর্শ করার মত যথেষ্ট নিকছে!
আমাদের এই আরোহণ ক্রমাগত খাড়া হতে থাকে। আমরা ৩,০০০ মিটার উঁচু এক স্থানে গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে বাতাস হালকা হওয়ার ফলে নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে আর পথগুলিও সরু। কিন্তু আমরা আনুভূমিকভাবে বিস্তৃত শাখাগুলিতে ঘনভাবে জন্মান মস্, ফার্ণ ও অর্কিডসহ হ্যাজিনিয়া গাছের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি। তা অরণ্যকে এক পরমদেশতুল্য সৌন্দর্য প্রদান করেছে।
এরপর পথপ্রদর্শকেরা এর আগের দিন গোরিলাদের যেখানে দেখা গিয়েছিল সেই স্থানের ছাপ খুঁজতে আরম্ভ করেন, যদিও টাটকা খাদ্যের অন্বেষণে গোরিলারা অবিরতভাবে ঘুরে বেড়ায়। “ওই দিকটায় দেখুন!” কেউ একজন বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠেন। জড়িয়ে থাকা নরম উদ্ভিদগুলি রুপালিপৃষ্ঠের গোরিলাদের বিছানা অথবা নীড়।
“একে বলা হয় ওমুগোমে,” পথপ্রদর্শক ব্যাখ্যা করেন। “একটি পুরুষ গোরিলার যখন ১৪ বছর হয় এর পিঠ রূপোর মত সাদা হতে থাকে। তখন সে দলের নেতা হিসাবে বিবেচিত হয়। কেবল রুপালিপৃষ্ঠের গোরিলারাই স্ত্রী গোরিলাদের সাথে মিলিত হয়। অপেক্ষাকৃত ছোটরা মিলিত হতে চেষ্টা করলে সাথে সাথে অগ্রাহ্য করা হয়! কিন্তু কোন প্রতিদ্বন্দ্বী যদি রুপালিপৃষ্ঠের গোরিলাকে হত্যা করতে সমর্থ হয়, তবে সে তার সমস্ত বংশধরদের হত্যা করে। তারপর, নতুন নেতা কর্তৃত্ব নেয় এবং দলের স্ত্রী গোরিলাদের সাথে মিলনের ফলে বংশ বৃদ্ধি করে।”
“একটি গোরিলা কতদিন বেঁচে থাকে?” একটি সুন্দর বাঁশঝাড়ের দিকে পথপ্রদর্শকদের অনুসরণ করার সময় আমাদের দলের একজন জিজ্ঞাসা করেন।
“প্রায় ৪০ বছর পর্যন্ত” শান্তভাবে একটি উত্তর আসে।
“হুস্! হুস্!” চাপাস্বরে কেউ একজন ফিস্ফিস্ করে বলে। “ওটা কী? গোরিলা?” না, কিন্তু পথপ্রদর্শকদের একজন গোরিলার মত ডাকছে, সাড়া পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। আমরা নিশ্চয়ই অনেক কাছে এসে গেছি!
সত্যই, আমাদের কাছ থেকে মাত্র ৫ মিটার দূরে ৩০টি গোরিলা রয়েছে! আমাদের বসে পড়তে এবং নীরব থাকতে বলা হয়। “তাদের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করবেন না,” একজন পথপ্রদর্শক অনুরোধ করেন, “কারণ ওরা হয়ত মনে করতে পারে যে আপনারা তাদের দিকে কিছু ছুড়ছেন। দয়া করে চিৎকার করবেন না। ছবি তোলার সময় ধীরে এবং সতর্কতার সাথে স্থান পরিবর্তন করুন আর ফ্ল্যাশ ব্যবহার করবেন না।”
আমরা ওদের স্পর্শ করার মত যথেষ্ট নিকটে! কিন্তু কেউ তা করার আগেই, একজন পথপ্রদর্শক ফিস্ফিস্ করে বলে ওঠেন: “ওদের স্পর্শ করবেন না!” এই কথা বলার সাথে সাথেই ছোট এক জোড়া গোরিলা আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে কাছাকাছি আসে। পথপ্রদর্শক একটি ছোট ডাল দিয়ে তাদের স্পর্শ করেন আর কৌতুহলী বাচ্চারা ঢালুর দিকে গড়াগড়ি দেয়, ছোট্ট বাচ্চাদের মত মারামারি করতে শুরু করে। খেলা যখন হিংস্রতার দিকে মোড় নেয় “মা” গোরিলা সেখানে হস্তক্ষেপ করে।
রুপালিপৃষ্ঠের গোরিলাটি দূর থেকে আমাদের দেখছে। হঠাৎ আমাদের দিকে সরে আসে এবং আমরা যেখানে বসেছি সেখান থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে বসে পড়ে। সে প্রকাণ্ড এবং ওর ওজন হবে প্রায় ২০০ কিলোগ্রাম! আমাদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে খাওয়ার দিকে বেশি ব্যস্ত থাকলেও সে আমাদের দেখছিল। আসলে, খাওয়াই হল গোরিলার প্রধান কাজ! রুপালিপৃষ্ঠের একটি গোরিলা দিনে প্রায় ৩০ কিলোগ্রাম খাবার খেতে পারে। আর দলের প্রতিটি প্রাণীই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাদ্যের অন্বেষণে ব্যস্ত থাকে। কখনও কখনও দেখা যায় যে তারা “আকর্ষণীয়” কিছু পেলে সেটির জন্য একে অপরের সাথে লড়াই করতে থাকে।
এদের প্রিয় খাবার হল বিশাল সেনেসিও গাছের শাঁস। এছাড়া এরা বন্য শাক, কোন কোন গাছের শিকড় এবং বাঁশ গাছের কচি অংশ খেতে পছন্দ করে। এমনকি কখনও কখনও এরা বাঁশ গাছের কচি অংশের সাথে বিছুটি, জেলিয়াম এবং বিভিন্ন শিকড় ও লতাপাতা মিশিয়ে “সালাদ”-ও তৈরি করে। “যে বিছুটিগুলিকে এরা আঁকড়ে ধরে এবং পরিষ্কার করে সেগুলির দ্বারা গোরিলারা কেন বিদ্ধ হয় না?” কেউ একজন জিজ্ঞাসা করেন। একজন পথপ্রদর্শক ব্যাখ্যা করেন: “এদের হাতের তালুর ভিতরে একটি পুরু চামড়ার আবরণ রয়েছে।”
আমরা যখন এই শান্তিপূর্ণ দৃশ্যটি উপভোগ করছি, হঠাৎ করে প্রকাণ্ড পুরুষ গোরিলাটি তার পায়ের উপর ভর করে ওঠে দাঁড়ায়, মুষ্টির মাধ্যমে তার বুকে আঘাত করে এবং ভয়ঙ্কর, লোমহর্ষক চিৎকার করে! সে একজন পথপ্রদর্শকের দিকে আসতে থাকে আর ঠিক কাছে পৌঁছানোর আগে হঠাৎ করে থেমে যায়। সে পথপ্রদর্শকের দিকে হিংস্রভাবে তাকায়! কিন্তু আমাদের পথপ্রদর্শক ভয় পান না। এর বদলে তিনি বসে পড়েন, শব্দ করেন এবং ধীরে ধীরে পিছনের দিকে সরে আসেন। মনে হয় যেন রুপালিপৃষ্ঠের গোরিলাটি তার শক্তি এবং ক্ষমতা দ্বারা আমাদের কেবল প্রভাবিত করতে চেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে সে তাতে সফল হয়েছিল!
এরপর পথপ্রদর্শক আমাদের চলে আসার জন্য সংকেত দিলেন। এই চমৎকার, শান্তিপ্রিয় প্রাণীদের “কুয়াশাচ্ছন্ন” অতিথি হিসাবে এক ঘন্টারও কিছু বেশি সময় আমরা কাটিয়েছি। যদিও সংক্ষিপ্ত ছিল, তবুও আমাদের এই পরিদর্শন অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে আছে। আমরা আসন্ন নতুন জগৎ সম্বন্ধে বাইবেলের প্রতিজ্ঞা স্মরণ না করে পারলাম না, যেখানে মানুষ ও পশু একে অপরের সাথে চিরকাল শান্তিতে বাস করবে!—যিশাইয় ১১:৬-৯.
[২৪ পৃষ্ঠার মানচিত্রগুলো]
সারিবদ্ধ পার্বত্য গোরিলা
গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো
কিভু হ্রদ
উগাণ্ডা
রুয়াণ্ডা
আফ্রিকা
প্রসারিত অঞ্চল
[Credit Line on page 18]
Mountain High Maps® Copywrite © 1997 Digital Wisdom, Inc.