ঐশিক ধাঁধা এবং ঈশ্বরের উদ্দেশ্য
জানা না থাকলেই সেটা কিছু কিন্তু জেনে গেলে সেটা কিছুই নয়। আসলে সেটা কী? সেটা একটা ধাঁধা।
আজকের সমাজের বাস্তববাদী লোকেরা ধাঁধাকে নিছক ছেলেখেলা বলে মনে করেন কিন্তু বাইবেলের ব্যাখ্যাকারী অভিধান (ইংরেজি) বলে প্রাচীনকালে ধাঁধা “জ্ঞানের পরীক্ষা ছিল।”—হিতোপদেশ ১:৫, ৬ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।
কখনও কখনও যিহোবা তাঁর ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য সরাসরি না বলে ইচ্ছা করেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছেন। তিনি তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে উপমা, “গূঢ় বাক্য” বা জটিল ধাঁধার মতো করে বলেছেন যেগুলো সহজে বোঝা যায় না। (গীতসংহিতা ৭৮:২; গণনাপুস্তক ১২:৮) যদিও ধাঁধার ইব্রীয় শব্দ বাইবেলে মাত্র সতেরো বার ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু আসলে বলা যায় যে বাইবেল ধাঁধা এবং নীতিবাক্যে ভরা।
বাইবেল ধাঁধায় ভরা
রাজা শলোমনের কাছে যে সব জটিল প্রশ্ন বা ধাঁধা নিয়ে আসা হতো তিনি ভালভাবে সেগুলোর সমাধান করতে পারতেন। (রাজাবলি ১০:১, পাদটীকা, NW) এতে কোন ভুল নেই যে ঈশ্বর তাকে জ্ঞান দিয়েছিলেন বলেই তিনি তা করতে পারতেন। কিন্তু প্রাচীন ইতিহাসবেত্তারা বলেন যে রাজা শলোমন একবার সোরের রাজা হীরমের সঙ্গে ধাঁধার প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা যদি সত্যি হয়, তাহলে তখন হয়তো শলোমন যিহোবার পথ থেকে সরে গিয়েছিলেন এবং যিহোবার আত্মা হারিয়েছিলেন। একইভাবে বিচারক শিম্শোনও ধাঁধা বলতে পছন্দ করতেন। একবার পবিত্র আত্মার ক্ষমতায় তিনি ঈশ্বরের শত্রুদের এমন একটি ধাঁধা জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল।—বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ১৪:১২-১৯.
তবুও বাইবেলের অনেক ধাঁধা সরাসরি ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলে। উদাহরণ হিসেবে আদিপুস্তক ৩:১৫ পদের কথা চিন্তা করুন। বলা যেতে পারে যে এই ভবিষ্যদ্বাণী বাইবেলের বিষয়বস্তুর ভিত্তি, এটা নিজেই এক রহস্য, এক “নিগূঢ়তত্ত্ব।” (রোমীয় ১৬:২৫, ২৬) ঈশ্বর প্রেরিত পৌলকে অলৌকিক দর্শন এবং কিছু আদেশ দেওয়া ছাড়াও কিছু “অস্পষ্ট” বা “দুর্বোধ্য” বিষয় বলে তাঁর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলেছিলেন। (১ করিন্থীয় ১৩:১২; ২ করিন্থীয় ১২:১-৪) আর আগে ও পরে কোন ব্যাখ্যা না করেই প্রকাশিত বাক্য ১৩:১৮ পদে হঠাৎই বলা হয়েছে যে বন্য পশুর সংখ্যা “ছয় শত ছেষট্টি।” এই রহস্যময় সংখ্যাকে ঘিরে যে অফুরন্ত জল্পনাকল্পনা রয়েছে সে সম্বন্ধেই বা কী বলা যায়? কে এই ঈশ্বরের ধাঁধার সমাধান করতে পারবে আর এই ধাঁধাগুলোর উদ্দেশ্যই বা কী?
নিগূঢ়তত্ত্বকে বোঝা
অনেকে আমাদের পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের মধ্যে চোখকে সবচেয়ে বেশি দরকারি বলে মনে করেন। কিন্তু আলো ছাড়া মানুষের চোখ একেবারেই অচল। আমরা প্রায় অন্ধ হয়ে পড়ব। মানুষের মনও ঠিক একইরকম। আমাদের মনের অর্থ বোঝার, যুক্তি করার আর কঠিন সমস্যার সমাধান করার এত আশ্চর্যজনক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিগূঢ়তত্ত্বকে বোঝার জন্য আরও বেশি কিছুর প্রয়োজন। বাইবেলে যে সব ধাঁধা রয়েছে তার উত্তর কেউ কেউ হয়তো দিতে পারেন কিন্তু শুধু বাইবেলের লেখক, জ্যোতির ঈশ্বর যিহোবা এর আসল অর্থ বলতে পারেন।—১ যোহন ১:৫.
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, লোকেরা এতই অহংকারী ও স্বাধীনচেতা যে তারা উত্তরের জন্য যিহোবার দিকে তাকান না। এমন কিছু লোকেরাও আছেন যারা রহস্য জানার জন্য অধৈর্য হয়ে পড়েন আর নিগূঢ়তত্ত্বের অর্থ ঈশ্বরের বাক্যে না খুঁজে অন্য জায়গায় খোঁজেন। তাদের আসলে সত্য খোঁজার কোন আগ্রহই নেই বরং তারা তাদের জ্ঞানকে বাড়ানোর চেষ্টা করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যিহূদীদের কাবালা গোষ্ঠীর লোকেরা ইব্রীয় বর্ণমালার অক্ষর ও সংখ্যাগুলোর মানে জানার জন্য জাদুমন্ত্র ব্যবহার করত। অন্যদিকে দ্বিতীয় শতাব্দীর রহস্যবাদী খ্রীষ্টানেরা গূঢ় অর্থগুলো পরিষ্কার করার জন্য ইব্রীয় এবং গ্রিক শাস্ত্রাবলি ব্যবহার করতেন।
কিন্তু এইধরনের অনুসন্ধান তাদেরকে সত্য থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছিল আর তারা পৌত্তলিক আচার অনুষ্ঠানের বা কুসংস্কারের দিকে ঝুঁকেছিল। সেই কারণে রহস্যবাদী খ্রীষ্টানেরা যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে ‘যদি জগৎ মন্দতায় ভরে থাকে, তাহলে এর সৃষ্টিকর্তা ইয়াওয়ে একজন ভাল ঈশ্বর হতে পারেন না।’ তারা কি এর চেয়ে ভাল কোন উপসংহারে আসতে পারতেন না? মানুষের চিন্তাভাবনা কতই না সীমিত! এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে প্রেরিত পৌল রহস্যবাদী খ্রীষ্টানদের শেখানো কিছু মিথ্যা শিক্ষাকে খণ্ডন করেছিলেন আর তার পত্রে দৃঢ় সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন: “যাহা লিখিত আছে, তাহা অতিক্রম করিতে নাই”!—১ করিন্থীয় ৪:৬.
“গূঢ় বাক্য” প্রকাশ করা
কিন্তু কেন জ্যোতির ঈশ্বর সবসময় “গূঢ় বাক্য” বলবেন? আসলে ধাঁধা একজন ব্যক্তির কল্পনা শক্তি ও অনুমান করার ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলে। যেমন খাবারকে আরও সুস্বাদু করার জন্য তাতে মশলা দেওয়া হয় তেমনি বাইবেলের বিভিন্ন জায়গায় গূঢ় বাক্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যাতে তা পাঠকদের আগ্রহ জাগিয়ে তোলে বা যে সংবাদ সেখানে রয়েছে তা আরও ভাল করে বোঝা যায়। বাইবেলে প্রায়ই গূঢ় বাক্য বলার পরেই তার ব্যাখ্যাও দেওয়া আছে।—যিহিষ্কেল ১৭:১-১৮; মথি ১৮:২৩-৩৫.
যিহোবা উদারভাবে আমাদের প্রজ্ঞা দেন ঠিকই কিন্তু তাই বলে তিনি তা সবাইকে এমনি এমনিই দেন না। (যাকোব ১:৫-৮) হিতোপদেশ বইয়ের কথাই ধরুন। এখানে ঈশ্বরের বলা এমন অনেক প্রবাদ রয়েছে যা সহজে বোঝা যায় না আর কিছুজনের কাছে এগুলো ধাঁধা বলে মনে হয়। সেগুলো বোঝার জন্য ধ্যান করার প্রয়োজন। কিন্তু তা বোঝার জন্য কতজন চেষ্টা করেন? শুধু তারাই এই প্রজ্ঞা পেতে পারেন যারা এর জন্য খোঁজ করতে ইচ্ছুক।—হিতোপদেশ ২:১-৫.
যীশু যখন দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেছিলেন তখন প্রকাশ পেয়েছিল যে তার শ্রোতারা প্রজ্ঞা পাওয়ার জন্য কতখানি ইচ্ছুক। লোকেরা তাঁর চারিদিকে ঘিরে থাকত। তারা তাঁর গল্পগুলো শুনে আনন্দ পেত। তাঁর অলৌকিক কাজগুলো তাদের খুব ভাল লাগত। কিন্তু কতজন তাদের জীবনধারা বদলে তাঁর শিষ্য হওয়ার জন্য তৈরি ছিল? তাদের থেকে যীশুর শিষ্যরা কতই না আলাদা ছিলেন যারা যীশুর শিক্ষাকে বোঝার জন্য বার বার তাঁর কাছে এসেছিলেন!—মথি ১৩:১০-২৩, ৩৪, ৩৫; ১৬:২৪; যোহন ১৬:২৫, ২৯.
জ্যোতির দিকে তাকানো
একটা বই বলে, ‘যে যুগে লোকেদের মধ্যে নতুন কিছু শেখার চেতনা ছিল সেই যুগের লোকেরা ধাঁধার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে।’ আজকে আমরা কতই না খুশি যে আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন ঈশ্বরের লোকেদের জন্য আধ্যাত্মিক “দীপ্তি বপন করা গিয়াছে।” (গীতসংহিতা ৯৭:১১; দানিয়েল ১২:৪, ৯) যিহোবা তাঁর নিরূপিত সময়ে তাঁর উদ্দেশ্য প্রকাশ করেন। আর আমরা কি ধৈর্য ধরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করি? আরও বড় বিষয় হল আমরা যখন জানতে পারি যে ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী চলার জন্য আমাদের কী কী করা দরকার তখন কি জীবনকে বদলানোর জন্য আমরা দ্রুত কাজ করি? (গীতসংহিতা ১:১-৩; যাকোব ১:২২-২৫) আমরা যদি তাই করি, তাহলে যিহোবা আমাদের চেষ্টাকে আশীর্বাদ করবেন আর পবিত্র আত্মা আমাদের মনের চোখ খুলে দেবে যাতে আমরা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যের পুরো চিত্রটা দেখতে পাই। আর তখন আমাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে যেমন দৃষ্টি আবছা হয়ে এলে চশমা আমাদের স্পষ্টভাবে দেখতে সাহায্য করে।—১ করিন্থীয় ২:৭, ৯, ১০.
প্রকৃতপক্ষে শাস্ত্রে দেওয়া ধাঁধাগুলো সত্যিই যিহোবাকে ‘নিগূঢ় বিষয়ের প্রকাশক’ হিসেবে মহিমা দেয়। (দানিয়েল ২:২৮, ২৯) এছাড়াও তিনি হৃদয়ের অনুসন্ধান করেন। (১ বংশা. ২৮:৯) কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ঈশ্বরের সত্যের জ্যোতি সবসময় ধীরে ধীরে দেদীপ্যমান হয়েছে। (হিতোপদেশ ৪:১৮; রোমীয় ১৬:২৫, ২৬) ঈশ্বরের গভীর বিষয়গুলো জানার জন্য যদি আমরা জাদুমন্ত্রের সাহায্য নিই বা আমাদের নিজেদের ভাসাভাসা অসাড় জ্ঞান ব্যবহার করার চেষ্টা করি, তাহলে আমরা কখনই তা জানতে পারব না। তাই আসুন আমরা আস্থার সঙ্গে যিহোবা ঈশ্বরের দিকে তাকাই কারণ তিনিই এগুলোর অর্থ বলে দেবেন ও তাঁর নিরূপিত সময়ে তাঁর বিশ্বস্ত দাসদেরকে ‘গূঢ় বাক্যের’ চমৎকার উদ্দেশ্য জানাবেন।—আমোষ ৩:৭; মথি ২৪:২৫-২৭.
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
Biblia Hebraica Stuttgartensia, Deutsche Bibelgesellschaft Stuttgart