প্রচ্ছদ বিষয়
বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে—জীবন বাঁচানোর জন্য যে-জরুরি পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন
“বিস্ফোরণের আওয়াজে আমার কানে যেন তালা লেগে যায় আর আমি ছিটকে মাটিতে পড়ে যাই। পুরো অফিস ধোঁয়ায় ভরে যায় আর পুরো বিল্ডিংয়ে আগুন লেগে যায়।”—জোশুয়া।
ভূমিকম্প … ঝড় … সন্ত্রাসবাদী হামলা … স্কুলে বন্দুক হামলা। প্রায়ই আমরা এই শব্দগুলো খবরের শিরোনামে দেখতে পাই। তবে, এই ধরনের খবর পড়া একরকম আর কোনো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া আরেক রকম। কোনো বিপর্যয় আসার আগে, তা চলাকালীন এবং পরে সুরক্ষিত থাকার জন্য আপনি কী করতে পারেন? আসুন, আমরা তা দেখি।
বিপর্যয় আসার আগে—প্রস্তুতি নিন!
কেউই বলতে পারে না যে, আমার উপর কোনো বিপর্যয় আসবে না। আমরা যদি আগে থেকে প্রস্তুতি নিই, তা হলে আমরা রক্ষা পেতে পারি। কিন্তু প্রশ্নটা হল, আমরা কোন কোন দিক দিয়ে প্রস্তুতি নেব?
মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিন। এটা স্বীকার করুন, বিপর্যয় আসা অসম্ভব নয় আর আপনার ও আপনার প্রিয়জনের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। একবার বিপর্যয় এসে গেলে, আপনি প্রস্তুতি নেওয়ার কোনো সুযোগই পাবেন না।
সেই বিপর্যয়গুলো সম্বন্ধে জানুন, যেগুলো সাধারণত আপনার এলাকায় ঘটে। কোথায় আশ্রয় নিতে হবে, তা আগে থেকে জেনে রাখুন। জানুন যে, আপনার বাড়ি এবং আপনার এলাকা যথেষ্ট নিরাপদ আছে কি না। সহজে আগুন লাগতে পারে, এমন জিনিসপত্র সরিয়ে রাখুন, যেমন মশা মারার ধূপ, মোমবাতি, দেশলাই, কেরোসিন। রান্না করার সময় সেখানে যেন কেউ উপস্থিত থাকে।
আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুত রাখুন। বিপর্যয়ের সময় ইলেকট্রিক ও জলের ব্যবস্থা পাওয়া না-ও যেতে পারে, ফোন না-ও চলতে পারে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হতে পারে। আপনার যদি নিজস্ব গাড়ি থাকে, তা হলে খেয়াল রাখুন, সেটাতে যেন অন্ততপক্ষে অর্ধেক জ্বালানি থাকে। সবসময় বাড়িতে কিছু খাবার ও জল রাখুন এবং আপৎকালীন ব্যাগ প্রস্তুত করে রাখুন—“বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য আপনার কাছে কি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রয়েছে?” নামক বাক্সটা দেখুন।
প্রস্তুতি নিন, যাতে আপনি বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারেন
জরুরি ফোন নম্বর নোট করে রাখুন। হতে পারে সেই বন্ধুদের ফোন নম্বর, যারা আপনার কাছাকাছি এলাকায় কিংবা দূরে কোথাও থাকে।
কীভাবে পালাবেন, সেটা আগে থেকে ঠিক করে রাখুন এবং প্র্যাকটিস করুন। কোনো বিপদ হলে আপনি আপনার বাড়ি কিংবা বিল্ডিংয়ের কোন জায়গা দিয়ে বাইরে পালাবেন, তা আগে থেকে স্থির করে রাখুন আর সেইসঙ্গে আপনার সন্তানদেরও শেখান, যদি স্কুলে থাকাকালীন সেখানে কোনো বিপদ হয়, তা হলে তাদের কী করা উচিত। বিপর্যয়ের সময় আপনারা পরিবারগতভাবে কোথায় একত্রিত হবেন, তা আগে থেকে স্থির করে রাখুন, হতে পারে কোনো স্কুলবাড়ি কিংবা কোনো লাইব্রেরিতে। দুটো জায়গা স্থির করুন, একটা আপনার বাড়ির কাছাকাছি এবং আরেকটা আপনার এলাকায় বাইরে। সরকারি কর্তৃপক্ষেরা আমাদের উৎসাহিত করে, আমরা যেন সেই একত্রিত হওয়ার জায়গায় আমাদের পরিবারের সঙ্গে পায়ে হেঁটে যাওয়া প্র্যাকটিস করি।
কীভাবে অন্যদের সাহায্য করবেন, তা পরিকল্পনা করুন, যাদের মধ্যে রয়েছে বয়স্ক ও অসুস্থ লোক।
বিপর্যয়ের সময়—দ্রুত পদক্ষেপ নিন
জোশুয়া, যার বিষয়ে আগে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি বলেন, “যখন আগুন লেগেছিল, তখন বেশিরভাগ লোকই বিষয়টাকে খুব-একটা গুরুত্ব দেয়নি বরং দেরি করছিল। কেউ কেউ নিজের কম্পিউটার বন্ধ করছিল আবার কেউ কেউ বোতলে জল ভরছিল। একজন তো আবার বলল, ’একটু অপেক্ষা করা যাক।’” যদিও অন্যেরা দেরি করছিল, কিন্তু জোশুয়া চিৎকার করে বলে ওঠে, “আমাদের এক্ষুনি এখান থেকে বের হতে হবে!” তা শুনে তার সহকর্মীরা তার পিছন পিছন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগল। জোশুয়া তাদের বলল, “আমাদের মধ্যে যদি কেউ পড়ে যায়, তা হলে তাকে তুলুন আর নীচে নামতে থাকুন। ভয় নেই, আমরা বের হতে পারব।”
যখন আগুন লাগে। হামাগুড়ি দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাছাকাছি দরজার দিকে এগিয়ে যান এবং সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করুন। ধোঁয়ার জন্য আপনি হয়তো কিছুই দেখতে পাবেন না। আসলে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে ধোঁয়া ঢুকে গিয়ে বেশিরভাগ লোকের মৃত্যু ঘটে। কোনো জিনিসপত্র নেওয়ার চেষ্টা করবেন না, যা আছে সবকিছু ফেলে বেরিয়ে যান। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আপনি আপনার জীবন হারাতে পারেন।
যখন ভূমিকম্প হয়। কোনো মজবুত আসবাবপত্রের নীচে আশ্রয় নিন কিংবা ঘরের মধ্যে থাকা কোনো দেওয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। মনে রাখবেন, ভূমিকম্পের সময় প্রথম কম্পনের পর আবারও একাধিক কম্পন হতে পারে আর তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ঘরের বাইরে বের হয়ে যান এবং বিল্ডিং থেকে দূরে চলে যান। হতে পারে, উদ্ধারকারী দলের পক্ষে সেখানে পৌঁছাতে ঘন্টাখানেক সময় লাগতে পারে, তাই যদি পারেন, অন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করুন।
যখন সুনামি হয়। যদি দেখেন নদী কিংবা সমুদ্রের জল তীর থেকে নেমে যাচ্ছে, তখন যত দ্রুত সম্ভব উঁচু কোনো জায়গায় পালিয়ে যান। কারণ এর পরই আরও বড়ো বড়ো ঢেউ আসতে পারে।
যখন প্রবল ঝড় হয়। দেরি না করে কোনো নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিন।
যখন বন্যা হয়। জল ঢুকে গিয়েছে এমন ঘর কিংবা বিল্ডিং ছেড়ে চলে যান। জলের মধ্যে দিয়ে হাঁটবেন না কিংবা গাড়ি চালাবেন না। বন্যার জলে বর্জ্য পদার্থ এবং বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা থাকে। এ ছাড়া, অন্যান্য বিপদও সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে, যেমন খোলা ম্যানহোল এবং লুকানো বিদ্যুতের তার।
আপনি কি জানেন? ২ ফুট [০.৬ মিটার] জলের স্রোত একটা গাড়িকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বন্যার সময় বেশির ভাগ লোকের মৃত্যুর কারণ হল, তারা স্রোতের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করে।
যখন সরকারি কর্তৃপক্ষ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়, তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সেখান থেকে বের হয়ে যান। আপনার বন্ধুবান্ধবকে জানান যে, আপনি কোথায় আছেন। তা না হলে, তারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনাকে খুঁজতে থাকবে।
কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিলে সঙ্গেসঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান!
আপনি কি জানেন? ফোনে কথা বলা কিংবা ভয়েস ম্যাসেজ না পাঠিয়ে বরং টেক্সট ম্যাসেজ পাঠানো বেশি ভালো হবে।
যখন সরকারি কর্তৃপক্ষ লোকদের তাদের ঘরে অথবা নিরাপদ আশ্রয়স্থানে থাকতে নির্দেশ দেয়, তখন ঘরের মধ্যেই থাকুন। যদি আপনার এলাকায় রাসায়নিক, জৈবিক কিংবা পারমাণবিক দুর্ঘটনা অথবা হামলা হয়, তা হলে ঘরের সমস্ত ভেন্টিলেটর এবং দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখুন। পারমাণবিক দুর্ঘটনা অথবা হামলার সময় রেডিয়েশন থেকে বাঁচার জন্য আপনার বাড়ি অথবা বিল্ডিংয়ের সবচেয়ে নীচে কোনো ঘরে কিংবা বেসমেন্টে গিয়ে লুকান। টিভি অথবা রেডিও থেকে স্থানীয় খবর শুনুন। যতক্ষণ না কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে যে, বিপদ কেটে গিয়েছে, ততক্ষণ ঘরের মধ্যেই থাকুন।
বিপর্যয়ের পরে—সুরক্ষিত থাকুন!
বিপদ এবং বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে বাঁচার জন্য নীচে দেওয়া পরামর্শগুলো মেনে চলুন:
বন্ধুদের সঙ্গে থাকুন, সম্ভব হলে শরণার্থী শিবিরে থাকা এড়িয়ে চলুন।
আপনি যেখানে রয়েছেন, সেই জায়গাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন।
সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার করে আবর্জনা পরিষ্কার করুন। যদি সম্ভব হয়, তা হলে হাতে গ্লাভ্স, পায়ে মজবুত জুতো, মাথায় শক্ত টুপি এবং মুখে মাস্ক পরুন। ইলেকট্রিক তার থেকে সাবধান থাকুন। এ ছাড়া এই বিষয়েও সাবধান থাকুন, আগুনে পুড়ে যাওয়া জিনিসগুলো বাইরে থেকে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে বলে মনে হলেও ভিতরে এখনও প্রচণ্ড গরম থাকতে পারে।
স্বাভাবিক রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিনের কাজ আগের মতোই করার প্রচেষ্টা করুন। আপনার সন্তানেরা যেন দেখে যে, আপনি শান্ত এবং আশাবাদী রয়েছেন। স্কুলের পড়াশোনায় তাদের সাহায্য করুন, তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করুন এবং পরিবারগতভাবে যিহোবার উপাসনা চালিয়ে যান। সবসময় দুঃখজনক খবর দেখা এড়িয়ে চলুন আর পরিবারের উপর নিজের উদ্বিগ্নতা কিংবা রাগ প্রকাশ করবেন না। অন্যদের কাছ থেকে সাহায্য নিন এবং অন্যদেরও সাহায্য করুন।
বিপর্যয় শেষ হয়ে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাভাবিক রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিনের কাজ করতে শুরু করুন
বিপর্যয়ের ফলে আপনাকে যে অনেক কিছু হারাতে হবে, তা মেনে নিন। সরকার এবং অন্যান্য সংস্থা বিপর্যয়ের সময় লোকদের বেঁচে থাকার জন্য ত্রাণসামগ্রী দিয়ে সাহায্য করে, কিন্তু তারা সেই সমস্ত জিনিসপত্র ফিরিয়ে দিতে পারে না, যেগুলো এই সময় একজন ব্যক্তি হারিয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের বিশুদ্ধ জল, খাবারদাবার, জামাকাপড় এবং আশ্রয় দরকার।—১ তীমথিয় ৬:৭, ৮.
মানসিকভাবে আপনি যে-আঘাত পেয়েছেন, তা বুঝুন এবং সাহায্য নিন। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ওঠার পর আপনি হয়তো মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন। আপনি এই ধরনের সমস্যাগুলো ভোগ করতে পারেন, যেমন উদ্বিগ্নতা ও হতাশা আর হঠাৎ করে আপনার মেজাজও পরিবর্তন হতে পারে। একইসঙ্গে আপনার পক্ষে সঠিকভাবে চিন্তা করা এবং কোনো কাজ করা কঠিন হতে পারে এবং ঘুমের সমস্যা আসতে পারে। এইরকম পরিস্থিতিতে বন্ধুবান্ধবের সাহায্য নিন।
কাজের জায়গায় আগুন লাগার পর যদিও জোশুয়া বেঁচে যান, কিন্তু তার সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই মারা যায়। এই সময় খ্রিস্টীয় প্রাচীন ও ডাক্তারেরা তাকে সাহায্য করে। জোশুয়া বলেন, “তারা আমাকে এই আশ্বাস দেয় যে, ধীরে ধীরে আমি এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারব। ছয় মাস পর আমার আতঙ্ক ক্রমশ কমতে থাকে। তবে অন্যান্য সমস্যা তখনও চলে যায়নি, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে আমার আরও কিছু সময় লাগে।”
বিপর্যয়ের ফলে আমরা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে পারি না। ফলে, কেউ কেউ ভুলভাবে ঈশ্বরকে দায়ী করে। এ ছাড়া, জোশুয়ার মতো অনেক এই ভেবে নিজেকে দোষ দেয় যে, ’অন্যেরা যখন মারা গেল, তখন আমি কেন বেঁচে রইলাম!’ জোশুয়া বলে, “আমি এখনও এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করি, আমি হয়তো আরও কিছু লোককে বাঁচাতে পারতাম! আমার বিশ্বাস আমাকে সান্ত্বনা দেয় যে, ঈশ্বর খুব তাড়াতাড়ি সারা পৃথিবীর লোকদের জন্য ন্যায়বিচার আনবেন এবং সবকিছু ঠিক করবেন। সেইসময় না আসা পর্যন্ত আমি প্রতিটা দিন আনন্দের সঙ্গে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি।”—প্রকাশিত বাক্য ২১:৪, ৫.a◼
a ভবিষ্যতের বিষয় ঈশ্বর কী প্রতিজ্ঞা করেন এবং কেন তিনি এখনও পর্যন্ত দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন, তা জানার জন্য বাইবেল প্রকৃতপক্ষে কী শিক্ষা দেয়? বইটা দেখুন। আপনি এই বইটা www.pr418.com ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করতে পারেন।