নারীজাতির বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ
পশ্চিম আফ্রিকার একজন ব্যবসায়ী একটি নয় বছরের শিশুকে ক্রয় করেন। এশিয়ায় একটি নবজাত শিশুকে মরুভূমিতে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। প্রাচ্যের একটি দেশে, এক ছোট শিশুকে একটি অনাথ আশ্রমে ক্ষুধায় মরতে হয়—অবাঞ্ছিতভাবে এবং যত্নের অভাবে। একটি সাধারণ বিষয় এই দুঃখজনক ঘটনাগুলিকে সংযুক্ত করেছিল: এই সমস্ত পরিস্থিতির শিকার ছিল মেয়েরা। তাদের নারী হওয়ার অর্থ ছিল অপ্রয়োজনীয় হিসাবে গণ্য হওয়া।
এগুলি বিরল ঘটনা নয়। আফ্রিকায় হাজার হাজার বালিকা এবং যুবতীদের ক্রীতদাসী হওয়ার জন্য বিক্রি করা হয়, কিছু জনকে এমনকি মাত্র ১৫ ডলারের বিনিময়ে। আর এটি রিপোর্ট করা হয়েছে যে প্রধানত এশিয়ায় লক্ষ লক্ষ মেয়েদের বিক্রি অথবা পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। এর চেয়েও খারাপ বিষয় হল যে কিছু দেশের জনসংখ্যার আকার ইঙ্গিত করে দশ কোটি মেয়ে “হারিয়ে যাচ্ছে।” এটি স্পষ্টতই গর্ভপাত, শিশুহত্যা অথবা নারীজাতিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষার কারণে ঘটে।
অনেক দিন যাবৎ—শতাব্দীগুলি ধরে—বহু দেশে নারীজাতিকে এই দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। আর কিছু দেশে তাদের এখনও এভাবে দেখা হচ্ছে। কেন? কারণ এই দেশগুলিতে, ছেলেদের প্রতি অধিক মূল্য দেওয়া হয়। সেখানে মনে করা হয় যে একটি ছেলে বংশ রক্ষা করতে, উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি লাভ করতে এবং বাবামা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের দেখাশোনা করতে পারে, কারণ সচরাচর এই দেশগুলিতে বৃদ্ধদের জন্য কোন সরকারি ভাতা দেওয়া হয় না। এশিয়ার একটি প্রবাদ বাক্য যুক্তি দেখায় যে “একটি মেয়েকে লালনপালন করা আপনার প্রতিবেশীর বাগানের একটি চারাগাছে জল দেওয়ার মতই।” সে যখন বড় হবে, বিয়ে হয়ে চলে যাবে অথবা এমনকি পতিতা হওয়ার জন্য বিক্রি হয়ে যাবে আর এভাবে বৃদ্ধ বাবামায়ের দেখাশোনার ক্ষেত্রে সামান্য কিংবা কোন সাহায্যেই আসবে না।
সামান্য অংশ
দরিদ্রতা জর্জরিত দেশগুলিতে, এই মনোভাবের অর্থ হল পরিবারের মেয়েদের জন্য স্বল্প খাদ্য, স্বল্প স্বাস্থ্যগত যত্ন এবং স্বল্প শিক্ষা। এশিয়ার একটি দেশে গবেষকেরা দেখতে পেয়েছিলেন যে মেয়েদের শতকরা চোদ্দ জন অপুত্ত্রষ্টতে ভোগে, সেই তুলনায় ছেলেদের শতকরা পাঁচ জন। কিছু দেশে মেয়েদের চেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যক ছেলেদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে আনা হয়, যুক্তরাষ্ট্র শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) একটি বিবরণ বর্ণনা করে। আফ্রিকা আর সেই সাথে দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার ৪০ শতাংশেরও বেশি যুবতীরা নিরক্ষর। “উন্নয়নশীল দেশগুলিতে লিঙ্গের ভয়ঙ্কর পৃথকীকরণ বিদ্যমান রয়েছে,” ইউনিসেফ এর প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, প্রয়াত অড্রে হেপবার্ন দুঃখ করে বলেছিলেন।
এই “লিঙ্গের পৃথকীকরণ” মেয়েরা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখনও বিদ্যমান থাকে। দরিদ্রতা, দৌরাত্ম্য এবং কঠোর পরিশ্রম প্রায়ই একজন নারীর জীবনে বর্তমান থাকে, যার সাধারণ কারণটি হল সে একজন নারী। বিশ্ব ব্যাংকের সভাপতি ব্যাখ্যা করেছিলেন: “নারীরা বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ কাজ করে থাকেন। . . . তবুও তারা বিশ্ব আয়ের কেবলমাত্র এক-দশমাংশ অর্জন করেন এবং বিশ্বের এক শতাংশেরও কম সম্পত্তির মালিক হন। তারা বিশ্বের দরিদ্র ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দরিদ্র।”
রাষ্ট্রসংঘের একটি বিবরণ অনুযায়ী, বিশ্বের ১৩০ কোটি লোক যারা চরম দরিদ্রতার মধ্যে বাস করেন তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি হলেন নারীরা। “আর এটি আরও খারাপ হচ্ছে,” বিবরণটি যুক্ত করেছিল। “প্রচুর সংখ্যক গ্রামীণ নারীরা চরম দরিদ্রতায় বাস করছেন যা গত দুই দশকে প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে, নারীরাই সর্বাপেক্ষা বেশি দরিদ্রতার সম্মুখীন হচ্ছেন।”
তথাপি পীড়নকর দরিদ্রতার চেয়ে দৌরাত্ম্য আরও বেশি আঘাতজনক যা অনেক নারীদের জীবনকে ধ্বংস করে। প্রধানত আফ্রিকায়, ১০ কোটি মেয়েকে স্ত্রীঅঙ্গ হানি ভোগ করতে হয়েছে। ধর্ষণ হল এক বহুবিস্তৃত অপব্যবহার যা কিছু এলাকায় প্রায়ই অলিখিত থাকে, তবুও গবেষণাগুলি ইঙ্গিত করে যে কিছু দেশে ছয়জনের মধ্যে একজন নারী তার জীবনকালে ধর্ষিত হন। যুদ্ধ পুরুষ ও নারী উভয়কে সমভাবে উৎপীড়িত করে, কিন্তু যে শরণার্থীদের তাদের গৃহ থেকে পালাতে বাধ্য করা হয় তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
মা ও যোগানদাতা
পরিবারকে দেখাশোনা করার ভার প্রায়ই অধিক দুর্বহরূপে মায়ের উপর চাপানো হয়। তিনি হয়ত দীর্ঘ সময় কাজ করেন এবং প্রায়ই একমাত্র যোগানদাতা হন। আফ্রিকার কিছু গ্রাম্য এলাকায়, প্রায় অর্ধেক পরিবারগুলিই মেয়েদের দ্বারা পরিচালিত হয়। পশ্চিম বিশ্বের কিছু স্থানে, এক বৃহৎ সংখ্যক পরিবার নারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে।
অধিকন্তু, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, নারীরা পরম্পরাগতভাবে সর্বাপেক্ষা শ্রমশীল কাজগুলির কয়েকটি পরিচালনা করে থাকেন যেমন জল ও প্তালানীকাঠ সংগ্রহ। বন উজাড় করা এবং অত্যধিক পশুচারণ এই কাজগুলিকে আরও বেশি কঠিন করে তুলেছে। কিছু শুষ্ক দেশে, নারীরা প্রতিদিন প্তালানীকাঠ খোঁজার জন্য তিন অথবা তার চেয়ে বেশি ঘন্টা এবং জল সংগ্রহের জন্য দিনে চার ঘন্টা ব্যয় করে থাকেন। একমাত্র এই শ্রমসাধ্য কাজ শেষ হওয়ার পরেই তারা গৃহে অথবা জমিতে তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত কাজ শুরু করতে পারেন।
স্পষ্টতই, যেখানে দরিদ্রতা, ক্ষুধা ও লড়াই নৈমিত্তিক ব্যাপার সেই দেশের পুরুষ ও নারী উভয়েই কষ্টভোগ করেন। কিন্তু নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি ভোগ করে থাকেন। এই পরিস্থিতি কি কখনও পরিবর্তিত হবে? এমন কোন প্রকৃত প্রত্যাশা কি রয়েছে যেদিন সর্বত্র নারীদের সাথে শ্রদ্ধা ও বিবেচনাসহ আচরণ করা হবে? তাদের পরিস্থিতির উন্নতি করার জন্য নারীরা এখনই কি কিছু করতে পারেন?
[৫ পৃষ্ঠার বাক্স//চিত্র]
বালিকা পতিতা—কাকে দোষ দেওয়া যায়?
প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ শিশু—প্রধানত মেয়েদের—পতিতাবৃত্তির জন্য বাধ্য অথবা বিক্রি করা হয়। আরায়া,a দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অধিবাসী। সে তার কিছু সহপাঠীদের প্রতি যা ঘটেছিল সেই বিষয়ে স্মরণ করেন। “মাত্র ১৩ বছর বয়সে কুলভাডি একজন পতিতায় পরিণত হয়েছিল। সে একটি ভাল মেয়ে ছিল কিন্তু যেহেতু তার মা প্রায়ই মদ্যপান করতেন এবং জুয়া খেলতেন তাই মেয়েকে দেখাশোনা করার মত সময় তার ছিল না। কুলভাডির মা তাকে পুরুষদের সাথে বাইরে যাওয়ার দ্বারা অর্থ উপার্জন করার বিষয়ে উৎসাহিত করেছিলেন এবং তখন থেকেই সে একজন পতিতা হিসাবে কাজ করেছিল।
“আমার শ্রেণীর আরেকজন ছাত্রী সিভান দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে এসেছিল। তার বাবামা যখন তাকে একজন পতিতা হিসাবে কাজ করার জন্য রাজধানীতে পাঠিয়েছিলেন তখন তার বয়স মাত্র ১২ বছর ছিল। তার বাবামায়ের স্বাক্ষরিত চুক্তি পূরণ করতে তাকে দুই বছরের জন্য কাজ করতে হয়েছিল। সিভান ও কুলভাডির ঘটনা বিরল নয়—আমার শ্রেণীর পনের জন মেয়ের মধ্যে পাঁচ জনই পতিতা হয়েছিল।”
সিভান ও কুলভাডির মত লক্ষ লক্ষ অল্পবয়স্ক মেয়েরা রয়েছে। “যৌন শ্রমশিল্প এর নিজস্ব গতি সহ এক বৃহৎ বাজার,” ইউনেস্কো-র (রাষ্ট্রসংঘ শিক্ষাগত, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন) ওয়াসেলা টামজালি দুঃখ করে বলেন। “একটি ১৪ বছর বয়সী মেয়েকে বিক্রি করা অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটি গতানুগতিক একটি বিষয়।” আর একবার যখন এই মেয়েদের যৌন দাসত্বের জন্য বিক্রি করা হয়, তখন তাদের পক্ষে ক্রয় মূল্য পরিশোধ করা প্রায় অসম্ভব প্রমাণিত হয়। মঞ্জু, যার বাবা তাকে ১২ বছর বয়সে বিক্রি করে দিয়েছিলেন, সাত বছর পতিতাবৃত্তি করার পরও সে ১২,০০০ টাকা ঋণী ছিল। “আমার কিছুই করার ছিল না—আমি ফাঁদে আঁটকে পড়েছিলাম,” সে ব্যাখ্যা করে।
মেয়েদের পক্ষে এইডস থেকে রক্ষা পাওয়া, দালালদের কাছ থেকে রক্ষা পাওয়ার মতই কঠিন, যারা তাদের ক্রীতদাসীতে পরিণত করেন। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় কৃত এক ব্যাপক নিরীক্ষা উল্লেখ করেছিল যে এই শিশু পতিতাদের ৩৩ শতাংশ এইডস ভাইরাসে আক্রান্ত। যতদিন এই ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের পতিতাবৃত্তি সমৃদ্ধি লাভ করবে, সম্ভবত ততদিন এই মেয়েরা কষ্টভোগ করে চলবে।
এই ভয়ঙ্কর অভ্যাসের জন্য কাদের দোষ দেওয়া যায়? স্পষ্টতই, যারা মেয়েদের পতিতাবৃত্তির জন্য বিক্রি করেন তারা দোষারোপের এক বিরাট অংশের দায় বহন করেন। কিন্তু সেই ঘৃণ্য পুরুষেরাও দোষী যারা যৌন কামলালসাকে চরিতার্থ করার জন্য অল্পবয়স্ক মেয়েদের ব্যবহার করেন। অনৈতিকতার এইধরনের অভ্যাসকারীরা না থাকলে, এই বালিকা পতিতাবৃত্তি অস্তিত্বে থাকত না।
[পাদটীকা]
a নামগুলি পরিবর্তন করা হয়েছে।
প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ অল্পবয়স্ক মেয়েদের পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়
[৬ পৃষ্ঠার বাক্স//চিত্র]
মধ্য আফ্রিকায় একজন নারীর কর্মদিন
একজন নারী ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে পরিবার ও তার জন্য প্রাতঃরাশ তৈরি করেন, যা তারা প্রায় বেলার দিকে খেয়ে থাকেন। নিকটবর্তী নদী থেকে জল আনার পরে, তিনি তার ক্ষুদ্র জমিতে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করেন—এটি হয়ত এক ঘন্টা হাঁটার পথ।
প্রায় বিকেল চারটে পর্যন্ত, তিনি চাষ করেন, আগাছা পরিষ্কার করেন অথবা জমিতে জলসেচন করেন, এর মধ্যবর্তী সময়ে তিনি তার সাথে যে খাবার নিয়ে আসেন তা খাওয়ার জন্য কেবল অল্পসময় বিরতি নেন। দিনের আলোর বাকি দুই ঘন্টা প্তালানীকাঠ কাটা এবং পরিবারের জন্য কাসাভা কিংবা অন্যান্য সব্জী সংগ্রহে ব্যবহৃত হয়—সেই সমস্ত জিনিস তিনি গৃহে বহন করে আনেন।
সাধারণত, সূর্যাস্তের সময় তিনি বাড়ি পৌঁছান। তখন রাতের খাবার প্রস্তুত করার কাজ থাকে যা দুই ঘন্টা অথবা তার চেয়েও বেশি সময় নিতে পারে। রবিবারগুলি স্থানীয় নদীতে কাপড় ধুয়ে এবং তারপর কাপড় শুকিয়ে গেলে ইস্ত্রি করে কেছে যায়।
তার স্বামী কদাচিৎ এই কঠোর পরিশ্রমের প্রতি উপলব্ধি প্রকাশ করেন অথবা তার পরামর্শগুলি শুনে থাকেন। স্বামী গাছ কাটা অথবা ঝোপঝাড়পূর্ণ জঙ্গল পুড়িয়ে দিতে আপত্তি করেন না যাতে স্ত্রী আবাদের জন্য জমি তৈরি করতে পারেন কিন্তু তিনি অন্যান্য কাজ খুব কমই করেন। মাঝে মাঝে, তিনি সন্তানদের স্নান করাতে নদীতে নিয়ে যান এবং হয়ত ছোটখাট শিকার করেন এবং মাছ ধরেন। কিন্তু তার দিনের অধিকাংশ সময়ই গ্রামের অন্যান্য পুরুষদের সাথে আড্ডা দিয়ে কাটে।
স্বামী যদি সমর্থ হন, তাহলে কিছু বছর পরে তিনি আরেকজন নতুন, অল্পবয়স্ক স্ত্রী নিয়ে আসবেন যে তার সমস্ত অনুরাগের কেন্দ্রে পরিণত হবে। কিন্তু তার প্রথমা স্ত্রী তখনও সবসময়ের মত কাজ করবে বলে প্রত্যাশা করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে অসুস্থ হয় অথবা মারা যায়।
আফ্রিকার নারীরা এক দুর্বহ কাজের বোঝা বহন করেন