প্রবাল প্রাচীরগুলিকে রক্ষা করতে কী করা যেতে পারে?
সারা বিশ্বের বহু বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে পৃথিবীর উষ্ণতা মানবজাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির শিল্পোন্নতির সাথে সাথে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। শক্তি উৎপাদনে জীবাশ্ম প্তালানী যেমন কয়লা, তেল ও কাঠ পোড়ানো এবং বনভূমি বিনাশকরণের ফলে প্রতি বছর ৩০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়। কয়েকজন বিজ্ঞানীর মতে, প্তালানীর দহনে উৎপন্ন গ্যাসের কারণে সৃষ্ট তথা-কথিত গ্রীন হাউজ ইফেক্ট পরবর্তী শতাব্দীর মাঝামাঝি, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাকে ৩ থেকে ৮ ডিগ্রী ফারেনহাইট বৃদ্ধি করতে পারে। এই বৃদ্ধি প্রবাল এবং প্রাচীর সমষ্টির জন্য মারাত্মক হবে।
কিন্তু প্রবাল প্রাচীরের বিলুপ্তি, স্থলে বসবাসকারী জীবদেরও প্রতিকূলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রাকৃতিক ইতিহাস (ইংরাজি) পত্রিকা উল্লেখ করে: “অপরপক্ষে, প্রবাল প্রাচীরগুলি গ্রীন হাউজ পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারী এবং সম্ভবত এটি গ্রীন হাউজ গ্যাসগুলিকে হ্রাস করার ক্ষেত্রে ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল বনভূমির মতই গুরুত্বপূর্ণ। প্রবালগুলি তাদের কঙ্কালের জন্য ক্যালসিয়াম কার্বোনেট জমা করার দ্বারা, সমুদ্র হতে বিপুল পরিমাণ CO2 দূরীভূত করে। জুঅক্সানথেলা [কোরালের মিথোজীবী শৈবাল] ছাড়া, প্রবালগুলির কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণের পরিমাণ তীব্রভাবে হ্রাস পায়। দুঃখের বিষয়, সমুদ্রতলের বাস্তব্যতন্ত্রের ধ্বংস সেই বিশেষ পদ্ধতির গতি বৃদ্ধি করে যা এর বিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করে।”
কয়েকজন বিজ্ঞানী মনে করেন যে দহনের ফলে মুক্ত অন্য কিছু গ্যাস গ্রীন হাউজ ইফেক্টকে বৃদ্ধি করে। একটি হচ্ছে নাইট্রাস অক্সাইড এবং অপরটি হচ্ছে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFCs)। বাস্তুতপক্ষে, প্রতিটি CFC অণু CO2 এর একটি অণুর থেকে ২০,০০০ গুণ বেশি তাপ ধারণে সক্ষম। এছাড়াও CFCs ওজোন স্তর হ্রাসের প্রধান কারণ হিসাবে গণ্য হচ্ছে, যা পৃথিবীর জীবদের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি হতে রক্ষা করে। উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর ওজোন পর্যাপ্তভাবে হ্রাস পাওয়ার ফলে গহ্বর তৈরি হয়েছে। সেটি প্রবালের জন্য আরও বেশি দুঃসংবাদ। গবেষণাগুলি দেখায় যে অতিবেগুনি আলোর সামান্য বৃদ্বিতেই, ইতিমধ্যে উষ্ণ জল দ্বারা প্রভাবিত ক্ষুদ্র প্রবাল প্রাচীরগুলির বিরঞ্জন ক্রিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকাটি খেদ করে বলে: “এমনকি যদি ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের নির্গতকরণ বর্তমানে বন্ধ হয়েও যায়, তবুও রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি কমপক্ষে আরও এক শতাব্দী পর্যন্ত ক্রমাগত স্ট্রাটোস্ফেরিক ওজোনের ধ্বংস ঘটাবে। কারণটি সাধারণ: যৌগগুলি বায়ুমণ্ডলে দীর্ঘ সময় থাকবে এবং নির্গতকরণ নিবৃত্ত হওয়ার পর অনেক সময় পর্যন্ত ট্রোপোস্ফিয়ার থেকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ক্রমাগত বিকীর্ণ হতে থাকবে।”
ব্যক্তিগত পর্যায়ে, একজন সমুদ্র অথবা উপকূলীয় এলাকাগুলি আবর্জনা বা নোংরা বস্তু দ্বারা দূষিত না করে দায়িত্বপূর্ণভাবে কাজ করতে পারেন। আপনি যদি প্রবাল প্রাচীর দর্শন করতে যান, তবে প্রবালের উপর না দাঁড়ানো অথবা স্পর্শ না করার নির্দেশাবলী মেনে চলুন। স্মারকচিহ্ন হিসাবে প্রবাল গ্রহণ করবেন না বা কিনবেন না। যদি ক্রান্তীয় প্রবাল প্রাচীরের নিকটে নৌকা চালান, তবে বালিময় তলদেশ অথবা সামুদ্রিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা সরবরাহকৃত ভাসমান নঙ্গর ফেলার স্থানে নঙ্গর ফেলুন। আপনার নৌকার প্রপেলার অথবা গতির দ্রুততার দ্বারা তলদেশকে প্রবলভাবে মন্থন করবেন না। নৌকার জঞ্জাল সমুদ্রে নিক্ষেপ করবেন না; জাহাজঘাট এবং পোতাশ্রয় খুঁজে বের করুন যা এইসব গ্রহণ করবে। লু কি ন্যাশনাল মেরিন স্যাংচুয়ারির (ফ্লোরিডা, ইউ.এস.এ.) ব্যবস্থাপক বিল কৌজি বলেন: “মানুষ প্রকৃত সমস্যা সৃষ্টি করে যা ভারসাম্যহীনতা ঘটায়। পৃথিবীব্যাপী এই সম্বন্ধে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমরা যদি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এক বাস্তব্যতন্ত্র হারানোর আশঙ্কা সম্বন্ধে ক্রমাগত জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করি, তবে হয়ত আমরা পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পারব।”
আঞ্চলিক পর্যায়ে, প্রবাল প্রাচীরকে সুরক্ষিত করতে আইনগুলি পাশ এবং কার্যকারী করা হয়েছে। ফ্লোরিডা স্টেট সেইসব জাহাজের মালিকদের অভিযুক্ত করেছে যারা এর প্রাচীরগুলির ক্ষতি করেছে। সমুদ্রের তল স্পর্শ করে চলার সময় বেশ কয়েক একর প্রবালকে ছিন্নভিন্ন করার কারণে এক মালবাহী জাহাজের মালিকেরা ৬০ লক্ষ মার্কিন ডলার জরিমানা দিয়েছেন। এই টাকার কিছু অংশ সামুদ্রিক আবাসভূমি পুনর্স্থাপন করতে ব্যয় করা হয়েছে। বর্তমানে, জীববিজ্ঞানীরা এক বিশেষ ধরনের আঠালো পদার্থ ব্যবহার করে, ১৯৯৪ সালে জাহাজ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত প্রবালগুলিকে পুনঃসংযোজন করার চেষ্টা করছেন। আরেকটি মালবাহী জাহাজের দ্বারা ফ্লোরিডা প্রাচীরের ক্ষতি করায় এক কোম্পানির বিরুদ্ধে অপর ৩২ লক্ষ মার্কিন ডলার জরিমানা ধার্য করা হয়েছিল। অন্যান্য দেশগুলি অনুরূপ বিধিগুলিকে আইনে পরিণত করছে। জনপ্রিয় সাঁতারের স্থানগুলি, যেমন ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে, নির্দিষ্ট এলাকাগুলি রয়েছে যেখানে সাঁতার অনুমোদিত। অষ্ট্রেলিয়া সেখানকার কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করতে গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ্ মেরিন পার্ক তৈরি করেছে। কিন্তু সকলে যেমন দেখেছেন যে, যতবেশি ডুবুরি, প্রাচীরগুলির ততবেশি ক্ষতি হবে।
সকল জাতি কি সংগ্রামে অংশ নেবে?
বিশ্বব্যাপী, শঙ্কিত বিজ্ঞানীরা এবং নেতারা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে সমাধান একটি জাতি অথবা এমনকি জাতি সমষ্টির নাগালের বাইরে। বাতাস এবং জলের চক্রাকার প্রবাহ দ্বারা দূষণ বিশ্বের চারিদিকে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং প্রাচীরগুলিকে আঘাত করছে। পৃথক পৃথক জাতিগুলির, তাদের অধিকারাধীন সমুদ্র এলাকার পরে কোন আইনগত অধিকার নেই। মুক্ত সমুদ্রে নোংরা বস্তু ফেলা হলে তা অবশেষে সৈকতে এসে পৌঁছায়। বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং সমাধানের প্রয়োজন।
কোন সন্দেহ নেই যে জগতে অনেক আন্তরিক এবং যোগ্য ব্যক্তিরা আছেন যারা পৃথিবীর অসাধারণ প্রবাল সম্পদকে রক্ষা করতে ক্রমাগত সংগ্রাম করে যাবেন। পৃথিবীর পরিবেশের প্রতি সচেতন এবং চিন্তিত এক বিশ্ব সরকার স্পষ্টভাবে ও নিশ্চিতভাবে প্রয়োজন। যথাযথভাবে, সৃষ্টিকর্তা নিজে বিশ্বব্যাপী পরিবেশকে উদ্ধার করবেন। যখন ঈশ্বর প্রথম মনুষ্যদের সৃষ্টি করেছিলেন, তখন বলেছিলেন, “তাহারা সমুদ্রের মৎস্যদের [এবং সমস্ত সামুদ্রিক জীবদের] উপরে, . . . কর্ত্তৃত্ব করুক।” (আদিপুস্তক ১:২৬) যেহেতু ঈশ্বর সামুদ্রিক জীবদের অপব্যবহার বা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেননি, তাই মানবজাতির প্রতি তাঁর আদেশের অর্থ হচ্ছে যে মনুষ্যদের বিশ্বব্যাপী পরিবেশের যত্ন নেওয়া উচিত। বাইবেল ভাববাণী করে: “তাঁহার প্রতিজ্ঞা অনুসারে আমরা এমন নূতন আকাশমণ্ডলের [ঈশ্বরের স্বর্গীয় রাজ্য] ও নূতন পৃথিবীর অপেক্ষায় আছি, যাহার মধ্যে ধার্ম্মিকতা বসতি করে।” (২ পিতর ৩:১৩) নিকট ভবিষ্যতে, সেই স্বর্গীয় সরকার সমুদ্র সহ দূষিত পৃথিবীকে সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করবে। তখন, ঈশ্বরের রাজ্যের অধিবাসীরা সুন্দর সমুদ্র এবং সেইগুলির সামুদ্রিক বসবাসকারীদের যত্ন নেবে এবং উপভোগ করবে।
(পটভূমি: ফিজির নিকটে, প্রশান্ত মহাসাগরে একটি সুন্দর প্রবাল প্রাচীর)
(অভ্যন্তরে স্থাপিত চিত্রগুলি: ১. ক্লাউন মাছের জলতলবর্তী এক ঘনিষ্ঠ চিত্র, ২. প্রবাল যা দেখতে একটি টেবিলের মত, ৩. প্রবালের উপর একটি পরিষ্কার শ্রিম্প)