যিহোবা—মঙ্গলভাবের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ
“বাহিনীগণের সদাপ্রভুর [“যিহোবার,” NW] প্রশংসা কর, কেননা সদাপ্রভু [“যিহোবা,” NW] মঙ্গলস্বরূপ।”—যিরমিয় ৩৩:১১.
১. কেন আমরা ঈশ্বরের মঙ্গলভাবের জন্য তাঁর প্রশংসা করতে প্রেরণা পাই?
যিহোবা ঈশ্বর পুরোপুরি মঙ্গলময়। ভাববাদী সখরিয় উচ্চৈঃস্বরে বলেছিলেন, “আঃ! তাঁহার কেমন মঙ্গলভাব!” (সখরিয় ৯:১৭, পাদটীকা) সত্যিই, আমাদের আনন্দের জন্য পৃথিবীকে তৈরি করতে ঈশ্বর যা কিছু করেছেন, তার সমস্ত কিছুতেই মঙ্গলভাব দেখা যায়। (আদিপুস্তক ১:৩১) এই নিখিলবিশ্ব সৃষ্টি করার সময় ঈশ্বর যে জটিল আইনগুলো ব্যবহার করেছেন, তা বোঝার সাধ্য আমাদের কখনও হবে না। (উপদেশক ৩:১১; ৮:১৭) কিন্তু আমরা যেটুকুই জানি, তা আমাদেরকে ঈশ্বরের মঙ্গলভাবের জন্য প্রশংসা করতে প্রেরণা দেয়।
২. মঙ্গলভাবকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
২ মঙ্গলভাব কী? এটা হল নৈতিক উৎকর্ষ বা সদ্গুণ। কিন্তু, এটা কোন খারাপ স্বভাব না থাকার চেয়ে আরও বেশি কিছুকে বোঝায়। মঙ্গলভাব হল আত্মার ফলগুলোর মধ্যে একটা ফল এবং এক ইতিবাচক গুণ। (গালাতীয় ৫:২২, ২৩) আমরা যখন অন্যদের জন্য ভাল এবং উপকারজনক কাজগুলো করি, তখন আমরা মঙ্গলভাব দেখাই। বর্তমান সমাজে কিছু দলের কাছে যেটাকে ভাল বলে মনে হয়, অন্যেরা হয়তো সেটাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখতে পারে। কিন্তু, আমরা যদি সুখশান্তি উপভোগ করতে চাই, তাহলে মঙ্গলভাবের একটা নির্দিষ্ট মান থাকতে হবে। তাই, কে এই মান সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেন?
৩. আদিপুস্তক ২:১৬, ১৭ পদ মঙ্গলভাবের মান সম্বন্ধে কী দেখায়?
৩ ঈশ্বর মঙ্গলভাবের মান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মানব ইতিহাসের একেবারে শুরুতেই যিহোবা নিজে প্রথম মানুষকে আজ্ঞা দিয়েছিলেন: “তুমি এই উদ্যানের সমস্ত বৃক্ষের ফল স্বচ্ছন্দে ভোজন করিও; কিন্তু সদসদ্-জ্ঞানদায়ক যে বৃক্ষ, তাহার ফল ভোজন করিও না, কেননা যে দিন তাহার ফল খাইবে, সেই দিন মরিবেই মরিবে।” (আদিপুস্তক ২:১৬, ১৭) হ্যাঁ, সদসদ্-জ্ঞান অর্থাৎ ভাল-মন্দের জ্ঞানের জন্য মানুষের তাদের সৃষ্টিকর্তার ওপর নির্ভর করার দরকার আছে।
অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও মঙ্গলভাব দেখানো
৪. আদম পাপ করার পর ঈশ্বর মানবজাতির জন্য কী করেছেন?
৪ আদম যখন পাপ করেছিল এবং মঙ্গলভাবের মান নির্ধারণ করার বিষয়ে ঈশ্বরের অধিকারকে প্রত্যাখান করেছিল, তখন সিদ্ধ অবস্থায় মানবজাতির অনন্ত সুখের আশা ঝুঁকির মুখে চলে গিয়েছিল। (আদিপুস্তক ৩:১-৬) কিন্তু, আদমের বংশধর উত্তরাধিকারসূত্রে পাপ ও মৃত্যু নিয়ে জন্মানোর আগেই সিদ্ধ বংশ আসবে বলে ঈশ্বর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আসলে, “পুরাতন সর্প” শয়তান দিয়াবলের উদ্দেশে যিহোবা ঘোষণা করেছিলেন: “আমি তোমাতে ও নারীতে, এবং তোমার বংশে ও তাহার বংশে পরস্পর শত্রুতা জন্মাইব; সে তোমার মস্তক চূর্ণ করিবে, এবং তুমি তাহার পাদমূল চূর্ণ করিবে।” (প্রকাশিত বাক্য ১২:৯; আদিপুস্তক ৩:১৫) যিহোবার উদ্দেশ্য ছিল পাপী মানবজাতিকে মুক্ত করা। যারা যিহোবার প্রিয় পুত্রের মুক্তির মূল্যে বিশ্বাস করে চলে, তারা অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রতি মঙ্গলভাব দেখিয়ে তিনি সত্যিই পরিত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন।—মথি ২০:২৮; রোমীয় ৫:৮, ১২.
৫. যদিও উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা দুষ্ট মনস্কল্পনা পেয়েছি, তারপরও আমরা কেন কিছুটা হলেও মঙ্গলভাব দেখাতে পারি?
৫ অবশ্য, আদমের পাপের কারণে আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে দুষ্ট মনস্কল্পনা পেয়েছি। (আদিপুস্তক ৮:২১) কিন্তু আনন্দের বিষয় হল, কিছুটা হলেও মঙ্গলভাব দেখানোর জন্য যিহোবা আমাদেরকে সাহায্য করেন। তাঁর মূল্যবান পবিত্র লেখাগুলো থেকে যা শিখেছি, তাতে সবসময় স্থির থাকা শুধু ‘আমাদেরকে পরিত্রাণের নিমিত্ত জ্ঞানবান্’ এবং ‘সমস্ত সৎকর্ম্মের জন্য সুসজ্জীভূতই করে’ না কিন্তু সেইসঙ্গে তাঁর চোখে যা ভাল, তা করতেও সাহায্য করে। (২ তীমথিয় ৩:১৪-১৭) কিন্তু, শাস্ত্রীয় নির্দেশনা থেকে উপকার পাওয়ার ও মঙ্গলভাব দেখানোর জন্য আমাদেরকে গীতরচকের মতো মনোভাব রাখতে হবে, যিনি গেয়েছিলেন: ‘তুমি [যিহোবা] মঙ্গলময় ও মঙ্গলকারী, তোমার বিধিকলাপ আমাকে শিক্ষা দেও।’—গীতসংহিতা ১১৯:৬৮.
যিহোবার মঙ্গলভাবের উচ্চ প্রশংসা করা হয়
৬. রাজা দায়ূদ যিরূশালেমে নিয়ম সিন্দুক নিয়ে আসার পর, লেবীয়রা যে গান গেয়েছিলেন তার মধ্যে কোন্ কথাগুলো ছিল?
৬ প্রাচীন ইস্রায়েলের রাজা দায়ূদ ঈশ্বরের মঙ্গলভাবের কথা স্বীকার করেছিলেন এবং তাঁর নির্দেশনা খুঁজেছিলেন। দায়ূদ বলেছিলেন: “সদাপ্রভু মঙ্গলময় ও সরল, এইজন্য তিনি পাপীদিগকে পথ দেখান।” (গীতসংহিতা ২৫:৮) ইস্রায়েলীয়দেরকে ঐশিক নির্দেশনা ও সেইসঙ্গে দুটো পাথরের ফলকে লেখা দশটা গুরুত্বপূর্ণ আইন দেওয়া হয়েছিল এবং সেগুলো পবিত্র সিন্দুকে অর্থাৎ যেটাকে নিয়ম সিন্দুক বলা হতো তার ভিতরে রাখা হয়েছিল। দায়ূদ সেই সিন্দুক ইস্রায়েলের রাজধানী যিরূশালেমে নিয়ে আসার পর, লেবীয়রা যে গান গেয়েছিলেন তার মধ্যে এই কথাগুলো ছিল: “সদাপ্রভুর স্তব কর, কেননা তিনি মঙ্গলময়, তাঁহার দয়া [“প্রেমপূর্ণ-দয়া,” NW] অনন্তকালস্থায়ী।” (১ বংশাবলি ১৬:৩৪, ৩৭-৪১) লেবীয় গায়কদের মুখ থেকে সেই কথাগুলো শোনা কত আনন্দদায়কই না ছিল!
৭. অতি পবিত্র স্থানে সিন্দুক রাখার এবং শলোমনের উৎসর্গীকরণ প্রার্থনার পর কী হয়েছিল?
৭ দায়ূদের ছেলে শলোমনের তৈরি যিহোবার মন্দির উৎসর্গীকরণের সময়ও এই একই প্রশংসা বাক্যগুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। নিয়ম সিন্দুকটা যখন নতুন তৈরি মন্দিরের অতি পবিত্র স্থানে রাখা হয়েছিল, তখন লেবীয়রা এই কথাগুলো বলে যিহোবার প্রশংসা করতে শুরু করেন যে, “তিনি মঙ্গলময়, হাঁ, তাঁহার দয়া [“প্রেমপূর্ণ-দয়া,” NW] অনন্তকালস্থায়ী।” সেই সময় মন্দির অলৌকিকভাবে মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল, যা যিহোবার প্রতাপান্বিত উপস্থিতিকে বুঝিয়েছিল। (২ বংশাবলি ৫:১৩, ১৪) শলোমনের উৎসর্গীকরণ প্রার্থনার পর, “আকাশ হইতে অগ্নি নামিয়া হোম ও বলি সকল গ্রাস করিল।” আর তা দেখার পর “ইস্রায়েল-সন্তানগণ . . . নত হইয়া প্রস্তরবাঁধা ভূমিতে উবুড় হইয়া প্রণিপাত করিল, এবং সদাপ্রভুর স্তব করিয়া কহিল, তিনি মঙ্গলময়, হাঁ, তাঁহার দয়া [“প্রেমপূর্ণ-দয়া,” NW] অনন্তকালস্থায়ী।” (২ বংশাবলি ৭:১-৩) ১৪ দিন উৎসবের পর ইস্রায়েলীয়রা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল, “সদাপ্রভু দায়ূদের, শলোমনের ও আপন প্রজা ইস্রায়েলের যে সকল মঙ্গল করিয়াছিলেন, তৎপ্রযুক্ত তাহারা আনন্দিত ও হৃষ্টচিত্ত হইয়াছিল।”—২ বংশাবলি ৭:১০.
৮, ৯. (ক) যদিও ইস্রায়েলীয়রা যিহোবার মঙ্গলভাবের প্রশংসা করেছিল কিন্তু পরে তারা কোন্ কাজগুলোতে জড়িয়ে পড়েছিল? (খ) যিরমিয়ের মাধ্যমে যিরূশালেম সম্বন্ধে কোন্ ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল এবং কীভাবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী পরিপূর্ণ হয়েছিল?
৮ দুঃখজনক যে, ঈশ্বরের উদ্দেশে ইস্রায়েলীয়রা যে প্রশংসা গীত গেয়েছিল তার সঙ্গে তারা মিল রেখে চলেনি। পরে যিহূদার লোকেরা ‘শুধু ওষ্ঠাধরে যিহোবার সম্মান করিত।’ (যিশাইয় ২৯:১৩) ঈশ্বরের দেওয়া মঙ্গলভাবের মান মেনে না চলে তারা মন্দ বিষয়গুলোতে জড়িয়ে পড়েছিল। তারা কোন্ মন্দ কাজগুলোতে জড়িয়ে পড়েছিল? হ্যাঁ, তারা জঘন্য প্রতিমাপূজা, অনৈতিকতা, গরিবদের ওপর জুলুম এবং অন্যান্য গুরুতর পাপ করেছিল! এর ফলে সা.কা.পূ. ৬০৭ সালে যিরূশালেম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং যিহূদার লোকেদেরকে বন্দি করে বাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
৯ এভাবেই ঈশ্বর তাঁর লোকেদেরকে শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু, ভাববাদী যিরমিয়ের মাধ্যমে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে যিরূশালেমে আবারও এই কথাগুলো শোনা যাবে: “বাহিনীগণের যিহোবার প্রশংসা কর, কেননা যিহোবা মঙ্গলস্বরূপ, তাঁহার দয়া [“প্রেমপূর্ণ-দয়া,” NW] অনন্তকালস্থায়ী।” (যিরমিয় ৩৩:১০, ১১) আর তা সত্যি হয়েছিল। ৭০ বছর ভূমি জনশূন্য অবস্থায় পড়ে থাকার পর সা.কা.পূ. ৫৩৭ সালে যিহুদি অভিষিক্তরা যিরূশালেমে ফিরে এসেছিল। (যিরমিয় ২৫:১১; দানিয়েল ৯:১, ২) মোরিয়া পর্বতে যেখানে আগে মন্দির ছিল, সেখানে তারা আবার যজ্ঞবেদি তৈরি করে তাতে বলি উৎসর্গ করতে শুরু করেছিল। তারা ফিরে আসার দ্বিতীয় বছরে মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। কত রোমাঞ্চকর সময়ই না তা ছিল! ইষ্রা বলেছিলেন: “আর গাঁথকেরা যখন সদাপ্রভুর মন্দিরের ভিত্তিমূল স্থাপন করিল, তখন ইস্রায়েল-রাজ দায়ূদের নিরূপণানুসারে সদাপ্রভুর প্রশংসা করণার্থে আপন আপন পরিচ্ছদপরিহিত যাজকগণ তূরী লইয়া ও আসফের সন্তান লেবীয়েরা করতাল লইয়া দণ্ডায়মান হইল। তাহারা সদাপ্রভুর প্রশংসা ও স্তব করিয়া পালানুসারে এই গান করিল; ‘তিনি মঙ্গলময়, ইস্রায়েলের প্রতি তাঁহার দয়া [“প্রেমপূর্ণ-দয়া,” NW] অনন্তকালস্থায়ী’।”—ইষ্রা ৩:১-১১.
১০. কোন্ গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো দিয়ে গীতসংহিতা ১১৮ অধ্যায় শুরু এবং শেষ হয়েছে?
১০ যিহোবার মঙ্গলভাব সম্বন্ধে একই প্রশংসা বাক্য বিভিন্ন গীতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে একটা হল গীতসংহিতা ১১৮ অধ্যায়, যা ইস্রায়েলীয় পরিবারগুলো নিস্তারপর্ব উদ্যাপনের শেষে গেয়েছিল। ওই গীত এই কথাগুলো দিয়ে শুরু এবং শেষ হয়েছে: “সদাপ্রভুর স্তব কর, কেননা তিনি মঙ্গলময়, তাঁহার দয়া [“প্রেমপূর্ণ-দয়া,” NW] অনন্তকালস্থায়ী।” (গীতসংহিতা ১১৮:১, ২৯) সা.কা. ৩৩ সালে যীশু খ্রীষ্টের মৃত্যুর আগের রাতে তিনি ও তাঁর বিশ্বস্ত প্রেরিতরা যে প্রশংসা গীত গেয়েছিলেন, তার শেষ কথাগুলো সম্ভবত এগুলোই ছিল।—মথি ২৬:৩০.
“বিনয় করি, তুমি আমাকে তোমার প্রতাপ দেখিতে দেও”
১১, ১২. মোশি যখন ঈশ্বরের প্রতাপের একটু আভাস দেখেছিলেন, তখন তিনি কোন্ ঘোষণা শুনতে পেয়েছিলেন?
১১ যিহোবার মঙ্গলভাব এবং প্রেমপূর্ণ-দয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে, তা ইষ্রার সময়ের কয়েকশ বছর আগে প্রথম বোঝা গিয়েছিল। প্রান্তরে ইস্রায়েলীয়রা সোনার বাছুর পূজা করার এবং অন্যায়কারীদেরকে শাস্তি দেওয়ার কিছু পরেই যিহোবার কাছে মোশি অনুরোধ করেছিলেন, “বিনয় করি, তুমি আমাকে তোমার প্রতাপ দেখিতে দেও।” যিহোবার মুখ দেখে মোশি বাঁচতে পারবে না বলে তিনি বলেছিলেন: “আমি তোমার সম্মুখ দিয়া আপনার সমস্ত উত্তমতা গমন করাইব।”—যাত্রাপুস্তক ৩৩:১৩-২০.
১২ পরের দিন সীনয় পর্বতে মোশির সামনে যিহোবা তাঁর উত্তমতা বা মঙ্গলভাব দেখিয়েছিলেন। সেই সময় মোশি যিহোবার প্রতাপের একটু আভাস দেখেছিলেন এবং এই ঘোষণা শুনেছিলেন: “যিহোবা, যিহোবা, করুণাময় ও সদয় ঈশ্বর, ক্রোধে ধীর এবং প্রেমপূর্ণ-দয়া ও সত্যে মহান; সহস্র সহস্র পুরুষ পর্যন্ত প্রেমপূর্ণ-দয়া দেখান এবং অপরাধ, অন্যায় ও পাপ ক্ষমা করেন; কিন্তু তিনি কোনভাবেই শাস্তি থেকে রেহাই দেবেন না; তিনি বাবার অন্যায়ের শাস্তি ছেলে এবং নাতিদের ও তিন-চার পুরুষ পর্যন্ত দিয়ে থাকেন।” (যাত্রাপুস্তক ৩৪:৬, ৭, NW) এই কথাগুলো দেখায় যে, যিহোবার মঙ্গলভাব তাঁর প্রেমপূর্ণ-দয়া ও ব্যক্তিত্বের অন্যান্য দিকগুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এগুলো বিবেচনা করলে, তা আমাদেরকে মঙ্গলভাব দেখাতে সাহায্য করবে। আসুন, প্রথমে আমরা ঈশ্বরের মঙ্গলভাবের এই অপূর্ব ঘোষণার মধ্যে যে গুণটা দুবার উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা বিবেচনা করি।
‘ঈশ্বর প্রেমপূর্ণ-দয়াতে মহান’
১৩. ঈশ্বরের মঙ্গলভাবের বিষয়ে ঘোষণা করার সময় কোন্ গুণের কথা দুবার উল্লেখ করা হয়েছে আর তা কেন উপযুক্ত?
১৩ ‘যিহোবা [হলেন] প্রেমপূর্ণ-দয়াতে মহান ঈশ্বর, সহস্র সহস্র পুরুষ পর্যন্ত প্রেমপূর্ণ-দয়া দেখান।’ যে ইব্রীয় শব্দ থেকে “প্রেমপূর্ণ-দয়া” শব্দটা অনুবাদ করা হয়েছে, তার অর্থ “নিষ্ঠাপূর্ণ প্রেম”-কেও বোঝায়। একমাত্র এই গুণটাই মোশির সামনে ঈশ্বরের ঘোষণায় দুবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু যিহোবার প্রধান গুণ হল প্রেম, তাই তা কত উপযুক্ত! (১ যোহন ৪:৮) “তিনি মঙ্গলময়, হাঁ, তাঁহার প্রেমপূর্ণ-দয়া অনন্তকালস্থায়ী,” যিহোবাকে প্রশংসা করার এই পরিচিত কথাগুলো এই গুণকে তুলে ধরে।
১৪. বিশেষ করে কারা ঈশ্বরের মঙ্গলভাব এবং প্রেমপূর্ণ-দয়া উপভোগ করেন?
১৪ যিহোবার মঙ্গলভাবের একটা প্রকাশ হল যে তিনি ‘প্রেমপূর্ণ-দয়াতে মহান।’ আর তা বিশেষ করে তাঁর কোমল যত্নের মধ্যে দেখা যায়, যা তিনি তাঁর উৎসর্গীকৃত ও বিশ্বস্ত দাসদের প্রতি নিয়ে থাকেন। (১ পিতর ৫:৬, ৭) যিহোবার একজন সাক্ষি হিসেবে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে, যারা তাঁকে ভালবাসেন এবং তাঁর সেবা করেন তাদেরকে তিনি ‘প্রেমপূর্ণ-দয়া দেখান।’ (যাত্রাপুস্তক ২০:৬) ইস্রায়েল জাতি যিহোবার পুত্রকে প্রত্যাখান করেছিল বলে তারা আর তাঁর প্রেমপূর্ণ-দয়া বা নিষ্ঠাপূর্ণ প্রেম পায়নি। কিন্তু, সমস্ত জাতি থেকে আসা বিশ্বস্ত খ্রীষ্টানদের প্রতি তাঁর মঙ্গলভাব এবং নিষ্ঠাপূর্ণ প্রেম চিরকাল থাকবে।—যোহন ৩:৩৬.
যিহোবা—করুণাময় ও সদয়
১৫. (ক) সীনয় পর্বতে মোশি যে ঘোষণা শুনেছিলেন, তা কোন্ কথাগুলো দিয়ে শুরু হয়েছিল? (খ) করুণার সঙ্গে কী জড়িত?
১৫ সীনয় পর্বতে মোশি যে ঘোষণা শুনেছিলেন, তা এই কথাগুলো দিয়ে শুরু হয়েছিল: “যিহোবা, যিহোবা, করুণাময় ও সদয় ঈশ্বর।” যে ইব্রীয় শব্দকে “করুণাময়” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, তা সম্ভবত “অন্ত্র”-কে বোঝায় আর এটা যে শব্দকে “জরায়ু” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাই করুণা বলতে কোমল অনুভূতিকেও বোঝায়, যা একজন ব্যক্তির গভীরে থাকে। কিন্তু করুণার সঙ্গে প্রকৃত সমবেদনার চেয়ে আরও বেশি কিছু জড়িত। এটা আমাদেরকে এমন কিছু করতে প্রেরণা দেবে, যাতে করে অন্যদের কষ্ট দূর হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রেমময় খ্রীষ্টান প্রাচীনরা যখন সহ বিশ্বাসীদের প্রতি করুণাময় হওয়া দরকার বলে মনে করেন, তখন তারা ‘হৃষ্টচিত্তে করুণা দেখান।’—রোমীয় ১২:৮; যাকোব ২:১৩; যিহূদা ২২, ২৩, NW.
১৬. কেন বলা যেতে পারে যে, যিহোবা সদয়?
১৬ ঈশ্বরের মঙ্গলভাব তাঁর সদয়ভাবের মধ্যেও দেখা যায়। একজন সদয় ব্যক্তি “অন্যদের অনুভূতিগুলো সম্বন্ধে বিশেষ বিবেচনা করেন” এবং ‘বিশেষ করে অসহায়দের প্রতি দয়া দেখান।’ যিহোবা তাঁর বিশ্বস্ত দাসদের সঙ্গে সদয়ভাব দেখানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তম উদাহরণ। যেমন, স্বর্গদূতেদের মাধ্যমে ঈশ্বর সদয়ভাবে বৃদ্ধ ভাববাদী দানিয়েলকে শক্তি জুগিয়েছিলেন এবং কুমারী মরিয়মকে সংবাদ দিয়েছিলেন যে, তিনি যীশুর জন্ম দেবেন। (দানিয়েল ১০:১৯; লূক ১:২৬-৩৮) যিহোবার লোক হিসেবে আমরা সত্যিই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ কারণ বাইবেলে দেওয়া তাঁর সদয়ভাব আমাদেরকে আকৃষ্ট করে। তিনি মঙ্গলভাব দেখিয়েছেন বলে আমরা তাঁর প্রশংসা করি এবং অন্যদের সঙ্গে ব্যবহার করার সময় আমরা সদয় হওয়ার চেষ্টা করি। যে ব্যক্তিদের বিভিন্ন আধ্যাত্মিক যোগ্যতা রয়েছে, তারা যখন কোন সহ বিশ্বাসীকে “মৃদুতার আত্মায়” সংশোধন করেন, তখন তারা নম্র ও সদয় হওয়ার চেষ্টা করেন।—গালাতীয় ৬:১.
ক্রোধে ধীর এক ঈশ্বর
১৭. যিহোবা “ক্রোধে ধীর” বলে কেন আমরা কৃতজ্ঞ?
১৭ “ঈশ্বর, ক্রোধে ধীর।” এই কথাগুলো যিহোবার মঙ্গলভাবের আরেকটা দিকের ওপর জোর দেয়। যিহোবা ধৈর্যের সঙ্গে আমাদের ভুলগুলোকে মেনে নেন এবং আমাদের গুরুতর দুর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে ওঠার ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে উন্নতি করার জন্য সময় দেন। (ইব্রীয় ৫:১২–৬:৩; যাকোব ৫:১৪, ১৫) ঈশ্বরের ধৈর্য সেই সমস্ত ব্যক্তিদেরও উপকার করে, যারা এখনও তাঁর উপাসক হননি। এখনও তাদের রাজ্যের বার্তার প্রতি সাড়া দেওয়ার এবং অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। (রোমীয় ২:৪) যদিও যিহোবা ধৈর্যশীল কিন্তু তাঁর মঙ্গলভাবের কারণে তিনি কখনও কখনও রাগ প্রকাশ করেন, যা তিনি ইস্রায়েলীয়রা যখন সীনয় পর্বতে সোনার বাছুরের উপাসনা করেছিল, তখন প্রকাশ করেছিলেন। শীঘ্রিই ঈশ্বর যখন শয়তানের দুষ্ট বিধিব্যবস্থার শেষ নিয়ে আসবেন, তখন তিনি আরও বেশি রাগ প্রকাশ করবেন।—যিহিষ্কেল ৩৮:১৯, ২১-২৩.
১৮. সত্যের বিষয়ে যিহোবা এবং মনুষ্য নেতাদের মধ্যে কোন্ পার্থক্য রয়েছে?
১৮ “যিহোবা . . . ঈশ্বর, . . . সত্যে মহান।” বড় বড় প্রতিজ্ঞা করে এবং সেগুলো পালন করতে ব্যর্থ হয়, এমন মনুষ্য নেতাদের চেয়ে যিহোবা কত আলাদা! বিপরীতে, যিহোবার উপাসকরা তাঁর অনুপ্রাণিত বাক্যে বলা সমস্ত কিছুর ওপর নির্ভর করতে পারেন। যেহেতু ঈশ্বর সত্যে মহান, তাই আমরা সবসময় তাঁর প্রতিজ্ঞাগুলোর ওপর আস্থা রাখতে পারি। আমাদের স্বর্গীয় পিতার মঙ্গলভাব থাকায়, আধ্যাত্মিক সত্য চেয়ে আমরা যে প্রার্থনা করি, তা প্রচুররূপে জুগিয়ে তিনি সবসময় আমাদের প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকেন।—গীতসংহিতা ৪৩:৩; ৬৫:২.
১৯. অনুতপ্ত পাপীদের প্রতি যিহোবা কোন্ উল্লেখযোগ্য মঙ্গলভাব দেখিয়েছেন?
১৯ “যিহোবা . . . ঈশ্বর . . . অপরাধ, অন্যায় ও পাপ ক্ষমা করেন।” মঙ্গলভাব থাকায় যিহোবা অনুতপ্ত পাপীদেরকে ক্ষমা করার জন্য সবসময় তৈরি। কোন সন্দেহ নেই যে, যীশুর বলিদানের মাধ্যমে আমাদের প্রেমময় স্বর্গীয় পিতা ক্ষমা পাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন বলে আমরা তাঁর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। (১ যোহন ২:১, ২) সত্যিই আমরা সুখী যে, যারা মুক্তির মূল্যে বিশ্বাস অনুশীলন করেন তারা যিহোবার সঙ্গে এক কাছের সম্পর্ক উপভোগ করতে পারেন ও সেইসঙ্গে তাঁর প্রতিজ্ঞাত নতুন জগতে চিরকাল বেঁচে থাকার আশা রাখেন। মানবজাতির প্রতি মঙ্গলভাব দেখানোর কারণে যিহোবাকে প্রশংসা করার কত উল্লেখযোগ্য কারণই না রয়েছে!—২ পিতর ৩:১৩.
২০. ঈশ্বর যে মন্দ বিষয়গুলো ক্ষমা করেন না তার কোন্ প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে?
২০ “[যিহোবা] কোনভাবেই শাস্তি থেকে রেহাই দেবেন না।” আসলে, এটা হল যিহোবার মঙ্গলভাবের জন্য তাঁর প্রশংসা করার আরেকটা কারণ। কেন? কারণ মঙ্গলভাবের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল যে, এটা কোনভাবেই মন্দ বিষয়গুলো ক্ষমা করে না। সবচেয়ে বড় কথা হল, “যখন প্রভু যীশু স্বর্গ হইতে আপনার পরাক্রমের দূতগণের সহিত জ্বলন্ত অগ্নিবেষ্টনে প্রকাশিত হইবেন,” তখন “যাহারা ঈশ্বরকে জানে না ও যাহারা আমাদের প্রভু যীশুর সুসমাচারের আজ্ঞাবহ হয় না” তাদের ওপর ধ্বংস নেমে আসবে। তারা “অনন্তকালস্থায়ী বিনাশরূপ দণ্ড ভোগ করিবে।” (২ থিষলনীকীয় ১:৬-৯) তখন অধার্মিক অর্থাৎ “সদ্বিদ্বেষী” লোকেরা থাকবে না বলে যিহোবার রক্ষাপ্রাপ্ত উপাসকরা পূর্ণরূপে জীবন উপভোগ করতে পারবে।—২ তীমথিয় ৩:১-৪.
যিহোবার মঙ্গলভাব অনুকরণ করুন
২১. কেন আমাদের মঙ্গলভাব দেখানো উচিত?
২১ নিঃসন্দেহে, যিহোবার মঙ্গলভাবের জন্য প্রশংসা করার এবং কৃতজ্ঞ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আমাদের রয়েছে। তাঁর দাস হিসেবে, এই গুণ দেখানোর জন্য আমাদের কি প্রাণপণ চেষ্টা করা উচিত নয়? হ্যাঁ, কারণ প্রেরিত পৌল তার সহ খ্রীষ্টানদের উৎসাহ দিয়েছিলেন: “ঈশ্বরের অনুকারী হও।” (ইফিষীয় ৫:১) আমাদের স্বর্গীয় পিতা সবসময় মঙ্গলভাব দেখান, তাই আমাদেরও তা দেখানো উচিত।
২২. পরের প্রবন্ধে আমরা কোন্ বিষয় বিবেচনা করব?
২২ আমরা যদি পূর্ণ হৃদয়ে যিহোবার কাছে উৎসর্গীকৃত হয়ে থাকি, তাহলে কোন সন্দেহ নেই যে তাঁর মঙ্গলভাব অনুকরণ করার জন্য আমরা অত্যন্ত আগ্রহী। যেহেতু আমরা পাপী আদমের বংশধর, তাই যা ভাল তা করা আমাদের জন্য সবসময় খুব সহজ নয়। কিন্তু, পরের প্রবন্ধে আমরা দেখব যে আমাদের পক্ষে মঙ্গলভাব দেখানো কেন সম্ভব। এছাড়া, আমরা বিভিন্ন দিক বিবেচনা করব, যেগুলোতে আমরা মঙ্গলভাবের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ যিহোবাকে অনুকরণ করতে পারি এবং করা উচিত।
আপনি কীভাবে উত্তর দেবেন?
• মঙ্গলভাব কী?
• কোন্ শাস্ত্রীয় কথাগুলো ঈশ্বরের মঙ্গলভাবকে তুলে ধরে?
• কোন্ কোন্ উপায়ে যিহোবার মঙ্গলভাব দেখা যায়?
• কেন আমাদের যিহোবার মঙ্গলভাবের উদাহরণ অনুকরণ করা উচিত?
[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]
যিহোবা তাঁর প্রাচীনকালের লোকেদেরকে শাস্তি দিয়েছিলেন কারণ তারা তাদের প্রশংসার বাক্য অনুসারে চলেনি
[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]
বিশ্বস্ত অভিষিক্তরা যিরূশালেমে ফিরে এসেছিল
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
ঈশ্বরের মঙ্গলভাবের অপূর্ব ঘোষণা মোশি শুনেছিলেন
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
বাইবেলের মাধ্যমে যিহোবা আমাদের ওপর যে ছাপ ফেলেন তাতে তাঁর মঙ্গলভাব দেখা যায়