“স্বর্ণের পরিবর্তে, আমি হীরেগুলি খুঁজে পেয়েছি”
মিকালিস কামিনারিস দ্বারা কথিত
দক্ষিণ আফ্রিকা যেখানে আমি স্বর্ণের অন্বেষণে গিয়েছিলাম সেখানে পাঁচ বছর থাকার পর, আরও মূল্যবান কিছু নিয়ে আমি গৃহে ফিরে আসি। সেই সম্পদ সম্পর্কে আমাকে আপনাদের কাছে বলতে দিন, এখন আমি যার অধিকারী এবং বন্টন করতে আকাঙ্ক্ষী।
আয়োনিয়ান সাগরের সেফালোনিয়ার গ্রীক দ্বীপে ১৯০৪ সালে আমি জন্মগ্রহণ করি। অল্পকাল পরেই আমার বাবামা উভয়েই মারা যান, তাই আমি একজন অনাথ হিসাবে বড় হয়ে উঠি। আমি সাহায্যের জন্য আকাঙ্ক্ষী ছিলাম আর তাই প্রায়ই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম। যদিও আমি নিয়মিতভাবে গ্রীক অর্থোডক্স গির্জায় যোগ দিতাম, তথাপি বাইবেল সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম। আমি কোন সান্ত্বনা খুঁজে পাইনি।
১৯২৯ সালে, আমি দেশান্তরী হওয়ার এবং অধিকতর উত্তম এক জীবন অন্বেষণ করার সিদ্ধান্ত নিই। আমার নিষ্ফলা দ্বীপ ছেড়ে, আমি ইংল্যান্ড হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে জলপথে যাত্রা করি। সমুদ্রে ১৭ দিন থাকার পরে, আমি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে পৌঁছাই, যেখানে একজন স্বদেশবাসী আমাকে তৎক্ষণাই চাকুরি দেয়। কিন্তু, আমি বস্তুগত সম্পদে সান্ত্বনা খুঁজে পাইনি।
আরও মহামূল্যবান কিছু
সেইসময় দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হয়েছিল যখন যিহোবার সাক্ষীদের একজন আমার কর্মস্থলে সাক্ষাৎ করে এবং আমাকে গ্রীক ভাষায় বাইবেল সাহিত্য দেয়। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল মৃতেরা কোথায়? (ইংরাজি) এবং উৎপীড়ন, কখন তা শেষ হবে? (ইংরাজি) নামক পুস্তিকাগুলি। আমার ভালভাবে স্মরণে আছে, কী তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমি সেগুলি পড়েছিলাম, এমনকি সমস্ত উদ্ধৃত পদগুলি মুখস্থ করেছিলাম। একদিন আমি একজন সহকর্মীকে বলেছিলাম: “বিগত বছরগুলি ধরে আমি যার অনুসন্ধান করছিলাম তা আমি খুঁজে পেয়েছি। স্বর্ণের জন্য আমি আফ্রিকাতে এসেছিলাম, কিন্তু স্বর্ণের পরিবর্তে আমি হীরেগুলি খুঁজে পেয়েছি।”
এটি অত্যন্ত আনন্দের ছিল যখন আমি জেনেছিলাম যে ঈশ্বরের একটি ব্যক্তিগত নাম আছে, যিহোবা, তাঁর রাজ্য ইতিমধ্যে স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আমরা এই বিধিব্যবস্থার শেষ কালে বাস করছি। (গীতসংহিতা ৮৩:১৮; দানিয়েল ২:৪৪; মথি ৬:৯, ১০; ২৪:৩-১২; ২ তীমথিয় ৩:১-৫; প্রকাশিত বাক্য ১২:৭-১২) এটি জানা কতই না রোমাঞ্চকর ছিল যে যিহোবার রাজ্য মানবজাতির সকল সম্প্রদায়ের জন্য অন্তহীন আশীর্বাদগুলি নিয়ে আসবে! অপর একটি বিষয় যা আমাকে প্রভাবিত করে তা ছিল যে এই মহামূল্যবান সত্যগুলি বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হচ্ছে।—যিশাইয় ৯:৬, ৭; ১১:৬-৯; মথি ২৪:১৪; প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪.
আমি শীঘ্রই কেপ টাউনে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির শাখা অফিসের ঠিকানা খুঁজে বের করি এবং আরও বাইবেল সাহিত্যাদি সংগ্রহ করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাইবেলের একটি কপি লাভ করে বিশেষভাবে আনন্দিত হই। আমি যা পড়ি তা আমাকে সাক্ষ্য দিতে প্রণোদিত করেছিল। আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্বব এবং আমার বাসস্থান লিক্সোরিওনের পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে বাইবেল প্রকাশনাদি পাঠানোর মাধ্যমে আমি শুরু করি। আমার অধ্যয়ন থেকে, ক্রমান্বয়ে আমি বুঝতে পারি যে যিহোবাকে খুশি করতে হলে একজনকে তার জীবন তাঁর কাছে উৎসর্গ করতে হবে। তাই আমি অবিলম্বে প্রার্থনায় তা করি।
কোন একটি উপলক্ষে, আমি যিহোবার সাক্ষীদের একটি সভাতে যোগ দিই, কিন্তু যেহেতু আমি ইংরাজি জানতাম না, তাই আমি একটি শব্দও বুঝতে পারিনি। যখন আমি জানতে পারি যে পোর্ট এলিজাবেথে অনেক গ্রীকেরা বসবাস করে, তখন আমি সেখানে যাই, কিন্তু আমি কোন গ্রীক-ভাষী সাক্ষীকে খুঁজে পেতে বিফল হই। তাই, একজন পূর্ণ-সময়ের সুসমাচার প্রচারক হওয়ার জন্য আমি গ্রীসে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার মনে আছে, আমি নিজেকে বলেছিলাম, ‘আমি গ্রীসে ফিরে যাব তার জন্য আমাকে যাই মূল্য দিতে হোক না কেন।’
গ্রীসে পূর্ণ-সময় পরিচর্যা
১৯৩৪ সালের বসন্তকালে আমি ইতালীয় সামুদ্রিক জাহাজ ডুলিওর ডেকের উপর ছিলাম। আমি ফ্রান্সের মার্সেলিসে পৌঁছাই এবং সেখানে ১০ দিন থাকার পর, গ্রীসের উদ্দেশ্যে যাত্রীবাহী জাহাজ পেট্রিস-এ আরোহণ করি। যখন আমরা সমুদ্রে, তখন জাহাজটির যান্ত্রিক গোলযোগ হয় এবং রাতে জীবন রক্ষাকারী নৌকাগুলিকে সমুদ্রে নামানোর আদেশ দেওয়া হয়। তখন আমি পুনরায় গ্রীসে যে কোন মূল্যে ফিরে যাওয়া সম্পর্কিত আমার চিন্তাকে স্মরণ করি। কিন্তু, পরিশেষে একটি ইতালীয় টাগবোট এসে পৌঁছায় এবং আমাদের ইতালীর নেপলসে টেনে নিয়ে যায়। পরে আমরা শেষপর্যন্ত গ্রীসের পিরেফসে (পাইরেয়াস) পৌঁছাই।
সেখান থেকে আমি এথেন্সে যাই যেখানে আমি ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির শাখা অফিস পরিদর্শন করি। শাখা অধ্যক্ষ, আথানাসিয়স কারানাসিয়সের সাথে এক আলোচনায় আমি পূর্ণ-সময় প্রচার করার কার্যভার পাওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করি। তার পরের দিন আমি গ্রীসের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ অংশ, পেলোপনিসসের দিকে যাত্রা করি। আমার ব্যক্তিগত এলাকা হিসাবে এই সম্পূর্ণ জেলাটির জন্য আমাকে নিযুক্ত করা হয়!
অসীম উদ্দীপনার সাথে আমি প্রচার কাজ শুরু করি, শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে, খামারে খামারে এবং বিচ্ছিন্ন গৃহে থেকে বিচ্ছিন্ন গৃহে যাওয়ার দ্বারা। শীঘ্রই মাইকেল ট্রিয়াণ্ডাফিলোপলোস আমার সাথে যোগ দেন, যিনি ১৯৩৫ সালের গ্রীষ্মকালে আমাকে বাপ্তিস্মিত করেন—আমার পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা শুরু করার এক বছরেরও কিছু বেশি সময় পরে! কোন জনসাধারণের পরিবহণ প্রাপ্তিসাধ্য ছিল না, তাই আমাদের সব জায়গায় হেঁটে যেতে হত। আমাদের সর্বপ্রধান সমস্যা ছিল যাজকদের বিরোধিতা, যারা আমাদের থামাতে যে কোন কিছু করত। ফলস্বরূপ, আমরা প্রচুর প্রতিকূল ধারণার সম্মুখীন হই। তথাপি, বাধাগুলি সত্ত্বেও, সাক্ষ্য দেওয়ার কাজ করা হয় এবং যিহোবার নাম সর্বত্র ঘোষিত হয়।
বিরোধিতা সহ্য করা
একদিন সকালে, আরকাদিয়ার পার্বত্য এলাকায় প্রচার করার সময়ে, আমি ম্যাগোলিয়ানা গ্রামে পৌঁছাই। এক ঘন্টা সাক্ষ্য দেওয়ার পর, আমি গির্জার ঘন্টা শুনতে পাই এবং শীঘ্রই বুঝতে পারি যে তারা আমার জন্য বাজাচ্ছে! একজন গ্রীক অর্থোডক্স আর্চিম্যানড্রাইটের (বিশপের নিচে গির্জার এক মর্যাদাপূর্ণ পদ) নেতৃত্বাধীনে এক উত্তেজিত জনতা একত্রিত হয়। আমি তাড়াতাড়ি আমার সাক্ষ্যদানের ব্যাগ বন্ধ করি এবং নীরবে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি। তার পশ্চাদ্গামী ছেলেমেয়ের একটি দলসহ, আর্চিম্যানড্রাইট সরাসরি আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তিনি চিৎকার করতে শুরু করেন: “এই সেই লোক! এই সেই লোক!”
ছেলেমেয়েরা আমাকে ঘিরে একটি দৃঢ় চক্র গড়ে তোলে এবং যাজক অগ্রসর হন ও তার বৃহৎ প্রসারিত ভুড়ি দ্বারা আমাকে ধাক্কা দিতে শুরু করে বলেন যে তিনি আমাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে চান না ‘যেহেতু আমি হয়ত দূষিত।’ তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, “ওকে মার! ওকে মার!” কিন্তু ঠিক তখনই একজন পুলিশ কর্মকর্তা আসেন এবং আমাদের উভয়কে থানায় নিয়ে যান। একটি দলকে উত্তেজিত করায় যাজককে বিচারের জন্য আদালতে হাজির করা এবং ৩০০ ড্রাকমা আর অতিরিক্ত আদালতের ব্যয়সমূহ জরিমানা করা হয়। আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আমরা যখন একটি নতুন এলাকায় পৌঁছাই, তখন আমাদের কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসাবে আমরা একটি বৃহত্তর শহরকে বেছে নিই এবং সেখান থেকে চার-ঘন্টা হাঁটা পথের দূরত্বের মধ্যে সমগ্র এলাকা আমরা সম্পূর্ণ করি। এর অর্থ যে সকালে অন্ধকার থাকতে আমরা রওনা দিতাম এবং সন্ধ্যায় অন্ধকার নেমে আসার পর গৃহে ফিরে আসতাম, সাধারণতঃ প্রতি দিন একটি অথবা দুটি গ্রাম ভ্রমণ করে। চতুর্দিকের গ্রামগুলি সম্পূর্ণ করার পর, আমরা কেন্দ্রীয় শহরটিতে প্রচার করি এবং তারপর অন্য স্থানে যাই। আমাদের প্রায়ই গ্রেপ্তার করা হত কারণ যাজকেরা আমাদের বিরুদ্ধে লোকেদের উত্তেজিত করে তুলত। মধ্য গ্রীসের, পারনাসাস অঞ্চলে পুলিশ কয়েক মাস ধরে আমার অন্বেষণ করে। কিন্তু, তারা কখনই আমাকে ধরতে পারেনি।
একদিন ভাই ট্রিয়াণ্ডাফিলোপলোস এবং আমি বিয়োসিয়া জেলার মুরিকী গ্রামে প্রচার করছিলাম। আমরা গ্রামটিকে দুটি বিভাগে বিভক্ত করি এবং আমি চরাই স্থানের গৃহগুলিতে প্রচার করতে শুরু করি, কারণ আমি বয়সে ছোট ছিলাম। হঠাৎ আমি নিচ থেকে চিৎকার শুনতে পাই। নিচে নামার সময়ে আমি মনে মনে চিন্তা করি, ‘ভাই ট্রিয়াণ্ডাফিলোপলোসকে প্রহার করা হচ্ছে।’ গ্রামবাসীরা স্থানীয় কফিখানায় একত্রিত হয়েছে এবং একজন যাজক একটি ক্রুদ্ধ ষাঁড়ের মত ইতস্ততঃ জোরে জোরে হাঁটছেন। তিনি চিৎকার করছিলেন, “এই লোকেরা বলে আমরা ‘সর্পের বংশ।’”
যাজকটি ইতিমধ্যেই ভাই ট্রিয়াণ্ডাফিলোপলোসের মাথায় একটি লাঠি ভেঙ্গেছিলেন, আর তাই তার মুখের উপর দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। রক্ত পরিষ্কার করার পর, আমরা সেখান থেকে বের হয়ে যেতে সক্ষম হই। আমরা থিবস্ শহরে পৌঁছানো পর্যন্ত তিন ঘন্টা হাঁটি। সেখানে একটি চিকিৎসালয়ে ক্ষত স্থানের পরিচর্যা করা হয়। আমরা ঘটনাটি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করি এবং একটি মামলা নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু, যাজকটির যোগাযোগ ছিল আর তাই শেষপর্যন্ত বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
যখন লোকাস শহরে আমরা কাজ করছিলাম, তখন এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের একজনের অনুগামীরা আমাদের “গ্রেপ্তার করে” এবং গ্রামের কফিখানায় নিয়ে আসে, যেখানে আমাদের অস্থায়ী গণ আদালতে অভিযুক্ত করা হয়। রাজনৈতিক নেতা এবং তার লোকেরা আমাদের চারিদিকে পালাক্রমে ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করছিল ও কথা বলছিল—ক্রমাগত চিৎকার করছিল—আর তাদের দৃঢ়ভাবে বদ্ধ মুষ্ঠি দ্বারা আমাদের ভয় দেখাচ্ছিল। তারা সকলে অত্যধিক পান করেছিল। আমাদের প্রতি তাদের নিন্দাযুক্ত চিৎকার দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্রমাগত চলে, কিন্তু আমরা অবিচলিত থাকি ও হাসি বজায় রাখি আর আমরা আমাদের নির্দোষ অবস্থা সম্বন্ধে ঘোষণা করি এবং সাহায্যের জন্য নীরবে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি।
সন্ধ্যাবেলায় দুজন পুলিশ আমাদের উদ্ধার করেন। তারা আমাদের থানায় নিয়ে যান এবং আমাদের সাথে ভাল ব্যবহার করেন। তার কাজের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে, রাজনৈতিক নেতা পরের দিন আসেন এবং গ্রীসের রাজার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে আমাদের অভিযুক্ত করেন। তাই পুলিশ, আরও তদন্তের জন্য দুজন রক্ষীর দ্বারা আমাদের লামিয়া শহরে পাঠিয়ে দেন। সাত দিনের জন্য আমরা আটক থাকি এবং তারপর বিচারের জন্য হাত-কড়া পরা অবস্থায় লারিসা শহরে নিয়ে যাওয়া হয়।
লারিসায় আমাদের খ্রীষ্টীয় ভাইয়েরা, যারা আগেই অবহিত হয়েছিলেন, তারা আমাদের পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। যে প্রচুর পরিমাণ ভালবাসা তারা আমাদের প্রতি দেখান তা রক্ষীদের জন্য এক উত্তম সাক্ষ্য ছিল। আমাদের উকিল, যিহোবার সাক্ষীদের একজন এবং একজন প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল, সেই শহরে সুপরিচিত ছিলেন। যখন তিনি আদালতে আসেন এবং আমাদের মামলার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন, তখন আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় এবং আমাদের মুক্ত করে দেওয়া হয়।
যিহোবার সাক্ষীদের প্রচারের সর্বজনীন সাফল্য চরম বিরোধিতার দিকে পরিচালিত করে। ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে ধর্মান্তরিতকরণের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত আইনগুলি পাশ হয় এবং এই বিষয়ে আমি ও মাইকেল কয়েক ডজন আদালতের মামলায় জড়িয়ে পড়ি। পরবর্তীকালে, শাখা অফিস আমাদের পৃথকভাবে কাজ করার পরামর্শ দেয় যাতে করে আমাদের কার্যক্রমের প্রতি কম মনোযোগ আকর্ষিত হয়। একজন সঙ্গী না থাকা আমার কাছে কঠিন মনে হয়েছিল। তথাপি, যিহোবাতে নির্ভর করে, আমি আটিকা, বিয়োসিয়া, থায়োটিস, ইবোয়া, এয়িটোলিয়া, আকার্নানিয়া, উরাটানিয়ার জেলাগুলি এবং পেলোপনিসসের জেলাটি পায়ে হেঁটে সম্পূর্ণ করি।
এই সময়ে আমাকে যা সাহায্য করে তা ছিল যিহোবাতে নির্ভর করা সম্বন্ধে গীতরচকের সুন্দর বাক্যগুলি: “তোমার দ্বারা আমি সৈন্যদলের বিরুদ্ধে দৌড়ি; আমার ঈশ্বরের দ্বারা প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করি। ঈশ্বর বল দিয়া আমার কটিবন্ধন করিয়াছেন। তিনি আমার পথ সিদ্ধ করিয়াছেন। তিনি আমার চরণ হরিণীর চরণবৎ করেন, আমার উচ্চস্থলীতে আমাকে সংস্থাপন করেন।”—গীতসংহিতা ১৮:২৯, ৩২, ৩৩.
১৯৪০ সালে, ইতালী গ্রীসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং তারপর শীঘ্রই জার্মান সৈন্যেরা দেশটি দখল করে নেয়। সামরিক আইন জারি এবং ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির বইগুলি নিষিদ্ধ করা হয়। গ্রীসে সেই সময়টি যিহোবার সাক্ষীদের জন্য কঠিন ছিল; তৎসত্ত্বেও নাটকীয়ভাবে তারা সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়—১৯৪০ সালে ১৭৮ জন সাক্ষী থেকে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১,৭৭০ জনে পরিণত হয়!
বেথেলে পরিচর্যা করা
১৯৪৫ সালে, এথেন্সে যিহোবার সাক্ষীদের শাখা অফিসে পরিচর্যা করার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানান হয়। বেথেল কথাটির অর্থ হচ্ছে “ঈশ্বরের গৃহ,” যেটি তখন লুম্বার্ডু স্ট্রীটে একটি ভাড়া করা গৃহে অবস্থিত ছিল। অফিসগুলি এক তলাতে এবং মুদ্রণ ব্যবস্থা ভূগর্ভস্থ কক্ষে ছিল। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল একটি ছোট ছাপাখানা এবং একটি ট্রিমিং মেশিন। প্রথমে ছাপাখানার কর্মী মাত্র দুজন ব্যক্তি নিয়ে গঠিত ছিল, কিন্তু শীঘ্রই অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজে সহযোগিতা করতে গৃহ থেকে যাতায়াত শুরু করে।
নিউ ইয়র্ক ব্রুকলিনে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির প্রধান কার্যালয়ের সাথে যোগাযোগ ১৯৪৫ সালে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই বছরে আমরা গ্রীসে পুনরায় নিয়মিত ভিত্তিতে প্রহরীদুর্গ ছাপাতে শুরু করি। তারপর, ১৯৪৭ সালে, আমরা আমাদের শাখা ১৬ টিনেডু স্ট্রীটে স্থানান্তরিত করি, কিন্তু ছাপাখানা লুম্বার্ডু স্ট্রীটেই থেকে যায়। পরবর্তীকালে ছাপাখানাটি লুম্বার্ডু স্ট্রীট থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে একজন সাক্ষীর কারখানায় স্থানান্তরিত করা হয়। তাই কিছু সময়ের জন্য আমাদের তিনটি স্থানে যাতায়াত করতে হত।
ভোর হওয়ার আগেই আমাদের বাসগৃহ ত্যাগ করা এবং ছাপাখানায় যাওয়ার কথা আমি স্মরণ করতে পারি। সেখানে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করার পর, আমি লুম্বার্ডু স্ট্রীটে যেতাম যেখানে আমরা যে কাগজগুলি ছাপাতাম তা নিয়ে যাওয়া হত। এগুলিকে সেখানে পত্রিকার আকারে ভাঁজ করা, সেলাই করা এবং হাতে ছাঁটা হত। পরে আমরা সম্পূর্ণ পত্রিকাগুলিকে ডাক বিভাগে নিয়ে যেতাম, সেগুলিকে তিনতলায় বহন করে নিয়ে যেতে, শ্রেণীভুক্ত করতে এবং ডাকযোগে পাঠানোর জন্য খামগুলির উপর ডাক টিকিট লাগাতে কর্মীদের সাহায্য করতাম।
১৯৫৪ সালের মধ্যে গ্রীসে সাক্ষীদের সংখ্যা ৪,০০০ এর অধিকে বৃদ্ধি পায় এবং ফলে প্রসারিত সুযোগসুবিধার প্রয়োজন হয়। তাই, আমরা এথেন্সের কেন্দ্রস্থলে কার্টালি স্ট্রীটে তিন-তলাবিশিষ্ট নতুন বেথেলে স্থানান্তরিত হই। ১৯৫৮ সালে, রান্নাঘরের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমাকে বলা হয় এবং ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সেটি ছিল আমার দায়িত্ব। ইত্যবসরে, ১৯৫৯ সালে, আমি এলিফ্থেরিয়াকে বিবাহ করি, যে যিহোবার পরিচর্যায় এক বিশ্বস্ত সহকারিণী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল।
পুনরায় বিরোধিতা সহ্য করা
১৯৬৭ সালে এক সামরিক দল ক্ষমতা দখল করে আর আমাদের প্রচার কাজের উপর আরও একবার বাধানিষেধ আরোপিত হয়। কিন্তু, আমাদের কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞার সাথে মোকাবিলা করার আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে, আমরা দ্রুত সমন্বয় সাধন করি এবং সফলভাবে গোপনে কাজ চালিয়ে যাই।
আমরা আমাদের সভাগুলি ব্যক্তিগত গৃহগুলিতে করতাম এবং আমাদের ঘরে-ঘরে পরিচর্যা কাজে সাবধানতা অবলম্বন করতাম। তৎসত্ত্বেও, আমাদের ভাইয়েদের নিয়মিতভাবে গ্রেপ্তার করা হয় এবং আদালতে মামলা বাড়তে থাকে। আমাদের আইনজীবীরা দেশের বিভিন্ন অংশে অনুষ্ঠিত বিচার পরিচালনা করতে যাতায়াতে ব্যস্ত থাকতেন। বিরোধিতা সত্ত্বেও, বেশির ভাগ সাক্ষীরা তাদের প্রচার কার্যে নিয়মিত ছিল, বিশেষভাবে সপ্তাহশেষগুলিতে।
আমাদের নিয়মমাফিক শনিবার অথবা রবিবারের প্রচার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর, আমাদের দলগুলিতে কেউ নিখোঁজ হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হত। সাধারণতঃ যারা নিখোঁজ তাদের নিকটবর্তী থানায় আটক করে রাখা হত। তাই আমরা তাদের জন্য কম্বল ও খাদ্য নিয়ে যেতাম এবং তাদের উৎসাহ দিতাম। এছাড়াও, আমরা আমাদের আইনজীবীদের জানাতাম, তখন যাদের কয়েদ করা হয়েছে তাদের স্বপক্ষে সরকারি উকিলেন সম্মুখে সোমবারে উপস্থিত হবেন। আমরা আনন্দের সাথে এই পরিস্থিতির মোকাবলি করেছিলাম কারণ আমরা সত্যের নিমিত্তে কষ্টভোগ করছিলাম!
নিষেধাজ্ঞার সময়ে বেথেলে আমাদের ছাপার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তাই এলিফ্থেরিয়া এবং আমি এথেন্সের শহরতলিতে যে গৃহে থাকতাম সেটি এক প্রকার ছাপাখানায় পরিণত হয়। এলিফ্থেরিয়া একটি ভারী টাইপরাইটার ব্যবহার করে প্রহরীদুর্গ এর প্রবন্ধগুলি টাইপ করত। সে একেক বার ১০ খণ্ড কাগজ টাইপরাইটারে প্রবেশ করাত এবং খুব জোরে চাপ দিতে হত যাতে করে অক্ষরগুলি ছাপা হয়। তারপর আমি পৃষ্ঠাগুলি সংগ্রহ করে সেগুলি একসাথে সেলাই করতাম। প্রত্যেক সন্ধ্যা থেকে এই কাজ মধ্যরাত পর্যন্ত চলত। একজন পুলিশ নিচের তলায় থাকতেন এবং আমরা এখনও আশ্চর্য হই কেন তিনি কখনও সন্দেহ করেননি।
ক্রমাগত সম্প্রসারণে আনন্দ করা
১৯৭৪ সালে গ্রীসে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং আমাদের প্রচার কাজ পুনরায় আরও প্রকাশ্যভাবে চলতে থাকে। তথাপি, আমাদের কাজের উপর সাত বছর বাধানিষেধ চলাকালীন সময়ে, আমরা ৬,০০০ এর অধিক নতুন সাক্ষীদের এক বিস্ময়কর বৃদ্ধি উপভোগ করি, যা সর্বমোট ১৭,০০০ এর অধিক রাজ্য ঘোষণাকারীদের সংখ্যায় পৌঁছে দেয়।
এছাড়াও আমরা শাখার স্থানগুলিতে আমাদের নিয়মিত ছাপানোর কার্যক্রম পুনরায় আরম্ভ করি। ফলস্বরূপ, শীঘ্রই কার্টালি স্ট্রীটের বেথেল সুযোগসুবিধাগুলি অত্যন্ত অপরিসর হয়ে পড়ে। তাই এথেন্সের শহরতলি মারুসিতে ২.৫ একর জমি ক্রয় করা হয়। নতুন বেথেল অট্টালিকাগুলি তৈরি করা হয় যার অন্তর্ভুক্ত ২৭টি শয়নকক্ষ, একটি কারখানা, অফিসগুলি এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধাগুলি। এগুলি ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে উৎসর্গীকৃত করা হয়।
কালক্রমে, আমাদের এমনকি আরও জায়গার প্রয়োজন হয়। তাই এথেন্সের প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তরে ৫৪ একর জমি ক্রয় করা হয়। জমিটি ইলিওনায়, পর্বতের দৃশ্য এবং সজল উপত্যকা সহ পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত ছিল। সেখানে ১৯৯১ সালের এপ্রিলে, আরও বৃহত্তর সুযোগসুবিধা যার অন্তর্ভুক্ত ২২টি গৃহ, যেগুলির প্রত্যেকটিতে আটজন লোক থাকতে পারে সেগুলি আমরা উৎসর্গ করি।
পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যায় ৬০ বছর অতিক্রান্ত করার পর, আমি এখনও সুস্বাস্থ্যসহ আশীর্বাদযুক্ত। আনন্দের বিষয় যে, আমি “বৃদ্ধ বয়সেও ফল উৎপন্ন” করছি। (গীতসংহিতা ৯২:১৪) আমি যিহোবার কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ যে তাঁর সত্য উপাসকদের সংখ্যার মহান বৃদ্ধি আমার নিজের চোখে দেখার জন্য আমি জীবিত রয়েছি। ভাববাদী যিশাইয় এইরূপ এক বৃদ্ধি সম্বন্ধে ভাববাণী করেছিলেন: “তোমার পুরদ্বার সকল সর্ব্বদা খোলা থাকিবে, কি দিন কি রাত্রি কখনও রুদ্ধ হইবে না; জাতিগণের ঐশ্বর্য্য তোমার কাছে আনা যাইবে।”—যিশাইয় ৬০:১১.
সমস্ত জাতি থেকে লক্ষ লক্ষ লোকেরা যিহোবার সংগঠনে একত্রিত হচ্ছে এবং মহাক্লেশের মধ্যে থেকে কিভাবে রক্ষা পেয়ে ঈশ্বরের নতুন জগতে প্রবেশ করবে তার শিক্ষা পাচ্ছে তা দেখা কতই না বিস্ময়কর! (২ পিতর ৩:১৩) আমি যথার্থভাবে বলতে পারি যে এই জগৎ যা কিছু দিতে পারে তার চাইতে পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা আমার কাছে অধিক মূল্যবান বলে প্রমাণিত হয়েছে। হ্যাঁ, আমি খুঁজে পেয়েছি, স্বর্ণ সম্পদ নয়, কিন্তু আধ্যাত্মিক হীরেগুলি যা অপরিমিতভাবে আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
মিকালিস এবং এলিফ্থেরিয়া কামিনারিস
(ডানদিকে) লুম্বাডু স্ট্রীটের ছাপাখানাটি