উইলিয়াম টিনডেল—এক দূরদর্শী ব্যক্তি
উইলিয়াম টিনডেল ইংল্যান্ডের “ওয়েলসের ধারে” সম্ভবত গ্লুসেসটারশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন, যদিও নির্দিষ্ট স্থান ও তারিখটি জানা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে, ইংল্যান্ড সেই ব্যক্তিটি যিনি “আমাদের ইংরাজি বাইবেল দিয়েছেন” তার ৫০০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করে। এই কাজের জন্যই টিনডেল শহীদ হয়েছিলেন। কেন?
উইলিয়াম টিনডেল গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ১৫১৫ সালে জুলাই মাসে, মাত্র ২১ বছর বয়সে, তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলাবিভাগে স্নাতকের উপাধি পান। ১৫২১ সালের মধ্যে তিনি একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক হিসাবে নিযুক্ত হন। সেই সময় মার্টিন লুথারের কার্যকলাপের দরুন জার্মানিতে ক্যাথলিক সম্প্রদায় এক সংকটপূর্ণ অবস্থায় ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ড ক্যাথলিক দেশ হিসাবেই থেকে যায় যতক্ষণ না রাজা ৮ম হেনরীর সাথে ১৫৩৪ সালে রোমের বিচ্ছেদ ঘটে।
যদিও টিনডেলের দিনে ইংরাজি ছিল সাধারণ কথোপকথনের ভাষা, কিন্তু সমস্ত শিক্ষা ল্যাটিন ভাষায় দেওয়া হত। এছাড়াও এটি গির্জা ও বাইবেলের ভাষা ছিল। ১৫৪৬ সালে কাউনসেল অফ্ ট্রেন্ট ঘোষণা করে যে পঞ্চম-শতাব্দীতে লিখিত জেরোমের ল্যাটিন ভালগেট-ই কেবলমাত্র ব্যবহার করা হবে। কিন্তু শুধুমাত্র শিক্ষিতরাই এটিকে পড়তে পারত। ইংল্যান্ডের লোকেদের কেন ইংরাজি বাইবেল দেওয়ার থেকে এবং তা পড়ার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হবে? “জেরো[ম]ও বাইবেলকে তার নিজের মাতৃভাষায় অনুবাদ করেছিলেন: অতএব আমরা কেন তা করতে পারব না?” এটিই ছিল টিনডেলের বিবাদ।
বিশ্বাসের এক পদক্ষেপ
অক্সফোর্ডে থাকার পরবর্তী কালে এবং সম্ভবত কেম্ব্রিজে আরও অতিরিক্ত অধ্যয়ন করার পর টিনডেল, গ্লুসেস্টারশায়ারে দুই বছর ধরে জন ওয়ালসের ছোট ছেলেদের পড়ান। এই সময়ের মধ্যে তিনি ইংরাজিতে বাইবেল অনুবাদ করার ইচ্ছাকে গড়ে তোলেন এবং নিঃসন্দেহে ইরাসমাসের নতুন বাইবেল, যেখানে দুটি কলম গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় লিখিত তার সাহায্যে অনুবাদের কৌশলতাকে গড়ে তোলার সুযোগ হয়। ১৫২৩ সালে, টিনডেল, ওয়ালস পরিবারকে ছেড়ে লন্ডনে চলে যান। তার উদ্দেশ্য ছিল লন্ডনের বিশপ, কুথবার্ট টানস্টলের কাছ থেকে অনুবাদ করার অনুমতি নেওয়া।
টানস্টলের স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল কারণ অক্সফোর্ডে ১৪০৮ সালে সম্মেলনের যে ব্যবস্থা, যাকে কনস্টিটিউশন অফ্ অক্সফোর্ড বলা হত, তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল বিশপের অনুমতি ব্যতিরেকে নিজেদের মাতৃভাষায় বাইবেল অনুবাদ করা অথবা পড়া যাবে না। এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করার সাহস দেখানোর ফলে, বহু ভ্রমণশীল প্রচারক যাদের লোলার্ডস বলা হত তাদের পাষণ্ড হিসাবে পুড়িয়ে মারা হয়। এই লোলার্ডসরা, জন ওয়াইক্লিফের বাইবেল, যা হল ভালগেট-এর ইংরাজি অনুবাদ, সেটিকে পড়ত ও তা বন্টন করত। টিনডেল উপলব্ধি করেছিলেন যে এখনই হল সময়, তার গির্জা ও ইংল্যান্ডের লোকেদের জন্য গ্রীক ভাষা থেকে খ্রীষ্টীয় লেখাগুলিকে অনুবাদ করে একটি নতুন ও ব্যবহারিক সংস্করণ প্রকাশ করা।
বিশপ টানস্টল ছিলেন একজন শিক্ষাগ্রাহী ব্যক্তি যিনি ইরাসমাসকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য অনেক কিছু করেছিলেন। টিনডেল তার নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য, টানস্টলের অনুমতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইস্কোরেটের একটি আলঙ্কারিক উক্তি অনুবাদ করেন, যা ছিল গ্রীক ভাষার একটি কঠিন পাঠ্যাংশ। টিনডেলের আসা ছিল যে টানস্টল তার বন্ধুত্ব ও সাহায্যের হাত বাড়াবেন এবং শাস্ত্র অনুবাদ করার প্রস্তাব গ্রহণ করবেন। বিশপ কী করবেন?
প্রত্যাখ্যান—কেন?
যদিও টিনডেলের কাছে পরিচিতি পত্র ছিল, কিন্তু টানস্টল তার সাথে দেখা করতে অস্বীকার করেন। অতএব টিনডেলকে সাক্ষাৎকারের জন্য তার কাছে চিঠি লিখে অনুরোধ জানাতে হয়। পরিশেষে টিনডেলের সাথে দেখা করতে টানস্টল সম্মত হয়েছিলেন কি না তা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি, কিন্তু তার সংবাদ ছিল, ‘আমার গৃহ পূর্ণ।’ কেন টানস্টল জেনেবুঝে টিনডেলের প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখিয়েছিলেন?
ইউরোপ মহাদেশে লুথারের সংস্কারমূলক কাজ ক্যাথলিক গির্জার পক্ষে এক চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর এর প্রভাব ইংল্যান্ডের উপরেও পড়েছিল। ১৫২১ সালে, রাজা ৮ম হেনরী পোপকে সমর্থন জানিয়ে লুথারের বিপক্ষে একটি বলিষ্ঠ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, পোপ, হেনরীকে “বিশ্বাসের রক্ষক”a নামক উপাধির দ্বারা ভূষিত করেন।” হেনরীর কার্ডিন্যাল ওলসিও লুথারের আইনতভাবে আমদানী-কৃত বইগুলিকে নষ্ট করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন। পোপ, রাজা ও তার কার্ডিন্যালের প্রতি একজন বিশ্বস্ত ক্যাথলিক বিশপ হিসাবে টানস্টল এই বিষয়ে দায়িত্ববদ্ধ ছিলেন যে, কোন রকম বিদ্রোহী লুথারের প্রতি সহানুভূতির মনোভাবকে যেন দমিয়ে রাখা হয়। টিনডেল ছিলেন এক প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি। কেন?
ওয়ালস পরিবাবের সাথে থাকার সময়, টিনডেল নির্ভীকভাবে স্থানীয় পাদ্রিদের অজ্ঞানতা ও গোঁড়ামি সম্বন্ধে বলেছিলেন। এদের মধ্যে একজন হলেন জন স্টক্সলি যিনি টিনডেলকে অক্সফোর্ডে থাকাকালীন জানতেন। পরিশেষে তিনি লন্ডনের বিশপ হিসাবে কুথবার্ট টানস্টলের স্থান নেন।
টিনডেলের প্রতি বিরোধিতা আরও প্রতীয়মান হয় উচ্চপদস্থ পাদ্রিদের সাথে তার সংঘর্ষের দ্বারা, যারা বলেছিল: “ঈশ্বরের নিয়মের পরিবর্তে বরঞ্চ পোপের নিয়মই আমাদের পক্ষে ভাল।” একটি স্মরণীয় বাক্যের মাধ্যমে টিনডেল উত্তর দিয়েছিলেন: ‘আমি পোপকে ও তার সমস্ত নিয়মকে অস্বীকার করি। যদি ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন, তাহলে কিছু বছরের মধ্যে আমি একটি চাষার ছেলেকে তোমাদের চাইতে অনেক বেশি শাস্ত্রীয় জ্ঞান অর্জন করতে সাহায্য করব।’
অর্কেস্টার ডাইওসিসের পরিচালকের সামনে টিনডেলকে ধর্মবিরোধিতার মিথ্যা অভিযোগের জন্য উপস্থিত হতে হয়। “তিনি আমাকে সাংঘাতিক ভয় দেখান ও গালাগালি করেন,” পরবর্তীকালে টিনডেল এই কথাগুলি বলেছিলেন আর এর সাথে যোগ দিয়ে তিনি এও বলেছিলেন যে তার সাথে “কুকুর” এর মত ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু প্রচলিত ধর্মবিরোধী সম্বন্ধীয় কোন অভিযোগই টিনডেলের বিরুদ্ধে পাওয়া যায়নি। ইতিহাসবেত্তারা বিশ্বাস করে যে এই সমস্ত বিষয়গুলি গোপনে টানস্টলের কাছে প্রচার করা হয় যাতে করে তার সিদ্ধান্তের উপর এর এক প্রভাব পড়ে।
এক বছর লন্ডনে থাকার পর, টিনডেল এই উপসংহারে আসেন: “আমার প্রভুর লন্ডনের প্রাসাদে নতুন নিয়মকে অনুবাদ করার কোন জায়গা নেই, এমনকি . . . সমগ্র ইংল্যান্ডে কোন স্থান নেই।” তিনি ঠিকই বলেছিলেন। লুথারের কাজের জন্য যে এক অবদম্য পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল এই রকম একটা পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডের কোন্ মুদ্রাকর ইংরাজিতে বাইবেল প্রকাশ করার সাহস করবে? অতএব ১৫২৪ সালে, টিনডেল ইংলিস চ্যানেল পার হন আর কখনও ফিরে আসেন না।
ইউরোপ অভিমুখে এবং নতুন সমস্যাগুলি
তার মূল্যবান বইগুলি সমেত, উইলিয়াম টিনডেল জার্মানিতে আশ্রয় পান। তিনি সঙ্গে করে ১০ পাউন্ড এনেছিলেন যা তার বন্ধু হামফ্রে মনমাউথ, লন্ডনের একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, দয়া করে তাকে দিয়েছিলেন। গ্রীক শাস্ত্রাবলী, যা তিনি অনুবাদ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন সেটিকে ছাপার জন্য টিনডেলের পক্ষে তখনকার দিনে সেই উপহারটির পরিমাণ যথেষ্ট ছিল। টিনডেলকে সাহায্য করার জন্য এবং লুথারের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর জন্য পরিশেষে মনমাউথকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর লন্ডনের টাওয়ারে তাকে নিক্ষেপ করা হয় আর পরিশেষে কারডিন্যাল ওলসির কাছে ক্ষমার আবেদন জানানোর পর মনমাউথকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জার্মানির কোন্ নির্দিষ্ট স্থানে টিনডেল গিয়েছিলেন তা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। কয়েকটি প্রমাণ হামবুর্গের প্রতি ইঙ্গিত দেয়, যেখানে হয়ত তিনি এক বছর কাটিয়েছিলেন। তার সাথে কি লুথারের দেখা হয়েছিল? এবিষয় সঠিক কোন প্রমাণ নেই, যদিও মনমাউথের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তাতে বলা হয়েছে যে তার সাথে দেখা হয়েছিল। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত: টিনডেল গ্রীক শাস্ত্রাবলী অনুবাদ করার কাজে সক্রিয়ভাবে ব্যস্ত ছিলেন। কোথায় তিনি তার হস্তলিখিত পান্ডুলিপি ছাপিয়ে ছিলেন? তিনি কোলোনে পিটার কুইনটেলকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
সব কিছুই ঠিক মত চলছিল, যতক্ষণ না বিরোধী জন ডবনেক, যিনি ককলিয়াস নামে পরিচিত, এই বিষয়ে জানতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে ককলিয়াস এই বিষয়টি ৮ম হেনরীর এক নিকট বন্ধুকে জানিয়ে দেন, যিনি তৎপরতার সাথে কুইনটেল যে টিনডেলের অনুবাদটি ছাপছিলেন তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেন।
টিনডেল ও তার সহকারী, উইলিয়াম রয়, তাদের জীবন হাতে নিয়ে সেই স্থান পরিত্যাগ করেন আর মথির সুসমাচার যা ইতিমধ্যেই ছাপা হয়ে গিয়েছিল তা সঙ্গে করে নিয়ে যান। তারা রাইন নদী অতিক্রম করে ওয়ার্মসে যান, যেখানে তারা তাদের কাজটিকে শেষ করেন। কালক্রমে, টিনডেলের নতুন নিয়ম এর ৬,০০০ প্রতিলিপি প্রকাশ করা হয়।b
সাফল্য—বিরোধিতা সত্ত্বেও
অনুবাদ করা ও ছাপা হল একটি বিষয়। ব্রিটেনে বাইবেল পাঠানো ছিল আরেকটি বিষয়। গির্জার প্রতিনিধিরা ও জাগতিক কর্তৃপক্ষেরা ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে জাহাজের মাধ্যমে চালান করাকে বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিল, কিন্তু বন্ধুত্বপরায়ণ বণিকদের কাছে এর উপায় ছিল। কাপড় ও অন্যান্য মালপত্রের মধ্যে লুকিয়ে খণ্ডের পর খণ্ডগুলি ইংল্যান্ডের তীরবর্তী স্থানগুলিতে এবং স্কটল্যান্ড অবধি পৌঁছে দেওয়া হয়। টিনডেল বেশ উৎসাহিত হন, কিন্তু তার লড়াই কেবলমাত্র শুরু হয়েছিল।
১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৫২৬ সালে, কারডিন্যাল ওলসি, ৩৬ জন বিশপ ও গির্জার সদস্য সমেত, “বাক্স ভরতি বই আগুনে ফেলে দেওয়া এই দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করার জন্য” লন্ডনের সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রেলে একত্রিত হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল টিনডেলের মূল্যবান অনুবাদের কয়েকটি প্রতিলিপি। এই প্রথম সংস্করণের মধ্যে মাত্র দুটি প্রতিলিপি এখনও রযেছে। একটি মাত্র সম্পূর্ণ প্রতিলিপি (কেবল প্রথম পাতাটি নেই) ব্রিটিশ গ্রন্থাগারে রয়েছে। আর কর্তৃত্বব্যঞ্জক বিষয়টি হল যে, আরেকটি প্রতিলিপি, যার মধ্যে ৭১টি পাতা নেই, সেটি সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রেলের গ্রন্থাগারে আবিষ্কৃত হয়েছে। কিভাবে সেটি সেখানে গিয়ে পৌঁছায়, তা কেউ জানে না।
অপ্রতিহত গতিতে, টিনডেল তার অনুবাদের নতুন সংস্করণগুলি উৎপাদন করেই চলেন, যেগুলি সুসংগঠিতভাবে ইংরেজ ক্লেরিকদের দ্বারা বাজেয়াপ্ত ও পুড়িয়ে ফেলা হয়। এরপর টানস্টল তার কৌশলতার পরিবর্তন করেন। তিনি অগাস্টিন প্যাকিনটান নামে এক ব্যবসায়ীর সাথে একটি চুক্তি করেন, যাতে করে তিনি টিনডেলের লেখা বইগুলি কেনেন, যার অন্তর্ভুক্ত হল নিউ টেস্টামেন্ট আর এইগুলিকে যাতে পুড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। এই ব্যবস্থাটি টিনডেলের সাথে করা হয়, যার সঙ্গে প্যাকিনটন একটি চুক্তি করেছিলেন। হ্যালের ক্রনকিল জানায়: “বিশপের কাছে বইগুলি ছিল, প্যাকিনটনের কাছে ছিল কৃতজ্ঞতা আর টিনডেলের কাছে ছিল টাকা। এরপর যখন আরও অধিক পরিমাণে নতুন নিয়মগুলি ছাপতে শুরু করা হল, তখন তা বিশাল সংখ্যায় ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছাতে শুরু করে।”
পাদ্রিরা কেন টিনডেলের অনুবাদের প্রতি এত তিক্ত বিরোধিতা করেছিল? যেখানে ল্যাটিন ভালগেট পবিত্র শাস্ত্রকে আচ্ছাদিত অবস্থায় রাখার চেষ্টা করেছিল, প্রাচীন গ্রীক থেকে নেওয়া টিনডেলের অনুবাদ, প্রথমবার ইংরেজদের কাছে স্পষ্ট ভাষায় বাইবেলের বার্তাটি তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ, টিনডেল ১ করিন্থীয় ১৩ অধ্যায়ে গ্রীক শব্দ আগাপে-কে “দান” হিসাবে অনুবাদ না করে “প্রেম” হিসাবে অনুবাদ করাকে বেছে নেন। তিনি “গির্জার” থেকে “মণ্ডলী” শব্দটির উপর বেশি জোর দেন এটা বোঝানোর জন্য যে এটি উপাসকদের চিত্রিত করছে, কোন গির্জার অট্টালিকাকে নয়। পাদ্রিরা তাদের ধৈর্য হারায় যখন টিনডেল “যাজক” শব্দটির পরিবর্তে “প্রাচীন” এবং “প্রায়শ্চিত্ত করা” এর পরিবর্তে “অনুতাপ” শব্দটি ব্যবহার করেন আর এটা করার দ্বারা তিনি পাদ্রিদের তাদের অধিকৃত যাজকের ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডেভিড ডানিয়েল বলেন: “সেখানে কোন পুরগাতরি ছিল না; সৌরভিত কোন স্বীকারোক্তি ও প্রায়শ্চিত্ত করার কোন ব্যাপার ছিল না। গির্জার সমৃদ্ধি ও ক্ষমতার পক্ষে দুটি সমর্থন ভেঙে যায়।” (উইলিয়াম টিনডেল—এ বাইয়োগ্রাফি) টিনডেলের অনুবাদ এইধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল এবং আধুনিক পণ্ডিতেরা সম্পূর্ণরূপে তার শব্দ বাছাইয়ের সঠিকতাকে সমর্থন করে।
অন্টওয়ার্প, বিশ্বাসঘাতকতা এবং মৃত্যু
১৫২৬ ও ১৫২৮ সালের মধ্যে, টিনডেল অন্টওয়ার্পে চলে যান, যেখানে তিনি ইংরেজ বণিকদের মাঝে নিরাপদে থাকেন। সেখানে তিনি দুষ্ট মাম্মনের দৃষ্টান্ত (ইংরাজি), এক খ্রীষ্টীয় পুরুষের বাধ্যতা (ইংরাজি) এবং প্রিলেটস্দের কার্যকলাপ (ইংরাজি) এই বইগুলি লেখেন। টিনডেল তার অনুবাদের কাজ চালিয়ে যান এবং তিনিই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ইব্রীয় শাস্ত্রাবলীর অনুবাদে ঈশ্বরের নাম, যিহোবা, ব্যবহার করেন। এই নামটি ২০ বারেরও বেশি ব্যবহার করা হয়।
যতদিন টিনডেল তার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী থমাস পয়েন্টসের সাথে অন্টওয়ার্পে ছিলেন, ততদিন তিনি ওলসি ও তার অনুচরদের চক্রান্ত থেকে নিরাপদে ছিলেন। রোগগ্রস্ত ও দুস্থ লোকেদের দেখাশোনা করার জন্য তিনি খুবই পরিচিত ছিলেন। পরিশেষে, হেনরী ফিলিপস নামে এক ইংরেজ ছলনাপূর্বকভাবে টিনডেলের বিশ্বাস জিতে নেন। এর ফলে, ১৫৩৫ সালে, টিনডেলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয় এবং তাকে ব্রাসেলের উত্তরে দশ কিলোমিটার দূরে ভিলভর্ডের প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে ১৬ মাস কারারুদ্ধ করে রাখা হয়।
কে ফিলিপসকে ভাড়া করেছিল তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না, কিন্তু সন্দেহের ইঙ্গিত সরাসরি বিশপ স্টক্সলির দিকেই যায়, যিনি সেই সময় লন্ডনে “প্রচলিত ধর্ম বিরোধীদের” পোড়ানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ১৫৩৯ সালে তার মৃত্যুসজ্জায়, স্টক্সলি “এই বিষয় আনন্দিত ছিল যে তার জীবনকালে সে পঞ্চাশজন প্রচলিত ধর্ম বিরোধীদের পুড়িয়ে মেরেছিল,” ডাব্লিউ. জে. হিটন দ্যা বাইবেল অফ দ্যা রিফরমেশন নামক বইটিতে বলেন। সেই সংখ্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন উইলিয়াম টিনডেল, যার দেহ ১৫৩৬ সালের অক্টোবর মাসে জনসাধারণের সামনে পোড়ানোর আগে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
ক্যাথলিক লোভেইন বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ফিলিপের নাম অন্তর্ভুক্ত, ছিল সেখানকার তিনজন বিখ্যাত ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞেরা সেই সমিতিতে উপস্থিত ছিল যেটি টিনডেলের বিচার করে। লোভেইনের তিনজন পাদ্রি এবং তিনজন বিশপ সেখানে উপস্থিত ছিলেন দেখার জন্য যে কিভাবে প্রচলিত ধর্ম বিরোধী হিসাবে টিনডেলের নিন্দা করা হয় এবং যাজকের পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সম্ভবত ৪২ বছর বয়সে তার মৃত্যুতে সকলে আনন্দ করেছিল।
“টিনডেল,” বায়োগ্রাফার রবার্ট ডিমাস প্রায় একশো বছরেরও আগে বলেছিলেন, “সবসময় তার নির্ভীক সততার জন্য সুপরিচিত ছিলেন।” তার সহযোগী জন ফ্রিথ, যাকে স্টক্সলি লন্ডনে পুড়িয়ে মারেন, তার উদ্দেশ্যে টিনডেল লিখেছিলেন: “আমার বিবেকের বিরুদ্ধে আমি ঈশ্বরের বাক্যের একটি শব্দও পরিবর্তন করিনি এবং আজও করব না, পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা আনন্দ, সম্মান অথবা ঐশ্বর্য, যা কিছুই আমাকে দেওয়া হোক না কেন?”
সুতরাং ইংল্যান্ডের লোকেরা যাতে সহজে বাইবেল বুঝতে পারে, সেটিকে দেওয়ার জন্যই উইলিয়াম টিনডেল তার নিজের জীবন দান করেছিলেন। কী সাংঘাতিক মূল্যই না তাকে দিতে হয়েছিল—কিন্তু কতই না অমূল্য এক উপহার!
[পাদটীকাগুলো]
a ফিডি ডিফেন্সর এই উপাধিটি শীঘ্রই রাজ্যে ব্যবহৃত মুদ্রার মধ্যে দেখা যেতে শুরু করে এবং হেনরী তার উত্তরাধিকারীদের উপরেও এই উপাধিটি দাবি করেন। আজকে ব্রিটেনের স্বর্ণ মুদ্রার উপর ফিড. ডেফ. অথবা শুধুমাত্র এফ.ডি. শব্দটি দেখা যায়। আগ্রহের বিষয হল যে, “বিশ্বাসের রক্ষক” এই উপাধিটি পরবর্তীকালে রাজা জেমসকে উৎসর্গ করে ১৬১১ সালের কিং জেমস ভারসন-এ ছাপা হয়।
b এই সংখ্যা অনিশ্চিত; কিছু কর্তৃপক্ষ বলে থাকেন ৩,০০০.
[২৯ পৃষ্ঠার বাক্স]
প্রাচীন অনুবাদগুলি
সাধারণ লোকের ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করার যে আবেদন টিনডেল করেছিলেন তা কখনই অযৌক্তিক বা পূর্ববর্তী নজিরবিহীন ছিল না। দশম শতাব্দীতে অ্যাংলো-স্যাক্সন এর অনুবাদ করা হয়েছিল। ল্যাটিন থেকে অনুবাদিত ছাপা বাইবেল অবাধগতিতে ইউরোপে ১৫শ শতাব্দীতে বন্টন করা হয়েছিল: জার্মান (১৪৬৬), ইতালীয়ান (১৪৭১), ফরাসী (১৪৭৪), চেক (১৪৭৫), ডাচ (১৪৭৭) ও ক্যাটালান (১৪৭৮). মার্টিন লুথার ১৫২২ সালে, তার নিউ টেস্টামেন্ট জার্মান ভাষায় প্রকাশ করেন। টিনডেলের কেবলমাত্র একটাই প্রশ্ন ছিল যে ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে কেন একই জিনিস করতে দেওয়া হবে না।
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্য]
Bible in the background: © The British Library Board; William Tyndale: By kind permission of the Principal, Fellows and Scholars of Hertford College, Oxford