চরম বিক্ষোভের মাঝে—খ্রীষ্টতত্ত্ব কার্যরত
সমস্ত কিছুই যেন আকস্মিকভাবে ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে শুরু হয়ে গিয়েছিল। এক বিমান দুর্ঘটনায় বুরুণ্ডি ও রুয়াণ্ডার রাষ্ট্রপতিদ্বয় নিহত হয়েছিলেন। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আতঙ্কজনক দৌরাত্ম্য রুয়াণ্ডাকে গ্রাস করেছিল। তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে ৫,০০,০০০ জনেরও বেশি রুয়াণ্ডাবাসী—পুরুষ, নারী ও শিশু—মারা গিয়েছিল। কিছু লোকেরা এই সময়টিকে “সাম্প্রদায়িক বিলোপসাধন” হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।
রুয়াণ্ডার ৭৫ লক্ষ অধিবাসীর অর্ধেককে পালাতে হয়েছিল। এর অন্তর্ভুক্ত ২৪ লক্ষ অধিবাসী প্রতিবেশী দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আধুনিক ইতিহাসে এটিই ছিল সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও দ্রুততম শরণার্থী যাত্রা। শরণার্থী শিবিরগুলি দ্রুতগতিতে জাইরে (এখন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো), তানজানিয়া ও বুরুণ্ডিতে স্থাপিত হয়েছিল। এই শিবিরগুলির কয়েকটি—যেগুলি বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ ছিল—২,০০,০০০ লোকেদের আশ্রয় দিয়েছিল।
শরণার্থীদের মধ্যে অনেক যিহোবার সাক্ষীরা ছিলেন, যারা শান্তিপ্রিয় ব্যক্তি ও জীবনে বাইবেলের নীতিগুলি প্রয়োগ করেন। যে দেশেই তারা বাস করুন না কেন, তারা কঠোর নিরপেক্ষতা বজায় রাখেন ও যিশাইয় ২:৪ পদের এই বাক্যগুলির অন্তর্গত নীতিটিকে প্রয়োগ করেন: “তাহারা আপন আপন খড়্গ ভাঙ্গিয়া লাঙ্গলের ফাল গড়িবে, ও আপন আপন বড়শা ভাঙ্গিয়া কাস্তা গড়িবে; এক জাতি অন্য জাতির বিপরীতে আর খড়্গ তুলিবে না, তাহারা আর যুদ্ধ শিখিবে না।” যিহোবার সাক্ষীরা এমন একটি ধর্মীয় দল হিসাবে ব্যাপকভাবে পরিচিত, যারা রুয়াণ্ডায় সাম্প্রদায়িক বিলোপসাধনে অংশগ্রহণ করেননি।
যীশু খ্রীষ্ট বলেছিলেন যে তাঁর অনুগামীরা “জগতের নয়।” কিন্তু, যেহেতু তারা “জগতে রহিয়াছে” তাই তারা জাতিগুলির চরম বিক্ষোভ থেকে সর্বদা রক্ষা পাবেন না। (যোহন ১৭:১১, ১৪) রুয়াণ্ডায় সাম্প্রদায়িক বিলোপসাধনের সময়, প্রায় ৪০০ জন সাক্ষী তাদের জীবন হারিয়েছিলেন। প্রায় ২,০০০ সাক্ষী ও রাজ্যের বার্তার প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিরা শরণার্থী হয়েছিলেন।
জগতের অংশ না হওয়া কি এটি বোঝায় যে যখন বিপর্যয় আঘাত করে তখন যিহোবার সাক্ষীরা কিছুই করেন না? না। ঈশ্বরের বাক্য বলে: “কোন ভ্রাতা কিম্বা ভগিনী বস্ত্রহীন ও দৈবসিক খাদ্যবিহীন হইলে যদি তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি তাহাদিগকে বলে, কুশলে যাও, উষ্ণ ও তৃপ্ত হও, কিন্তু তোমরা তাহাদিগকে শরীরের প্রয়োজনীয় বস্তু না দেও, তবে তাহাতে কি ফল দর্শিবে? তদ্রূপ বিশ্বাসও কর্ম্মবিহীন হইলে আপনি একা বলিয়া তাহা মৃত।” (যাকোব ২:১৫-১৭) এছাড়াও প্রতিবেশীর প্রতি প্রেম সাক্ষীদের উদ্বুদ্ধ করে তাদের সাহায্য করতে, এমনকি যারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সহমত নন।—মথি ২২:৩৭-৪০.
যদিও জগদ্ব্যাপী যিহোবার সাক্ষীরা রুয়াণ্ডার চরম দুর্দশাপূর্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন সহবিশ্বাসীদের সাহায্য করতে আকুল আকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তবুও ত্রাণ কাজকে সমন্বয়িত করার দায়িত্ব পশ্চিম ইউরোপকে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৪ সালের গ্রীষ্মকালে, ইউরোপের সাক্ষী স্বেচ্ছাসেবীদের একটি দল আফ্রিকায় তাদের খ্রীষ্টীয় ভাই এবং বোনেদের সাহায্য করার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন। রুয়াণ্ডার শরণার্থীদের জন্য সুসংগঠিত শিবির ও অস্থায়ী হাসপাতালগুলি স্থাপন করা হয়েছিল। প্রচুর পরিমাণ পোশাক, কম্বল, খাদ্য ও বাইবেল সাহিত্যাদি বিমানযোগে বা অন্যান্য উপায়ে তাদের কাছে পাঠান হয়েছিল। ৭,০০০ জনেরও অধিক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি—সেই সময়ে রুয়াণ্ডার যিহোবার সাক্ষীদের প্রায় তিন গুণ—ত্রাণ কাজের দ্বারা উপকার লাভ করেছিলেন। সেই বছরের ডিসেম্বরে, হাজার হাজার শরণার্থী যার বেশির ভাগই যিহোবার সাক্ষী, তাদের জীবন পুনর্গঠন করার জন্য রুয়াণ্ডায় ফিরে এসেছিলেন।
কঙ্গোয় যুদ্ধ
১৯৯৬ সালে, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই এলাকাটি রুয়াণ্ডা ও বুরুণ্ডির সীমান্ত। পুনরায় সেখানে ধর্ষণ ও হত্যা চলতে থাকে। ধাবমান গুলি ও জ্বলন্ত গ্রামগুলির মধ্যে থেকে, লোকেরা তাদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। যিহোবার সাক্ষীরা এই চরম বিক্ষোভের মধ্যে আটকা পড়েছিলেন আর প্রায় ৫০ জন মারা গিয়েছিলেন। কিছুজন এলোপাথাড়ি গুলির দ্বারা হত হয়েছিলেন। অন্যান্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল কারণ তারা একটি নির্দিষ্ট উপজাতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বা তাদের ভুলবশত শত্রু মনে করা হয়েছিল। একটি গ্রাম যেখানে ১৫০ জন সাক্ষী বাস করতেন, সেটি আগুন দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল। অন্য গ্রামগুলিতে বহুসংখ্যক গৃহ ও কিছু কিংডম হল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। গৃহ ও সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে, সাক্ষীরা অন্যান্য এলাকায় পালিয়ে গিয়েছিলেন ও সেখানে সহউপাসকদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছিলেন।
যুদ্ধের পরেই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় কারণ শস্য বিনষ্ট, সঞ্চিত খাদ্যদ্রব্য লুঠ আর সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যে খাদ্য পাওয়া যাচ্ছিল তার দাম ছিল অত্যন্ত বেশি। ১৯৯৭ সালের মে মাসের প্রারম্ভে, কিসাঙ্গানিতে এক কিলোগ্রাম আলুর দাম ছিল প্রায় একশ টাকা যা অধিকাংশ লোকেদের আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে ছিল। বেশির ভাগ লোকেরা দিনে কেবল একবার খেতে পারতেন। স্বভাবতই, দুর্ভিক্ষের পরে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ম্যালেরিয়া, উদরাময় জাতীয় রোগ ও পাকস্থলীসংক্রান্ত সমস্যাগুলিকে প্রতিহত করার জন্য দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে, অপুষ্টি দুর্বল করে দেয়। বিশেষভাবে শিশুরা আক্রান্ত হয় ও মারা যায়।
প্রয়োজন নির্ধারণ করা
ইউরোপের যিহোবার সাক্ষীরা আবারও প্রয়োজনের প্রতি ত্বরিত সাড়া প্রদান করেছিলেন। ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে দুইজন চিকিৎসকসহ সাক্ষীদের একটি ত্রাণ দল ওষুধ ও অর্থ নিয়ে বিমানযোগে ছুটে গিয়েছিলেন। গোমায় স্থানীয় সাক্ষীরা পরিস্থিতি নির্ধারণ করার জন্য ইতিমধ্যেই ত্রাণ কমিটিগুলি গঠন করেছিলেন যাতে তাৎক্ষণিক সাহায্য প্রদান করা যায়। দলটি শহর ও চতুর্দিকের এলাকা নিরীক্ষণ করেছিলেন। অধিক দূরবর্তী এলাকাগুলি থেকে বিবরণ সংগ্রহ করার জন্য বার্তাবাহকদের পাঠান হয়েছিল। গোমার ১,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি পশ্চিমে অবস্থিত কিসাঙ্গানি থেকেও তথ্য সংগৃহীত করা হয়েছিল। স্থানীয় ভাইরা গোমা, যেখানে প্রায় ৭০০ জন সাক্ষী বাস করতেন সেখানে ত্রাণ কাজগুলি সমন্বয়িত করতে সাহায্য করেছিলেন।
গোমার একজন খ্রীষ্টীয় প্রাচীন বলেছিলেন: “আমরা আমাদের ভাইদের দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলাম যারা বহু দূর থেকে আমাদের সাহায্য করতে এসেছিলেন। তারা আসার পূর্বে, আমরা একে অপরকে সাহায্য করেছিলাম। ভাইদের গ্রামাঞ্চল থেকে গোমায় পালিয়ে আসতে হয়েছিল। কিছুজন তাদের গৃহ হারিয়েছিলেন ও তাদের শস্যক্ষেত্রগুলি ফেলে এসেছিলেন। আমরা তাদের গৃহে নিয়ে যাই এবং আমাদের পোশাক ও যে অল্প খাদ্য আমাদের ছিল তা তাদের সাথে ভাগ করে নিই। স্থানীয়ভাবে আমরা সামান্যই করতে পেরেছিলাম। আমাদের মধ্যে কিছুজন অপুষ্টিতে ভুগছিলেন।
“কিন্তু, ইউরোপের ভাইরা যে অর্থ নিয়ে এসেছিলেন তার দ্বারা আমরা দুষ্প্রাপ্য ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল খাদ্য কিনতে পেরেছিলাম। খাদ্য উপযুক্ত সময়েই পাওয়া গিয়েছিল কারণ অনেকের গৃহে খাওয়ার জন্য কিছুই ছিল না। আমরা সাক্ষী ও ন-সাক্ষী সকলের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করেছিলাম। যথাসময়ে যদি সাহায্য না আসত, তাহলে আরও অনেকে বিশেষ করে শিশুরা মারা যেত। যিহোবা তাঁর লোকেদের রক্ষা করেছিলেন। ন-সাক্ষীরা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন। অনেকে আমাদের একতা ও প্রেম সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন। কিছুজন স্বীকার করেছিলেন যে আমাদের ধর্মই সত্য।”
যদিও স্থানীয়ভাবে খাদ্য ক্রয় এবং ওষুধ প্রদান করা হয়েছিল, তথাপি আরও বেশি কিছুর প্রয়োজন ছিল। পোশাক, কম্বল আর সেই সাথে আরও প্রচুর পরিমাণ খাদ্য ও ওষুধের প্রয়োজন ছিল। এছাড়া ধ্বংসপ্রাপ্ত গৃহগুলি পুনর্নির্মাণের জন্য সহযোগিতারও প্রয়োজন ছিল।
লোকেরা উদারভাবে দান করেন
ইউরোপের ভাইরা সাহায্য করার জন্য আবারও অত্যন্ত উৎসুক ছিলেন। ফ্রান্সের লুভিয়ায় যিহোবার সাক্ষীদের দপ্তর রোন ভ্যালি, নরম্যানডি এবং প্যারিসের কয়েকটি মণ্ডলীতে সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে ঘোষণা করেছিল। এখানে আরেকটি শাস্ত্রীয় নীতি কার্যকর হয়েছিল: “যে অল্প পরিমাণে বীজ বুনে, সে অল্প পরিমাণে শস্যও কাটিবে; আর যে ব্যক্তি আশীর্ব্বাদের সহিত বীজ বুনে, সে আশীর্ব্বাদের সহিত শস্যও কাটিবে। প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আপন হৃদয়ে যেরূপ সঙ্কল্প করিয়াছে, তদনুসারে দান করুক, মনোদুঃখপূর্ব্বক কিম্বা আবশ্যক বলিয়া না দিউক; কেননা ঈশ্বর হৃষ্টচিত্ত দাতাকে ভাল বাসেন।”—২ করিন্থীয় ৯:৬, ৭.
হাজার হাজার ব্যক্তি দান করার সুযোগটি আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। পোশাক, জুতো ও অন্যান্য সামগ্রী ভর্তি বাক্স ও থলিগুলি প্রচুর পরিমাণে কিংডম হলগুলিতে এসেছিল এবং পরে তা ফ্রান্সে যিহোবার সাক্ষীদের শাখা দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ৪০০ জন স্বেচ্ছাসেবী “জাইরেকে সাহায্য করুন” কার্যক্রমের পরবর্তী পদক্ষেপে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। যখন প্রচুর পরিমাণে দানসামগ্রী এসেছিল, তখন এই স্বেচ্ছাসেবীরা পোশাক বাছাই ও ভাঁজ করেছিলেন এবং বাক্সগুলিতে ভরেছিলেন যেগুলি এক একটি প্যালেটে ৩০টি করে রাখা হয়েছিল। শিশুরা তাদের অল্পবয়স্ক ভাই ও বোনেদের কথা চিন্তা করে খেলনা পাঠিয়েছিল যার মধ্যে ছিল চক্চকে খেলনা গাড়ি, লাটিম, পুতুল এবং পশমের তৈরি খেলনা ভল্লুক। এইগুলি অত্যাবশ্যক সামগ্রীগুলির সাথে ভরে দেওয়া হয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে, ১২ মিটারের নয়টি বাক্স পূর্ণ করা হয়েছিল এবং কঙ্গোতে পাঠান হয়েছিল।
বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের হাজার হাজার সাক্ষীদের সহায়তায় মধ্য আফ্রিকায় কী পরিমাণ সাহায্য পাঠান হয়েছে? ১৯৯৭ সালের জুন মাসের মধ্যে সর্বমোট পরিমাণ ছিল ৫০০ কিলোগ্রাম ওষুধ, ১০ টন উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ বিস্কুট, ২০ টন অন্যান্য খাদ্য, ৯০ টন পোশাক, ১৮,৫০০ জোড়া জুতো ও ১,০০০টি কম্বল। বাইবেল সাহিত্যাদিও প্রচুর পরিমাণে পাঠান হয়েছিল। এই সমস্তকিছুর প্রতি প্রচুর উপলব্ধি দেখান হয়েছিল যা শরণার্থীদের সান্ত্বনা দিয়েছিল ও পরীক্ষাগুলি সহ্য করতে তাদের সাহায্য করেছিল। সরবরাহকৃত বস্তুর সর্বমোট মূল্য ছিল প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। এইধরনের দান যারা যিহোবাকে সেবা করেন তাদের মধ্যে বিদ্যমান ভ্রাতৃত্ব ও প্রেমের প্রমাণস্বরূপ ছিল।
কঙ্গোয় বিতরণ
পণ্যদ্রব্য যখন কঙ্গোতে পৌঁছাতে শুরু করেছিল, ফ্রান্স থেকে দুইজন ভাই ও একজন বোন স্থানীয় ত্রাণ কমিটির সাথে কাজ করার জন্য এসেছিলেন। কঙ্গোর সাক্ষীদের দ্বারা প্রদর্শিত কৃতজ্ঞতা সম্বন্ধে, জোসেলিন বলেছিলেন: “আমরা উপলব্ধিপূর্ণ অনেক চিঠি পেয়েছিলাম। একজন দরিদ্র বোন আমাকে একটি ম্যালাকাইটের অলঙ্কার দিয়েছিলেন। অন্যান্যেরা আমাদের তাদের ছবি দিয়েছিলেন। যখন আমরা চলে আসছিলাম, বোনেরা আমাকে চুমো দিয়েছিলেন, জড়িয়ে ধরেছিলেন ও কেঁদেছিলেন। আমিও কেঁদেছিলাম। অনেকে এইধরনের মন্তব্যগুলি করেছিলেন যেমন, ‘যিহোবা মঙ্গলময়। যিহোবা আমাদের জন্য চিন্তা করেন।’ তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে এই দানের কৃতিত্ব যিহোবার প্রাপ্য। আমরা যখন খাদ্য বিতরণ করছিলাম, তখন ভাই ও বোনেরা রাজ্যের গানগুলি গেয়ে যিহোবার প্রশংসা করেছিলেন। এটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ছিল।”
লইক নামে একজন চিকিৎসক দলের এক সদস্য ছিলেন। অনেকে কিংডম হলে জড়ো হয়েছিলেন এবং তার সাহায্য পাওয়ার জন্য ধৈর্য ধরে তাদের পালা আসার অপেক্ষা করেছিলেন। কিছু করার আকাঙ্ক্ষায়, কঙ্গোর একজন বোন যারা চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাদের জন্য প্রায় ৪০টি পিঠা তৈরি করে এনেছিলেন। যেহেতু প্রায় ৮০ জন লোক অপেক্ষা করছিলেন, তাই প্রত্যেকজন অর্ধেক করে পিঠা পেয়েছিলেন।
ন-সাক্ষীদের প্রতি সাহায্য
এই মানবিক সাহায্য কেবল যিহোবার সাক্ষীদেরই দেওয়া হয়নি। ১৯৯৪ সালের মত অন্যান্যেরাও উপকৃত হয়েছিলেন। এটি গালাতীয় ৬:১০ পদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যা উল্লেখ করে: “এজন্য আইস, আমরা যেমন সুযোগ পাই, তেমনি সকলের প্রতি, বিশেষতঃ যাহারা বিশ্বাস-বাটীর পরিজন, তাহাদের প্রতি সৎকর্ম্ম করি।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)
সাক্ষীরা বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গোমার নিকটবর্তী একটি অনাথ আশ্রমে ওষুধ ও পোশাক বিতরণ করেছিলেন। এই অনাথ আশ্রমটি ৮৫ জন শিশুর আশ্রয়স্থল ছিল। পরিস্থিতি নির্ধারণের প্রাথমিক সফরে, ত্রাণ দলটি অনাথ আশ্রমে গিয়েছিলেন ও ৫০ বাক্স উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ বিস্কুট, কয়েক বাক্স পোশাক, ১০০টি কম্বল, ওষুধ ও খেলনা সরবরাহ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। শিশুরা আঙ্গিণায় সারিবদ্ধ হয়ে দর্শনার্থীদের জন্য গান গেয়েছিল। এরপর তারা একটি বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছিল—তারা কি খেলার জন্য একটি ফুটবল পেতে পারে?
কয়েক সপ্তাহ পরে ত্রাণ দলটি পণ্যদ্রব্যাদি আনার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেছিলেন। উদারতা এবং তাকে যে বাইবেল সাহিত্য দেওয়া হয়েছিল তা পড়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, অনাথ আশ্রমের পরিচালক বলেছিলেন যে তিনি যিহোবার সাক্ষীদের একজন হতে চলেছেন। আর শিশুদের কি একটি ফুটবল দেওয়া হয়েছিল? “না,” ফ্রান্সের ত্রাণ দলের সমন্বয়কারী ক্লড উত্তর দিয়েছিলেন। “আমরা তাদের দুটি ফুটবল দিয়েছিলাম।”
শরণার্থী শিবিরগুলি
সাহায্য কেবল কঙ্গোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। হাজার হাজার শরণার্থীরা যুদ্ধ এলাকা থেকে নিকটবর্তী একটি দেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে দ্রুত তিনটি শরণার্থী শিবির স্থাপিত হয়েছিল। কী করা যায় তা দেখার জন্য সাক্ষীরা সেখানেও গিয়েছিলেন। এই বিবরণ তৈরি হওয়া অবধি, শিবিরগুলি ২,১১,০০০ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল যাদের অধিকাংশই ছিলেন কঙ্গোর। প্রায় ৮০০ জন সাক্ষী ও তাদের সন্তানেরা এবং রাজ্যের সুসমাচারের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিরা ছিলেন। খাদ্যের অভাব ছিল শিবিরগুলির একটি জরুরি সমস্যা। একটি শিবিরে মাত্র তিন দিনের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ছিল আর তা ছিল তিন বছরের পুরনো সীম জাতীয় বীচি।
তৎসত্ত্বেও, সাক্ষীদের উত্তম মনোভাব ছিল। যদিও তাদের কাছে অল্পসংখ্যক বাইবেল সাহিত্য ছিল, নিজেদের আধ্যাত্মিকভাবে গড়ে তোলার জন্য তারা নিয়মিত উন্মুক্ত স্থানে সভা করতেন। এছাড়া তারা শিবিরগুলিতে অন্যদের কাছে ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করার কাজেও ব্যস্ত ছিলেন।—মথি ২৪:১৪; ইব্রীয় ১০:২৪, ২৫.
সাক্ষীদের অনুসন্ধানকারী দলটির মধ্যে একজন চিকিৎসকও ছিলেন। যদিও কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিটি শিবিরে কেবল অল্প কয়েকদিন থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন, তবুও তারা চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারা খ্রীষ্টীয় প্রাচীনদের কাছে ওষুধ ও অর্থ রেখে এসেছিলেন। ফলে, ভাইরা রক্ষা পেয়েছিলেন। এছাড়া তারা আশা করছিলেন যে শিবিরের সাক্ষীরা শীঘ্রই তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারবেন।
ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কী বলা যায়? যীশু খ্রীষ্ট ভাববাণী করেছিলেন যে আমাদের দিন যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের দ্বারা চিহ্নিত এক চরম বিক্ষোভের সময় হবে। (মথি ২৪:৭) যিহোবার সাক্ষীরা জানেন যে একমাত্র ঈশ্বরের রাজ্যই বর্তমানে পৃথিবীতে বিদ্যমান দুঃখকষ্ট দূর করবে। এর শাসনাধীনে, আমাদের পার্থিব গৃহ শান্তি, প্রাচুর্য এবং বাধ্য মানবজাতির জন্য অনন্তকালীন সুখের একটি পরমদেশে পরিণত হবে। (গীতসংহিতা ৭২:১, ৩, ১৬) ইত্যবসরে, সাক্ষীরা সেই স্বর্গীয় রাজ্যের সুসমাচার ঘোষণা করবেন ও প্রয়োজনের সময়ে সহউপাসক ও অন্যান্যদের সাহায্যও করে চলবেন।
[৪ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
১৯৯৪ সাল থেকে, কেবল ইউরোপের যিহোবার সাক্ষীরাই ১৯০ টনেরও বেশি খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী আফ্রিকার গ্রেট লেকস্ অঞ্চলে পাঠিয়েছেন
[৬ পৃষ্ঠার বাক্স]
খ্রীষ্টীয় প্রেমকে কার্যে প্রয়োগ
ফ্রান্সে “জাইরেকে সাহায্য করুন” প্রকল্পে যারা উদ্দীপনার সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে রূৎ ডানার ছিলেন। বাল্যাবস্থায় তিনি তার খ্রীষ্টীয় বিশ্বাসের জন্য নাৎসী কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন: “আমরা আমাদের আফ্রিকার ভাই ও বোনেদের জন্য কিছু করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম! কিন্তু সেখানে আরও কিছু ছিল যা আমাকে দ্বিগুণ সুখী করেছিল। ১৯৪৫ সালে, আমরা যখন জার্মানি থেকে গৃহে ফিরে আসি, তখন আমাদের একেবারে কিছুই ছিল না। এমনকি আমাদের পরিধেয় পোশাকটি পর্যন্ত ধার করা ছিল। কিন্তু, শীঘ্রই আমাদের আমেরিকার আধ্যাত্মিক ভাইদের কাছ থেকে আমরা বস্তুগত সাহায্য পেয়েছিলাম। তাই এই ত্রাণ কাজ, দীর্ঘদিন পূর্বে আমাদের প্রতি যে দয়া দেখান হয়েছিল তার প্রতিদান দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। ভ্রাতৃবর্গের এইরকম এক বৃহৎ পরিবার, যেটি খ্রীষ্টীয় প্রেমকে কার্যে প্রয়োগ করে তার অংশী হওয়া কতই না এক মহান সুযোগ!”—যোহন ১৩:৩৪, ৩৫.
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
শীঘ্রই—সকলের জন্য প্রাচুর্যসহ এক পার্থিব পরমদেশ