যিহোবা আমাদের কখনও পরিত্যাগ করেননি
নাশো ডোরির দ্বারা কথিত
ম্রেষ্টান হল দক্ষিণ আলবেনিয়ার একটি ছোট পাহাড়ী গ্রাম, গ্রীস থেকে বেশি দূরে নয়। আমি ১৯০৭ সালে সেখানে জন্ম গ্রহণ করি। যখন আমার পাঁচ বছর বয়স, তখন আমি গ্রীক স্কুলে যেতে আরম্ভ করি, কিন্তু আমার স্কুলে যাওয়া বিঘ্নিত হয় যখন ইতালিয় সামরিক বাহিনী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আলবেনিয়া আক্রমণ করে। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি আবার স্কুলে যেতে শুরু করি, কিন্তু আলবেনিয়ান ভাষায়।
যদিও আমার বাবামা খুব একটা ধর্মীয় ভাবাপন্ন ছিলেন না, কিন্তু তারা আলবেনিয়ান অর্থোডক্স গির্জার রীতিনীতিগুলি পালন করতেন। আমার বাবার কাকা ছিলেন ম্রেষ্টানের একজন পুরোহিত, সুতরাং আমি গির্জার ভিতরে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম এবং সেখানে কী চলে তারও একটা আভাস পেয়েছিলাম। রীতিনীতিগুলি অসার বলে মনে হত এবং কপটতা আমাকে বিশেষভাবে বিচলিত করত।
স্থানীয় রীতি অনুসারে, আমার বাবা-মা একটি অল্পবয়সী মেয়েকে বেছে নেন আমার সাথে বিবাহ দেওয়ার জন্য। আরজিরো ছিল গ্রাবোভা নামক একটি নিকটবর্তী গ্রামের মেয়ে, আর আমাদের বিবাহ হয় ১৯২৮ সালে, যখন তার বয়স ছিল ১৮ বছর।
বাইবেলের সত্য শেখা
সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা আমার একজন আত্মীয়ের কাছে আমি অর্থোডক্স গির্জা সম্বন্ধে কিছু অভিযোগ করি। “আমেরিকায়, আমার বাড়ির কাছেই,” সে উত্তরে বলে, “একটি দল আছে যাদের কোন গির্জা নেই, কিন্তু তারা বাইবেল অধ্যয়ন করে।” গির্জা ছাড়া বাইবেল অধ্যয়ন করার ব্যাপারটি আমাকে খুবই আকর্ষিত করে। অতএব আমি তাকে বলি সে যদি আমাকে কিছু বাইবেল সাহিত্যাদি পাঠিয়ে দেয়।
আমাদের এই কথোপকথন সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম যতক্ষণ না একদিন প্রায় এক বছর পর আমি মিলওয়াকী, উইসকসিন থেকে একটি প্যাকেট পাই। ভিতরে ছিল আলবেনিয়া ভাষায় ঈশ্বরের বীনা (ইংরাজি) নামক বইটি এবং গ্রীক ভাষায় প্রহরীদুর্গ। আমি বইটির পাতা উলটাই এবং সত্য গির্জা সম্বন্ধে কিছু তথ্য দেখতে পাই। সেটাই আমাকে খুবই দুঃখিত করে তুলেছিল। ‘গির্জার সাথে আমি কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না,’ আমি নিজেকে বলি। অতএব আমি ভালভাবে বইটিকে পড়িনি।
১৯২৯ সালে, আমি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিই এবং আমাকে আলবেনিয়ার রাজধানী টিরানে পাঠান হয়। সেখানে আমার স্টাথি মুসির সাথে দেখা হয়, যিনি গ্রীক বাইবেল পাঠ করছিলেন। “আপনি কি গির্জায় যান?” আমি জিজ্ঞাসা করি। “না,” তিনি উত্তর দেন। “আমি গির্জা ছেড়ে দিয়েছি। আমি আন্তর্জাতিক বাইবেল ছাত্রদের মধ্যে একজন।” অপর এক সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে আমি রবিবার স্টাথির সাথে সভাতে যাই। সেখানে আমি জানতে পারি যে সত্য গির্জা কোন গৃহ বা ধর্ম নয়, কিন্তু এটি খ্রীষ্টের অভিষিক্ত দাসেদের নিয়ে গঠিত। এখন আমি বুঝতে পারি যে ঈশ্বরের বীনা কী বলতে চাইছিল।
নাশো ইড্রিজি ও স্পিরো ভ্রুহো ১৯২০ এর দশকের মাঝামাঝি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলবেনিয়ায় ফিরে আসেন এবং সেখানে তারা যা বাইবেলের সত্য শিখেছিলেন তা ছড়িয়ে দিতে আরম্ভ করেন। কয়েকজন বাইবেল ছাত্রদের সাথে আমি টিরানেতে সভায় যোগদান করতে আরম্ভ করি। শীঘ্রই এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে আমি যিহোবার সংগঠনকে খুঁজে পেয়েছি। সুতরাং ৪ঠা আগস্ট, ১৯৩০ সালে আমি একটি নিকটবর্তী নদীতে বাপ্তাইজিত হই।
এরপর আমি ম্রেষ্টানে ফিরে আসি এবং জুতো তৈরি করার আমার বৃত্তি আরম্ভ করি। কিন্তু, এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে বাইবেলের সত্য সম্বন্ধে আমি যা শিখেছি, অপরের সাথে তা বন্টন করতে শুরু করি। আমি তাদের বলতাম: “যীশু খ্রীষ্ট গির্জার কোন মূর্তি নন। তিনি জীবিত আছেন!”
বাধা সত্ত্বেও প্রচার করে যাওয়া
আহমেদ, বে জগু ১৯২৫ সালে ক্ষমতায় আসেন, নিজেকে ১৯২৮ সালে রাজা জগ ১ম বলে প্রতিপন্ন করেন এবং ১৯৩৯ সাল অবধি শাসন করেন। মানবাধিকার সম্বন্ধীয় তার মন্ত্রী আমাদের খ্রীষ্টীয় কাজ করার অনুমতি দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমাদের সমস্যা ছিল। এর কারণ হল দেশের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী, মুসা জুকা, রোমের পোপের সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিলেন। জুকা, আদেশ দেন যে কেবলমাত্র তিনটি ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে—মুসলিম, অর্থোডক্স এবং রোমান ক্যাথলিক। পুলিশেরা আমাদের বই নিয়ে নেওয়ার এবং আমাদের প্রচার কাজ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তারা অকৃতকার্য থেকে যায়।
১৯৩০ এর দশকে, আমি প্রায়ই আলবেনিয়ার একটি বড় শহর, বিরাটে যেতাম যেখান থেকে মিহাল সেসি আমাদের প্রচার কাজ পরিচালনা করতেন। আমরা সমগ্র শহর জুড়ে প্রচার করার ব্যবস্থা নিই। একবার আমাকে স্কোডার নামক একটি শহরে পাঠানো হয় দুই সপ্তাহের জন্য এবং আমি সেখানে অনেক সাহিত্যাদি অর্পণ করতে পেরেছিলাম। ১৯৩৫ সালে কেলসিরে শহরে প্রচার করার জন্য আমাদের একটি দল একটা বাস ভাড়া করেছিল। এরপর সমস্ত আলবেনিয়াতে আমরা কাজ করার ব্যবস্থা নিই এবং এই সব শহরগুলিতে যেমন পারমেট, লেসকভিক, এরসেক, কোরসে, পোগরাডেক ও এলবাসান। আমরা টিরানের কাজ শেষ করি ঠিক এমন সময় যাতে করে খ্রীষ্টের মৃত্যুর স্মরণার্থক পালন করতে পারি।
আধ্যাত্মিক খাদ্যের সরবরাহ আমাদের সাহায্য করেছে আত্মিকভাবে দৃঢ় থাকতে, অতএব আমরা কখনও পরিত্যক্তবোধ করিনি। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত আমি গ্রীক ভাষায় নিয়মিতভাবে প্রহরীদুর্গ পেয়ে এসেছি। এছাড়াও আমার লক্ষ্য ছিল প্রতিদিন অন্ততপক্ষে এক ঘন্টা বাইবেল পাঠ করা, যা আমি প্রায় ৬০ বছর ধরে করে এসেছি যতক্ষণ না আমার চোখের দৃষ্টি কমে আসে। মাত্র সম্প্রতি সমগ্র বাইবেলটি আলবেনিয়া ভাষায় পাওয়া যাচ্ছে, সুতরাং আমি খুশি যে ছোটবেলায় আমি গ্রীক শিখেছিলাম। সেই সময় অন্যান্য আলবেনিয়ার সাক্ষীরাও গ্রীক পড়তে শিখেছিল যাতে করে তারাও সমগ্র বাইবেলটি পড়তে পারত।
১৯৩৮ সালে আরজিরো বাপ্তাইজিত হয়। ১৯৩৯ সালের মধ্যে আমাদের দশটি সন্তানদের মধ্যে সাতটির ইতিমধ্যেই জন্ম হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, আমাদের সাতটি সন্তানদের মধ্যে প্রথম তিন জন খুব অল্প বয়সে মারা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কষ্ট
১৯৩৯ সালে এপ্রিল মাসে, ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ইটালির ফ্যাসিস্ট দল আলবেনিয়া আক্রমণ করে। এর কিছুদিন পরেই যিহোবার সাক্ষীদের কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, কিন্তু ৫০ জন রাজ্যের প্রকাশক সমেত আমাদের এই ছোট দলটি প্রচার করে চলে। আমাদের প্রায় ১৫,০০০ বই ও পুস্তিকা বাজেয়াপ্ত করা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এগুলিকে নষ্ট করে দেওয়া হয়।
জানি কোমিনোর বাড়ির সাথে সংযুক্ত সাহিত্যাদি রাখার জন্য একটি বড় গুদাম ঘর ছিল। যখন ইতালির সামরিক বাহিনী জানতে পারে যে বইগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছাপা হয়েছে, তখন তারা বিচলিত হয়ে পড়ে। “তোমরা মতপ্রচারক! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালির বিরুদ্ধে!” তারা বলে। থোমাই ও ভাসিলি কামা নামক উদ্যোগী যুবক ভাইয়েদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং যখন তারা জানতে পারে যে যে বইগুলি তারা বন্টন করেছে সেগুলি কোমিনোর কাছ থেকে এসেছে, তখন তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এর কিছু পরেই পুলিশের দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আমাকে তলব করা হয়।
“আপনি কি এই ব্যক্তিদের চেনেন?” তারা জিজ্ঞাসা করে।
“হ্যাঁ,” আমি উত্তর দিই।
“আপনি কি এদের সাথে কাজ করেন?”
“হ্যাঁ,” আমি উত্তর দিই। “আমরা যিহোবার সাক্ষী। আমরা সরকারগুলির বিরুদ্ধে নই। আমরা নিরপেক্ষ।”
“আপনারা কি এই সাহিত্যগুলি বিলি করছিলেন?”
আমি যখন ইতিবাচক সাড়া দিই, তারা আমায় হাতকড়া পরিয়ে দেয় এবং ১৯৪০ সালে ৬ই জুলাই আমাকে কারাবদ্ধ করা হয়। সেখানে আমার গ্রামের পাঁচ জনের সাথে দেখা হয়—যোশেফ কাসি, লুকান বারকো, জানি কোমিনো এবং কামা ভাইয়েরা। কারাগারে থাকার সময় আরও তিন জন সাক্ষীদের সাথে আমাদের দেখা হয়—গোরি নাসি, নিকোধিম শিটি এবং লেওনিডাস পোপ। আমাদের এই নয় জনকে ১.৮ ও ৩.৭ মিটার সেলের মধ্যে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে হয়!
কয়েকদিন বাদে, আমাদের একসাথে শিকলে বেঁধে পারমেট শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন মাস পর আমাদের টিরানের কারাগারে বদলি করা হয় আর সেখানে আমরা আরও আট মাস শুনানি ছাড়াই থাকি।
পরিশেষে, আমরা সামরিক আদালতে উপস্থিত হই। ভাই শিটি ও আমাকে ২৭ মাস, ভাই কোমিনোকে ২৪ মাস এবং অন্যান্যদের ১০ মাস পর ছেড়ে দেওয়া হয়। আমাদের গিরোকাস্টার কারাগারে বদলি করা হয়, যেখানে ভাই গোলে ফ্লোকো ১৯৪৩ সালে মুক্তি পেতে আমাদের সাহায্য করেন। এরপর আমার পরিবার পারমেট শহরে বসবাস করতে আরম্ভ করে যেখানে একটি ছোট মণ্ডলীতে আমি অধ্যক্ষের কাজে নিযুক্ত হই।
যদিও আমাদের কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং আমাদের চারধারের দেশগুলিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগে, কিন্তু আমরা যতদূর সম্ভব রাজ্যের বার্তা প্রচার করার দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার চেষ্টা করি। (মথি ২৪:১৪) ১৯৪৪ সালে মোট ১৫ জন সাক্ষী কারাবদ্ধ হয়। কিন্তু তবুও, এই কষ্টের সময়ও আমরা কখনও যিহোবার দ্বারা পরিত্যক্তবোধ করিনি।
নিরপেক্ষতার বিষয়ের উপর পরীক্ষা
যদিও ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়, তবুও আমাদের কষ্ট চলতেই থাকে এবং তা আরও তীব্ররূপ ধারণ করে। ১৯৪৬ সালের ২রা ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাধ্যতামূলকভাবে ভোট দেওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়। যদি কেউ এর থেকে বিরত থাকার সাহস দেখাত তাহলে তাকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসাবে গণ্য করা হত। আমাদের পারমেট মণ্ডলীর সদস্যেরা জিজ্ঞাসা করতে থাকে, “আমাদের কী করা উচিত?”
“যদি আপনি যিহোবাকে বিশ্বাস করেন,” আমি উত্তর দিই, “তাহলে আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না যে কী করতে হবে। আপনি ইতিমধ্যেই জানেন যে যিহোবার লোকেরা হল নিরপেক্ষ। তারা এই জগতের অংশ নয়।”—যোহন ১৭:১৬.
নির্বাচনের দিন আসে এবং সরকারি কর্তৃপক্ষেরা আমাদের ঘরে আসে। তারা শান্তভাবে শুরু করে, “আসুন আমরা এক কাপ কফি খাই ও কথা বলি। আপনারা কি জানেন যে আজ কী?”
“হ্যাঁ, আজ নির্বাচন হচ্ছে,” আমি উত্তর দিই।
“তাড়াতাড়ি করুন নয়ত দেরি হয়ে যাবে,” একজন অফিসার বলে ওঠেন।
“না, আমরা যাওয়ার কোন পরিকল্পনা করিনি। আমাদের ভোট যিহোবার জন্য,” আমি উত্তর দিই।
“ঠিক আছে, তাহলে বিরোধী পক্ষের হয়ে ভোট দিন।”
আমি ব্যাখ্যা করি যে যিহোবার সাক্ষীরা সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ। যখন আমাদের পরিস্থিতি সর্বজনবিদিত হয়ে পড়ে, তখন আরও আমাদের উপর চাপ আসতে থাকে। আমাদের সভা বন্ধ করে দেওয়ার আজ্ঞা দেওয়া হয়, অতএব আমরা গোপনে সভার আয়োজন করি।
আমাদের নিজেদের গ্রামে ফিরে আসা
১৯৪৭ সালে আমার পরিবার ও আমি ম্রেষ্টানে ফিরে আসি। কিছুদিন পরেই ডিসেম্বরের এক ঠাণ্ডার দুপুরে আমাকে সিগুরিমি (গোপন পুলিশ) দপ্তরে ডেকে পাঠান হয়। “আপনি কি জানেন কেন আমি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি?” কর্তৃপক্ষটি জিজ্ঞাসা করেন।
“মনে হয় আপনি আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পেয়েছেন,” আমি উত্তর দিই। “কিন্তু বাইবেল বলে যে জগৎ আমাদের ঘৃণা করবে, অতএব এই অভিযোগ আমাকে অবাক করেনি।”—যোহন ১৫:১৮, ১৯.
“আমার কাছে বাইবেল সম্বন্ধে কথা বলবেন না,” রুক্ষভাবে তিনি উত্তর দেন। “আমি আপনাকে প্রচুর মারধোর করব।”
কর্তৃপক্ষ ও তারা সঙ্গীরা প্রস্থান করে কিন্তু আমাকে ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে। এর কিছু সময় পর তিনি আবার তার দপ্তরে আমাকে ডেকে পাঠান এবং বলেন যে আমি যেন আমাদের বাড়িতে কোন সভা না করি। “আপনার গ্রামে কত লোকের বসতি?” তিনি জিজ্ঞাসা করেন।
“একশো কুড়িজন,” আমি উত্তর দিই।
“তাদের ধর্ম কী?”
“আলবেনিয়ান অর্থোডক্স।”
“আর আপনার?”
“আমি একজন যিহোবার সাক্ষী।”
“একশো কুড়িজন এক দিকে যাচ্ছে আর আপনি অন্য দিকে?” এরপর তিনি আমাকে গির্জার ভিতরে মোমবাতি জ্বালানোর আদেশ দেন। যখন আমি বলি যে আমি তা করতে পারব না, তখন তিনি আমাকে লাঠি দিয়ে মারতে আরম্ভ করেন। প্রায় দুপুর একটা নাগাদ আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সাহিত্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, আবার আমরা ডাকযোগে প্রহরীদুর্গ পেতে আরম্ভ করি, কিন্তু পরিশেষে পত্রিকাগুলি আর আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় না। এরপর একদিন রাত দশটার সময় গোপন পুলিশ বিভাগ আমাকে ডেকে পাঠায়। “গ্রীক ভাষায় একটি পত্রিকা এসেছে,” আমাকে বলা হয়, “এবং আমরা চাই যে আপনি আমাদের ব্যাখ্যা করে দিন যে এতে কী বিষয় লেখা আছে।”
“আমি খুব ভাল গ্রীক জানি না,” আমি বলি। “আমার প্রতিবাসীরা আমার চাইতে ভাল জানে। হয়ত তারা আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।”
“না, আমরা চাই যে আপনি আমাদের ব্যাখ্যা করুন,” প্রহরীদুর্গ এর একটা গ্রীক ভাষার কপি দেখিয়ে কর্তৃপক্ষটি বলেন।
“এগুলি আমার!” আমি বলে উঠি। “অবশ্যই, আমি এর ব্যাখ্যা করতে পারব। আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে এই পত্রিকাটি নিউ ইয়র্কের, ব্রুকলিন থেকে আসে। এখানেই যিহোবার সাক্ষীদের প্রধান অফিসটি অবস্থিত। আমি একজন যিহোবার সাক্ষী। কিন্তু মনে হচ্ছে যে এরা ঠিকানার কোন গোলমাল করেছে। এই পত্রিকাগুলি আমার কাছে পাঠানোর কথা আপনাদের কাছে নয়।”
তারা আমাকে সেই পত্রিকাটি ফিরত দিতে নারাজ হয়, আর সেই সময় থেকে আরম্ভ করে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা আলবেনিয়া ভাষায় কোন বাইবেল সাহিত্য পাইনি। সমগ্র এই বছরগুলি ধরে, আমরা আমাদের বাইবেল ব্যবহার করার দ্বারা প্রচার করে গিয়েছি। ১৯৪৯ সালে প্রায় ২০ জন সাক্ষী কারাগারে ছিল; এমনকি কয়েকজন পাঁচ-বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিল।
অসুবিধার বৃদ্ধি
১৯৫০ এর দশকে, লোকেদের একটি নথিপত্র নিজেদের কাছে রাখতে হত যাতে এটা প্রমাণ করা যায় যে তারা সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করে। কিন্তু যিহোবার সাক্ষীরা এইধরনের কোন নথিপত্র সঙ্গে রাখতে অস্বীকার করে। এই কারণে ভাই কোমিনো ও আমাকে আরও দুই মাস কারাগারে কাটাতে হয়।
এই সময় রাষ্ট্র কয়েকটি ধর্মের অস্তিত্বকে অনুমতি দেয়, আর আমাদের কিছুটা স্বাধীনতা বাড়ে। কিন্তু, ১৯৬৭ সালে সমস্ত ধর্মের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, যার ফলে আলবেনিয়া সম্পূর্ণভাবে নাস্তিক রাজ্যে পরিণত হয়। সাক্ষীরা সভা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু এটি খুবই অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে। আমাদের মধ্যে কয়েকজন জ্যাকেটের ভিতরে একটা বিশেষ পকেট সেলাই করি যাতে তার মধ্যে ছোট একটি বাইবেল লুকিয়ে রাখা যেতে পারে। এরপর আমরা ক্ষেত্রে গিয়ে এটি পড়ি।
টিরানে সাক্ষীরা ধরা পড়ে এবং তাদের মধ্যে তিনজনকে পাঁচ বছরের জন্য সুদূর সশ্রম শিবিরে দণ্ডিত করা হয়। এর ফলে তাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের মধ্যে যারা, সুদূর গ্রাম থেকে এসেছি তাদের কোথাও পাঠান হয় না, কারণ আমাদের খুব একটা বিপজ্জনক বলে বিবেচনা করা হত না। কিন্তু নিরপেক্ষতার জন্য আমাদের নাম খাদ্য তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অতএব জীবন খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে। এছাড়াও আমাদের আরও দুটি সন্তান মারা যায়। তবুও আমরা যিহোবার দ্বারা কখনও পরিত্যক্তবোধ করিনি।
আলবেনিয়াতে ভয় ছড়িয়ে ছিল। প্রত্যেকের উপর নজর রাখা হত, গোপনে পুলিশ সেইসব ব্যক্তিদের উপর রিপোর্ট লিখত যারা শাসক দলের বিরুদ্ধে কোন রকম মন্তব্য করার সাহস করত। অতএব আমাদের কাজকর্ম সম্বন্ধে কোন রিপোর্ট লেখার ক্ষেত্রে আমরা খুবই সজাগ থাকতাম। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উৎসাহ পাওয়ার জন্য আমরা দলগতভাবে দুই বা তিনজনের বেশি একত্রে মিলিত হতে পারতাম না। তবুও আমরা প্রচার বন্ধ করিনি।
ভাইয়েদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য, ছদ্মবেশী পুলিশেরা এই গুজব ছড়ায় যে টিরানের একজন সুপরিচিত সাক্ষী হল গুপ্তচর। এটা অনেকের মধ্যে আস্থা কমিয়ে দিয়েছিল এবং আমাদের একতা খানিকটা বিঘ্নিত হয়ে পড়ে। সম্প্রতি প্রকাশিত কোন বাইবেল সাহিত্যাদি না থাকার দরুন এবং যিহোবার দৃশ্যত সংগঠনের সাথে কোন যোগাযোগ না থাকায়, কয়েকজন ভয়ের বশীভূত হয়।
এছাড়াও, কর্তৃপক্ষেরা আরেকটি গুজব ছড়ায় যে স্পিরো ভ্রুহো, আলবেনিয়ার এক অত্যন্ত সম্মানিত খ্রীষ্টান প্রাচীন আত্মহত্যা করেছেন। “দেখতে পেলেন,” তারা বলে, “এমনকি ভ্রুহো পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলেন।” পরে অবশ্য জানা যায় যে ভাই ভ্রুহোকে হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালে, আরজিরো ও আমি আমাদের ছেলের সাথে কয়েক মাস টিরানে থাকি। নির্বাচনের সময়, শহরের কর্তৃপক্ষেরা আমাদের উপর চাপের সৃষ্টি করে এবং ভয় দেখায় যে: “যদি আপনারা ভোট না দেন তাহলে আমরা আপনার ছেলের চাকুরি নিয়ে নেব।”
“আমার ছেলে ২৫ বছর ধরে কাজ করছে,” আমি উত্তর দিই। “আপনাদের কাছে ওর ব্যক্তিগত রিপোর্ট ও পরিবার পরিচিতি রয়েছে। আমি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভোট দিইনি। এই তথ্যগুলি ব্যক্তিগত রিপোর্টের মধ্যেই সাধারণত থাকে। যদি না থাকে তাহলে আপনাদের রেকর্ডগুলি সঠিকভাবে সাজানো নেই। আর এটা যদি আপনাদের রেকর্ডে থাকে তাহলে এত বছর ধরে তাকে কাজ করতে দিয়ে আপনারা আপনাদের দলের প্রতি নিজেদের অবিশ্বস্ত প্রমাণ করেছেন।” এটা শোনার পর, কর্তৃপক্ষেরা বলে যে যদি আমরা ম্রেষ্টানে ফিরে যাই, তাহলে তারা এই বিষয়টির উপর জোর দেবে না।
নাটকীয় পরিবর্তন
১৯৮৩ সালে আমরা ম্রেষ্টান থেকে ল্যাক নামক একটি শহরে যাই। এর কিছু দিন পরেই, ১৯৮৫ সালে, সেখানকার একনায়ক শাসকের মৃত্যু ঘটে। তিনি ১৯৪৬ সালে বাধ্যতামূলক নির্বাচনের সময় থেকে শাসন করে আসছেন। কালক্রমে, তার ও স্টালিনের মূর্তি যা টিরানের প্রধান চৌমাথার মোড়কে দখল করে থাকত, তা সরিয়ে ফেলা হয়।
আমাদের কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন দশকগুলিতে, অনেক সাক্ষীদের উপর নৃশংসভাবে অত্যাচার করা হয়েছে এবং অনেকে মারাও গেছে। একজন ব্যক্তি কয়েকজন সাক্ষীদের রাস্তায় দেখতে পেয়ে বলে: “গণতন্ত্রের সময়, আমাদের মধ্যে সকলেই ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করি। কেবলমাত্র যিহোবার সাক্ষীরাই পরীক্ষা ও কষ্টের মধ্যেও তাঁর প্রতি বিশ্বততা বজায় রেখেছিল।”
যতই স্বাধীনতা বাড়তে থাকে, নয়জন খ্রীষ্টীয় পরিচর্যা সম্বন্ধে জুন ১৯৯১ সালে রিপোর্ট করে। জুন ১৯৯২ সালে, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার একমাস বাদে ৫৬ জন প্রচার কাজে অংশ নেয়। সেই বছরের প্রথম দিকে খ্রীষ্টের মৃত্যুর স্মরণার্থক দিবসে ৩২৫ জনের উপস্থিতি দেখে আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। সেই সময় থেকে প্রচার করার সংখ্যা বেড়ে ৬০০ এরও বেশি দাঁড়ায় এবং ১৪ই এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে স্মরণার্থক দিবসে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল মোট ৩,৪৯১ জন! সম্প্রতি বছরগুলিতে এটি দেখে আমি অত্যন্ত আনন্দ পাই যখন অধিক সংখ্যায় অল্পবয়সীরা আমাদের মণ্ডলীগুলিতে যোগদান করে।
আরজিরো যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ততা এবং এত বছর ধরে আমার প্রতিও আনুগত্য বজায় রেখেছে। যখন আমি কারাগারে ছিলাম অথবা প্রচার কাজের জন্য ভ্রমণ করতাম, সে তখন বিনা অভিযোগে আমার পরিবারের দেখাশোনা করত। আমাদের একটি ছেলে ও তার স্ত্রী ১৯৯৩ সালে বাপ্তাইজিত হয়। এটা আমাদের খুব আনন্দ দিয়েছিল।
কেবলমাত্র ঈশ্বরের রাজ্যের জন্য
এটি দেখতে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত যে আলবেনিয়াতে যিহোবার সংগঠন অত্যন্ত একতাবদ্ধ ও এটি আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি উপভোগ করছে। আমি নিজেকে ঠিক যিরূশালেমের শিমিয়োন মত মনে করি, যাকে মৃত্যুর আগে প্রতিজ্ঞাত মশীহকে দেখার এক মহান সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। (লূক ২:৩০, ৩১) এখন যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে কোন্ ধরনের সরকার আমি পছন্দ করি, আমি বলি: “আমি গণতন্ত্র অথবা পুঁজিবাদ কোনটাই পছন্দ করি না। জমির মালিক মানুষ বা রাষ্ট্র সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সরকারগুলি রাস্তা তৈরি করে, সুদূর গ্রামে বিদ্যুৎ নিয়ে আসে এবং কিছুটা শৃঙ্খলতাও আনে। কিন্তু, যিহোবার সরকার, তাঁর স্বর্গীয় রাজ্যই হল আলবেনিয়ার এবং সমস্ত পৃথিবীর কষ্টকর সমস্যার একমাত্র সমাধান।”
ঈশ্বরের রাজ্য প্রচারের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ঈশ্বরের দাসেরা যা করছে তা কোন মানুষের কাজ নয়। এটা হল ঈশ্বরের কাজ। আমরা হলাম তাঁর দাস। যদিও আলবেনিয়াতে আমাদের অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং অনেকদিন ধরে যিহোবার দৃশ্যত সংগঠন থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম, কিন্তু তবুও আমরা কখনও তাঁর দ্বারা পরিত্যক্ত হইনি। তাঁর আত্মা সবসময়ই এখানে ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি আমাদের পরিচালনা করেছেন। আমি আমার সমগ্র জীবন ধরে এটা অনুভব করে এসেছি।