জেরম—বাইবেলের প্রথম বিতর্কিত অনুবাদক
পনেরোশ ছেচল্লিশ সালের ৮ই এপ্রিল কাউন্সিল অফ ট্রেন্ট আইন জারি করে যে ল্যাটিন ভালগেট বাইবেলকে “[ক্যাথলিক] গির্জা মঞ্জুর করেছে . . . আর তাই কারোরই কোন অজুহাত দেখিয়ে এর বিরুদ্ধে কোন কথা বলার মতো সাহস কিংবা স্পর্ধা দেখানো উচিত নয়। ভালগেট বাইবেলের অনুবাদ যদিও এক হাজার বছরেরও বেশি আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল তবুও এই বাইবেল ও এর অনুবাদক জেরমকে নিয়ে বিতর্ক হয়েই চলেছিল। জেরম কে ছিলেন? কেন তাকে ও তার অনূদিত বাইবেলকে ঘিরে এত বিতর্ক হয়েছিল? তার কীর্তি কিভাবে আজকের বাইবেল অনুবাদের উপর প্রভাব ফেলে?
এক বিদ্বান ব্যক্তি হওয়া
জেরমের ল্যাটিন নাম ছিল ইউসেবিয়াস হিয়েরোনিমাস। তিনি সা.কা. ৩৪৬ সালে রোমীয় প্রদেশের ডালমেশিয়ার স্ট্রিডোন শহরে জন্মেছিলেন। যে শহরটা এখন ইতালি ও স্লোভিনিয়ার সীমানার কাছে অবস্থিত।a তার বাবামা ধনী ছিলেন আর ধনী পরিবারে জন্মানোর সুবিধা তিনি ছোটবেলা থেকেই পেয়েছিলেন কারণ তিনি রোমে, বিখ্যাত ব্যকরণবিদ্ ডনাটাসের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। জেরম নিজেকে ব্যকরণ, ভাষাজ্ঞান ও দর্শনের একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবে প্রমাণ করেছিলেন। এই সময়ে তিনি গ্রিকও শিখতে শুরু করেন।
সা.কা. ৩৬৬ সালে রোম ছেড়ে যাওয়ার পর জেরম বেশ কিছু জায়গায় ঘুরে বেড়ান আর শেষে তিনি ইতালির আকোইলেয়া শহরে এসে থাকতে শুরু করেন। সেখানেই তিনি সন্ন্যাসী জীবন সম্বন্ধে জানতে পারেন। বৈরাগী হওয়ার এই চিন্তায় আকর্ষিত হয়ে তিনি তার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে পরের কিছু বছর সন্ন্যাসী হিসাবে জীবন কাটান।
সা.কা. ৩৭৩ সালে কোন এক অজানা কারণে বন্ধুদের এই দল ভেঙে গিয়েছিল। মনমরা জেরম ঘুরতে ঘুরতে পূর্ব দিকে বিথুনিয়া, গালাতীয় ও কিলিকিয়া হয়ে সিরিয়া প্রদেশের আন্তিয়খিয়ায় এসে পৌঁছেছিলেন।
এই দীর্ঘ যাত্রার জন্য তাকে প্রচুর মাশুল দিতে হয়েছিল। ক্লান্তিতে এবং স্বাস্থ্য ভেঙে যাওয়ায় জেরম জ্বরে ভুগে প্রায় মরতে বসেছিলেন। বন্ধুকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “প্রভু যীশু খ্রীষ্ট যদি তাড়াতাড়িই আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিত। আমার শরীর এতই ভেঙে পড়েছে যে সুস্থ অবস্থাতেও আমি খুবই দুর্বল।”
এমনিতেই জেরম অসুস্থতা, একাকীত্ব ও অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, তার উপর আবার এক তৃতীয় সংকট এসে পড়ে আর তা ছিল আধ্যাত্মিক বিষয়ে। তিনি স্বপ্ন দেখেন যে তাকে ঈশ্বরের “বিচারাসনের সামনে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে।” সেখানে যখন তার নিজের পরিচয় দিতে বলা হয় তখন জেরম বলেছিলেন: “আমি একজন খ্রীষ্টান।” কিন্তু বিচারক বলেন: “তুমি মিথ্যা কথা বলছ, তুমি খ্রীষ্টের নও কিন্তু সিসেরোর শিষ্য।”
এই সময় পর্যন্ত জেরম তার জ্ঞান পিপাসাকে কেবল অখ্রীষ্টীয় গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করে মিটিয়েছিলেন কিন্তু তিনি ঈশ্বরের বাক্য অধ্যয়ন করেননি। তিনি বলেছিলেন “আমাকে আমার বিবেক খুবই যন্ত্রণা দিয়েছিল।” এই অশান্তিকে দূর করার আশায় জেরম তার স্বপ্নের মধ্যেই শপথ করেছিলেন: “হে প্রভু যদি আমি আর কখনও জাগতিক বই নিজের কাছে রাখি বা পড়ি তবে তার মানে হবে যে আমি আপনাকে অস্বীকার করেছি।”
পরে জেরম যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে স্বপ্নের মধ্যে করা শপথের জন্য তিনি জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তবুও অন্তত কিছুটা হলেও তার শপথ পূর্ণ করবেন বলে তিনি স্থির করেছিলেন আর সেইজন্য তিনি আন্তিয়খিয়া ছেড়ে সিরিয়ার জনশূন্য মরুভূমি কালকিসে চলে যান। তিনি একজন সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটিয়েছিলেন এবং নিজেকে বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মীয় বই পড়ার মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। জেরম বলেছিলেন: “ঈশ্বরের বইগুলো আমি যে উৎসাহ নিয়ে পড়েছিলাম, মানুষের লেখা বইগুলো আমি কখনও সেভাবে পড়িনি।” এছাড়াও তিনি স্থানীয় সিরীয় ভাষা শিখেছিলেন আর খ্রীষ্টান হয়েছিলেন এমন একজন যিহূদীর কাছে ইব্রীয় শিখতে শুরু করেছিলেন।
পোপের দেওয়া কাজ
প্রায় পাঁচ বছর সন্নাসী জীবন কাটানোর পর জেরম অধ্যয়ন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তিয়খিয়ায় ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু সেখানে ফিরে তিনি দেখেছিলেন যে গির্জা অনৈক্যে একেবারে ভরে গিয়েছে। মরুভূমিতে থাকার সময়েই জেরম পোপ দামাসসের কাছে এই কথা জিজ্ঞাসা করে পরামর্শ চেয়েছিলেন: “গির্জা তিন দলে ভাগ হয়ে গিয়েছে আর এদের মধ্যে প্রত্যেকটা দলই আমাকে তাদের দলে নেওয়ার জন্য খাড়া হয়ে আছে।”
কিছু সময় পরে জেরম ঠিক করেন যে তিনি পলিনাসের দলে যোগ দেবেন। পলিনাস সেই তিনজন ব্যক্তির মধ্যে একজন ছিলেন যারা দাবি করেছিলেন যে তিনি আন্তিয়খিয়ার বিশপের উপাধি পাওয়ার যোগ্য। পলিনাস তাকে পাদ্রি বানাতে চেয়েছিলেন আর জেরম দুটো শর্তে তা মেনে নিয়েছিলেন। প্রথমত, তাকে সন্ন্যাসী হিসাবেই জীবনযাপন করতে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত কোন একটি নির্দিষ্ট গির্জার পাদ্রি হয়েই কাজ করে চলার জন্য তাকে যেন বাধ্য না করা হয়।
সা.কা. ৩৮১ সালে জেরম পলিনাসের সঙ্গে কাউন্সিল অফ কনস্টানটিনোপলে যোগ দেন ও তারপর তার সঙ্গে রোম পর্যন্ত যান। শীঘ্রই পোপ দামাসাস বুঝতে পেরেছিলেন যে জেরম একজন বিদ্বান ব্যক্তি আর ভাষাতত্ত্বে খুবই দক্ষ। এক বছরের মধ্যে জেরম দামাসাসের ব্যক্তিগত সচিব হওয়ার সম্মান পেয়েছিলেন।
সচিব হওয়ার পরও জেরম বিতর্ক থেকে দূরে ছিলেন না। বরং সবসময়ই তিনি বিতর্কের বস্তু হয়েই ছিলেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, যেখানে পোপের দরবারের অন্য লোকেরা বিলাসিতার মধ্যে জীবন কাটাতেন, সেখানে জেরম এক সন্ন্যাসী হয়েই জীবন কাটিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি নিজের সহজ-সরল জীবনযাপনের পদ্ধতিকে উন্নত করেছিলেন আর অমিতাচারে ডুবে থাকা পাদ্রিদের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। আর এইজন্য অনেক লোকেরা তার শত্রু হয়েছিলেন।
এত লোকেদের সমালোচনার লক্ষ্য হওয়া সত্ত্বেও জেরম পোপ দামাসাসের পুরো সমর্থন পেতেন। জেরমকে তার বাইবেলের গবেষণায় উৎসাহ দেওয়ার পিছনে পোপের এক বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। সেই সময়ে বাইবেলের অনেক ল্যাটিন সংস্করণ ছিল যেগুলো ব্যবহার করা হতো। এর মধ্যে বেশ কয়েকটিকে অসতর্কভাবে অনুবাদ করার ফলে অজস্র ভুল চোখে পড়ত। আবার ভাষার কারণে যে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের গির্জাগুলোর মধ্যে বিভেদ বেড়ে চলেছিল, দামাসাস সেই বিষয়েও চিন্তিত ছিলেন। প্রাচ্যের খুব কম লোকই ল্যাটিন জানতেন আর পশ্চিমে অনেক কম লোকেরা গ্রিক পারতেন।
সেইজন্য পোপ দামাসাস সুসমাচারের একটা পুনর্সংস্করণ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করাতে চেয়েছিলেন। দামাসাস এমন একটা অনুবাদ চেয়েছিলেন যা মূল গ্রিক ভাষার ঠিক-ঠিক অর্থ দেবে আর সেইসঙ্গে এর ল্যাটিন আরও সাবলীল ও স্পষ্ট হবে। জেরম সেই অল্প কয়েকজন পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি বাইবেলের এইরকম অনুবাদ করতে পারতেন। গ্রিক, ল্যাটিন ও সিরীয় ভাষা খুব ভালভাবে বলতে পারায় এবং ইব্রীয় ভাষায় প্রচুর জ্ঞান থাকায় তিনি অনুবাদ করার জন্য পুরোপুরি যোগ্য ছিলেন। তাই দামাসাসের কাছ থেকে আদেশ পেয়ে জেরম এমন এক কাজ হাতে নিয়েছিলেন যাতে তার জীবনের পরের ২০টা বছর কেটে গিয়েছিল।
বিতর্ক আরও বেড়ে যায়
যদিও জেরম খুব তাড়াতাড়ি সুসমাচারের বই অনুবাদ করছিলেন তবুও তিনি খুব স্পষ্ট, পাণ্ডিত্যপূর্ণ শৈলী বজায় রেখেছিলেন। সেই সময়ে পাওয়া যেত এমন সব গ্রিক পাণ্ডুলিপিগুলোর সঙ্গে তুলনা করে তিনি ল্যাটিন পাঠের লেখার শৈলী ও বিষয়বস্তুকে সংশোধন করেছিলেন যাতে যতটা সম্ভব গ্রিক পাঠের সঙ্গে মিল থাকে।
জেরমের চারটি সুসমাচারের অনুবাদ আর গ্রিক সেপ্টুয়াজিন্ট এর উপর ভিত্তি করে তার গীতসংহিতার ল্যাটিন অনুবাদটি লোকেরা খুবই পছন্দ করেছিল। কিন্তু তারপরও তিনি সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। জেরম লিখেছিলেন, “কয়েকজন বাজে লোক ইচ্ছা করে আমার উপর দোষ চাপিয়েছিল যে আমি আগেকার লোকেদের ও সমস্ত জগতের সাধারণ ধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে সুসমাচারের বইয়ে কিছু পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছি।” সা.কা. ৩৮৪ সালে পোপ দামাসাসের মৃত্যুর পর এই দোষ চাপানোর মাত্রা আরও বেড়ে যায়। নতুন পোপের সঙ্গে জেরমের ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তাই তিনি রোম ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আবারও জেরম প্রাচ্যে চলে যান।
একজন ইব্রীয় বিদ্বান হওয়া
সা.কা. ৩৮৬ সালে জেরম বেৎলেহমে বাস করতে শুরু করেন আর তিনি তার বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দেন। তার সঙ্গে তার বিশ্বস্ত অনুগামীদের একটা ছোট দলও ছিল যার মধ্যে পউলা নামে রোমের একজন ধনী ও সম্ভ্রান্ত মহিলাও ছিলেন। জেরম যখন পউলার কাছে প্রচার করেন তখন তিনিও সন্ন্যাসিনী হয়েছিলেন। তার আর্থিক সাহায্যে ও জেরমের নির্দেশনায় একটা মঠ বানানো হয়েছিল। সেখানে তিনি তার কাজ শেষ করেছিলেন আর তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন পূর্ণ করেছিলেন।
প্যালেস্টাইনে থাকার সময় জেরম ইব্রীয় ভাষাতে উন্নতি করার সুযোগ পান। এই ভাষার কঠিন দিকগুলো রপ্ত করার জন্য তিনি বেশ কিছু যিহূদী শিক্ষকের কাছে পড়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষক থাকলেও এটা খুব সহজ ছিল না। তীবরিয়ের বারানিনাস নামে এক শিক্ষকের সম্বন্ধে জেরম বলেন: “বারানিনাসের কাছে শিখবার জন্য আমাকে কত অসুবিধাই সহ্য করতে আর কত পয়সাই খরচ করতে হয়েছিল।” কেন তারা রাতে পড়তেন? কারণ বারানিনাসের ভয় ছিল যে একজন “খ্রীষ্টানের” সঙ্গে মেলামেশা করলে যিহূদী সমাজ তাকে কোন্ চোখে দেখবে!
জেরমের দিনে যিহূদীরা প্রায়ই ইব্রীয় ভাষাভাষী পরজাতীয়দের নিয়ে ঠাট্টা করতেন কারণ তারা কণ্ঠবর্ণগুলোকে ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারতেন না। তবুও অনেক চেষ্টার পর জেরম এই বর্ণগুলো উচ্চারণ করায় দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। জেরম অনেক ইব্রীয় শব্দকে ল্যাটিন ভাষায় বর্ণান্তরিত করেছিলেন আর এটা করা তাকে কেবল সেই শব্দগুলোকে মনে রাখতেই সাহায্য করেনি কিন্তু এর ফলে তখনকার ইব্রীয় উচ্চারণকে বাঁচিয়ে রাখাও সম্ভব হয়েছিল।
জেরমের সবচেয়ে বড় বিতর্ক
পোপ দামাসাস জেরমকে দিয়ে বাইবেলের কতখানি অংশ অনুবাদ করাতে চেয়েছিলেন তা বলা মুশকিল। কিন্তু এটা স্পষ্টই বোঝা যায় যে জেরম এই কাজকে কোন্ চোখে দেখেছিলেন। জেরম তার কাজে মন প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন আর তিনি খুবই দৃঢ় ছিলেন। তার প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল যে তিনি এমন কিছু কাজ করবেন যার থেকে “গির্জা আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপকার হয়।” সেইজন্য তিনি ঠিক করেন যে তিনি পুরো বাইবেলের একটি নতুন ল্যাটিন অনুবাদ তৈরি করবেন।
জেরম ঠিক করেছিলেন যে এটা তিনি ইব্রীয় শাস্ত্রের অনুবাদ সেপ্টুয়াজিন্ট এর উপর ভিত্তি করে করবেন। ইব্রীয় শাস্ত্রের এই গ্রিক সংস্করণ সা.কা.পূ. তৃতীয় শতাব্দীতে হয়েছিল। কিছু লোকেরা মনে করতেন যে এই অনুবাদ সরাসরি ঈশ্বরের অনুপ্রাণিত। তাই সেপ্টুয়াজিন্ট-কে সেই সময়ের গ্রিক ভাষাভাষী খ্রীষ্টানেরা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
কিন্তু অনুবাদ করার সময় জেরম দেখেন যে ল্যাটিন পাণ্ডুলিপির মতো গ্রিক পাণ্ডুলিপির মধ্যেও অনেক অসংগতি রয়েছে। জেরমের হতাশা বেড়ে যায়। শেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে যদি তাকে এক নির্ভরযোগ্য অনুবাদ করতে হয় তাহলে গ্রিক পাণ্ডুলিপি বা পবিত্র বলে বিবেচিত সেপ্টুয়াজিন্ট এর উপর ভিত্তি করে অনুবাদ করলে চলবে না বরং তাকে সরাসরি ইব্রীয় পাঠ থেকে অনুবাদ করতে হবে।
কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তাকে বিরোধিতার সামনে পড়তে হয়েছিল। অনেক লোকেরা জেরমের উপর দোষ দিয়েছিল যে তিনি বাইবেলকে মিথ্যাভাবে তুলে ধরছেন, ঈশ্বরের নিন্দা করছেন ও যিহূদীদের পক্ষ নিয়ে গির্জার পরম্পরার বিরুদ্ধে যাচ্ছেন। সেই সময়ে গির্জার সবচেয়ে বড় ধর্মতত্ত্ববিদ আগস্টিনও জেরমকে অনুরোধ করেছিলেন যে তিনি যেন সেপ্টুয়াজিন্ট-কে ভিত্তি করেই অনুবাদ করেন। তিনি বলেছিলেন: “যদি তোমার অনুবাদ বিভিন্ন গির্জাগুলোতে পড়া হয় তাহলে দুঃখের বিষয় হবে যে শাস্ত্রই ল্যাটিন আর গ্রিক গির্জার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেবে।”
হ্যাঁ আগস্টিনের ভয় ছিল যে পশ্চিমের গির্জাগুলো যদি ইব্রীয় পাঠের উপর ভিত্তি করে লেখা জেরমের ল্যাটিন অনুবাদ পড়ে আর প্রাচ্যের গির্জাগুলো যদি সেপ্টুয়াজিন্ট সংস্করণকে ব্যবহার করে তাহলে গির্জার ঐক্য একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।b আগস্টিন আরও বলেছিলেন যে এটা ঠিক নয় যে আমরা সেপ্টুয়াজিন্ট-কে অস্বীকার করে এমন একটা বাইবেলকে প্রাধান্য দেব যেটির পক্ষ সমর্থন জেরম ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না।
এই বিরোধীদের প্রতি জেরম কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? স্বভাবতই জেরম তার বিরোধীদের উপেক্ষা করেছিলেন। তিনি সরাসরি মূল ইব্রীয় পাঠ থেকে অনুবাদ করতে থাকেন আর সা.কা. ৪০৫ সালের মধ্যে ল্যাটিন ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করা শেষ করে ফেলেন। বেশ কিছু বছর পরে অনুবাদের নাম ভালগেট দেওয়া হয়েছিল যা একটা এইরকম সংস্করণকে বুঝিয়েছিল যেটিকে সবাই স্বীকার করে নিয়েছিলেন (ল্যাটিন শব্দ ভালগেটাস এর অর্থ “সুপরিচিত অর্থাৎ খুবই জনপ্রিয়”)।
দীর্ঘস্থায়ী কীর্তি
জেরম ইব্রীয় শাস্ত্রের যে অনুবাদ করেছিলেন তা কেবল ওই সময়ের জন্যই একটা নতুন সংস্করণ ছিল না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটা বাইবেল অধ্যয়ন ও অনুবাদের ধরণ পালটে দিয়েছিল। ইতিহাসবেত্তা উইল ডুরান্ট বলেছিলেন: “ভালগেট চতুর্থ শতাব্দীর এক মহৎ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্যিক কীর্তি হিসাবে রয়ে গেছে।”
যদিও জেরম স্বভাবে স্পষ্টবাদী ও ঝগড়াটে ছিলেন কিন্তু তিনি একাই বাইবেল অনুবাদ করে অনুপ্রাণিত ইব্রীয় পাঠ থেকে বাইবেলের পরীক্ষা করার রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন। তিনি খুবই উৎসাহের সঙ্গে সেই ইব্রীয় ও গ্রিক পাণ্ডুলিপিগুলো অধ্যয়ন করেছিলেন আর সেগুলোর তুলনা করেছিলেন যা এখন আর আমাদের কাছে নেই। এই অনুবাদ যিহূদী ম্যাসোরাইটদের অনুবাদের চেয়েও অনেক আগের ছিল। এইজন্য বাইবেল পাঠের তুলনা করার জন্য ভালগেট খুবই সাহায্যকারী।
জেরমের ব্যবহার ও ধর্মীয় দৃষ্টভঙ্গিকে উপেক্ষা না করেই ঈশ্বরের বাক্যের প্রেমিকেরা এই বিতর্কিত ব্যক্তির পরিশ্রমকে উপলব্ধি করেন যিনি বাইবেল অনুবাদের জন্য পথ তৈরি করেছিলেন। আর হ্যাঁ জেরম তার স্বপ্ন পূর্ণ করেছিলেন—যিনি এমন কাজ করেছিলেন যার থেকে “ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উপকার পায়।”
[পাদটীকাগুলো]
a জেরমের জীবনের ঘটনাগুলোর তারিখ ও কোন্টার পর কোন্টা ঘটেছিল সে বিষয়ে সব ইতিহাসবেত্তারা একমত নন।
b শেষ পর্যন্ত জেরমের অনুবাদটাই পশ্চিমী খ্রীষ্টীয়জগতের মূল বাইবেল হয়ে যায় আর সেপ্টেয়াজিন্ট এখনও প্রাচ্যের খ্রীষ্টীয়জগতে ব্যবহার করা হয়।
[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
বৈৎলেহমে জেরমের মূর্তি
[সজন্যে]
Garo Nalbandian
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্য]
উপরে বামদিকে, ইব্রীয় পাণ্ডুলিপি: Courtesy of the Shrine of the Book, Israel Museum, Jerusalem; নিচে বামদিকে সিরীয় পাণ্ডুলিপি: Reproduced by kind permission of The Trustees of the Chester Beatty Library, Dublin; উপরে মাঝখানে গ্রিক পাণ্ডুলিপি: Courtesy of Israel Antiquities Authority