“তোমার প্রেমপূর্ণ-দয়া জীবনের থেকেও উত্তম”
ক্যালভিন এইচ. হোমস্ দ্বারা কথিত
সময়টি ছিল ১৯৩০ সালের ডিসেম্বর মাস আর আমি সবেমাত্র গরুর দুধ দোহন করা শেষ করেছিলাম যখন বাবা কাছাকাছিই এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে ঘরে ফিরেছিলেন। “এই বইটি, উইমেন আমাকে ধার দিয়েছে,” তার পকেট থেকে একটি নীল রং এর প্রকাশনা বের করার সময় তিনি বলেছিলেন। ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত এই বইটির শিরোনাম ছিল মুক্তি (ইংরাজি)। বাবা, যিনি খুব কমই কিছু পড়তেন, গভীর রাত পর্যন্ত ওই বইটি পড়েছিলেন।
পরে, বাবা একই প্রকাশকদের অন্য বইগুলি ধার করেছিলেন, যেগুলির শিরোনাম ছিল দীপ্তি (ইংরাজি) এবং পুনর্মিলিতকরণ (ইংরাজি)। তিনি মায়ের পুরনো বাইবেলটি খুঁজে পেয়েছিলেন এবং কেরোসিনের বাতিতে তা পড়ার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন। বাবার জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন এসেছিল। সেই শীতে যখন আমরা আমাদের পুরনো কাঠের উনানের চতুর্দিকে গাদাগাদি করে বসতাম, তিনি আমাদের—মা, তিন বোন ও আমার সাথে বেশ কিছু ঘন্টা আলোচনা করেছিলেন।
বাবা বলেছিলেন, যে লোকেরা এই বইগুলি প্রকাশ করেছেন তাদের বাইবেল ছাত্র বলা হয় আর তাদের কথানুসারে আমরা এখন “শেষ কালে” বাস করছি। (২ তীমথিয় ৩:১-৫) তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে এই জগৎ ধ্বংসের সময় পৃথিবী বিনষ্ট হবে না কিন্তু ঈশ্বরের রাজ্যের অধীনে তা এক পরমদেশে পরিণত হবে। (২ পিতর ৩:৫-৭, ১৩; প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪) এটি আমার কাছে সত্যই আগ্রহজনক মনে হয়েছিল।
আমরা একসাথে কাজ করার সময়, বাবা আমার সাথে কথা বলা শুরু করতেন। আমার মনে পড়ে যে আমরা যখন ভুট্টার খোসা ছাড়াচ্ছিলাম, তিনি বর্ণনা করেছিলেন যে ঈশ্বরের নাম যিহোবা। (যাত্রাপুস্তক ৬:৩) তাই, ১৯৩১ সালের বসন্তকালে আমার বয়স যখন মাত্র ১৪ বছর, আমি যিহোবা ও তাঁর রাজ্যের পক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। আমি বাড়ির পিছনের পুরনো আপেল বাগানে গিয়ে প্রার্থনা করেছিলাম ও গাম্ভীর্যপূর্ণভাবে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আমি তাঁকে চিরকাল সেবা করব। আমাদের বিস্ময়কর ঈশ্বরের প্রেমপূর্ণ-দয়া সম্বন্ধে আমার হৃদয় ইতিমধ্যেই প্রণোদিত হয়েছিল।—গীতসংহিতা ৬৩:৩.
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, মিসৌরীর সেন্ট যোষেফ থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এবং কানসাস সিটি থেকে ৬৫ কিলোমিটারের কিছু কম দূরত্বে অবস্থিত একটি খামারে আমরা বাস করতাম। বাবা গাছের গুঁড়ি দ্বারা নির্মিত ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যেটি আমার প্রপিতামহ উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সেই খামারে নির্মাণ করেছিলেন।
পরিচর্যার জন্য প্রশিক্ষণ
১৯৩১ সালের গ্রীষ্মকালে, আমাদের পরিবার বেতারে “জগতের আশা, রাজ্য” নামক জনসাধারণের বক্তৃতাটি শুনেছিল, যেটি ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট যোষেফ রাদারফোর্ড ওহাইওর কলম্বাসে একটি সম্মেলনে দিয়েছিলেন। এই বিষয়টি আমার হৃদয়কে উদ্দীপিত করেছিল আর আমি বাবার সাথে, আমাদের পরিচিত ব্যক্তিদের মাঝে এই গুরুত্বপূর্ণ জনসাধারণের বক্তৃতা সম্বলিত পুস্তিকাটি বিতরণ করতে আনন্দিত হয়েছিলাম।
১৯৩২ সালের বসন্তকালে, আমি প্রথমবারের মত যিহোবার সাক্ষীদের সভায় যোগ দিয়েছিলাম। আমাদের প্রতিবেশী, বাবা ও আমাকে যিহোবার সাক্ষীদের একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ, জর্জ ড্রেপারের একটি বক্তৃতা শোনার জন্য সেন্ট যোষেফে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমরা যখন পৌঁছেছিলাম তখন সভার প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল আর আমি বসার জন্য বলিষ্ঠ, চওড়া কাঁধের অধিকারী জে. ডি. ড্রেয়ারের পিছনে একটি আসন পেয়েছিলাম, যিনি আমার জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
১৯৩৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, বাবার সাথে আমি কানসাস সিটির এক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম যেখানে আমি প্রথমবারের মত জনসাধারণ্যে প্রচারে অংশগ্রহণ করেছিলাম। বাবা আমাকে তিনটি পুস্তিকা দিয়েছিলেন ও এই কথা বলতে শিখিয়েছিলেন: “আমি একজন যিহোবার সাক্ষী ও রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করছি। নিঃসন্দেহে আপনি বেতারে জাজ্ রাদারফোর্ড সম্বন্ধে শুনেছেন। তার বক্তৃতাগুলি প্রতি সপ্তাহে ৩০০-র থেকেও বেশি কেন্দ্রগুলি থেকে সম্প্রচারিত হয়।” তারপর আমি একটি পুস্তিকা নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেই সন্ধ্যায় খামারে ফিরে গরুর দুধ দোহনের সময় আমি চিন্তা করেছিলাম যে এটিই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন।
শীঘ্রই শীত শুরু হয় আর আমাদের পক্ষে ভ্রমণ করা সীমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তখন ভাই ড্রেয়ার ও তার স্ত্রী সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং আমাকে শনিবার সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে আসার ও সেই রাতে সেখানে থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দশ কিলোমিটার হেঁটে ড্রেয়ারের বাড়ি যাওয়া সার্থক হয়েছিল, কারণ পরের দিন পরিচর্যায় আমি তাদের সঙ্গী হতে পেরেছিলাম ও সেন্ট যোষেফে প্রহরীদুর্গ পাঠে যোগ দিয়েছিলাম। তখন থেকে আমি কদাচিৎ রবিবারের পরিচর্যায় অংশগ্রহণ করা বাদ দিই। ভাই ড্রেয়ারের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ অমূল্য প্রমাণিত হয়েছিল।
অবশেষে, ১৯৩৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর, কানসাস সিটির এক অধিবেশনে আমি যিহোবার প্রতি আমার উৎসর্গকে জলে বাপ্তিস্ম নেওয়ার মাধ্যমে চিহ্নিত করেছিলাম।
এক চিরকালীন কর্মজীবনের শুরু
১৯৩৬ সালের প্রথম দিকে, আমি একজন অগ্রগামী বা পূর্ণ সময়ের পরিচারক হিসাবে সেবা করার জন্য আবেদন করেছিলাম এবং যারা একজন অগ্রগামী সাথী খুঁজছিলেন তাদের তালিকায় আমাকে রাখা হয়েছিল। এর অল্প কিছু সময় পরেই আমি উইয়োমিং আর্ভাডার, এডুয়ার্ড স্টেডের একটি চিঠি পেয়েছিলাম। তিনি বর্ণনা করেছিলেন যে তিনি হুইল চেয়ারে আবদ্ধ ও অগ্রগামীর কাজ করার জন্য তার একজন সাথীর প্রয়োজন। আমি তৎক্ষণাৎ সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম আর ১৯৩৬ সালের ১৮ই এপ্রিল একজন অগ্রগামী হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলাম।
ভাই স্টেডের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে, মা নিরালায় আমার সাথে কথা বলেছিলেন। “বাবা, তুমি কি নিশ্চিত যে এই কাজই তুমি করতে চাও?” তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
“অন্যথায় আমার জীবন সার্থক হবে না,” আমি উত্তর দিয়েছিলাম। আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়া অন্য যে কোন কিছুর চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
টেডের সাথে, অর্থাৎ ভাই স্টেডকে আমরা যেভাবে ডাকতাম, অগ্রগামীর কাজ করা এক চমৎকার প্রশিক্ষণ ছিল। তিনি উদ্দীপনায় পূর্ণ ছিলেন ও রাজ্যের বার্তাকে এক অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী উপায়ে উপস্থাপন করার ক্ষমতা তার ছিল। কিন্তু টেড যা কিছু করতে পারতেন তা ছিল কেবল লেখা ও কথা বলা; তার গ্রন্থি গিঁটেবাতের কারণে অক্ষম ছিল। আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম ও তাকে স্নান করিয়ে এবং তার দাড়ি কামিয়ে দিতাম, সকালের খাবার তৈরি করতাম ও তাকে খাইয়ে দিতাম। তারপর তাকে পোশাক পরাতাম ও পরিচর্যার জন্য প্রস্তুত করে দিতাম। সেই গ্রীষ্মে আমরা উইয়োমিং ও মন্টানায় অগ্রগামীর কাজ করেছিলাম আর রাতে আমরা তাঁবুতে থাকতাম। টেড তার পিকাপ ট্রাকে নির্মিত এক বিশেষ ক্যাবে ঘুমাতেন আর আমি নিচে ঘুমাতাম। সেই বছরই পরবর্তী সময়ে আমি টেনেসি, আরকানসাস ও মিসিসিপিতে অগ্রগামীর কাজ করার জন্য দক্ষিণাঞ্চলে গিয়েছিলাম।
১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে আমি ওহাইওর কলম্বাসে প্রথমবারের মত বড় সম্মেলনে যোগদান করেছিলাম। সেখানে ধ্বনিগ্রাহী যন্ত্র ব্যবহার করে প্রচার কাজ অগ্রসর করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যতবার আমরা ধ্বনিগ্রাহী যন্ত্র ব্যবহার করতাম তার প্রত্যেকটিকে আমরা এক সেটাপ বলতাম। এক মাসে আমি ৫০০ এর থেকেও বেশি সেটাপ করেছিলাম আর ৮০০ জনেরও বেশি লোক শুনেছিলেন। পূর্ব টেনেসি, ভার্জিনিয়া ও পশ্চিম ভার্জিনিয়ার অনেক শহরে সাক্ষ্যদান করার পর, আমি বিশেষ অগ্রগামী হিসাবে এক নতুন দায়িত্বে আঞ্চলিক দাসের সাথে, অর্থাৎ ভ্রমণ অধ্যক্ষকে তখন যেভাবে ডাকা হত, কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম।
আমি পশ্চিম ভার্জিনিয়ার মণ্ডলী ও বিচ্ছিন্ন দলগুলি পরিদর্শন করেছিলাম—প্রত্যেকের সাথে দুই থেকে চার সপ্তাহ কাটিয়েছিলাম—আর ক্ষেত্রের পরিচর্যায় নেতৃত্ব নিয়েছিলাম। তারপর, ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে আমি আঞ্চলিক দাস হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলাম। সেই সময়ের মধ্যে মা ও আমার তিন বোন—ক্লারা, লোয়িস ও রূৎ—রাজ্যের পক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছিল। তাই সেই গ্রীষ্মে আমাদের সম্পূর্ণ পরিবার একত্রে সেন্ট লুইসের বড় সম্মেলনে যোগদান করেছিল।
সম্মেলনের অল্প সময় পরেই আঞ্চলিক দাসেদের জানানো হয়েছিল যে ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসের শেষে আঞ্চলিক কাজ শেষ করা হবে। এর পরের মাসেই যুক্তরাষ্ট্র ২য় বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত হয়েছিল। আমি বিশেষ অগ্রগামী সেবার জন্য কার্যভার পাই যখন পরিচর্যায় এক মাসে ১৭৫ ঘন্টা কাজ করতে হত।
পরিচর্যার বিশেষ সুযোগগুলি
১৯৪২ সালের জুলাই মাসে আমি একটি চিঠি পেয়েছিলাম যেটিতে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি দেশের বাইরে সেবা করতে ইচ্ছুক কি না। ইতিবাচক সাড়া প্রদানের পর, আমি যিহোবার সাক্ষীদের বিশ্বের প্রধান কার্যালয়, নিউইর্য়কের ব্রুকলিন বেথেলে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেই সময়ে এক বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় ২০ জন অবিবাহিত ভাইদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নেথেন এইচ. নর ব্যাখ্যা করেছিলেন যে প্রচারের কাজকর্ম হ্রাস পেয়েছে আর তাই মণ্ডলীগুলিকে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। “মণ্ডলীতে সমস্যাগুলি কী আমরা কেবল তাই জানতে চাই না,” তিনি বলেছিলেন, “কিন্তু এই সম্বন্ধে আপনারা কী করেছেন তা জানতে চাই।”
আমাদের বেথেলে থাকাকালীন, ভাই ফ্রেড ফ্রাঞ্জ, যিনি ভাই নরের পরে ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, একটি বক্তৃতা দেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন: “২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবে আর এক ব্যাপক প্রচার কাজ শুরু হবে। নিঃসন্দেহে, যিহোবার সংগঠনে এখনও লক্ষ লক্ষ লোকেরা একত্রিত হওয়ার আছে!” সেই বক্তৃতাটি আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছিল। যখন কার্যভার দেওয়া হয়েছিল আমি জেনেছিলাম যে আমাকে টেনেসি ও ক্যান্টাকি রাষ্ট্রের সব মণ্ডলী পরিদর্শন করতে হবে। আমাদের ভ্রাতৃবর্গের দাস হিসাবে ডাকা হত, এক পরিচিতি যা পরে সীমা অধ্যক্ষে পরিবর্তিত হয়েছিল।
১৯৪২ সালের ১লা অক্টোবর থেকে আমি মণ্ডলীগুলির সেবা করা শুরু করেছিলাম আর তখন আমার বয়স মাত্র ২৫ বছর ছিল। সেই সময়ে কিছু মণ্ডলীতে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় ছিল পায়ে হাঁটা বা ঘোড়ার পিঠে চড়া। কখনও কখনও, যে পরিবার আমাকে আশ্রয় দিত তাদের সাথে আমি একই কক্ষে ঘুমাতাম।
১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে যখন আমি টেনেসির গ্রীণভিল মণ্ডলীতে সেবা করছিলাম, তখন আমি ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডের ২য় ক্লাসে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেই গিলিয়েডে আমি “অধিক আগ্রহের সহিত মনোযোগ করা” এবং ‘প্রভুর কার্য্যে সর্ব্বদা উপচিয়া পড়ার’ প্রকৃত অর্থ কী তা শিখেছিলাম। (ইব্রীয় ২:১; ১ করিন্থীয় ১৫:৫৮) পাঁচ মাসের বিদ্যালয় পর্ব খুব শীঘ্রই কেটে গিয়েছিল এবং ১৯৪৪ সালের ৩১শে জানুয়ারি ছিল স্নাতক হওয়ার দিন।
কানাডা ও বেলজিয়ামে
আমাদের বেশ কয়েক জনকে কানাডায় কার্যভার দেওয়া হয়েছিল, যেখানে সম্প্রতি যিহোবার সাক্ষীদের কাজকর্মের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আমি ভ্রমণ কাজে নিযুক্ত হয়েছিলাম যেখানে কিছু মণ্ডলীতে ভ্রমণের জন্য অনেক দূরত্ব অতিক্রম করতে হত। আমি যখন ভ্রমণ করতাম তখন কানাডায় নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও আমাদের প্রচার কাজ কিভাবে সম্পাদিত হয়েছিল তা শোনা আনন্দায়ক ছিল। (প্রেরিত ৫:২৯) এক রাতের মধ্যে, কানাডার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত, প্রায় প্রত্যেক ঘরে একটি পুস্তিকা অর্পণ করার সময় যে তথাকথিত বেসামরিক আক্রমণ হয়েছিল, সেই সম্বন্ধে অনেকে বলেছিলেন। ১৯৪৫ সালের মে মাসে, ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল তা শোনা, কী এক সুসংবাদই না ছিল!
ওই গ্রীষ্মে সাসকাচুয়ানের ছোট শহর ওসেজের একটি মণ্ডলীতে সেবা করার সময়, আমি ভাই নরের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলাম যেটিতে বলা হয়েছিল: “আমি আপনাকে বেলজিয়ামে যাওয়ার সুযোগের কথা জানাচ্ছি। . . . সম্পন্ন করার জন্য ওই দেশে অনেক কাজ আছে। এটি এক যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ আর আমাদের ভ্রাতৃবর্গের সাহায্য প্রয়োজন এবং তাদের উপযুক্ত সাহায্য ও সান্ত্বনা প্রদানের জন্য আমেরিকা থেকে কাউকে পাঠানো যথোপযুক্ত বলে মনে হয়।” সেই কার্যভারে সম্মত হয়ে তৎক্ষণাৎ আমি উত্তর দিয়েছিলাম।
১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসে আমি চার্লস্ ইকের নামে একজন বয়স্ক অ্যাল্সেশীয় ভাইয়ের সাথে ফ্রেঞ্চ ভাষা অধ্যয়নের জন্য ব্রুকলিন বেথেলে ছিলাম। এছাড়াও আমি শাখা তত্ত্বাবধানের কার্যপ্রণালীর উপরে কিছু প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম। ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রার আগে, আমি মিসৌরী, সেন্ট যোষেফে আমার পরিবার ও বন্ধুদের সাথে এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ করেছিলাম।
১১ই ডিসেম্বর কুইন এলিজাবেথ নামে এক জাহাজে চড়ে আমি নিউ ইয়র্ক ত্যাগ করেছিলাম ও চারদিন পর ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটনে এসে পৌঁছেছিলাম। ব্রিটেন শাখায় আমি এক মাস ছিলাম, যেখানে আমি আরও প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলাম। তারপর, ১৯৪৬ সালের ১৫ই জানুয়ারি আমি ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেছিলাম ও বেলজিয়ামের ওস্টেন্ডে নেমেছিলাম। সেখান থেকে আমি ট্রেনে চড়ে ব্রাসেলস্-এ গিয়েছিলাম যেখানে সম্পূর্ণ বেথেল পরিবার রেলওয়ে স্টেশনে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিল।
যুদ্ধের পরে তৎপরতামূলক কাজকর্ম
আমার বেলজিয়ামে রাজ্যের কাজ দেখাশোনা করার কার্যভার ছিল, যদিও আমি তখনও সেই ভাষা বলতে পারতাম না। প্রায় ছয় মাসের মধ্যে আমি প্রতিদিন চলার মত যথেষ্ট ফ্রেঞ্চ শিখেছিলাম। পাঁচ বছর নাৎসী শাসন চলাকালীন প্রচার কাজ সম্পাদনের জন্য যারা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন সেই ব্যক্তিদের সাথে কাজ করা একটি সুযোগ ছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্প্রতি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
কাজকে সংগঠিত করতে আর যারা বাইবেলের সত্যের জন্য ক্ষুধার্ত, তাদের পুষ্ট করার জন্য ভাইরা উদ্গ্রীব ছিলেন। তাই অধিবেশন অনুষ্ঠিত করার ও মণ্ডলীগুলি পরিদর্শন করার জন্য ভ্রমণ অধ্যক্ষদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এছাড়া আমরা নেথেন নর, মিল্টন হেনসেল, ফ্রেড ফ্রাঞ্জ, গ্র্যান্ট সুইটার ও জন বুথের উৎসাহজনক পরিদর্শনগুলি পেয়েছিলাম—যারা প্রত্যেকেই ব্রুকলিনের প্রধান কার্যালয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। প্রথম দিকের সেই সময়গুলিতে আমি সীমা অধ্যক্ষ, জেলা অধ্যক্ষ ও শাখা অধ্যক্ষ হিসাবে সেবা করেছিলাম। বেলজিয়ামে সেবা করার প্রায় সাত বছর পর, ১৯৫২ সালের ৬ই ডিসেম্বর আমি এমিলিয়া ভানোপস্লাফকে বিয়ে করি, যে বেলজিয়াম শাখায় কাজ করত।
এর কয়েক মাস পরে, ১৯৫৩ সালের ১১ই এপ্রিল আমাকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে উপস্থিত হওয়ার জন্য আদেশনামা পাঠানো হয়েছিল এবং সেটি জানিয়েছিল যে বেলজিয়ামের নিরাপত্তার জন্য আমার উপস্থিতি বিপদজনক। অপেক্ষা করার জন্য আমি লুক্সেমবার্গে গিয়েছিলাম যেখানে আমার মামলার জন্য রাজ্য পরিষদের কাছে একটি আবেদন করা হয়েছিল।
১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেলজিয়ামের রাজ্য পরিষদ এই রায় দিয়েছিল যে সেই দেশের জন্য আমার উপস্থিতি বিপদজনক। যে প্রমাণ পেশ করা হয়েছিল তা হল, বেলজিয়ামে আমার আগমনের পর সেই দেশে সাক্ষীদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল—১৯৪৬ সালে ৮০৪ জন থেকে ১৯৫৩ সালে তা ৩,৩০৪ জনে পৌঁছেছিল—আর এর ফলস্বরূপ বেলজিয়ামের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল কারণ অনেক যুবক সাক্ষী খ্রীষ্টীয় নিরপেক্ষতার প্রতি এক দৃঢ় পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন। এই কারণে এমেলিয়া ও আমি, সুইজারল্যান্ডে কার্যভার পেয়েছিলাম, যেখানে আমরা ফ্রেঞ্চ ভাষী এলাকায় সীমার কাজ শুরু করেছিলাম।
রাজ্যের পরিচর্যা বিদ্যালয়—খ্রীষ্টীয় প্রাচীনদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দানের এক বিদ্যালয়—১৯৫৯ সালে নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ ল্যান্সিং-এ প্রবর্তিত হয়েছিল। ইউরোপে এই বিদ্যালয়ের ক্লাসগুলিতে শিক্ষা দিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য আমি সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন আমি মিসৌরীর, সেন্ট যোষেফে আমার পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। সেখানে আমার প্রেমময়ী মাকে আমি শেষবারের মত দেখেছিলাম। তিনি ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে মারা যান; বাবা ১৯৫৫ সালের জুন মাসে মারা গিয়েছিলেন।
ফ্রান্সের প্যারিসে, ১৯৬১ সালের মার্চ মাসে রাজ্যের পরিচর্যা বিদ্যালয় শুরু হয়েছিল এবং এমিলিয়া আমার সঙ্গী হয়েছিল। সেই বিদ্যালয়ে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ড থেকে জেলা অধ্যক্ষ, সীমা অধ্যক্ষ, মণ্ডলীর অধ্যক্ষ ও বিশেষ অগ্রগামীরা এসেছিলেন। পরবর্তী ১৪ মাস, চার-সপ্তাহ পর্বের ১২টি ক্লাস আমি পরিচালনা করেছিলাম। এরপর, ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে আমরা জানতে পেরেছিলাম এমিলিয়া গর্ভবতী।
পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া
আমরা সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে ফিরে গিয়েছিলাম, যেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থানের অনুমতি আমাদের ছিল। কিন্তু থাকার জন্য স্থান খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না কারণ সেখানে বাসস্থানের অত্যন্ত অভাব ছিল। চাকুরি পাওয়াও সহজ ছিল না। অবশেষে আমি মধ্য জেনেভায়, একটি বড় দোকানে চাকুরি পেয়েছিলাম।
আমি ২৬ বছর পূর্ণ সময়ের পরিচর্যায় ছিলাম তাই আমাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে প্রচুররূপে খাপ খাওয়াতে হয়েছিল। ২২ বছর সেই দোকানে আমি কাজ করেছি আর আমাদের দুই মেয়ে লোয়িস ও ইউনিসকে প্রতিপালন করতে সাহায্য করেছিলাম, আমাদের পরিবার সবসময় রাজ্যের আগ্রহকে প্রথম স্থানে রেখেছে। (মথি ৬:৩৩) ১৯৮৫ সালে জাগতিক কাজ থেকে অবসর গ্রহণের পর, আমি একজন বিকল্প সীমা অধ্যক্ষ হিসাবে সেবা করা শুরু করেছি।
এমিলিয়ার স্বাস্থ্য খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু পরিচর্যায় সে তার যথাসম্ভব করে। লোয়িস প্রায় দশ বছর একজন অগ্রগামী হিসাবে সেবা করেছিল। ১৯৯৩ সালের গ্রীষ্মকালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত সর্বাপেক্ষা চমৎকার আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি, তার সাথে উপভোগ করা কী এক আধ্যাত্মিক উল্লেখযোগ্য ঘটনাই না ছিল! এর অল্প সময় পরই আফ্রিকার সেনেগালে ছুটি কাটাতে গিয়ে, সমুদ্রে সাতাঁর কাটার সময়ে সে তার জীবন হারিয়েছিল। যখন আমি মৃতদেহ সমাহিত করতে সেনেগালে গিয়েছিলাম, আফ্রিকায় আমাদের ভাই এবং মিশনারীদের প্রেম ও দয়া আমার কাছে এক বিরাট সান্ত্বনাস্বরূপ হয়েছিল। পুনরুত্থানে লোয়িসকে দেখার জন্য আমি কতই না আকাঙ্ক্ষী!—যোহন ৫:২৮, ২৯.
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এক প্রেমময় সঙ্গীর নিষ্ঠাপূর্ণ সমর্থন উপভোগ করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। বস্তুত, দুঃখ ও সমস্যা থাকা সত্ত্বেও, যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়া মধুর হয়ে এসেছে ও আমার জীবনকে সার্থক করেছে। আমাদের ঈশ্বর, যিহোবা সম্বন্ধে গীতরচকের ভাষায় আমার হৃদয়ও ঘোষণা করতে প্রণোদিত হয় যে: “কারণ তোমার প্রেমপূর্ণ-দয়া জীবনের থেকেও উত্তম; আমার ওষ্ঠাধর তোমার প্রশংসা করবে।”—গীতসংহিতা ৬৩:৩, NW.
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
ধ্বনিগ্রাহী যন্ত্রের মাধ্যমে আমরা প্রচার কাজকে অগ্রসর করেছিলাম
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৩৬ সালে আমার পিতামাতা
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৪৮ সালে বেলজিয়ামে রাস্তায় সাক্ষ্যদান