কেন আপনি ঈশ্বরকে সেবা করেন?
একজন ঈশ্বর ভীরু রাজা তার ছেলেকে একবার এই উপদেশ দেন: “তুমি আপন পিতার ঈশ্বরকে জ্ঞাত হও, এবং একাগ্র অন্তঃকরণে ও ইচ্ছুক মনে তাঁহার সেবা কর।” (১ বংশাবলি ২৮:৯) এই কথার দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় যে যিহোবা চান তাঁর সেবকেরা যেন কৃতজ্ঞ ও উপলব্ধিতে ভরা হৃদয় নিয়ে তাঁকে সেবা করে।
যিহোবার সাক্ষি হিসেবে আমরা অকপটে এ কথা স্বীকার করি যে বাইবেলে দেওয়া ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা সকল প্রথম বার যখন আমাদের বোঝান হয়েছিল তখন আমাদের হৃদয় যেন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিল। প্রতিটা দিন যেন আমরা ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নতুন কিছু শিখেই যাচ্ছিলাম। যিহোবাকে আমরা যত ভাল করে জানতে পেরেছি ততই যেন তাঁকে “একাগ্র অন্তঃকরণে ও ইচ্ছুক মনে” সেবা করার ইচ্ছা আমাদের মনে বেড়েই গেছে।
অনেকেই যারা যিহোবার সাক্ষি হচ্ছেন তারা সারাটা জীবন যিহোবাকে আনন্দের সঙ্গে সেবা করেই চলছেন। কিন্তু কিছু খ্রীষ্টানেরা সত্য শেখার শুরুতে যিহোবাকে আনন্দের সঙ্গে সেবা করেন, পরে সময় যেতে যেতে তারা সেই কারণগুলো ভুলে যান যা আমাদের মধ্যে ঈশ্বরকে সেবা করার আগ্রহ বাড়িয়েছে। আপনারও কি এমন মনে হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তাহলে হতাশ হবেন না। হারিয়ে যাওয়া আনন্দ আবার ফিরে পাওয়া যায়। কিন্তু কীভাবে?
আপনার আশীর্বাদগুলোকে ভেবে দেখুন
যে আশীর্বাদগুলো প্রতিদিন আপনি ঈশ্বরের কাছ থেকে পাচ্ছেন প্রথমে সেগুলোর কথা চিন্তা করুন। যিহোবার দেওয়া উত্তম উপহারগুলোর কথা ভাবুন: তাঁর নিজের তৈরি বহু ধরনের সৃষ্টি যা ধনী বা গরীব সকলেই পেতে পারে যেমন খাওয়া ও পান করার জন্য প্রকৃতিতে তিনি অনেক কিছু দিয়েছেন, আপনাকে উপভোগ করার জন্য সুস্বাস্থ্য দিয়েছেন, বাইবেল থেকে আপনি সত্য জেনেছেন ও সবচেয়ে বড় উপহার হল আমাদের জন্য তাঁর পুত্রকে দিয়েছেন। তাঁর পুত্রের মৃত্যু আমাদের জন্য ঈশ্বরকে শুদ্ধ বিবেক নিয়ে সেবা করার এক পথ খুলে দিয়েছে। (যোহন ৩:১৬; যাকোব ১:১৭) ঈশ্বরের দেওয়া উপহারের কথা আমরা যত বেশি চিন্তা করব তাঁর প্রতি তত বেশি আমাদের উপলব্ধি বাড়বে। আর এটা আপনাকে তিনি যা কিছু করেছেন তার জন্য তাঁকে কৃতজ্ঞ হৃদয়ে সেবা করতে সাহায্য করবে। তাই কোন সন্দেহ নেই যে আপনিও গীতরচকের মতো মনে করবেন যিনি লিখেছিলেন: “সদাপ্রভু, আমার ঈশ্বর, তুমিই বাহুল্যরূপে সাধন করিয়াছ আমাদের পক্ষে তোমার আশ্চর্য্য কার্য্য সকল ও তোমার সঙ্কল্প সকল; তোমার তুল্য কেহ নাই; . . . কিন্তু সে সকল গণনা করা যায় না।”—গীতসংহিতা ৪০:৫.
এই গীত দায়ূদের লেখা। তার জীবনেও যে সমস্যা আসেনি তা নয়। তিনি যখন যুবক ছিলেন তখন তার বেশির ভাগ সময়ই দুষ্ট রাজা শৌল ও তার প্রহরীদের থেকে পালিয়ে বাঁচতেই কেটে গিয়েছিল কারণ তারা দায়ূদকে মেরে ফেলার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ( ১ শমূয়েল ২৩:৭, ৮, ১৯-২৩) এমনকি দায়ূদের নিজের কিছু দুর্বলতা ছিল যার সঙ্গে তাকে লড়াই করে যেতে হয়েছিল। তার এই দুর্বলতাগুলো তিনি স্বীকার করেন যখন তিনি ৪০তম গীত লেখেন: “অসংখ্য বিপদ আমাকে ঘেরিয়াছে; আমার অপরাধ সকল আমাকে ধরিয়াছে; আমি দেখিতে পাইতেছি না; আমার মস্তকের কেশ অপেক্ষাও সে সকল অধিক।” (গীতসংহিতা ৪০:১২) এটা সত্যিই যে দায়ূদের জীবনে সমস্যা ছিল কিন্তু তিনি কখনও এই সমস্যাগুলোর জন্য একেবারে হতাশ হয়ে পড়েননি। তার সমস্যা থাকলেও যিহোবা যেভাবে তাকে আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন তিনি সেটা নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। আর সেই আশীর্বাদগুলো দেখে তিনি বুঝেছিলেন যে সেগুলোর সামনে তার সমস্যাগুলো কিছুই নয়।
নিজের সমস্যাগুলোর জন্য বা নিজেকে অযোগ্য ভেবে যখন আপনি অসহায় মনে করেন তখন সেই চিন্তা বাদ দিয়ে বরং দায়ূদের মতো যিহোবা যে আশীর্বাদগুলো দিচ্ছেন সেটা নিয়ে বেশি ভাবুন। কোন সন্দেহ নেই যে ওই আশীর্বাদগুলোর জন্য আপনার যে উপলব্ধি আছে তা আপনাকে যিহোবার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করতে সাহায্য করবে। শুধু তাই নয় এই চিন্তাধারা আপনার হারিয়ে যাওয়া আনন্দকে ফিরে পেতে ও হৃদয়ে উপলব্ধি নিয়ে ঈশ্বরকে সেবা করতে সাহায্য করবে।
মণ্ডলীর সভাগুলো সাহায্য করতে পারে
যিহোবা আমাদের জন্য যে ভাল কিছু করেছেন সেগুলো নিয়ে একান্তে চিন্তা করা ছাড়াও আমাদের খ্রীষ্টান ভাইবোনদের সঙ্গেও মেলামেশা করতে হবে। যে সকল স্ত্রী, পুরুষ ও যুবক-যুবতীরা ঈশ্বরকে ভালবাসেন ও তাঁকে সেবা করার জন্য অটল তাদের সঙ্গে নিয়মিত মেলামেশা করা সত্যিই আমাদের উৎসাহ দেয়। তাদের উদাহরণ আমাদের পূর্ণ হৃদয়ে যিহোবার কাজ করতে উৎসাহিত করে। এমনকি কিংডম হলে আমাদের উপস্থিতি তাদেরও উৎসাহিত করতে পারে।
এ কথা ঠিক যে, সারাটা দিন খাটাখাটনি করে যখন আমরা ঘরে ফিরি অথবা নিজেদের কিছু সমস্যা বা দুর্বলতার জন্য যখন হতাশ হয়ে পড়ি তখন কিংডম হলে গিয়ে সভাতে যোগ দেওয়ার কথা হয়ত চিন্তা করতেও ইচ্ছা করে না। সেই সময়, আমাদের নিজেদের প্রতি কড়া হওয়া দরকার ঠিক যেমন আমরা ‘নিজেদের দেহকে প্রহার করি’ আর তাহলে খ্রীষ্টান ভাইবোনদের সঙ্গে মেলামেশা করার যে আদেশ তা মেনে চলতে পারব।—১ করিন্থীয় ৯:২৬, ২৭; ইব্রীয় ১০:২৩-২৫.
আমাদের যদি নিজেদের প্রতি কড়া হতে হয়, তাহলে কি আমরা এই ধরে নেব যে ঈশ্বরকে আমরা সত্যিকারের ভালবাসি না? একেবারেই নয়। অতীতের পরিপক্ব খ্রীষ্টানদের ঈশ্বরের প্রতি গভীর ভালবাসা থাকলেও তাদের ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে হয়েছিল। (লূক ১৩:২৪) প্রেরিত পৌল ছিলেন সেই খ্রীষ্টানদের একজন। তিনি নিজে যা বোধ করেছিলেন তা স্পষ্ট করে এইভাবে বলেছিলেন: “আমি জানি যে আমাতে, অর্থাৎ আমার মাংসে, উত্তম কিছুই বাস করে না; আমার ইচ্ছা উপস্থিত বটে, কিন্তু উত্তম ক্রিয়া সাধন উপস্থিত নয়। কেননা আমি যাহা ইচ্ছা করি, সেই উত্তম ক্রিয়া করি না; কিন্তু মন্দ, যাহা ইচ্ছা করি না, কাজে তাহাই করি।” (রোমীয় ৭:১৮, ১৯) আর তিনি করিন্থীয়দের বলেছিলেন: “কারণ আমি যদিও সুসমাচার প্রচার করি, তবু আমার শ্লাঘা করিবার কিছুই নাই; কেননা অবশ্য বহনীয় ভার আমার উপরে অর্পিত; . . . বস্তুতঃ আমি যদি স্ব-ইচ্ছায় ইহা করি, তবে আমার পুরস্কার আছে; কিন্তু যদি স্ব-ইচ্ছায় না করি, তবু ধনাধ্যক্ষের কার্য্য আমার হস্তে সমর্পিত রহিয়াছে।”—১ করিন্থীয় ৯:১৬, ১৭.
আমাদের অনেকেরই মতো পৌলেরও পাপ করার প্রবণতা ছিল যা তাকে ঠিক কাজ করার যে ইচ্ছা সেটাতে বাধা দিত। কিন্তু তাকে এই প্রবণতার সঙ্গে কঠিন লড়াই করে যেতে হয়েছিল ও বেশির ভাগ সময়ই তিনি এই প্রবণতাকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তবে এটা ঠিক যে তিনি নিজের শক্তিতে তা কাটিয়ে উঠেননি। তাই তিনি লেখেন: “যিনি আমাকে শক্তি দেন, তাঁহাতে আমি সকলই করিতে পারি।” (ফিলিপীয় ৪:১৩) যিহোবা যিনি পৌলকে শক্তি দিয়েছিলেন তিনি আপনাকেও ঠিক কাজ করার জন্য শক্তি দিতে পারেন যদি আপনি তাঁর সাহায্য চান। (ফিলিপীয় ৪:৬, ৭) তাই “বিশ্বাসের পক্ষে প্রাণপণ” করুন আর তাহলে যিহোবা আপনাকে আশীর্বাদ করবেন।—যিহূদা ৩.
আপনাকে এই লড়াই যে একাই চালিয়ে যেতে হবে তা নয়। যিহোবার সাক্ষিদের মণ্ডলীগুলোতে অনেক পরিপক্ক খ্রীষ্টীয় প্রাচীনরা আছেন যারা নিজেরা “বিশ্বাসের পক্ষে প্রাণপণ” করে যাচ্ছেন। তারা আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন। আপনি যদি কোন এক প্রাচীনের কাছে সাহায্যের জন্য যান তিনি আপনাকে “সান্ত্বনা” দেবেন। (১ থিষলনীকীয় ৫:১৪) তার লক্ষ্য হবে নিজেকে সেইভাবে কাজে আনা “যেমন বাত্যা হইতে আচ্ছাদন, ও ঝটিকা হইতে অন্তরাল।”—যিশাইয় ৩২:২.
“ঈশ্বর প্রেম” ও তিনি চান যে তাঁর সেবকেরা তাঁকে ভালবেসে সেবা করুক। (১ যোহন ৪:৮) ঈশ্বরের প্রতি আপনার প্রেমকে যদি জাগিয়ে তোলার প্রয়োজন থাকে, তাহলে এখানে যা বলা হয়েছে সেই মতো কাজ করুন। আর সেই মতো কাজ করে আপনি খুশী হবেন।