যিহোবার সেবায় এক দীর্ঘ জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ
ওটিলি মিডল্যান্ড দ্বারা কথিত
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পালতোলা জাহাজগুলি পশ্চিম নরওয়ের কপারভিক বন্দরে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। সেই দিনগুলিতে মানুষ ও ঘোড়া রাস্তায় গাড়ি টানত। লোকেরা আলোর জন্য খনিজ তেলের বাতিগুলি ব্যবহার করত আর সাদা রঙ করা কাঠের ঘরগুলি কাঠ ও কয়লার সাহায্যে গরম করা হত। ১৮৯৮ সালের জুন মাসে পাঁচ সন্তানের দ্বিতীয়জন আমি সেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।
বাবা ১৯০৫ সালে বেকার ছিলেন সুতরাং তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। তিন বছর পরে তিনি আমাদের, ছেলেমেয়েদের জন্য এক বাক্স ভর্তি রোমাঞ্চকর উপহার এবং মায়ের জন্য সিল্কের কাপড় ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু তার সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ ছিল শাস্ত্রগুলির উপর অধ্যয়ন (ইংরাজি) নামক চার্লস টেজ রাসেল প্রণীত খণ্ডগুলি।
এই সমস্ত বইগুলি থেকে বাবা যা শিখেছিলেন তা তিনি বন্ধু ও আত্মীয়দের বলতে শুরু করেছিলেন। স্থানীয় গির্জার সভাগুলিতে তিনি নরক বলে কোন স্থান নেই এটি দেখাতে বাইবেল ব্যবহার করেছিলেন। (উপদেশক ৯:৫, ১০) ১৯০৯ সালে বাবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার পরের বছর ভাই রাসেল নরওয়ে পরিদর্শন করেছিলেন এবং বারগেন ও ক্রিসটিয়ানিয়ায় এখন যেটি ওসলো সেখানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বাবা তার বক্তৃতা শোনার জন্য বারগেনে গিয়েছিলেন।
অধিকাংশ লোকেরা মিথ্যা শিক্ষা ছড়ানোর জন্য বাবাকে অভিযুক্ত করেছিলেন। আমি দুঃখ পেয়েছিলাম ও তাকে বাইবেল ট্র্যাক্টগুলি প্রতিবেশীদের কাছে অর্পণ করতে সাহায্য করেছিলাম। ১৯১২ সালে আমি নরক সম্বন্ধে একটি ট্র্যাক্ট এক পাদ্রির মেয়ের কাছে অর্পণ করেছিলাম। সে আমাকে ও বাবাকে তীব্রভাবে গালাগালি করেছিল। এক পাদ্রির মেয়ে এত নোংরা ভাষা ব্যবহার করতে পারে দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম!
অন্যান্য বাইবেল ছাত্রেরা, যে নামে যিহোবার সাক্ষীদের তখন ডাকা হত, কখনও কখনও কপারভিকে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসতেন যার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন একজন দক্ষ বক্তা থিয়োডর সিমেনসন। তিনি আমাদের ঘরে যে বক্তৃতা দিতেন তাতে আমি লোকেদের আমন্ত্রণ করতাম। তার বক্তৃতার পূর্বে তিনি গিটার বাজাতেন ও গান গাইতেন আর তার বক্তৃতার পরে তিনি একটি বিদায়ী গান গাইতেন। তার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ছিল।
আমাদের ঘরে আরেকজন সাক্ষাৎকারী ছিলেন অ্যানা এনডারসেন, একজন ধর্মপুস্তক বিক্রেতা অথবা পূর্ণ-সময়ের পরিচারক। তিনি সম্পূর্ণ নরওয়ের শহর থেকে শহরগুলিতে ভ্রমণ করতেন প্রধানত সাইকেলে করে আর লোকেদের কাছে বাইবেল সাহিত্যাদি অর্পণ করতেন। তিনি একসময় স্যালভেশন আর্মির নিযুক্ত পরিচারক ছিলেন আর তাই কপারভিকে স্যালভেশন আর্মির কিছু পরিচারকদের জানতেন। তারা তাদের সভাগৃহে তাকে একটি বাইবেল বক্তৃতা দিতে অনুমতি দিয়েছিল আর সেটি শুনবার জন্য আমি লোকেদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।
আর একজন ধর্মপুস্তক বিক্রতা যিনি আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন তিনি হলেন কার্ল গানবার। এই মার্জিত, শান্ত অথচ রসিক ব্যক্তি সময়ে সময়ে ওসলোর শাখা দপ্তরে অনুবাদক হিসাবে সেবা করতেন। বেশ কিছু বছর পরে আমরা একসাথে সেখানে কাজ করেছিলাম।
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত
সেই সময়ে অধিকাংশ লোকেদের কেবলমাত্র ঈশ্বর এবং বাইবেলের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসই ছিল না কিন্তু নরকাগ্নি ও ত্রিত্বের মত বিশ্বাসগুলির দ্বারাও তারা পরিবেষ্টিত ছিল। সুতরাং এই বিষয়টি আলোড়ন তুলেছিল যখন বাইবেল ছাত্রেরা শিখিয়েছিল যে এই মতবাদগুলি বাইবেলের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। বাবা একজন বিধর্মী ছিলেন, আমার প্রতিবেশীদের এই প্রবল অভিযোগ দ্বারা আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম। একবার আমি এমনকি তাকে বলেছিলাম: “তুমি যা শিক্ষা দিচ্ছ সেটি সত্য নয়। এটি ধর্মবিরোধী!”
‘ওটিলি এখানে এসো আর দেখো বাইবেল কী বলে,’ তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন। তারপর তিনি আমার সামনে শাস্ত্র থেকে পড়েছিলেন। ফলস্বরূপ, তার প্রতি ও তিনি যা শিখিয়েছিলেন সেই বিষয়ে আমার প্রত্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি আমাকে শাস্ত্রগুলির উপর অধ্যয়ন-টি পড়তে উৎসাহিত করেছিলেন আর তাই ১৯১৪ সালের গ্রীষ্মকালে আমি প্রায়ই একটি টিলার উপর বসে পড়তাম যেখান থেকে সম্পূর্ণ শহরটি দেখা যেত।
১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে লোকেরা ভিড় করে স্থানীয় সংবাদপত্র দপ্তরের বাইরে ১ম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়া সম্বন্ধে পড়তে থাকে। সেখানে কী ঘটছে তা দেখার জন্য বাবা সেখানে গিয়েছিলেন। “ঈশ্বরের ধন্যবাদ!” তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন। তিনি যুদ্ধের আরম্ভকে বাইবেল ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণতা হিসাবে শনাক্ত করেছিলেন যার সম্বন্ধে তিনি প্রচার করেছিলেন। (মথি ২৪:৭) অনেক বাইবেল ছাত্রেরা তখন বিশ্বাস করত যে শীঘ্রই তাদের স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন এটি ঘটেনি কিছুজন হতাশ হয়েছিলেন।
বাইবেল সত্যের পক্ষে আমার পদক্ষেপ
১৯১৫ সালে ১৭ বছর বয়সে আমি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শেষ করি ও এক দপ্তরে জাগতিক কাজ শুরু করি। সেইসময় আমি নিয়মিত প্রহরীদুর্গ পড়া শুরু করি। কিন্তু ১৯১৮ সাল পর্যন্ত কপারভিকে নিয়মিত সভাগুলি অনুষ্ঠিত হত না। শুরুতে আমরা মাত্র পাঁচজন উপস্থিত হতাম। আমরা ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির প্রকাশনাগুলি পড়তাম যেমন শাস্ত্রগুলির উপর অধ্যয়ন আর প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে বিষয়বস্তুটি আলোচনা করতাম। যদিও মা অন্যদের কাছে বাইবেল ছাত্রদের সম্বন্ধে উচ্চপ্রশংসা করতেন কিন্তু তিনি কখনও আমাদের একজন হননি।
যে দপ্তরে আমি কাজ করতাম, সেখানে ১৯১৮ সালের শুরুতে আমি এনটোন সল্টনেসের সাথে পরিচিত হই যাকে আমি এক বাইবেল ছাত্র হওয়ার জন্য সাহায্য করতে সমর্থ হয়েছিলাম। সেই সময়ে আমি এক নিয়মিত প্রকাশক হয়েছিলাম আর বারগেনের এক অধিবেশনে ১৯২১ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।
১৯২৫ সালের মে মাসে সম্পূর্ণ স্কেনডিনেভিয়ার জন্য সুইডেন অরেব্রোতে এক অধিবেশন হয়েছিল। ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির তৎকালীন সভাপতি যোষেফ এফ. রাদারফোর্ড সহ ৫০০ জনেরও বেশি ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাদের মধ্যে প্রায় ৩০ জন ট্রেনের একটি সংরক্ষিত কামরায় ওসলো থেকে ভ্রমণ করেছিলাম।
অধিবেশনে ঘোষণা করা হয়েছিল যে স্কেনডিনেভিয়া ও বাল্টিক সাগরীয় দেশগুলিতে প্রচার কাজ দেখাশোনা করার জন্য ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে একটি উত্তর ইউরোপীয় দপ্তর স্থাপন করা হবে। স্কটল্যান্ডের উইলিয়াম ডে প্রচার কাজের তত্ত্বাবধান করার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি সকলের প্রিয় ছিলেন এবং শীঘ্রই বিগ স্কটম্যান হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন। প্রথম প্রথম ভাই ডের স্কেনডিনেভীয় ভাষা সম্বন্ধে কোন জ্ঞান ছিল না, তাই তিনি সভা এবং অধিবেশনগুলিতে পিছনের দিকে বসতেন আর ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা করতেন যাতে করে তাদের বাবামায়েরা মঞ্চ থেকে যা বলা হচ্ছে তার প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন।
১৯২৫ সালের ১লা মার্চের প্রহরীদুর্গ (ইংরাজি) প্রকাশিত বাক্য ১২ অধ্যায়টি আলোচনা করেছিল আর ব্যাখ্যা করেছিল যে এই অধ্যায়টি ১৯১৪ সালে ঈশ্বরের রাজ্যের জন্ম হয়েছিল ও তা স্বর্গে হয়েছিল বলে বর্ণনা করে। এটি বুঝতে আমার অসুবিধা হয়েছিল তাই আমি প্রবন্ধটি বার বার পড়েছিলাম। যখন পরিশেষে আমি এটি বুঝেছিলাম আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।
বাইবেলের বিষয়ে যখন আমাদের বোধগম্যতার কিছু সমন্বয়সাধন করা হয়েছিল কিছুজন বিঘ্ন পেয়েছিল ও ঈশ্বরের লোকেদের থেকে সরে গিয়েছিল। কিন্তু যখনই এইধরনের এক সমন্বয়সাধন আত্মস্থ করা কঠিন হয়েছে আমি সর্বদা যুক্তিটি বুঝবার চেষ্টা করে বিষয়বস্তুটি বারবার পড়েছি। যদি আমি তারপরেও নতুন ব্যাখ্যাটি বুঝতে পারিনি, আমি সেটি স্পষ্ট হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছি। এইপ্রকার ধৈর্যের জন্য আমি বারবার পুরস্কৃত হয়েছি।
বেথেলে সেবা
কিছু বছর আমি বই সংরক্ষণ, সচীব ও হিসাবরক্ষক হিসাবে কাজ করি। ১৯২৮ সালে যে ব্যক্তি সোসাইটির অর্থের হিসাব দেখাশোনা করতেন তিনি অসুস্থ হন ও তাকে বেথেল ছেড়ে চলে যেতে হয়। যেহেতু এই কাজে আমার অভিজ্ঞতা ছিল আমাকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়। আমি ১৯২৮ সালের জুন মাসে বেথেল সেবা শুরু করি। কখনও কখনও ভাই ডে আমাদের পরিদর্শন করতেন ও আমার হিসাব পরীক্ষা করতেন। আমাদের বেথেল পরিবারও ওসলোয় জনসাধারণের প্রচার কাজে নেতৃত্ব নিত যেখানে তখন আমাদের মাত্র একটি মণ্ডলী ছিল।
আমাদের মধ্যে কিছুজন বেথেলের জাহাজযোগে প্রেরণ বিভাগের ভাই স্যক্সহমারকে স্বর্ণযুগ (ইংরাজি) (এখন সচেতন থাক!) পত্রিকাগুলি বাঁধা এবং ডাকে পাঠানোর কাজে সাহায্য করতাম। ভাই সাইমনসন ও গানবার ছিলেন তাদের অন্তর্ভুক্ত যারা সাহায্য করেছিলেন। আমাদের খুব ভাল সময় কেটেছিল, কাজের সময় আমরা ভাইরা প্রায়ই গান গাইতাম।
রাজ্যের আশার প্রতি প্রত্যয়ী
১৯৩৫ সালে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে “বিস্তর লোক” দ্বিতীয় স্বর্গীয় শ্রেণী ছিল না। আমরা শিখেছিলাম যে পরিবর্তে এটি একটি শ্রেণীকে চিত্রিত করে যারা মহাক্লেশ থেকে রক্ষা পাবে আর যাদের অনন্তকাল পরমদেশ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সুযোগ রয়েছে। (প্রকাশিত বাক্য ৭:৯-১৪) এই নতুন বোধগম্যতার কারণে কিছুজন যারা স্মরণার্থক প্রতীকে অংশগ্রহণ করত উপলব্ধি করে যে তাদের জন্য পার্থিব আশা ছিল আর তাই তারা অংশগ্রহণ করা বন্ধ করে দেয়।
যদিও আমার স্বর্গীয় আশা সম্পর্কে কোন সন্দেহ ছিল না, আমি প্রায়ই ভাবতাম ‘কেন ঈশ্বর আমাকে চান?’ আমি নিজেকে এমন একটি মহান সুযোগের অযোগ্য বোধ করতাম। এক ক্ষুদ্র, লাজুক স্ত্রীলোক হিসাবে নিজের জন্য স্বর্গে খ্রীষ্টের সাথে একত্রে রাজা হিসাবে শাসন করার বিষয়টি ভাবতে আমি আশ্চর্য হতাম। (২ তীমথিয় ২:১১, ১২; প্রকাশিত বাক্য ৫:১০) যাইহোক আমি প্রেরিত পৌলের এই বাক্যগুলি চিন্তা করতাম যে “পরাক্রমী অনেক”-কে আহ্বান করা হয়নি কিন্তু “ঈশ্বর জগতের দুর্ব্বল বিষয় সকল মনোনীত করিলেন, যেন শক্তিমন্ত বিষয় সকলকে লজ্জা দেন।”—১ করিন্থীয় ১:২৬, ২৭.
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কার্যকলাপ
১৯৪০ সালের ৯ই এপ্রিল, জার্মান বাহিনী নরওয়ে আক্রমণ করে আর শীঘ্রই দেশটি অধিকৃত হয়। যুদ্ধের ফলস্বরূপ, অনেকেই রাজ্যের বার্তার প্রতি সাড়া দিয়েছিল। ১৯৪০ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪১ সালের জুন পর্যন্ত আমরা ২,৭২,০০০টিরও বেশি পুস্তক ও পুস্তিকা অর্পণ করেছিলাম। এর অর্থ নরওয়েতে তখন ৪৭০ জনেরও বেশি সাক্ষীরা প্রত্যেকে সেই নয় মাসে গড়ে প্রায় ৫৭০টিরও বেশি পুস্তক ও পুস্তিকা অর্পণ করেছিল!
১৯৪১ সালের ৮ই জুলাই নাৎসী গোয়েন্দা সমস্ত পরিচালক অধ্যক্ষদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিল এবং বলেছিল যে যদি প্রচার কাজ বন্ধ করা না হয় তাহলে তারা তাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাবে। পাঁচজন জার্মান পুলিশ আধিকারিক বেথেলে এসেছিল ও ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির অনেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিল। বেথেল পরিবারকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল কিন্তু আমাদের কাউকে কারাগারে পাঠানো হয়নি। পরিশেষে, ১৯৪১ সালের ২১শে জুলাই, সোসাইটির অট্টালিকা ইনকংনিটোগেটেন ২৮ বি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং আমাদের প্রচার কাজকে নিষিদ্ধ করা হয়। আমি কপারভিকে ফিরে যাই ও নিজের খরচ চালানোর জন্য জাগতিক কাজ নিই।
সেই সময়ে, বাবা অগ্রগামী হিসাবে সেবা করছিলেন। একদিন নাৎসীরা এসে বাবার ঘরটিতে তল্লাশি চালায়। তারা তার বাইবেল ও বাইবেল বর্ণানুক্রমিক সূচিটি সমেত সমস্ত সাহিত্যগুলি নিয়ে নেয়। সেই সময়কাল ব্যাপী আমরা খুব অল্প পরিমাণ আধ্যাত্মিক খাদ্যই পেয়েছিলাম। আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী থাকার জন্য আমরা পুরনো বইগুলিই যেমন সরকার (ইংরাজি) বইটি বারবার পড়েছিলাম আর আমরা ক্রমাগতভাবে প্রচার করে চলেছিলাম।
দুঃখের বিষয় ছিল যে, কিছু জায়গায় ভাইরা বিভাজিত হয়ে পড়েছিলেন। কিছু ভাইদের অভিমত ছিল যে আমাদের প্রকাশ্যে প্রচার করা এবং গৃহ থেকে গৃহে যাওয়া উচিত যখন অন্যেরা মনে করতেন যে আমাদের আরও গোপনভাবে কাজ করা উচিত, অন্যভাবে লোকেদের সাথে যোগাযোগ করে। এইভাবে বিশিষ্ট ভাইরা যারা পূর্বে খুব উত্তমভাবে সহযোগিতা করেছিলেন আর যাদের আমরা খুব ভালবাসতাম, তারা পরস্পরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। সাক্ষী হিসাবে আমার জীবনে অন্য যা কিছু পরিস্থিতি এসেছে সেই সবকিছুর চেয়ে তাদের মধ্যে বিভাজন আমার মনে ভীষণ দুঃখ দিয়েছিল।
যুদ্ধের পরে পুনরুজ্জীবিত কার্যকলাপ
যুদ্ধের পরে ১৯৪৫ সালের গ্রীষ্মকালে, ভাই ডে নরওয়ে পরিদর্শন করেছিলেন আর ওসলোর শেন ও বারগেনে সভাগুলি আয়োজিত করেছিলেন। তিনি ভাইদের কাছে মতৈক্যকে মীমাংসা করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন আর সকলে যারা তা করতে ইচ্ছুক তাদের উঠে দাঁড়াতে বলেছিলেন। সকলে উঠে দাঁড়িয়েছিল! ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির তৎকালীন সভাপতি নেথন এইচ. নরের এক পরিদর্শনের পর স্থায়ীভাবে বিতর্কিত বিষয়টির মীমাংসা হয়েছিল।
ইতিমধ্যে ১৯৪৫ সালের ১৭ই জুলাই শাখা পরিচারক ভাই ইনক ওম্যানের কাছে থেকে আমি একটি টেলিগ্রাম পাই যেটি জানিয়েছিল: ‘আপনি কবে বেথেলে ফিরে আসতে পারবেন?’ কিছুজন বলেছিল যে আমার ঘরে থাকা ও আমার বাবার দেখাশোনা করা উচিত যিনি তখন ৭০ বছরেরও বেশি বয়স্ক ছিলেন। কিন্তু বাবা আমাকে বেথেল পরিচর্যা পুনরারম্ভ করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন, যেটি আমি করেছিলাম। ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক ভাই মারভেন এফ. এনডারসন আমাদের শাখা অধ্যক্ষ হয়েছিলেন আর প্রচার কাজ পুনর্সংগঠিত হয়েছিল।
গ্রীষ্মের ছুটির সময় আমি আমার পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য কপারভিকে আসতাম। আমার দুই ভাই ও দুই বোন সাক্ষী হয়নি কিন্তু তারা বাবা ও আমার প্রতি বন্ধুত্বপরায়ণ ছিল। আমার ভাইদের একজন পোতাশ্রয় ও বিমানচালক হয়েছিল আর অন্যজন শিক্ষক ছিল। যদিও আমি বস্তুগত দিক থেকে অপ্রতুল ছিলাম বাবা তাদের বলতেন: ‘ওটিলি তোমাদের থেকেও অনেক বেশি ধনী।” আর এটি সত্য ছিল! তারা যা অর্জন করেছিল তা আধ্যাত্মিক ধনের সাথে তুলনীয় ছিল না যা আমি উপভোগ করছিলাম! ১৯৫১ সালে ৭৮ বছর বয়সে বাবা মারা যান। মা মারা গিয়েছিলেন ১৯২৮ সালে।
১৯৫৩ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে যিহোবার লোকেদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমার উপস্থিতি জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ছিল। সেই বছর জগতের ক্ষেত্র ৫,০০,০০০ জন প্রকাশক সীমাকে অতিক্রম করেছিল ও ১,৬৫,০০০ জনেরও বেশি সেই সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিল! ১৯৫৩ সালের সম্মেলনের পূর্বে আমি এক সপ্তাহ পৃথিবীতে যিহোবার সংগঠনের প্রধান কার্যালয় ব্রুকলিনের বেথেলে কাজ করেছিলাম।
আমি যা করতে পারি সেটি করা
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চোখে ছানির কারণে আমার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। আমি এখনও শক্তিশালী চশমা ও বিবর্ধিত কাচের সাহায্যে বড় অক্ষরে মুদ্রণ পড়তে পারি। আর খ্রীষ্টীয় বোনেরা আমার সাথে দেখা করেন ও সপ্তাহে দুবার আমাকে তারা পড়ে শোনান যার জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ।
আমার প্রচার কাজও এখন সীমিত। গ্রীষ্মের সময় খ্রীষ্টীয় বোনেরা কখনও কখনও আমার চাকাওয়ালা চেয়ারটি বাইরে এমন এক জায়গায় নিয়ে যান যেখানে আমি কিছুটা প্রচার করতে পারি। আমি পত্রিকা ও ব্রোশারগুলি কপারভিকের বিদ্যালয়গুলিতে নিয়মিত ডাকযোগে পাঠাই যেমন প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে প্রায় ১০০ বছর আগে আমি একজন ছাত্রী ছিলাম। আমি খুশি যে এক নিয়মিত প্রকাশক থাকা আমার পক্ষে এখনও সম্ভব হয়ে চলেছে।
ওসলোর বাইরে ইট্রে এনেবাকে ১৯৮৩ সাল থেকে অবস্থিত বেথেলে সৌভাগ্যবশত খাওয়ার ঘর আর কিংডম হল একই তলায় ছিল যেখানে আমার থাকার ঘরটিও অবস্থিত। সেইজন্য আমি সকালের উপাসনা, খাবার সময় এবং সভাগুলিতে হাঁটতে সাহায্যকারী বস্তুটিতে ভর দিয়ে আসতে পারি। আর আমি খুশি যে আমি এখনও সম্মেলন ও অধিবেশনগুলিতে যোগ দিতে পারি। আমি সেই সমস্ত বন্ধুদের যাদের আমি অনেক বছর ধরে চিনি ও সেইসাথে নতুন ভাই ও বোনেদের ও অনেক সুন্দর ছোট বাচ্চাদের সাহচর্য উপভোগ করি।
শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস বজায় রাখা
বেথেলে সক্রিয়, আনন্দিত এবং আধ্যাত্মিক লোকেদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকা এক আশীর্বাদস্বরূপ। যখন আমি আমার বেথেল পরিচর্যা শুরু করেছিলাম সম্পূর্ণ পরিবারটি তাদের নিয়ে গঠিত ছিল যাদের স্বর্গীয় আশা ছিল। (ফিলিপীয় ৩:১৪) এখন আমাকে ছাড়া বেথেলের প্রত্যেকে পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকার প্রত্যাশা রাখে।
সত্য যে আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম যিহোবা আরও পূর্বে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। কিন্তু, বিরাট জনতাকে আরও আরও বৃদ্ধি পেতে দেখে আমি আনন্দিত। কত মহান বৃদ্ধিই না আমি দেখেছি! যখন প্রথম বার আমি পরিচর্যায় যোগ দিয়েছিলাম তখন জগদ্ব্যাপী প্রায় ৫,০০০ জন প্রকাশক ছিল। এখন তা ৫৪,০০,০০০ লক্ষেরও বেশি! সত্যই, আমি দেখেছি “যে ছোট, সে সহস্র হইয়া উঠিবে, যে ক্ষুদ্র, সে বলবান্ জাতি হইয়া উঠিবে।” (যিশাইয় ৬০:২২) আমাদের যিহোবার অপেক্ষায় থাকার প্রয়োজন আছে যেমন ভাববাদী হবক্কূক লিখেছিলেন: “তাহার বিলম্ব হইলেও তাহার অপেক্ষা কর, কেননা তাহা অবশ্য উপস্থিত হইবে।”—হবক্কূক ২:৩.