ম্যাসোরেটিক পুঁথি কী?
যেকোন ভাষাতেই আপনি বাইবেল পড়ুন না কেন, প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে, তার খানিকটা অংশ, সম্ভবত ম্যাসোরেটিক পুঁথি থেকে অনুবাদিত, যার অন্তর্ভুক্ত হল ইব্রীয় শাস্ত্রাবলি অথবা “পুরাতন নিয়ম।” প্রকৃতপক্ষে, ম্যাসোরেটিক পুঁথির সংখ্যা ছিল একাধিক। তাহলে কোন্টিকে পছন্দ করা হয়েছিল এবং কেন? আসলে, ম্যাসোরেটিক পুঁথি কী এবং আমরা কিভাবে জানতে পারি তা নির্ভরযোগ্য কি না।
যিহোবার বাক্য
বাইবেল লেখা শুরু হয়েছিল সীয়ন পর্বতে সা.শ.পূ. ১৫১৩ সালে। যাত্রাপুস্তক ২৪:৩, ৪ পদ আমাদের জানায়: “মোশি আসিয়া লোকদিগকে সদাপ্রভুর সকল বাক্য ও সকল শাসন কহিলেন, তাহাতে সমস্ত লোক একস্বরে উত্তর করিল, সদাপ্রভু যে যে কথা কহিলেন, আমরা সমস্তই পালন করিব। পরে মোশি সদাপ্রভুর সমস্ত বাক্য লিখিলেন।”
সা.শ.পূ. ১৫১৩ সাল থেকে শুরু করে প্রায় সা.শ.পূ. ৪৪৩ সাল পর্যন্ত, সহস্র বছরেরও অধিককাল যাবৎ ইব্রীয় শাস্ত্রাবলি লেখা হয়েছিল। যেহেতু লেখকেরা ছিলেন ঈশ্বরের দ্বারা অনুপ্রাণিত, তাই এটাই যুক্তিযুক্ত যে তিনি বিষয়গুলিকে এমনভাবে পরিচালনা করবেন যাতে তাঁর বার্তা সঠিকভাবে রক্ষা পায়। (২ শমূয়েল ২৩:২; যিশাইয় ৪০:৮) কিন্তু, এর অর্থ কি এই যে যিহোবা মানুষের সকল ভুলভ্রান্তিকে সরিয়ে দেবেন, যাতে প্রতিলিপি করার সময়ে একটি শব্দও আর পরিবর্তিত হবে না।
ভুলভ্রান্তি ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে শুরু করে
যদিও ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিরা পুরুষানুক্রমে এগুলি নকল করেছিলেন, কিন্তু কিছুটা পরিমাণ ভুলভ্রান্তি অবশ্যই সেখানে প্রবেশ করেছিল। বাইবেল লেখকেরা ছিলেন অনুপ্রাণিত, কিন্তু নকলনবিশেরা তাদের কাজ ঐশিক অনুপ্রেরণায় করেননি।
সা.শ.পূ. ৫৩৭ সালে বাবিলনের বন্দীত্ব থেকে ফিরে আসার পর যিহূদীরা বাবিলনে যা শিখেছিল, তা লেখার এক নতুন ধারা প্রবর্তন করে, যার অক্ষরগুলি ছিল চৌক আকৃতির। এই বিরাট পরিবর্তনটি সঙ্গে এনেছিল একটি সহজাত সমস্যা, যা হল, একই রকম দেখতে অক্ষরগুলি যা পরস্পরের সাথে গুলিয়ে যেত।a যেহেতু ইব্রীয় ভাষার ভিত্তিমূল হল ব্যঞ্জনবর্ণ, তাই যখন একজন পাঠক কোন প্রসঙ্গকে বুঝবার জন্য তাতে কোন স্বরবর্ণ যোগ করত, তখন একটি ব্যঞ্জনবর্ণের পরিবর্তন হয়ত অতি সহজেই একটি শব্দের অর্থকে পরিবর্তন করে দিতে পারত। যদিও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ভুলগুলিকে আবিষ্কার ও সংশোধন করা হয়েছে।
বাবিলনের পতনের পর অধিকাংশ যিহূদীরাই ইস্রায়েলে ফিরে আসেনি। তাই সমগ্র মধ্য প্রাচ্য ও ইউরোপে যিহূদী সম্প্রদায়গুলির আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় সমাজগৃহগুলি।b প্রতিটি সমাজগৃহেরই প্রয়োজন হত শাস্ত্রীয় পুঁথির একটি প্রতিলিপি। এইগুলির সংখ্যা যতই বাড়তে থাকে, আর তার সাথে বাড়তে থাকে নকলনবিশের ভুলগুলিও।
ভুলগুলিকে সংশোধন করার প্রয়াস
সা.শ. প্রথম শতাব্দীর শুরু থেকেই যিরূশালেমের অধ্যাপকেরা মূল একটি শাস্ত্রীয় পুঁথিকে প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার দ্বারা অন্যান্য ইব্রীয় শাস্ত্রকে সংশোধন করা যেতে পারে। তথাপি, সেখানে কোন নির্দিষ্ট পন্থা ছিল না, যার দ্বারা মূল পুঁথি এবং পাণ্ডুলিপিগুলির অন্তর্ভুক্ত ভ্রান্তিকর প্রতিলিপিগুলির মধ্যে পার্থক্য দেখা যেতে পারে। সা.শ. দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে ইব্রীয় শাস্ত্রের ব্যঞ্জনবর্ণ সমন্বিত পুঁথিটি হয়ত আকার আয়তন অনুসারে ভালভাবে রাখা হয়েছিল, যদিও তা নির্ভরযোগ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইব্রীয় শাস্ত্রাবলির উক্তিগুলি যা তালমুডে পাওয়া যায়, (যেগুলি সা.শ. দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়) প্রায়ই এক ভিন্ন সূত্রের বিষয় ইঙ্গিত দেয় যা পরবর্তীকালে ম্যাসোরেটিক পুঁথি নামে পরিচিত হয়।
ইব্রীয় ভাষায় “ট্র্যাডিশন” শব্দটি “ম্যাসোরা” অথবা “ম্যাসোরেথ” নামে পরিচিত। সা.শ. ষষ্ঠ শতাব্দীতে যারা ইব্রীয় শাস্ত্রাবলিকে নকল করার রীতিকে রক্ষা করে চলেছিল, তারা ম্যাসোরাইটস্ নামে পরিচিত হয়। যে প্রতিলিপিগুলি তারা তৈরি করেছিল সেগুলিকে বলা হয় ম্যাসোরেটিক পুঁথি। তাদের কাজ এবং তাদের তৈরি পুঁথিগুলিতে বিশেষ জিনিস কী ছিল?
ইব্রীয় ভাষাকে আর কেউ জাতীয় এবং সাধারণ ভাষা বলে গণ্য করত না এবং বহু যিহূদী আর এই ভাষায় কথা বলত না। সুতরাং, ব্যঞ্জনবর্ণ সমন্বিত বাইবেলের অর্থ উপলব্ধি করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাকে রক্ষা করার জন্য ম্যাসোরাইটসরা স্বরবর্ণের একটি প্রকল্প তৈরি করে যা বিন্দু এবং ড্যাস অথবা পয়েন্ট দ্বারা চিহ্নিত করে। এগুলি ব্যঞ্জনবর্ণের উপরে ও নিচে রাখা হয়। এই ম্যাসোরাইটসরা চিহ্নের এক জটিল পন্থা চালু করে, যা যতিচিহ্ন এবং আরও নির্ভুলভাবে উচ্চারণ করতে নির্দেশনা দেয়।
ম্যাসোরাইটসরা যেখানে মনে করত যে তাদের আগের বংশের অধ্যাপকেরা ভুলভাবে নকল করেছে, সেক্ষেত্রে তারা সেগুলি পরিবর্তন করার পরিবর্তে সেগুলির পাশে লিখে রাখত। তারা অস্বাভাবিক শব্দগুলির মিলিত হওয়া বা সংযুক্ত হওয়ার বিষয়গুলি এবং কত ঘন ঘন সেগুলি একটি অধ্যায়ের মধ্যে অথবা সম্পূর্ণ ইব্রীয় শাস্ত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়, তা লিখে রাখত। নকলনবিশেরা যাতে বিপরীত সম্বন্ধযুক্ত মন্তব্যগুলিকে তুলনামূলকভাবে পরীক্ষা করতে পারে, তার জন্য অতিরিক্ত মন্তব্যগুলিও লিখে রাখা হত। এই তথ্যগুলিকে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে রক্ষা করার জন্য সংক্ষিপ্ত “চিহ্ন” এর ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। উপরে ও নিচের সারিতে ছোট আকারের এক ধরনের বর্ণানুক্রমিক সূচী রাখা হয় এর সাথে সম্পর্কযুক্ত শাস্ত্রপদগুলির তালিকা রাখা হত যার উপর পাশের মার্জিনে মন্তব্য করা হত।
সবচেয়ে বিখ্যাত পন্থা টাইবেরিয়াসে, গালীল সমুদ্রের ধারে ম্যাসোরা দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল। সা.শ. নবম এবং দশম শতাব্দীতে বেন আশের পরিবার এবং বেন ন্যাফটালি পরিবার, সম্ভবত কারাইটসরা বিশেষ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।c যদিও উচ্চারণপদ্ধতি এবং সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যার মধ্যে এই দুটি স্কুলের পার্থক্য ছিল, তবুও সম্পূর্ণ ইব্রীয় শাস্ত্রে মাত্র দশ বারেরও কম তাদের পুঁথির ব্যঞ্জনবর্ণগুলির মধ্যে পার্থক্য দেখা দিয়েছিল।
ম্যাসোরাইটসদের উভয় স্কুলই, বেন আশের এবং বেন ন্যাফটালি তাদের সময়ে পাঠ্যবিষয়ের উপর অগাধ পাণ্ডিত্য দেখিয়েছিলেন। মাইমোনাইডস (১২শ শতাব্দীর একজন প্রভাবশালী তালমুডের পন্ডিত) বেন আশের পুঁথিকে প্রশংসা করার পর অন্যেরাও দারুণভাবে তাদের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এটা যে সত্যি, তার প্রমাণ হল যে বেন ন্যাফটালির পুঁথি এখনও খুঁজে পাওয়া যায় না। যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা হল দুটি স্কুলের পার্থক্যের মধ্যে যে সূচী। কর্তৃত্বব্যঞ্জকরূপে, মাইমোনাইডস সূক্ষ্মভাবে কী করে নকল করা যায়, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির উপর জোর না দিয়ে শুধুমাত্র সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য, যেমন দুটি অনুচ্ছেদের মাঝে কতটা ব্যবধান থাকা উচিত, এই বিষয়ের উপর মন্তব্য।
আমরা কি “আসল” ম্যাসোরেটিক পুঁথি পেতে পারি?
পণ্ডিতদের মাঝে অনেক বিতর্ক রয়েছে যে বর্তমানে প্রাপ্ত পুঁথিগুলির মধ্যে কোন্টি “আসল,” বেন আশের পুঁথি, তা যেন আমাদের “আসল” ম্যাসোরেটিক পুঁথি দেবে। প্রকৃতপক্ষে, কখনই কোন অদ্বিতীয়, “আসল” এবং নির্ভরযোগ্য ম্যাসোরেটিক পুঁথি ছিল না। পরিবর্তে ছিল অনেকগুলি ম্যাসোরেটিক পুঁথি, প্রতিটি একে অপরের থেকে একটু আলাদা। বর্তমানে যে সকল পুঁথিগুলি আছে সেগুলি বেন আশের এবং বেন ন্যাফটালির পাঠ্যবিষয়ের সাথে মিশে আছে।
বর্তমানে ইব্রীয় শাস্ত্রের অনুবাদকেরা যে দায়িত্বের মোকাবিলা করছে, তা ভয়ঙ্কর। তাকে শুধুমাত্র ইব্রীয় শাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হলেই চলবে না, কিন্তু সেই সঙ্গে সকল যুক্তিযুক্ত বিকল্পগুলির সাথেও, যেখানে হয়ত শাস্ত্রটি নকলনবিশের দ্বারা ভুলবশত অথবা অন্যভাবে বিকৃত হয়েছে, পরিচিত হতে হবে। যদিও বিভিন্ন ম্যাসোরেটিক পুঁথিগুলি ভিত্তিমূল হিসাবে কাজ করে, তথাপি একজনের অন্যান্য সূত্রগুলিকেও বিবেচনা করা উচিত যা হয়ত তাকে যুক্তিযুক্তভাবে ব্যঞ্জনবর্ণ সমন্বিত পুঁথির আরও অধিক প্রাচীন ও সূক্ষ্ম সংস্করণের সন্ধান দেবে।
দি টেক্সট অফ দ্যা ওল্ড টেস্টামেন্ট বইটির সূচনায় আরনেস্ট ভার্থওয়াইন ব্যাখ্যা করে বলেন: “যখন আমরা কোন কঠিন বিষয়বস্তুর মুখোমুখি হই, যেখানে আমরা বিভিন্ন তথ্যগুলিকে হয়ত সমন্বয় করতে অসমর্থ এবং সহজতম সমাধানটিকে বেছে নিতেও অসমর্থ, তখন হয়ত কখন আমরা ইব্রীয় শাস্ত্র, কখন বা সেপ্টুয়াজিন্ট, আবার কখনও বা অরামিয় ভাষায় লিখিত শাস্ত্র পছন্দ করি। শাস্ত্রীয় প্রমাণগুলির সবকটি সমান নির্ভরযোগ্য নয়। প্রত্যেকটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং অদ্ভুত ইতিহাস রয়েছে। যদি আমরা অপর্যাপ্ত এবং ভুয়ো সমাধান না চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই এগুলির সাথে পরিচিত হতে হবে।”
যিহোবা যে তাঁর বাক্যকে রক্ষা করে এসেছেন, সেই বিষয়ে আমাদের দৃঢ় আস্থা রাখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দীর্ঘ শতাব্দীব্যাপী বহু অন্তরঙ্গ ব্যক্তিদের মিলিত প্রচেষ্টার ফলে বাইবেলের সারাংশ, তার বিষয়বস্তু এবং এমনকি তার বার্তার বিশদ বিবরণ আজ আমাদের কাছে সহজলভ্য। শব্দ অথবা অক্ষরের একটু রদবদল আমাদের বোধশক্তিকে শাস্ত্র উপলব্ধি রোধ করতে পারেনি। এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল, আমরা কি ঈশ্বরের বাক্য, বাইবেল অনুসারে জীবন যাপন করব?
[পাদটীকাগুলো]
a শতাব্দীব্যাপী, দুটি ধারায় লিখিত অধিকাংশ পুঁথিই প্রচলিত ছিল। ডেড সি স্ক্রোলের কিছু কিছু অংশ পুরনো ধারায় লেখা, যা আমাদের তুলনা করতে সাহায্য করে।
b যেহেতু ইস্রায়েলের বহির্দেশের অনেক যিহূদীরা সাবলীলভাবে ইব্রীয় ভাষা পড়তে পারত না, সেইহেতু মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায়, যিহূদী সম্প্রদায়গুলি তাদের আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করার প্রয়োজন অনুভব করে। এই প্রয়োজনকে পরিপূরণ করার জন্য সা.শ.পূ. তৃতীয় শতাব্দীতে গ্রীক সেপ্টুয়াজিন্ট সংস্করণ প্রস্তুত করা হয়। এই সংস্করণটি পরবর্তীকালে তুলনা করার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।
c সা.শ. ৭৬০ সালে কারাইটস নামে একটি যিহূদী দল শাস্ত্রকে কঠোরভাবে পালন করার উপর জোর দেয়। রব্বি, “মৌখিক আইন” এবং তালমুডের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে বাইবেলের পুস্তকের নিয়ম রক্ষা করার তাদের মহৎ কারণ ছিল। অবশ্যই, এই দলের থেকেই বিশেষ পরিবারগুলি ম্যাসোরেটিক পুঁথির নকলনবিশ হিসাবে দক্ষ হয়ে ওঠে।
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
আলেপ্পো কোডেক্সের মধ্যে ম্যাসোরেটিক পুঁথি পাওয়া যায়
[সজন্যে]
Bibelmuseum, Münster