অহংকারের পরিণতি—কতটা ভয়াবহ?
আপনি কি কখনও এমন কোন ব্যক্তির সঙ্গে চলাফেরা করেছেন যিনি ইচ্ছা করে আপনাকে ছোট চোখে দেখতেন, আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন? যিনি আপনাকে নিচু ভাবতেন ও অবজ্ঞা করতেন? তিনি আপনার ম্যানেজার, বস, ওভারসিয়ার বা কোন আত্মীয় যেই হোক না কেন আপনি সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কেমন মনে করতেন? তার ব্যক্তিত্ব কি আপনার ভাল লাগত? নিশ্চয়ই না! কেন? কারণ অহংকার এমন একটা বেড়া সৃষ্টি করে যা ভাববিনিময়ে বাধা দেয়।
অহংকারী ব্যক্তি সবাইকে ছোট মনে করেন যাতে করে তিনি (পুরুষ বা মহিলা) সবসময়ই উঁচু থাকেন। তাই এইরকম ব্যক্তিরা অন্যদের সম্পর্কে খুব কমই ভাল কথা বলেন। কিছু নেতিবাচক কথাগুলো এইরকম হতে পারে যেমন “হতে পারে এটা সত্যি কিন্তু তার এই সমস্যা আছে বা ওই ভুলটা আছে।”
চিন্তায় স্বর্ণ কিন্তু কথায় রৌপ্য (ইংরাজি) বইটা অহংকারকে এই বলে বর্ণনা করে যে এটা হল “এমন একটা বদগুণ যাকে দমন করা কঠিন আর যা একজনকে শেষ করে দেয়, তাকে এমন এক ব্যক্তি করে তোলে যার ছায়া মাড়াতে লোকে ভয় পায়।” তাই এতে কী আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে যে কেউই কোন অহংকারী ব্যক্তির কাছে যেতে চান না? আসলে, অহংকারী হলে প্রায়ই প্রকৃত বন্ধুর অভাব ঘটে। “বিপরীতে” সেই একই বই আরও বলে, “লোকেরা নম্র ব্যক্তিদের পছন্দ করেন—যারা নম্রতার জন্য গর্বিত তাদের নয় কিন্তু যারা আসলেই নম্র তাদেরকে।” বাইবেল ঠিকই বলে: “মনুষ্যের অহংকার তাহাকে নীচে নামাইবে, কিন্তু নম্রচিত্ত ব্যক্তি সম্মান পাইবে।”—হিতোপদেশ ২৯:২৩.
কিন্তু মানুষের বন্ধুত্ব অথবা মানুষের কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার চেয়েও বড় কথা হল অহংকার কিভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে একজন ব্যক্তির সম্পর্ককে প্রভাবিত করে? অহংকারী, উদ্ধত এবং দাম্ভিক ব্যক্তিকে ঈশ্বর কোন্ চোখে দেখেন? আমরা অহংকারী হই বা নম্র হই—যিহোবার কাছে কি এর কোন পার্থক্য আছে?
নম্রতার শিক্ষা
হিতোপদেশের লেখক ঈশ্বরের প্রেরণায় লিখেছিলেন: “বিনাশের পূর্ব্বে অহঙ্কার, পতনের পূর্ব্বে মনের গর্ব্ব। বরং দীনহীনদের সহিত নম্রাত্মা হওয়া ভাল, তবু অহঙ্কারীদের সহিত লুট বিভাগ করা ভাল নয়।” (হিতোপদেশ ১৬:১৮, ১৯) এই কথাগুলো অরামীয় সেনাপতি নামানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল, যিনি ভাববাদী ইলীশায়ের সময়ে ছিলেন।
নামান একজন কুষ্ঠরোগী ছিলেন। তাই সুস্থ হওয়ার আশায় তিনি শমরীয়ায় রওনা হন। এই ভেবে যে ইলীশায় নিজে তার কথা শুনবেন। কিন্তু, তা না করে ভাববাদী ইলীশায় তার দাসকে এই বলে নামানের কাছে পাঠান যে নামান যেন সাত বার যর্দন নদীতে স্নান করেন। নামান এই চিকিৎসা এবং পরামর্শে অপমান বোধ করেছিলেন। একজন দাস না পাঠিয়ে ভাববাদী নিজে কেন তার সঙ্গে কথা বলতে আসেননি? আর সিরিয়ার যে কোন নদী যর্দ্দনের চেয়ে কোন অংশে কম নয়! অহংকারই ছিল তার সমস্যা। এর ফল কী হয়? আনন্দের বিষয় যে তিনি বিজ্ঞ পরামর্শ মেনে নিয়েছিলেন। “তখন তিনি ঈশ্বরের লোকের আজ্ঞানুসারে নামিয়া গিয়া সাতবার যর্দ্দনে ডুব দিলেন, তাহাতে ক্ষুদ্র বালকের ন্যায় তাঁহার নূতন মাংস হইল, ও তিনি শুচি হইলেন।”—২ রাজাবলি ৫:১৪.
কখনও কখনও কেবল একটু নম্রতার ফলে অনেক বড় উপকার পাওয়া যেতে পারে।
আত্ম-অহংকারের পরিণতি
অহংকারের পরিণতি কেবল সামান্য উপকার অথবা কিছু থেকে বঞ্চিত হওয়ার চাইতেও অনেক বেশি ভয়াবহ হতে পারে। আরেক ধরনের অহংকার রয়েছে যা গ্রিক শব্দ হিউব্রিস থেকে এসেছে আর গ্রিক পণ্ডিত উইলিয়াম বার্কলের মতে, “হিউব্রিস এমন অহংকার যার সঙ্গে নিষ্ঠুরতা জড়িত . . . , আর অবজ্ঞা যা [একজন ব্যক্তিকে] নিচু দেখানোর জন্য তাকে ছোট করে।”
অত্যধিক অহংকারের একটা স্পষ্ট উদাহরণ বাইবেলে দেওয়া আছে। আর সেটা হল অম্মোন রাজ, হানূনের উদাহরণ। শাস্ত্রের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি (ইংরাজি) বই ব্যাখ্যা করে: “যেহেতু নাহশ দায়ূদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করেছিলেন, নাহশ যখন মারা যান তখন তার পুত্র হানূনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য দায়ূদ তার দাসদের পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু হানূনের অধ্যক্ষেরা তাকে বুঝিয়েছিলেন যে দায়ূদ আসলে তাদের ধোঁকা দিয়ে নগর সম্বন্ধে খবরাখবর নিতে চান, ফলে হানূন দায়ূদের দাসদের দাড়ির অর্ধেক কামিয়ে এবং কাপড় নিতম্ব পর্যন্ত কেটে দিয়ে তাদের অপমান করে তাদের ফেরৎ পাঠিয়ে দেন।”a এই ঘটনা সম্বন্ধে বার্কলে মন্তব্য করেন: “এমন আচরণই ছিল হিউব্রিস যা ছিল একসাথে অপমান, অমর্যাদা এবং সবার সামনে ছোট করা।”—২ শমূয়েল ১০:১-৫.
হ্যাঁ, একজন অহংকারী সহজেই দাম্ভিক হতে পারেন এবং অন্যদের ছোট করতে পারেন। তিনি কাউকে নির্দয় ও নির্মমভাবে আঘাত করতে ভালবাসেন এবং তাদেরকে অস্বস্তির মধ্যে পড়তে ও লজ্জা পেতে দেখে আনন্দ পান। কিন্তু কাউকে ছোট করা কিংবা কারও আত্মসম্মানে আঘাত করা দু-দিক দিয়ে ক্ষতিকর। এর ফলে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায় এবং সম্ভবত তা শত্রু তৈরি করে। অথবা এর থেকেও ভয়াবহ কিছু হতে পারে।
তাহলে কিভাবে একজন সত্য খ্রীষ্টান এই ক্ষতিকর অহংকার দেখাতে পারেন, যেখানে তার প্রভু আজ্ঞা দিয়েছেন যে ‘প্রতিবাসীকে আপনার মত প্রেম’ করতে হবে? (মথি ৭:১২; ২২:৩৯) স্পষ্টতই অহংকার ঈশ্বর এবং যীশুর মানদণ্ডের একেবারে বিপরীত। এই কারণেই বার্কলে খুবই গম্ভীর মন্তব্য করেন যখন তিনি বলেন: “দম্ভই হল অহংকার যা ঈশ্বরকে তুচ্ছ করতে মানুষকে পরিচালিত করে।” এটাই সেই অহংকার যা বলে: “ঈশ্বর নাই।” (গীতসংহিতা ১৪:১) অথবা গীতসংহিতা ১০:৪ পদে যেমন বলে: “দুষ্ট লোক নাক তুলিয়া [বলে,] তিনি অনুসন্ধান করিবেন না; ঈশ্বর নাই, ইহাই তাহার চিন্তার সার।” এই অহংকার বা অহমিকা একজন ব্যক্তিকে শুধু তার বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছ থেকেই দূরে সরিয়ে দেয় না কিন্তু তা তাকে ঈশ্বরের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কী নির্মম পরিণতিই না তাকে ভোগ করতে হয়!
নিজের মধ্যে অহংকারকে জায়গা দেবেন না
অনেক কারণে অহংকার আসতে পারে যেমন জাতীয়তাবাদ, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক মর্যাদা এবং জাতের পার্থক্য, শিক্ষা, সম্পদ, খ্যাতি এবং ক্ষমতা। যে কোনভাবেই হোক না কেন অহংকার সহজেই আমাদের মধ্যে আসতে পারে আর তা আমাদের ভাল গুণগুলোকে শেষ করে দিতে পারে।
এমন অনেক লোক আছেন যাদেরকে তাদের চেয়ে উঁচু মর্যাদার ব্যক্তিদের কিংবা তাদের সমকক্ষদের সঙ্গে নম্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু যাকে নম্র বলে মনে হয় তিনি যখন কোন ক্ষমতা পান তখন কী হয়? হঠাৎই তিনি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন আর তার অধীন ব্যক্তিদের জীবন অসহ্য করে তোলেন! কিছুজনের ক্ষেত্রে এটা হয়তো তখনই হয়ে থাকে যখন তারা ইউনিফর্ম অথবা কোন ব্যাজ পরে থাকেন যা তাদের ক্ষমতাকে ইঙ্গিত করে। এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও সাধারণ লোকেদের সঙ্গে ওঠাবসা করার সময়ে অহংকার বোধ করে থাকেন, এই কথা ভেবে যে জনগণই তাদের সেবা করবে কিন্তু তারা নয়। অহংকার আপনাকে রূঢ়, অনুভূতিহীন করে তুলতে পারে কিন্তু নম্রতা দয়ালু করে তুলতে পারে।
যীশু তাঁর শিষ্যদের সামনে অহংকার দেখাতে পারতেন তাদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করতে পারতেন। কারণ তিনি সিদ্ধ ছিলেন ও ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন আর তার শিষ্যরা ছিল অসিদ্ধ, আবেগপ্রবণ, ও ঝোঁকের বশবর্তী। তবুও যাদের শোনার ইচ্ছা ছিল তাদের তিনি কিভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন? “হে পরিশ্রান্ত ও ভারাক্রান্ত লোক সকল, আমার নিকটে আইস, আমি তোমাদিগকে বিশ্রাম দিব। আমার যোঁয়ালি আপনাদের উপরে তুলিয়া লও, এবং আমার কাছে শিক্ষা কর, কেননা আমি মৃদুশীল ও নম্রচিত্ত; তাহাতে তোমরা আপন আপন প্রাণের জন্য বিশ্রাম পাইবে। কারণ আমার যোঁয়ালি সহজ ও আমার ভার লঘু।”—মথি ১১:২৮-৩০.
আমরা কি সবসময় যীশুর উদাহরণ অনুসরণ করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি? বা আমরা রূঢ়, অনমনীয়, স্বৈরাচারী, ক্ষমাহীন, অহংকারী? যীশুর মতো, লোকেদের আনন্দ দিতে চেষ্টা করুন, তাদেরকে নিচু করতে নয়। অহংকারের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলুন।
এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলা যায় যে সমস্ত অহংকারই ভুল?
আত্মসম্মান বনাম আত্মগর্ব
এছাড়াও অহংকার হল “যুক্তিসঙ্গত অথবা ন্যায়সম্মত আত্মসম্মান।” (ওয়েবস্টারস্ নাইনথ কলেজিয়েট ডিকশনারি) আত্মসম্মান হল নিজের সম্মান বজায় রাখা। এর অর্থ লোকেরা আপনার সম্বন্ধে যা মনে করেন আপনি তাকে গুরুত্ব দেন। আপনি নিজের চেহারা এবং সুনামের ব্যাপারে চিন্তা করেন। এক্ষেত্রে একটা স্প্যানিশ প্রবাদবাক্য খুবই সত্যি যেটা বলে, “আমাকে শুধু বলো যে তুমি কাদের সঙ্গে চলো, আমি তোমাকে বলব যে তুমি কেমন লোক।” আপনি যদি এইরকম ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে বেশি পছন্দ করেন যারা অগোছালো, অলস, অমার্জিত এবং গালিগালাজ করে; তাহলে আপনি তাদের মতোই হয়ে যাবেন। তাদের ব্যবহার আপনাকে বদলে দেবে আর তখন তাদের মতো আপনার মধ্যেও আত্মসম্মান বোধ থাকবে না।
অহংকারের আরও একটা চরম পরিণতি হল আত্মগর্ব যা একজনকে একেবারে বাজে লোক করে তোলে। যীশুর দিনে অধ্যাপক এবং ফরীশীরা তাদের পরাম্পরাগত বিধিগুলোর জন্য এবং তাদের অতি ধার্মিক মনোভাবের জন্য অহংকার বোধ করতেন। যীশু তাদের বিষয়ে সাবধান করেছিলেন: “তাহারা লোককে দেখাইবার জন্যই তাহাদের সমস্ত কর্ম্ম করে; কেননা তাহারা আপনাদের কবর প্রশস্ত করে, এবং [অতি ধার্মিক দেখানোর জন্য] বস্ত্রের থোপ বড় করে, আর ভোজে প্রধান স্থান, সমাজগৃহে প্রধান প্রধান আসন, হাটে বাজারে মঙ্গলবাদ, এবং লোকের কাছে রব্বি (গুরু) বলিয়া সম্ভাষণ, এ সকল ভাল বাসে।”—মথি ২৩:৫-৭.
সুতরাং, যথার্থ বা সঠিক মনোভাব রাখা দরকার। এটাও মনে রাখবেন যে যিহোবা হৃদয় দেখেন শুধু বাইরেটা নয়। (১ শমূয়েল ১৬:৭; যিরমিয় ১৭:১০) আত্মধার্মিকতা ঈশ্বরের চোখে ধার্মিকতা নয়। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, কিভাবে আমরা প্রকৃতই নম্র হতে এবং অহংকারের ভয়াবহ পরিণতিকে এড়াতে পারি?
[পাদটীকাগুলো]
a ওয়াচটাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত।
[৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
সামান্য নম্রতা নামানের জন্য প্রচুর পুরস্কার এনেছিল