কিভাবে সমস্যাগুলির মোকাবিলা করা যায় সে সম্বন্ধে একটি শিক্ষা
খুব কম লোকই আছে যাদের হয়ত কখনও ইয়োবের মতো সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে তার সম্পত্তি ও জীবনের উপার্জন নষ্ট হয়ে যায়, তার সন্তানদের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে এবং পরিশেষে এক অতি বেদনাদায়ক রোগে তিনি আক্রান্ত হন। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের দ্বারা তাড়িত হন, তিনি স্ত্রীর দ্বারা প্ররোচিত হন “ঈশ্বরকে জলাঞ্জলি দিয়া প্রাণত্যাগ” করতে।—ইয়োব ২:৯; ১৯:১৩, ১৪.
কিন্তু, ইয়োব, সেই সব ব্যক্তিদের জন্য এক অদ্বিতীয় উৎসাহের উৎস যারা ঐ ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছে। তার তাড়নার ইতিবাচক ফলাফল দেখায় যে বিপদের মুখে ধৈর্য রাখা যিহোবার হৃদয়কে আনন্দিত করে, বিশেষ করে যখন আমরা ব্যক্তিগত সুবিধার দ্বারা প্রণোদিত না হয়ে আন্তরিক ঈশ্বরীয় ভক্তির দ্বারা প্ররোচিত হই।—ইয়োব, অধ্যায় ১, ২; ৪২:১০-১৭; হিতোপদেশ ২৭:১১.
সমস্যার মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বাইবেলের এই বিবরণের মধ্যেও রয়েছে মূল্যবান শিক্ষা। এর মধ্যে রয়েছে কয়েকটি অসাধারণ উদাহরণ যা দেখায় যে যখন কেউ পরীক্ষার সম্মুখীন হয় তখন তাকে কিভাবে উপদেশ—দেওয়া উচিত—এবং উচিত নয়। এছাড়াও, ইয়োবের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমাদের সাহায্য করতে পারে ভারসাম্যমূলক প্রতিক্রিয়া দেখাতে যখন আমরা কোন বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে পড়ি।
নেতিবাচক উপদেশ থেকে এক শিক্ষা
“ইয়োবের সান্ত্বনাকারী” এই অভিব্যক্তিটি সেই ব্যক্তিকে চিত্রিত করে যে দুঃখের সময় সহানুভূতি না দেখিয়ে, পরিস্থিতিকে আরও বেশি সঙ্কটপূর্ণ করে তোলে। কিন্তু ইয়োবের এই তিন সহযোগী যে ধরনের আরোপিত চারিত্রিক গুণই অর্জন করে থাকুক না কেন আমাদের কখনই ভেবে নেওয়া উচিত নয় যে তাদের সমস্ত উদ্দেশ্যই খারাপ ছিল। তাদের ভ্রান্ত ধারণা থাকা সত্ত্বেও তারা কিছু ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই ইয়োবকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা কেন অকৃতকার্য হয়েছিল? কিভাবে তারা শয়তানের মাধ্যম হয়ে পড়েছিল, যে ইয়োবের বিশ্বস্ততা ভাঙ্গার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল?
বাস্তবিকভাবে তারা তাদের সমস্ত উপদেশগুলি ভ্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছিল: বিশেষ করে এই ধারণার উপর যে কেবলমাত্র যারা পাপ করে তাদের উপর তাড়না আসে। তার প্রথম বক্তৃতায় ইলীফস বলেছিল: “কে নির্দ্দোষ হইয়া বিনষ্ট হইয়াছে? আমি দেখিয়াছি, যাহারা অধর্ম্মরূপ চাষ করে, যাহারা অনিষ্ট-বীজ বপন করে, তাহারা তাহাই কাটে।” (ইয়োব ৪:৭, ৮) ইলীফস ভুলভাবে বিশ্বাস করেছিল যে নির্দোষের উপর কোন বিপদ আসে না। সে যুক্তি করেছিল যে যেহেতু ইয়োব এধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়েছে, তার মানে সে নিশ্চয়ই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করেছে।a একই রকমভাবে বিল্দদ ও সোফার উভয়ই জোর দেয় যে ইয়োব যেন তার পাপের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে।—ইয়োব ৮:৫, ৬; ১১:১৩-১৫.
ঈশ্বরের প্রজ্ঞা ব্যবহার না করে নিজেদের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ করার দ্বারা তার তিন সহকারী ইয়োবকে আরও দুঃখিত করেছিল। ইলীফস এও বলে যে ‘ঈশ্বর তাঁর দাসেদের বিশ্বাস করেন না’ এবং ইয়োব ধার্মিক হোন বা নাই হোন তাতে যিহোবার কিছু এসে যায় না। (ইয়োব ৪:১৮; ২২:২, ৩) এর থেকে আরও নিরুৎসাহজনক—অথবা মিথ্যা—মন্তব্য কল্পনা করা অসম্ভব! এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে যিহোবা পরে ইলীফস ও তার সহকারীদের এই ঈশ্বর নিন্দার জন্য তিরস্কার করেন। “তোমরা আমার বিষয়ে তদ্রূপ যথার্থ কথা বল নাই,” তিনি বলেন। (ইয়োব ৪২:৭) কিন্তু আরও ক্ষতিকর অভিযোগ আসতে তখনও বাকি ছিল।
পরিশেষে ইলীফস সরাসরি চরম অভিযোগ নিয়ে আসে। যেহেতু সে ইয়োবকে দোষ স্বীকার করাতে বাধ্য করতে পারল না, অতএব সে এমন কিছু পাপের কথা পরিকল্পনা করতে আরম্ভ করে যা সে ভেবে নিয়েছিল যে ইয়োব তা করেছেন। “তোমার দুষ্ক্রিয়া কি বিস্তর নয়? তোমার অপরাধের সীমা নাই।” ইলীফস জিজ্ঞাসা করে। “তুমি অকারণে নিজ ভ্রাতা হইতে বন্ধক লইতে, তুমি বস্ত্রহীনের বস্ত্র হরণ করিতে। তুমি পরিশ্রান্তকে পান করিতে জল দিতে না, ক্ষুধিতকে আহার দিতে অস্বীকার করিতে।” (ইয়োব ২২:৫-৭) এই অভিযোগগুলির কোন ভিত্তিই ছিল না। যিহোবা নিজে ইয়োবকে “সিদ্ধ ও সরল” ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করেছেন।—ইয়োব ১:৮.
তার ব্যক্তিগত বিশ্বস্ততার বিরুদ্ধে এই আক্রমণের প্রতি ইয়োব কিভাবে সাড়া দিয়েছিল? অবশ্যই এটা তাকে তিক্ত ও বিষণ্ণ করেছিল কিন্তু তিনি আরও বেশি দৃঢ় হয়েছিলেন এই অভিযোগের অসত্যতাকে প্রমাণ করতে। বস্তুতপক্ষে, তিনি নিজেকে মহিমান্বিত করার জন্য এত বেশি মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি একরকমভাবে যিহোবাকে এই দুর্বিপাকের জন্য দায়ী করতে আরম্ভ করেছিলেন। (ইয়োব ৬:৪; ৯১৬-১৮; ১৬১১, ১২) আসল বিচার্য বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে পড়ে এবং প্রধান বিতর্কের বিষয়গুলি হয়ে দাঁড়ায় যে ইয়োব বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিল কী ছিল না। এই ধ্বংসাত্মকমূলক উপদেশ থেকে খ্রীষ্টানেরা কী শিখতে পারে?
১. একজন প্রেমময় খ্রীষ্টান আগে থেকেই ধরে নেবে না যে এক ভাইয়ের সমস্যার জন্য সে নিজেই দায়ী। অতীতের কোন ভুলকে কেন্দ্র করে কঠোর সমালোচনা—তা বাস্তব বা কল্পনা যাইহোক না কেন—তা একজন ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহ করে দিতে পারে যে সাহস না হারিয়ে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে। ভগ্ন হৃদয়ে প্রয়োজন ‘সান্ত্বনা,’ অবমাননা নয়। (১ থিষলনীকীয় ৫:১৪) যিহোবা চান যে অধ্যক্ষেরা যেন “বাত্যা হইতে আচ্ছাদন” হয়, ইলীফস, বিল্দদ ও সোফারের মতো “কষ্টজনক সান্ত্বনাকারী” না হয়।—যিশাইয় ৩২:২; ইয়োব ১৬:২.
২. সঠিক প্রমাণ ছাড়া আমাদের কখনও অভিযোগ করা উচিত নয়। কানে শোনা অথবা অনুমান করে নেওয়া—ইলীফসের মতো—যেগুলি কখনও অনুযোগ করার ভিত্তি হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোন প্রাচীন মিথ্যা অভিযোগ করেন, তাহলে তিনি হয়ত তার সততা হারাতে পারেন এবং মানুষিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেন। ঐ ধরনের ভ্রান্তিমূলক উপদেশ শোনার প্রতি ইয়োবের কি ধরনের মনোভাব হয়েছিল? তিনি ব্যাঞ্জনাপূর্বক এই বলে তার ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন: “তুমি বলহীনের কেমন সাহায্য করিলে!” (ইয়োব ২৬:২) একজন সহানুভূতিশীল অধ্যক্ষ “শিথিল হস্ত . . .সবল” করবে, সমস্যাকে আরও খারাপ করে তুলবে না।—ইব্রীয় ১২:১২.
৩. উপদেশের ভিত্তি হবে ঈশ্বরের বাক্য, কোন ব্যক্তিগত অভিমত নয়। ইয়োবের সহকারীদের বিতর্কগুলি ছিল ভুল ও ধ্বংসাত্মকমূলক। ইয়োবকে যিহোবার কাছে না নিয়ে গিয়ে তারা তাকে এটাই চিন্তা করতে প্ররোচিত করেছিল যে তার স্বর্গীয় পিতার সাথে একটা বিরাট ব্যবধান আছে। (ইয়োব ১৯:২, ৬, ৮) অন্যদিকে, বাইবেলের সঠিক ব্যবহার, সমস্যার সমাধান করে, অপরকে উৎসাহিত করে এবং প্রকৃত সান্ত্বনা দেয়।—লূক ২৪:৩২; রোমীয় ১৫:৪; ২ তীমথিয় ৩:১৬; ৪:২.
একদিকে যেমন ইয়োবের পুস্তক খ্রীষ্টানদের কিছু ভ্রান্তিকর ধারণাকে শনাক্ত করতে সাহায্য করে, অন্যদিকে তেমনি এটি কিভাবে কার্যকারী উপদেশ দিতে হয় সে সম্বন্ধে কিছু মূল্যবান শিক্ষাও দেয়।
কিভাবে উপদেশ দিতে হয়
ইয়োবের তিন সহকারীর তুলনায় ইলীহূর উপদেশ ছিল একেবারেই ভিন্ন, বিশেষ করে এর বিষয়বস্তু এবং যেভাবে ইলীহূ ইয়োবের সাথে ব্যবহার করেছিলেন সেই ক্ষেত্রে। তিনি ইয়োবের নাম ধরে ডেকেছিলেন এবং তার সাথে বন্ধু হিসাবে কথা বলেছিলেন, ইয়োবের বিচারক হিসাবে নয়। “যাহা হউক, ইয়োব, বিনয় করি, আমার কথা শুনুন, আমার সকল বাক্যে কর্ণপাত করুন। দেখুন, ঈশ্বরের কাছে আমিও আপনার মত; আমিও মৃত্তিকা হইতে গঠিত হইয়াছি।” (ইয়োব ৩৩:১, ৬) ইলীহূ কিন্তু ইয়োবকে তার উত্তম কাজের জন্য সত্বর প্রশংসাও করেছিলেন। “আমি আপনাকে নির্দ্দোষ করিতে চাই,” তিনি ইয়োবকে পুনরায় আশ্বাস দিয়েছিলেন। (ইয়োব ৩৩:৩২) কোমলতার সাথে উপদেশ দেওয়া ছাড়াও, ইলীহূ অন্যান্য কারণের জন্যও কৃতকার্য হয়েছিলেন।
অন্যান্যেরা তাদের কথা শেষ করা অবধি ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করার ফলে, ইলীহূ উপদেশ প্রদান করার আগে বিচার্য বিষয়টি ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। যদি ইয়োব ধার্মিক ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে যিহোবা কি তাকে শাস্তি দেবেন? “ইহা দূরে থাকুক যে, ঈশ্বর দুষ্কার্য্য করিবেন, সর্ব্বশক্তিমান্ অন্যায় করিবেন।” ইলীহূ ব্যাখ্যা করেন। “তিনি ধার্ম্মিকদের হইতে চক্ষু ফিরান না।”—ইয়োব ৩৪:১০; ৩৬:৭.
ইয়োবের ধার্মিকতাই কি প্রকৃতরূপে প্রধান বিচার্য বিষয় ছিল? ভারসাম্যহীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ইলীহূ ইয়োবের দৃষ্টি আরোপ করান। “আপনি কি বলিতেছেন, ঈশ্বরের ধর্ম্ম হইতে আমার ধর্ম্ম অধিক?” তিনি ব্যাখ্যা করেন। “আকাশমণ্ডলের প্রতি দৃষ্টি করিয়া দেখুন, মেঘমালা নিরীক্ষণ করুন, তাহা আপনা হইতে উচ্চ।” (ইয়োব ৩৫:২, ৫) ঠিক যেমন মেঘ আমাদের চাইতে অনেক উচ্চে থাকে, তেমনি যিহোবার পথ আমাদের পথের চাইতে অনেক উচ্চে। তিনি যেভাবে কাজ করেন আমাদের সেই বিষয় বিচার করার কোন অধিকার নেই। “এ কারণ মনুষ্যগণ তাঁহাকে ভয় করে, তিনি বিজ্ঞচিত্তদের মুখাপেক্ষা করেন না,” ইলীহূ এই বলে শেষ করেন।—ইয়োব ৩৭:২৪; যিশাইয় ৫৫:৯.
ইলীহূর উত্তম উপদেশ ইয়োবকে প্রস্তুত করে স্বয়ং যিহোবার কাছ থেকে বারতি কিছু নির্দেশ গ্রহণ করতে। বস্তুতপক্ষে, ৩৭ অধ্যায়ে বর্ণিত “ঈশ্বরের আশ্চর্য্য কার্য্য সকল” এবং ৩৮ থেকে ৪১ অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ ইয়োবের উদ্দেশ্যে যিহোবার আপন বাক্যগুলি সম্বন্ধে ইলীহূর পর্যালোচনার মধ্যে একটা সমতা দেখা যায়। এটা প্রমাণ করে যে ইলীহূ যিহোবার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিষয়গুলি দেখেছিলেন। (ইয়োব ৩৭:১৪) কিভাবে খ্রীষ্টানেরা ইলীহূর উত্তম উদাহরণকে অনুকরণ করতে পারে?
ইলীহূর মত, অধ্যক্ষদের বিশেষ করে সহানুভূতিশীল এবং দয়াময় হতে হবে এবং মনে রাখতে হবে যে তারাও অসিদ্ধ। এটা তাদের কাছ থেকে আশা করা হচ্ছে যে উপদেশ দেওয়ার আগে তারা যেন মন দিয়ে শোনেন যাতে করে বিষয়টিকে ভাল করে বুঝতে পারেন। (হিতোপদেশ ১৮:১৩) এছাড়াও, বাইবেল ও শাস্ত্রীয় প্রকাশনাগুলি ব্যবহার করার দ্বারা, তারা নিশ্চিত থাকতে পারে যে যিহোবার দৃষ্টিভঙ্গি এর মধ্যে রয়েছে।—রোমীয় ৩:৪.
প্রাচীনদের ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়া ছাড়াও, ইয়োবের পুস্তক আমাদের শিক্ষা দেয় যে কিভাবে ভারসাম্যতা বজায় রেখে সমস্যার মোকাবিলা করা যায়।
বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে নেই
তাড়নার দ্বারা পর্যুদস্ত হয়ে এবং মিথ্যা সান্ত্বনাকারীদের দ্বারা নিরুৎসাহ হয়ে ইয়োব অত্যন্ত তিক্ত ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। “বিলুপ্ত হউক সেই দিন, যে দিন আমার জন্ম হইয়াছিল . . . আমার প্রাণ জীবনে ক্লান্ত হইয়াছে,” তিনি আর্তনাদ করেন। (ইয়োব ৩:৩; ১০:১) শয়তানই যে আসল অপরাধী তা না জেনে, তিনি ঈশ্বরকেই ভেবে নিয়েছিলেন সমস্ত দুর্বিপাকের জন্য দায়ী। মনে হয়েছিল যে এটা কতই না অন্যায় যে তিনি—অর্থাৎ এক ধার্মিক ব্যক্তি—তাড়না পাবে। (ইয়োব ২৩:১০, ১১; ২৭:২; ৩০:২০, ২১) এই মনোভাব ইয়োবকে অন্যান্য বিবেচ্য বিষয়ের প্রতি অন্ধ করে তুলেছিল এবং তাকে বাধ্য করেছিল মানবজাতির সাথে ঈশ্বরের ব্যবহারকে সমালোচনা করতে। যিহোবা জিজ্ঞাসা করেন: “তুমি কি . . . আমার বিচার অগ্রাহ্য করিবে? নিজে ধার্ম্মিক হইবার জন্য আমাকে দোষী করিবে?”—ইয়োব ৪০:৮.
হতে পারে যে বিপদের সম্মুখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হয়ত নিজেদের নির্দোষ বলে মনে করতে পারি যেরকম ইয়োব আপাতদৃষ্টিতে মনে করেছিলেন। সাধারণ প্রতিক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে জিজ্ঞাসা করা, ‘কেন আমি? অন্যেরা—যারা আমার থেকে আরও অনেক বেশি খারাপ—তারা কেন তুলনামূলকভাবে সমস্যাহীন জীবন উপভোগ করবে?’ ঈশ্বরের বাক্যের উপর ধ্যান করার দ্বারা আমরা এধরনের নেতিবাচক মনোভাবকে এড়িয়ে চলতে পারব।
ইয়োবের তুলনায়, আমরা অনেক বেশি অন্তর্ভুক্ত বিচার্য বিষয়টি বুঝতে পারি। আমরা জানি যে শয়তান “গর্জ্জনকারী সিংহের ন্যায়, কাহাকে গ্রাস করিবে, তাহার অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছে।” (১ পিতর ৫:৮) ইয়োবের পুস্তক যেমন প্রকাশ করে যে, আমাদের সামনে সমস্যা আনার দ্বারা আমাদের বিশ্বস্ততা ভেঙ্গে ফেলাই দিয়াবলকে আনন্দ দেয়। আমরা যিহোবার সুসময়ের সাক্ষী এই দাবিটিকে প্রমাণ করতে সে বদ্ধপরিকর। (ইয়োব ১:৯-১১; ২:৩-৫) আমাদের কি সার্বভৌমত্বকে ধরে রাখার এবং এইভাবে দিয়াবলকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার সাহস থাকবে?
যীশু ও অন্যান্য বিশ্বস্ত যিহোবার দাসেদের উদাহরণ দেখায় যে এই বিধিব্যবস্থায় কোন না কোন রকমের তাড়না অবশ্যম্ভাবী। যীশু বলেছিলেন যে তাঁর শিষ্যেরা ‘আপন ক্রুশ তুলে নেওয়ার’ জন্য যেন প্রস্তুত থাকে, যদি তারা তাঁর অনুগামী হতে চায়। (লূক ৯:২৩) আমাদের ব্যক্তিগত “ক্রুশ” ইয়োব যা সহ্য করেছিলেন সেই রকম বা আরও বেশি বিপজ্জনক হতে পারে—অসুস্থতা, প্রিয়জনদের মৃত্যু, নৈরাশ্য, অর্থনৈতিক চাপ অথবা অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে আসা বিরোধিতা। যে ধরনেরই সমস্যার সম্মুখীন আমরা হই না কেন, এর মধ্যে একটি উত্তম দিক রয়েছে। যিহোবার প্রতি আমাদের সহ্যশক্তি এবং বিশ্বস্ততা প্রমাণ করার একটা সুযোগ হিসাবে আমরা আমাদের পরিস্থিতিকে ধরে নিতে পারি।—যাকোব ১:২, ৩.
ওই রকম প্রতিক্রিয়াই যীশুর প্রেরিতেরা দেখিয়েছিলেন। যীশুর বিষয় প্রচার করার জন্য পঞ্চাশত্তমীর ঠিক কিছু পরেই তাদের প্রহার করা হয়। নিরুৎসাহিত না হয়ে তারা “আনন্দ” করতে করতে চলে গিয়েছিলেন। তারা আনন্দিত হয়েছিলেন, শুধু কষ্টের জন্যই নয় কিন্তু “তাঁহারা সেই নামের [খ্রীষ্টের] জন্য অপমানিত হইবার যোগ্যপাত্র গণিত হইয়াছিলেন।”—প্রেরিত ৫:৪০, ৪১.
অবশ্যই, সব সমস্যা যিহোবাকে সেবা করার ফলে আসে না। আমাদের সমস্যাগুলি হয়ত হতে পারে আত্ম-আরোপিত—অন্তত নিঃসন্দেহে তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে। অথবা হয়ত, আমাদের নিজেদের ভুলের জন্য, সেই সমস্যা আমাদের আধ্যাত্মিক সমতাকে প্রভাবিত করেছে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, যদি আমাদের ইয়োবের মত নম্র মনোভাব থাকে, তাহলে যেখানে আমরা ভুল করেছি তা বুঝতে সাহায্য করবে। ইয়োব যিহোবার কাছে স্বীকার করেন: “আমি তাহাই বলিয়াছি, যাহা বুঝি নাই।” (ইয়োব ৪২:৩) এইভাবে যে ব্যক্তি তার ভুলগুলি শনাক্ত করতে পারে সে সম্ভবত ভবিষ্যতে একই ধরনের বিপত্তিগুলি আরও বেশি করে এড়িয়ে চলতে পারবে। যেমন প্রবাদবাক্যটি বলে: “সতর্ক লোক বিপদ দেখিয়া আপনাকে লুকায়।”—হিতোপদেশ ২২:৩.
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ইয়োবের পুস্তকটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের সমস্যাগুলি চিরদিন থাকবে না। বাইবেল বলে: “যাহারা স্থির রহিয়াছে, তাহাদিগকে আমরা ধন্য বলি। তোমরা ইয়োবের ধৈর্য্যের কথা শুনিয়াছ; প্রভুর পরিণামও দেখিয়াছ, ফলতঃ প্রভু স্নেহপূর্ণ ও দয়াময়।” (যাকোব ৫:১১) আমরা এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি যে যিহোবা আজকের দিনে একইভাবে তাঁর দাসেদের বিশ্বস্ততার পুরস্কার দেবেন।
আমরা সেই সময়েরও আশা করে আছি যখন সব রকমের সমস্যা—“প্রথম বিষয় সকল”—শেষ হয়ে যাবে। (প্রকাশিত বাক্য ২১:৪) সেই দিন না আসা পর্যন্ত ইয়োবের পুস্তকটি আমাদের মহামূল্যবান পথনির্দেশক হিসাবে কাজ করবে যা আমাদের প্রজ্ঞা ও আত্ম-সংযমের সাথে সমস্যাগুলিকে মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে পারে।
[পাদটীকাগুলো]
a যদিও বাইবেল বলে যে “মনুষ্য যাহা কিছু বুনে তাহাই কাটিবে,” কিন্তু এর মানে নয় যে একজন ব্যক্তির দুঃখ হল ঐশিক ক্রোধের প্রকাশ। (গালাতীয় ৬:৭) শয়তান পরিচালিত এই জগতে, ধার্মিকেরা প্রায়ই দুষ্টদের চাইতে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়। (১ যোহন ৫:১৯) “আমার নাম প্রযুক্ত তোমরা সকলের ঘৃণিত হইবে,” যীশু তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন। (মথি ১০:২২) অসুস্থতা এবং অন্যান্য দুর্বিপাক ঈশ্বরের বিশ্বস্ত যে কোন দাসেদের উপর আসতে পারে।—গীতসংহিতা ৪১:৩; ৭৩:৩-৫; ফিলিপীয় ২:২৫-২৭.
[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
“আকাশমণ্ডলের প্রতি দৃষ্টি করিয়া দেখুন, . . . তাহা আপনা হইতে উচ্চ।” ইলীহূ এইভাবে ইয়োবকে বুঝতে সাহায্য করেছিলেন যে ঈশ্বরের পথসকল মানুষের চাইতে অনেক উচ্চে